মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১২

করিডোরের বাইপাসে তিতাসসহ ১৮ নদী-খাল বন্ধ : পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো নীরব : স্থায়ী ট্রানজিট পেতে ভারতের চাপ


ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্টের মোড়কে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য করিডোর দিতে গিয়ে তিতাস নদীসহ ১৮টির বেশি নদী ও খাল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ একেবারে নীরব বাংলাদেশের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তারা ন্যূনতম প্রতিবাদও করছে না। কোনো ধরনের আপত্তি জানাচ্ছে না স্থানীয় জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেউই; বরং জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ অনেকে কথা বলছেন তিতাস নদী হত্যাকারী ও পরিবেশ বিপর্যয়কারী বাঁধের পক্ষে। একমাত্র সাধারণ মানুষই এসব বাঁধের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন কিন্তু কেউ তাদের কথা কানে নিচ্ছে না।
ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্টের মোড়কে আশুগঞ্জ-আখাউড়া করিডোর রুট স্থায়ী করতে অব্যহতভাবে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে আসছে ভারত। গত দুই মাসে তারা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে দুই দফা চিঠি দিয়েছে। চিঠির জবাবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় এখনই স্থায়ীভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যকর করা সম্ভব নয়। এ প্রেক্ষিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ-ভারত স্ট্যান্ডিং কমিটির একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে। পাশাপাশি গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ট্রানজিট সংক্রান্ত কোর কমিটি বৈঠক করে স্থায়ী ট্রানজিট দেয়া সংক্রান্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের ৩৬টি সুপারিশই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তিতাসসহ ১৮টি নদীখাল বন্ধ রেখেই কি ভারত করিডোর স্থায়ী করতে চাইছে?
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তিতাস এখন খুন হয়ে যাওয়া একটি নদী। রেলব্রিজ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া সড়কের তিতাস সড়ক ব্রিজের মধ্য দিয়ে সিমেন্টের বস্তা, বাঁশের খুঁটি, ইট-বালু ও মাটি ফেলে নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দেয়া হয়েছে। মাঝে মধ্যে শক্ত করে পুঁতে দেয়া হয়েছে পাকা খুঁটি। তিতাসপারের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম ক্ষুব্ধ। তার কণ্ঠে নদী হারানোর হাহাকার। বললেন, ‘এই দেখেন ডিজিটাল রাস্তা। এখন থেকে নদীর ওপর ব্রিজ আর খালের ওপর কালভার্ট নির্মাণের কোনো দরকার নেই। নদী কিংবা খালের ওপর ইট, বালু, সিমেন্টের বস্তা ফেলে পানি চলাচলের জন্য নিচে কয়েকটা কংক্রিটের পাইপ বসিয়ে দিলেই তার ওপর ১৪০ চাকার গাড়ি চলছে। স্থানীয় মাঝি মঞ্জু মিয়া বলেন, নদীতে বাঁধ দেয়ায় তারা আখাউড়া বাজারে যেতে পারেন না। উজানের মানুষ নৌকায় বাঁধের কাছে পণ্য এনে আবার লেবার ভাড়া দিয়ে বাজারে নেন। এতে চাল-ডাল, তেল, শাক-সবজির দাম বাড়ছে। স্থানীয় জেলে সুধীর ও সুবল বলেন, নদীতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। আখাউড়ার বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহাবুব হোসেন বলেন, প্রিয় তিতাস এখন একটি খুন হয়ে যাওয়া নদীর নাম। ভারতকে ট্রানজিট করিডোর দিতে গিয়ে বাংলাদেশের নতজানু শাসকগোষ্ঠী তিতাসসহ ১৮টি খালকে খুন করেছে। বিশ্বের অন্য কোন দেশের সরকার নদী-খালের মাঝখানে বাঁধ দিয়ে আরেক দেশের মালামাল পরিবহনের ব্যবস্থা করেছে বলে আমাদের জানা নাই। অথচ সে কাজটিই করেছে ভারতের প্রতি চরম নতুজানু বাংলাদেশের বর্তমান শাসক শ্রেণী।
কবরী সারোয়ার : কথাসাহিত্যিক অদ্বৈত মল্ল বর্মণের বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। ১৯৭৩ সালে ওই উপন্যাস নিয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক তৈরি করেছিলেন ভুবন-ভোলানো, মনমাতানো ছবি তিতাস একটি নদীর নাম। সেই ছবির নায়িকা ছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগদলীয় এমপি কবরী সারোয়ার। তার অভিনয়-দক্ষতা এখনও সর্বস্তরের চলচ্চিত্র দর্শকের মনে নাড়া দেয়। ছবিটিতে দেখা যায় তিতাসের ভরা যৌবন। তিতাস নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীটিকে হত্যার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কবরী সারোয়ার আমার দেশ-কে বলেন, ‘বাবারে বাবা, আপনারা তো রাজনীতি কম জানেন না। এত ঘুরিয়ে কথা বলেন কেন? তিতাস নদীতে কেউ বাঁধ দিয়েছে কি না, সেটা আমি কীভাবে জানব। কোনো বাঁধের খবর আমার জানা নেই। আমি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে আমাকে আগে জানতে হবে কারা কোন প্রেক্ষাপটে বাঁধ দিয়েছে, তার পর কথা বলতে হবে।’
বেলা : তিতাস নদীসহ ১৮ টির বেশি নদী-খালে বাঁধ দিয়ে পরিবেশের বিপর্যয় সংক্রান্ত খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তিনি বাঁধ দেয়ার কথা শুনেছেন। তবে তিনি এখন ঢাকায় নেই। তিনি যে এলাকায় অবস্থান করছেন সেখানে টেলিভিশনও নেই। ফলে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না। তিনি ঢাকায় ফেরার পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্টের বাইপাসের জন্য তিতাসসহ আশুগঞ্জ-আখাউড়ার নদী ও খালগুলো বন্ধ করা বিষয়ে নীরব থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বেলার সিনিয়র আইনজীবী ইকবাল কবির বলেন, বেলা এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছে। তারা প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করছেন। শিগগিরই এ বিষয়ে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এফইজেবি : বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের (এফইজেবি) চেয়ারম্যান বিশিষ্ট সাংবাদিক কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তিতাস আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। আমরা অন্য দেশের গাড়ি চলার জন্য নদীটিতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। ট্রানজিট বা করিডোর যে নামেই বলুন, রাস্তা তৈরির আগে পরিবেশের বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া উচিত ছিল। সেখানে মজবুত করে সেতু তৈরি করে নেয়া যেত, কিন্তু তা না করে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীটির প্রবাহ রুদ্ধ করা হয়েছে। এখন উজানের পানি ভাটিতে নামতে পারে না। আমি মনে করি কর্তৃপক্ষের উচিত নদীটিকে নদীর মতোই থাকতে দেয়া। সম্প্রতি ভারত ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্ট স্থায়ী করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিচ্ছে এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে—তিতাসে বাঁধ রেখেই কি ট্রানজিট রুট স্থায়ী হবে? এ প্রসঙ্গে কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শুধু তিতাস নয়, অন্য যে ১৮টি নদী ও খালে বাঁধ দিয়েছে সেগুলোর একটিতেও বাঁধ রেখে ট্রানজিট রুট স্থায়ী করা যাবে না। সরকার যদি ভারতকে ট্রানজিট দিতেই চায়, তাহলে নদী খালগুলোর ওপর মজবুত করে সেতু তৈরি করে নিক। ট্রানজিটের গাড়ি চলার জন্য পরিবেশের একচুলও বিপর্যয় ঘটানো যাবে না।
বাপা : বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন বলেন, তিতাস নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দেয়ার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে তারা একটি মানববন্ধন করেছেন। ডা. আবদুল মতিন বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিদেশে অবস্থান করায় তিতাসে বাঁধের বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পারেননি। দেশে ফিরে বিষয়টি অবগত হওয়ামাত্রই তিনি কর্মসূচি হাতে নেন। তিনি বলেন, এমনিতেই আমাদের সব নদী-খাল বিপর্যস্ত। দেড় হাজার বছর আগে আমাদের দেশে এক হাজার নদী ছিল। যদিও সরকার বলছে এখন নদী ৩১০টি, কিন্তু বাস্তবে নদী হচ্ছে ২০১টি। অধিকাংশ নদীর অপমৃত্যু হয়েছে। এর প্রধান কারণ উজান থেকে পানি না আসা। ভারত ফারাক্কাসহ ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর বেশিরভাগে বাঁধ দিয়েছে। তারা সেখানে ড্যাম করে সেচ ও বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য পানি ব্যবহার করছে। আমি বলছি না যে তাদের পানির প্রয়োজন নেই; তাদেরও পানির প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেটা ভাটির দেশের ক্ষতি করে নয়। উজানের পানিপ্রবাহ না থাকায় আমাদের সবগুলো নদী মরে যাচ্ছে। তিনি তিতাস নদী প্রসঙ্গে বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রাণ এই নদী। এতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে এর প্রবাহ রোধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ট্রানজিট দেয়ার জন্য কোনো নদী ও খাল বন্ধ করা যাবে না। তিনি বলেন, আমাদের দর কষাকষির বড় একটি অস্ত্র ট্রানজিট। আমাদের উচিত, ট্রানজিট দেয়ার আগে ফারাক্কাসহ ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ওপর যত বাঁঁধ আছে, সেগুলো খুলে দেয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা আদায় করা। নদীগুলোর বাঁধ খুলে দেয়ার আগে ট্রানজিট দেয়া উচিত নয়। তিস্তা চুক্তিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের আপত্তি উপেক্ষা করে টিপাইমুখে ও সারি নদীতে বাঁধ দিচ্ছে ভারত। সেগুলো খোলা তো দূরে থাক, এখন আমাদের প্রবহমান একটি নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে ট্রানজিটের গাড়ি চলছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
পবা : বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, তিনি পত্রিকা ও টেলিভিশনে তিতাসসহ ১৮টি নদী-খালে বাঁধ দেয়ার বিষয়ে অবগত। তারা এর বিরুদ্ধে ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সামনে বিশাল মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জন্য তো নয়-ই, বরং ভারত তাদের নিজের দেশের মধ্যেও পণ্য পরিবহনের জন্য মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে ফেলে এভাবে একটি নদীতে বাঁধ দিত না। তিনি এসব বাঁধের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট : পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের মারুফ রহমান বলেন, তারা তিতাসসহ নদী-খালে বাঁধ দেয়ার বিপক্ষে স্থানীয়ভাবে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে তারা স্থানীয় মানুষকে নিয়ে মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক : জেলার পরিবেশ রক্ষা এবং দুর্যোগে ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের। তিতাসের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি বহমান নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে হত্যার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না জেলা প্রশাসন। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তিতাসে বাঁধ দেয়ার আগে তাদের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেয়নি। অনুমোদনের প্রয়োজন হয়নি কেন—এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছর জানুয়ারি মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে ঘোষিত ইশতেহারের আলোকে ভারতীয় কোম্পানি নদীতে বাঁধ দিয়েছে। এটা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সেখানে জেলা প্রশাসকের কোনো ভূমিকা নেই। আর বাঁধ তৈরির জন্য জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন নেই।
সওজ : জেলার রাস্তাঘাট সংরক্ষণ ও তৈরির দায়িত্ব সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ)। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও সেতু মেরামত করে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দায়িত্বও এ বিভাগের। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়—তিতাসসহ সবগুলো নদী ও খালে বাঁধ দেয়ার আগে তাদের অনুমোদন নেয়া হয়েছে কি না। তিনি জানান, তারা বিষয়টি জানেন, তবে লিখিত কোনো অনুমোদন দেননি। তিনি বলেন, ভারতীয় ঠিকাদাররা ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে ঘোষিত যৌথ ইশতেহার অনুযায়ী বাঁধ দিয়েছে। সরকারের শীর্ষপর্যায়ে একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে, আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সড়কে যেসব ব্রিজ ভারি যানবাহন চলার উপযোগী নয়, তার পাশ দিয়ে বাইপাস সড়ক করবে। সে হিসেবে ভারতীয় ঠিকাদাররা বাইপাস সড়কগুলো তৈরি করে। কুরুলিয়া নদী বা এন্ডারসন খাল ও তিতাস নদী দিয়ে বর্ষা মৌসুমে বার্জ দিয়ে ট্রানজিটের পণ্য পরিবহন হতো কিন্তু এখন তিতাস নদীতে পানি না থাকায় বার্জ চালানো যায় না; তাই গত অক্টোবর মাসে তারা বাঁধ দিয়েছে কিন্তু কুরুলিয়ায় বাঁধ দেয়নি। তিনি বলেন, বর্ষায় তিতাস খুবই খরস্রোতা থাকে। ওই সময় এমনিতেই এসব বাঁধ তলিয়ে যাবে অথবা ভারতীয়রাই কেটে দেবে। গত সেপ্টেম্বর মাসে কার অনুমতি নিয়ে ভারতীয়রা তিতাসে বাঁধ দিয়েছে—এর উত্তরে মো. জাহাঙ্গীর জানান, সেটা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিষয়।
পাউবো : জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা জানান, তাদের না জানিয়েই নদীতে বাঁধ দেয়া হয়েছে। তারা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। পাউবোর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, এই বাঁধ বর্ষা মৌসুমেও তিতাসের প্রবাহ রোধ করবে। নদীটি নাব্য হারিয়ে মরা গাঙে পরিণত হবে। নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবে। মাছের উত্পাদন হ্রাস পাবে। পরে এই বাঁধ নদীটির জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে।
উপজেলা পরিষদ : উপজেলা চেয়ারম্যানের কাজের মধ্যে উপজেলার পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন অন্যতম। সেই প্রেক্ষিতে আখাউড়া উপজেলার চেয়ারম্যান শেখ বোরহান উদ্দিনের কাছে জানতে চাই, তার এলাকার তিতাস নদী, তিতাসের শাখা নদী কোড্ডা খালসহ অন্যান্য নদী-খালে বাঁধ দেয়ার বিষয়ে তার দফতর থেকে কোনো অনুমতি নেয়া হয়েছে কি না। তিনি জানান, যে তার দফতর থেকে কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, বাঁধ দিয়েছে সরকারি সিদ্ধান্তে। ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য পরিবহনের জন্য বাঁধ হয়েছে। গত বর্ষায় এসব বাঁধের কারণে কোনো ক্ষতি হয়নি। এখন শুকনো মৌসুমেও ক্ষতি হচ্ছে না। সরেজমিন অনুসন্ধানে আমাদের কাছে কমপক্ষে ৫০ ব্যক্তি তাদের ক্ষতি বিষয়ে অভিযোগ করেন এবং তাদের ভিডিও ফুটেজ আমাদের কাছে আছে। এ বিষয়ে বোরহান বলেন, ‘আপনাদের কাছে মানুষ বলতে পারে কিন্তু আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। এই বাঁধে আখাউড়ার মানুষের কোনো ক্ষতি হয়নি।’
বন্ধ ১৮ নদী-খাল : তিতাস নদী ছাড়া ট্রানজিটের বাইপাসের জন্য বন্ধ হওয়া খাল ও নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আশুগঞ্জের দিক থেকে সোনারামপুর খাল, সুহিলপুর হলাপাড়া খাল, মিরাহাটি খাল, ঘাটুরা তিতাস খাল, পৈরতলা গোপন খাল, কুরুলিয়া নদী বা এন্ডারসন খাল, রামরাইল খাল (উত্তর), রামরাইল (দক্ষিণ) খাল, সুলতানপুরের রাধিকা উশিওড়া খাল, সুলতানপুর পূর্বপাড় খাল, চিনাইর হন্তা খাল, ভাতশালা রেলব্রিজ খাল, বাসুদেব দুবলার খাল, কোড্ডা খাল, চান্দি কোড্ডা খাল, আখাউড়া পৌরসভার নূরপুর খাল, কালুন্দি খাল, জাজিরপুর খাল।
স্থায়ী করতে চাপ ভারতের : এদিকে আর পরীক্ষামূলক নয়, ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের মোড়কে পূর্ণাঙ্গ করিডোর দেয়ার প্রস্তাব করেছে ভারত। এরই মধ্যে গত দুই মাসে দুই দফা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে করিডোর স্থায়ী করার জন্য চিঠি দিয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, অবকাঠামোগত কারণে এখনই পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সম্মতিতেই এখন ট্রান্সশিপমেন্ট নামে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট চলছে। কিন্তু পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এখনই পূর্ণাঙ্গ ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশের অবকাঠামোগত সক্ষমতা নেই।
তার পরও ভারতের বারবার তাগাদা। দুই মাসে দু’বার চিঠি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ ট্রান্সশিপমেন্ট পরিচালনার অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। কারণ এর জন্য কোনো নতুন প্রটোকলেরও প্রয়োজন নেই বলে ভারত জানিয়েছে। এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ-ভারত স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ট্রাজিট সংক্রান্ত কোর কমিটির প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছে। প্রতিবেদনটি আগামী ১০ জানুয়ারির মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হবে। এই প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের ৩৬টিই পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কোর কমিটির প্রধান ও ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান জানান, প্রতিবেদনে ট্রান্সশিপমেন্ট এবং ট্রানজিট দুটি বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ট্রান্সশিপমেন্ট হলে দেশের বন্দর শ্রমিকের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মসংস্থান হবে।
আশুগঞ্জের পাশাপাশি এখনই ভারত নৌ ট্রানজিটের মাধ্যমে শেরপুরের সুতারকান্দি ব্যবহারের সুযোগ চায়। ভারতের প্রস্তাবের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সরকারকে জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান নৌ-প্রটোকল অনুসারে আশুগঞ্জের পাশাপাশি শেরপুর থেকে সুতারকান্দি পর্যন্ত ভারতীয় পণ্য পরিবহনে কোনো বাধা নেই। সর্বশেষ গত ২০ নভেম্বর এ বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে পররাষ্ট্র ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং এনবিআরে চিঠি পাঠানো হয়। কাস্টমস কমিশন জানিয়েছে, শুল্ক আদায়ের জন্যও তাদের পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। এজন্য উন্নয়ন প্রয়োজন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন