মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১২

মেজর জিয়াকে নিয়ে রহস্য!

পুরো নাম মেজর জিয়াউল হক। সংক্ষেপে ডাকা হয় মেজর জিয়া। ই-মেইল ও ফেসবুকে দেয়া তার জবানবন্দি নিয়ে নানা রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। নিজেকে ৪১ বিএমএ লং কোর্সের একজন অফিসার দাবি করে ফেসবুক ও ইন্টারনেটে তার নামে একটি জবানবন্দি প্রকাশ করা হয়েছে। মেজর জিয়ার এ বক্তব্যের রহস্য সম্পর্কে জানার জন্য আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করা হয়। এ নিয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগের বক্তব্য কী—জানার জন্য সংস্থার পরিচালকের সঙ্গে একাধিকার যোগাযোগ করা হয়েছে। গতকাল বিকাল ৩টা ৪৭ মিনিটেও ফোন করা হয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগে। বিপরীত দিক থেকে বলা হলো, স্যার মিটিংয়ে আছেন। কখন মিটিং শেষ হবে বলা যাচ্ছে না। একপর্যায়ে কী বিষয়ে ফোন করা হয়েছে, জানতে চাওয়া হয়। ফেসবুকে মেজর জিয়ার বক্তব্য ও ই-মেইল জবানবন্দি প্রসঙ্গে বলা হলে জানানো হয়, এ বিষয়ে এখান থেকে কিছুই বলা যাবে না। এটা নিয়ে সেনা সদর দফতর বা সামরিক গোয়েন্দা পরিদফতর জানাতে পারবে। এ টেলিফোনের আগে বিষয়টি জানতে সরাসরি ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
গেটে বসিয়ে রেখে বলা হয়, সাংবাদিক প্রবেশ নিষেধ। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া যাওয়া যাবে না। চেষ্টা করা হয়েছে ফেসবুক জবানবন্দিতে মেজর জিয়াউল হকের দেয়া বাসার ঠিকানায় যাওয়ার; মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে পলাশ ভবনের ডি-১৩/১নং ফ্ল্যাট-এর কথা বলা আছে সেখানে। সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট গেটে একই কথা বলা হয়, সাংবাদিক প্রবেশে উপরের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ফেসবুক বা ই-মেইলে প্রচারিত মেজর জিয়াউল হকের জবানবন্দি অনুযায়ী, তাকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা অপহরণ করেছিল। দুই দিন দুই রাত আটক রাখার পর কৌশলে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে কোর্স শেষে বদলিকৃত রেজিমেন্টে যোগদানে যাওয়ার পথে তিনি অপহৃত হন। ৩ বিআইআরে (বাংলাদেশ ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্ট) তাকে বদলি করা হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পথে সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তুলে নেয়ার পর অজ্ঞাত স্থানে রেখে চোখ বেঁধে তাকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জবানবন্দিতে প্রকাশিত বর্ণনা অনুযায়ী, বাংলাদেশীদের পাশাপাশি পাশের একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যও ছিল সেখানে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় উপস্থিত পাশের রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা দোভাষীর মাধ্যমে এমন কিছু তথ্য তার কাছে জানতে চেয়েছে, যা একটি স্বাধীন দেশের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল।
মেজর জিয়াউল হকের প্রকাশিত জবানবন্দি মতে, তাকে আবারও অপহরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য এখন আত্মগোপনে রয়েছেন এবং নিরাপদ কোনো স্থানে চলে যেতে চাচ্ছেন। প্রকাশিত জবানবন্দিতে বলা হয়, যারা তাকে অপহরণ করেছিল তারা চায়নি আর চাকরিতে যোগদান করুক। তার এ অপহরণের বিষয়টি সেনাবাহিনীর অনেক অফিসার জেনেও না জানার ভান করছেন। প্রকাশিত জবানবন্দিতে তিনি বলেন, লে. কর্নেল জায়েদী, লে. কর্নেল হাসিন ও লে. কর্নেল এহসান ইউসুফ নামে দেশপ্রেমিক তিন সেনা অফিসারকে গ্রেফতার দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি রাখা হয়েছে। পুরাতন আর্মি হেডকোয়ার্টার মেসে তারা আটক আছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
এতে তিনি আরও বলেন, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কেন্দ্রীয় এবং ৬৪টি জেলাভিত্তিক ফিল্ড অফিসের মেধাবী অফিসারদের ব্যবহার করে আবারও এক-এগারোর মতো আরেকটি পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা বিভাগের কিছু অফিসার পাশের দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। তার লেখা জবানবন্দি অনুযায়ী, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের বড় ক্ষতি হবে।
সেনা অফিসারদের বিনাবিচারে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বন্দি করে রাখা প্রসঙ্গে সাবেক সেনা কর্মকর্তা বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমার দেশ-কে বলেন, ১৫০ দিনের বেশি সময় ধরে লে. কর্নেল পদমর্যাদার দুই অফিসার আটক আছেন বলে তিনিও জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, যতটুকু জানি এদের একজন গত ৯ জুলাই ও আরেকজন ১২ জুলাই কর্মরত অবস্থায় গ্রেফতার হন। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিচার শুরু হয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের আর্মি অ্যাক্টের ৭৫ ধারা অনুযায়ী, অভিযোগের ভিত্তিতে সেনা অফিসারদের গ্রেফতার করা যায়। এ ধারায়ই বলা আছে, গ্রেফতারের ৮ দিনের ভেতর কোর্ট মার্শাল গঠন করতে হবে। ৮ দিনের মধ্যে কোর্ট মার্শাল গঠন করা সম্ভব না হলে উপযুক্ত কারণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইনে। তিনি বলেন, আইনেই বলা আছে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে কোর্ট মার্শাল গঠন করতে না পারলে আটক ব্যক্তিদের মুক্ত করে দিতে হবে। ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন বলেন, ১৫০ দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল গঠন করা সম্ভব হয়নি। এতে অনুমান করা যায় প্রমাণ করার মতো কোনো অভিযোগ এ অফিসারদের বিরুদ্ধে নেই। প্রমাণের মতো অভিযোগ থাকলে কোর্ট মার্শাল গঠন হয়ে যেত।
এদিকে গত শুক্রবার সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের অফিসার পরিচয় দিয়ে দৈনিক আমার দেশ-এর বার্তা সম্পাদককে ফোন করা হয়। তাকে ফোনে বলা হয়, আপনারা সেনাবাহিনীর একটি বিষয় নিয়ে সংবাদ করছেন। সেটা ছাপাবেন না। এটার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। আমার দেশ থেকে বলা হয়, আমরা এ সম্পর্কে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার বক্তব্য চাচ্ছি। বক্তব্য পেলে আমরা রিপোর্টটির সঙ্গে ছাপতে চাই। এতে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে মানুষ অবহিত হতে পারবে। কিন্তু ওই অফিসার সংবাদটি যাতে ছাপা না হয় সে ব্যাপারেই কয়েকবার ফোন করে বলেন, আপনারা সংবাদটি ছাপবেন না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন