মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১২

স্বাধীন বাংলাদেশে মওলানা ভাসানীর প্রত্যাবর্তন


স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, উপমহাদেশের মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন এ অঞ্চলের নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। ছিলেন উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রবক্তা।
১৯৭১ সালের ৯ মার্চ পল্টনের জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী জনসম্মুখে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো আপস সম্ভব নয়, আপস চলবে না।’ সেদিন তারই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বাংলাদেশের আজাদীপ্রিয় মানুষ ও ভাসানী অনুসারীরা স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুতি নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তখন থেকেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেও শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আলোচনা চলতে থাকে।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর যখন সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন মওলানা ভাসানী অবস্থান করছিলেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। টাঙ্গাইল থেকে হানাদার বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে মওলানা ভাসানী ১৫-১৬ এপ্রিল ’৭১-এ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত পৌঁছেন। এর সপ্তাহখানেক পর মওলানা ভাসানীর এক সুদীর্ঘ বিবৃতি প্রকাশিত হয় ভারতীয় পত্রপত্রিকায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র তিন সপ্তাহ পর তার এই বিবৃৃতি মুক্তিযোদ্ধা ও বিশ্ববাসীর কাছে অসামান্য আবেদন সৃষ্টি করে। ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানীকে কখনও দীর্ঘ সময় এক জায়গায় থাকতে দেয়া হয়নি। তিনি নজরবন্দি ছিলেন। তার স্বাধীনভাবে চলাফেরা, সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের অধিকার ছিল না। মওলানা ভাসানীর বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গড়ায়। ’৭১-এর ২ জুন দি টাইমসের সংবাদদাতা পিটার হেজেরসাস্ট এক সংবাদ পাঠান এ মর্মে যে, ‘মওলানা ভাসানী ভারত সরকার কর্তৃক অন্তরীণ।’ এ সংবাদকে কেন্দ্র করে লন্ডনে তার মুক্তির জন্য কমিটি গঠিত হয়। মওলানা ভাসানীর অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য না থাকায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান ও সেগুলোর সঙ্গে জড়িত বিখ্যাত নেতারাও ভারত সরকারের ওপর তার নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। নজরবন্দি থাকলেও মওলানা ভাসানী ভারতের মাটিতে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধকে একটি সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার জন্য ৯ সেপ্টেম্বর ’৭১-এ গঠন করে উপদেষ্টা পরিষদ। যে পরিষদে চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে।
শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১২ দিন পর যখন ঢাকায় পত্রপত্রিকায় মওলানা ভাসানীকে নিয়ে নানা ধরনের লেখালেখি শুরু হয়, তখন ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি মেঘালয় থেকে তিনি বাংলাদেশের হালুয়াঘাটে পৌঁছেন। হালুয়াঘাটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মহান এই জাতীয় নেতাকে মামুলি অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং তার ভক্তরা। সড়কপথে ক্লান্তশ্রান্ত দেহে ২২ জানুয়ারি ’৭২ শেষ রাতে তিনি পৌঁছেন টাঙ্গাইলে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনারা তার সন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। পরদিন অর্থাত্ ২৩ জানুয়ারি সকালে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ন্যাপসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী তাকে দেখতে যান। এলাকার কে কোথায় মারা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা কেমন আছে সে খবর নিলেন তিনি। ঘনিষ্ঠ কারও কারও নিহত হওয়ার কথা শুনে তার চোখ অশ্রুসিক্ত ও কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হলো।
তারই স্বপ্নের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো দালানের একটি কক্ষে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। ভক্তরা পুরু করে নাড়া বিছিয়ে তার ওপর একটি চট দিয়ে বিছানা করে দিলেন তাকে। আশপাশের কারও বাড়ি থেকে জোগাড় হয়েছিল একটি জীর্ণ কাঁথা। স্বাধীন দেশে ফিরে এসে মাটির শয্যায় প্রথমবার স্বাধীনভাবে পরম শান্তিতে ঘুমালেন মাটির এক উঁচু-মানব।
স্বাধীন বাংলাদেশে সেদিন এটাই কি প্রাপ্য ছিল মওলানা ভাসানীর? অথচ ভারতে নজরবন্দি থাকা অবস্থায়ও ইন্দিরা সরকার তাকে একজন মহান জাতীয় নেতার মর্যাদা দিয়েছিল। পক্ষান্তরে নিজের দেশে পেলেন ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীর একজনের মতো ব্যবহার। অথচ তিনিই ছিলেন গণঅভ্যুত্থানসহ সফল নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে স্থপতি। মজলুম জনগণের স্বপ্ব বাস্তবায়িত করার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, উপমহাদেশের অত্যাচারিত ও নির্যাতিত মেহনতি জনগণের নয়নমণি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য সরকারের প্রতি এবং তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে সব রাজনৈতিক দলকে কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানাই।
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন