বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ইরান নিয়ে যুদ্ধ হলে দায়ী হবে আমেরিকা


গত ২০ জানুয়ারি মাহমুদ আহমাদিনেজাদের সাথে আমার চমৎকার আলাপ হয়েছে। ২০০৬ সালের পর তার সাথে আর দেখা হয়নি। তখন তিনি আমাদের দেশে এসেছিলেন হাভানায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্দশ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে। সম্মেলনে কিউবা দ্বিতীয়বারের মতো ন্যাম সভাপতি নির্বাচিত হয় তিন বছরের জন্য।

ওই সম্মেলনের দেড় মাস আগে, ২৬ জুলাই মারাত্মকভাবে অসুস' হয়ে পড়ি। বিছানায় উঠে বসতেও কষ্ট হচ্ছিল। ন্যাম সম্মেলনে যোগদানকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকেই অনুগ্রহ করে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। শ্যাভেজ ও ইভো আসেন কয়েকবার। এক অপরাহ্ণে এলেন চারজন মেহমান- যাদের কথা আমার মনে থাকবে সব সময়। তারা হচ্ছেন আমার পুরনো বন্ধু জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদেল আজিজ বুতেফলিকা, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ও চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী (বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ইয়াং জিয়েচি। চীনা এই মন্ত্রী এসেছিলেন সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও প্রেসিডেন্ট হু জিন তাওয়ের পক্ষ থেকে। তখন আমার ডান হাতে নিবিড়ভাবে ফিজিওথেরাপি চলছিল। পড়ে গিয়ে হাতে মারাত্মক আঘাত পেয়েছিলাম। ওই চারজনের সাথে আলোচনা করেছিলাম কয়েকটি সঙ্কট নিয়ে, বিশ্ব যেগুলোর সম্মুখীন।

২০ তারিখে আমাদের বৈঠকের সময় লক্ষ করলাম, ইরানি প্রেসিডেন্ট পরম শান্ত ও নিরুদ্বেগ ইয়াঙ্কিদের হুমকির ব্যাপারে। তার এই বিশ্বাস পুরোপুরি আছে যে, ইরানি জনগণ যেকোনো আগ্রাসন মোকাবেলায় এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র আগ্রাসীদের চরম শিক্ষা দিতে সক্ষম। এই অস্ত্রের বিরাট অংশই তারা নিজেরা তৈরি করছেন।
আহমাদিনেজাদ হাভানা ভার্সিটিতে তার আইডিয়া তুলে ধরেন মানবজাতির সংগ্রামের বিষয়ে। আমি নিশ্চিত, ইরান এমন কোনো হঠকারী পদক্ষেপ নেবে না, যা যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদি যুদ্ধ বেধে যায়, তা হবে ইয়াঙ্কি (মার্কিন) সাম্রাজ্যবাদের বেপরোয়া মনোভাব এবং মজ্জাগত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দরুন। ইরানের চার পাশের রাজনৈতিক পরিসি'তি এবং পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি খুবই নাজুক। কারো পরমাণু অস্ত্র থাকুক বা না থাকুক, আমরা সবাই এ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। পরমাণু অস্ত্রের যুদ্ধ আমাদের প্রজাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই গ্রহে সবচেয়ে সঙ্কটসঙ্কুল অঞ্চল এখন মধ্যপ্রাচ্য। এই অঞ্চলই বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য, জ্বালানি সম্পদ উৎপন্ন হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কিছু অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এবং এ কারণে জনগণের দুর্ভোগের প্রেক্ষাপটে তীব্র আন্দোলন হয়েছিল শ্বাসরোধকারী গ্যাসের মতো অস্ত্র নিষিদ্ধ করার জন্য। তবুও, স্বার্থের সঙ্ঘাত এবং প্রচুর মুনাফার লোভে আরো ভয়াবহ, আরো ধ্বংসাত্মক অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তি অস্ত্রশস্ত্র তৈরির এমন মালমসলা জুগিয়েছে যে, এগুলো বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা হলে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যেত। যাদের ন্যূনতম দায়িত্ববোধ রয়েছে, তারা সবাই এ মত পোষণ করেন যে, ছোট-বড় কোনো দেশের অধিকার নেই পরমাণু অস্ত্রের মালিক হওয়ার। আমিও একমত। এটা হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো প্রতিরক্ষাহীন দু’টি নগরীতে ব্যবহার করা কিছুতেই উচিত হয়নি। সেখানে লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু নিহত এবং তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের দীর্ঘমেয়াদি ভয়ানক বিভীষিকার শিকার হয়েছিল। জাপান ওই হামলার আগেই পরাজিত হয়েছিল। যদি নাৎসিরা ও ফ্যাসিবাদ সত্যিই মিত্রশক্তিকে বাধ্য করে থাকে ওদের সাথে এসব অস্ত্র উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় নামতে, তাহলে জাতিসঙ্ঘের প্রথম দায়িত্ব ছিল সবার ক্ষেত্রে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করা।
যা হোক, সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিত্তবান দেশ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্য সবাইকে বাধ্য করেছে তাকে অনুসরণ করতে। আজ তাদের শত শত উপগ্রহ আছে যেগুলো দিয়ে মহাশূন্য থেকে গোটা দুনিয়ার ওপর গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটির নৌ, বিমান ও স'ল বাহিনী হাজার হাজার পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অর্থ ও বিনিয়োগকে খেয়াল-খুশিমতো নিয়ন্ত্রণ করছে আইএমএফের মাধ্যমে। মেক্সিকো থেকে সান্টো ডোমিঙ্গো ও হাইতি হয়ে প্যাটাগোনিয়া পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার প্রতিটি দেশের ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, তাদের প্রত্যেকেই দুই শ’ বছর ধরে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। এর সূচনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে। দেশগুলোতে ক্ষমতার মদমত্ততায় জনগণের অধিকার ছিনিয়ে নিকৃষ্টতম অপরাধ ঘটানো অব্যাহত রয়েছে। এতে এসব দেশ দিন দিন আরো বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

১১ জানুয়ারি জানা গেল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিশ্চিত হয়ে বলেছেন, ‘ইরানের বিরুদ্ধে আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞার নতুন সিরিজ নিয়ে আলোচনা হতে যাচ্ছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কারণে এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। নতুন নিষেধাজ্ঞা শুধু তেল শিল্প নয়, ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও টার্গেট করবে।’ ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের বলেন, ইরানের আর্থিক কাঠামোর পাশাপাশি তেল শিল্পের বিরুদ্ধেও আমাদের নিষেধাজ্ঞার মাত্রা বাড়াব।’ এসব থেকে এটা এখন স্পষ্ট, ইসরাইল শত শত পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। কিন' ইরান ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণও করার অনুমতি পাবে না।

ব্রিটিশ বার্তা সংস'ার খবর- চীন চায় না যে, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেলরাজস্ব আয়ে বাধা সৃষ্টি করুক। তেহরানের ওপর ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞাকে চীন মনে করে বাড়াবাড়ি।’
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় অবিশ্বাস্য ও পরিকল্পিত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মাধ্যমে ইরানবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে, তা যে কাউকে করবে মর্মাহত। শুধু এই খবরটা পড়-ন : বুধবার ইরানি পরমাণু বিশেষজ্ঞ মোস্তফা আহমাদি রোশনের হত্যাকাণ্ড গত দুই বছরে ইরানের নেতৃস'ানীয় বিজ্ঞানী হত্যার চতুর্থ ঘটনা। ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রফেসর মাসুদ আলী মোহাম্মদী নিহত হন। রাজধানীতে তার বাড়ির বাইরে মোটরসাইকেলে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণে ঘটনাটি ঘটে। ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর নেতৃস'ানীয় ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের ওপর হামলার দু’টি ঘটনা ঘটে। দেশটির পরমাণু শক্তি সংস'ার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মজিদ শাহরিয়ারী তেহরানে তার গাড়িতে বাঁধা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। তার সহকর্মী ফেরিদুন আব্বাসী দাভানিকেও টার্গেট করা হয়েছিল একই পন'ায়। তবে তিনি বেঁচে যান। গাড়িটি তেহরানে শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক করা ছিল। ওই দু’জনই এ প্রতিষ্ঠানের প্রফেসর। এরপর ২০১১ সালের ২৩ জুলাই ইরানের সিনিয়র বিজ্ঞানী দারিউশ রেজায়িনেজাদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। স্ত্রীসহ সন্তানের জন্য একটি কিন্ডারগার্টেনের বাইরে অপেক্ষার সময় এ ঘটনা ঘটে। স্ত্রী গুলিতে আহত হন।

এবার গত ১১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ নিকারাগুয়া থেকে কিউবা আসেন হাভানা ভার্সিটিতে একটি সম্মেলনে ভাষণ দিতে। ওই দিনই বিজ্ঞানী মোস্তফা আহমদী রোশন গাড়িবোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারালেন। পূর্ব তেহরানের আল্লামা তাবাতাবায়ী ভার্সিটির বাইরে এটা ঘটেছে। রোশন ছিলেন নাতাঞ্জে অবসি'ত পরমাণু সমৃদ্ধকরণ স'াপনার একজন ডেপুটি ডিরেক্টর। আগের ঘটনাগুলোর মতো এবারো ইরান এ জন্য দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে। এসব হত্যাকাণ্ড থেকে বোঝা যায়, পরিকল্পিতভাবে, বাছাই করে ইরানের মেধাবী বিজ্ঞানীদের খুন করা হচ্ছে। ইসরাইল সমর্থকদের লেখায় পড়েছি, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সহায়তায় ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস'াগুলো এমনভাবে বিভিন্ন অপরাধ ঘটায়, যেন এগুলো একেবারে স্বাভাবিক ঘটনা।

এ দিকে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি নিকোলাই পাত্রুশেভ বলেছেন, পাশ্চাত্য দামেস্ককে শায়েস্তা করতে চায়, এর কারণ যতটা না সরকারবিরোধীদের নির্যাতন, তার চেয়ে বেশি তেহরানের সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে অনীহা।
মধ্যপ্রাচ্য সংলগ্ন মধ্য এশিয়া থেকে আসা রিপোর্টগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, এই বিপজ্জনক অঞ্চলে অত্যন্ত জটিল সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে মারাত্মক সঙ্কটে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ছে তার সাম্রাজ্যবাদী নীতির দরুন। উপনিবেশবাদীরা সংশ্লিষ্ট জনগণের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতির তোয়াক্কা না করেই আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত রচনা করেছিল।

আফগানিস্তান উপনিবেশবাদী ইংরেজদের হাত থেকে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করেছে শতবর্ষ ধরে। আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর মাদক উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। ড্রোন বিমানের সহায়তায় এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বিদেশী সৈন্যরা সেখানে নারকীয় গণহত্যা ঘটাচ্ছে একের পর এক। এতে জনগণের ঘৃণা বেড়েছে আর শান্তির সম্ভাবনা সরে গেছে দূরে।
লেখক : কিউবার বিপ্লবের নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন