টিপাইমূখ বাঁধ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, সেই আলোকে গত ২৯.১২.২০১১ তারিখে প্রথমআলো পত্রিকায় জনাব মহিউদ্দিন আহম্মদ একটি কলাম লেখেন, সেই লেখা কতটা যুক্তিযুক্ত তার বিচার বাংলাদেশের জনগনের। এই লেখার সমালোচনা করেছেন মুক্তিআন্দোলনের আহবায়ক জনাব রইসউদ্দিন আরিফ Ges Aa¨vcK Rvdi BKevj| পাঠকদের সুবিদার্থে সমালোচনার সাথে নিচে মূল লেখাটিও দেয়া হলো।
মাঝেমধ্যে শোনা যায় পেঙ্গুইনরা দলবদ্ধভাবে আত্মহত্যা করে। কেন করে, জানি
না। জাতি হিসেবে বাঙালিও আত্মহত্যাপ্রবণ। আত্মঘাতী বাঙালি নামে আমার প্রিয়
লেখক নীরদ চৌধুরীর একটি বই আছে। শিরোনামটির সঙ্গে আমি একমত। ইতিহাসের
বিভিন্ন পর্বে আমরা বুঝে না-বুঝে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিই, যা আত্মহত্যার
শামিল। তেমনি একটি বিষয় নিয়ে আজ লিখব। আমরা জানি, রাজনীতিবিদেরা অনেক
সময় অনেক কিছু বলে থাকেন, যার পেছনে যুক্তি থাকে না। কী বললে মানুষ খুশি
হবে, হাততালি দেবে, তা তাঁরা বুঝে নিতে কসুর করেন না। আর কিছু কিছু মানুষ
আছে, যারা ওই সব কথা শুনতে পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘জনতা’ শব্দটির একটি
ইতিবাচক তাৎপর্য থাকলেও এ ধরনের ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষকে ‘ক্রাউড’ হিসেবে দেখা
হয়। এই ক্রাউড কখনো-সখনো দাঙ্গা বাধাতে পারে, কিন্তু ইতিহাস তৈরি করতে
পারে না। আমরা এখন এই ক্রাউড কালচারে আক্রান্ত। আজকের লেখার বিষয় হলো
টিপাইমুখ বাঁধ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্রাউড মনস্তত্ত্ব। বছর তিনেক
আগে অঙ্গীকার বাংলদেশ নামে একটি এনজিও এবং আসামের রিভার বেসিন ফ্রেন্ডস
নামের অনুরূপ আরেকটি এনজিও যৌথভাবে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ঢাকায় একটি
সেমিনারের আয়োজন করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল এই বাঁধ বাস্তবায়িত হলে
বাংলাদেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। দুটো এনজিওর কর্তাব্যক্তিদের ব্যক্তিগতভাবে
আমি চিনি। তাঁরা ভালো মানুষ, এককালে বাম রাজনীতি করতেন। ওই সেমিনারে আমি
বলেছিলাম, এই বাঁধ তৈরি হলে মণিপুরের অনেক পরিবার উদ্বাস্তু হবে, তাদের
জীবনযাত্রা তছনছ হয়ে যাবে, পরিবেশের প্রচণ্ড ক্ষতি হবে। কিন্তু বাংলাদেশের
ক্ষতি হবে, এ কথাটা বেঠিক। বরং বাংলাদেশ লাভবান হবে। মণিপুরের মানুষ এই
বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে, প্রতিরোধ গড়ে তুললে তার প্রতি আমি সংহতি
জানাব। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে যদি এই বাঁধ তৈরি
করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের উচিত হবে তার বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। আমি এও
বলেছিলাম, আপনারা এই ইস্যুটি তুলে এ দেশের ধর্মান্ধ রাজনৈতিক অপশক্তির
হাতে একটি মারাত্মক অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। আজ আমার আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত
হয়েছে। এই রাজনৈতিক অপশক্তির সঙ্গে জোট বেঁধেছে কিছু নির্বোধ অথবা চতুর
‘সুশীল’, যাঁরা একসঙ্গে রা তুলছেন, টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি হলে বাংলাদেশ
মরুভূমি হয়ে যাবে, বাংলাদেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। আমি যেহেতু এই
বাঁধের পক্ষে, তাই এই বিষয়ে দু-একটা কথা বলতে চাই। যেহেতু টিপাইমুখ
বাঁধবিরোধী একটা মনস্তত্ত্ব ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে আমাদের জাতীয় পর্যায়ে,
আমাকে এ জন্য বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত হাজির করতে হবে। আমাদের জানা আছে,
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে
যায় তার শতকরা ৮৭ ভাগ আসে সীমান্তের বাইরে থেকে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের
অংশ ৫৫ শতাংশ, গঙ্গার অংশ ৩৬ শতাংশ, আর মেঘনার ভাগ ৯ শতাংশ, মেঘনার পানির
প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম হলেও বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য এটা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলে যে পরিমাণ পানি উজান থেকে এসে মেঘনায় ‘লীন
হয়ে যায়’, তার ৩১ শতাংশ আসে মেঘালয় থেকে, ৫ শতাংশ আসে ত্রিপুরা থেকে এবং
১৬ শতাংশ আসে মণিপুর, মিজোরাম ও আসামে বিস্তৃত বরাক অববাহিকা থেকে। নাগাল্যান্ড-মণিপুর
সীমান্তে জাভো পর্বতের চূড়া থেকে নেমে আসা বরাক নদীর প্রবাহ ২৫০ কিলোমিটার
পেরিয়ে টিপাইমুখ নামের একটা গভীর উপত্যকায় এসে পৌঁছে। তারপর উত্তরে ৯০
কিলোমিটার অতিক্রম করে ফুলেরতল নামক স্থানে এসে আবার বাঁক নিয়ে পশ্চিম
দিকে কাছার জেলার ভেতর দিয়ে আরও দূরে অমলশিদে পৌঁছে। অমলশিদ হলো
আসাম-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। এখানে বরাক দুই ভাগ হয়ে
বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করে। একটি কুশিয়ারা এবং অন্যটি সুরমা। এই দুটো
নদী আবার দিলালপুর নামক গ্রামে এসে একত্র হয়ে মেঘনা নামে দক্ষিণ দিকে
যাত্রা শুরু করে। টিপাইমুখ উপত্যকার গভীর খাদ এবং চারদিকের খাড়া
পাহাড়ের জন্য এটা জলাধারের পক্ষে একটা আদর্শ স্থান। প্রথম দিকে ভারত
সরকারের চিন্তা ছিল, কাছারের সমতলে সেচ সুবিধা দেওয়া এবং শিলচর শহরে পানীয়
জল সরবরাহের জন্য টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে বরাক থেকে পানি নিয়ে আসা। এর ফলে
টিপাইমুখের আশপাশে বন্যা সমস্যারও একটা সুরাহা হবে। কিন্তু দেখা গেল, এটা
হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল কাঠামো। শুরু হলো নতুন করে চিন্তাভাবনা।
প্রাক-সমীক্ষায় দেখা গেল এর চেয়ে কম উচ্চতায় বাঁধ তৈরি করে যদি জলবিদ্যুৎ
তৈরি করা যায়, তাহলে আর্থিক দিক থেকে তা লাভজনক হবে। ১৯৯২ সালের যৌথ
নদী কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী টিপাইমুখ বাঁধের উচ্চতা হবে ১৬১ মিটার এবং
দৈর্ঘ্য হবে ৩৯০ মিটার। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১৫০০ মেগাওয়াট।
জলাধারের ধারণক্ষমতা হবে ৯ ঘনকিলোমিটার। এখন দেখা যাক, এই বাঁধ তৈরি হলে
এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে এর ২২৫ কিলোমিটার ভাটিতে বাংলাদেশ
সীমান্তবর্তী অমলশিদ গ্রামে বরাকের পানিপ্রবাহে কী অভিঘাত হবে। টিপাইমুখে শুধু যদি জলবিদ্যুৎ তৈরি হয় এবং সেচের জন্য যদি পানি সরিয়ে না নেওয়া হয়, তাহলে অমলশিদে আমরা যে চিত্রটি পাব তা হলো: জুলাই মাসে সর্বোচ্চ পানিপ্রবাহ ৪০ শতাংশ কমে যাবে। জুলাই মাসে নদীতে পানির উচ্চতা হ্রাস পাবে ২.৬ মিটার। বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমে যাবে ৩১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে, যখন পানির প্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়, তখন তা ৭১৩ কিউসেক (ঘনমিটার প্রতি সেকেন্ডে) বেড়ে যাবে। ফেব্রুয়ারি মাসে নদীতে পানির উচ্চতা বাড়বে ৩ দশমিক ৫ মিটার। শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বাড়বে ৯ ঘনকিলোমিটার। যদি
জলবিদ্যুৎ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে পানি প্রত্যাহার করে কাছার সেচ প্রকল্প চালু
করা হয়, সেজন্য ফুলেরতল গ্রামে একটা ব্যারাজ তৈরি করতে হবে। খনন করতে হবে
দুটো খাল, একটি ৮৯ কিলোমিটার ও অন্যটি ১১০ কিলোমিটার লম্বা। এই দুটো খাল
দিয়ে বরাকের পানি নিয়ে যাওয়া হবে এবং এর ফলে ১৬৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায়
সেচ সুবিধা দেওয়া যাবে। বিদ্যুৎ এবং সেচ এই উভয় প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে
অমলশিদে বরাকের পানিপ্রবাহে তার যে প্রতিক্রিয়া হবে তা হলো: জুলাই মাসে আগের মতোই ৪০ শতাংশ প্রবাহ হ্রাস পাবে। তবে ফেব্রুয়ারিতে যেখানে ৭১৩ কিউসেক পানিপ্রবাহ বাড়ার কথা ছিল, তা হ্রাস পেয়ে ৪০৫ কিউসেক বাড়বে। নদীতে পানির উচ্চতা বাড়বে ২ দশমিক ১ মিটার। শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বাড়বে ৪ দশমিক ৯১ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ
বর্ষা মৌসুমে উভয় ক্ষেত্রে পানিপ্রবাহের মাত্রা একই রকম হ্রাস পাবে। সেচ
সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারটি যেহেতু শুকনো মৌসুমের, ওই সময় পানিপ্রবাহ যেটুকু
বাড়ার কথা তার চেয়ে কম বাড়বে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই শুকনো মৌসুমে অমলশিদ
হয়ে বাংলাদেশে বরাক নদী দিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারায় পানিপ্রবাহ বাড়বে। এখন
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশ নিয়ে আলোচনা করা যাক। এখানে
বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে শতাধিক হাওর। বর্ষাকালে হাওরগুলো জলে টইটুম্বর
থাকে, কোনো ফসল হয় না। শীতকালে হাওরের পানি শুকিয়ে যায়, কৃষকেরা বোরো ধান
চাষ করেন। হাওর অঞ্চলের এখনকার প্রধান সমস্যা দুটো। আগাম বন্যা, যার ফলে
ফেব্রুয়ারি-মার্চে উঠতি ফসল মাঠেই তলিয়ে যায়। আর আছে দেরিতে পানি
নিষ্কাশন, যার ফলে বোরো ধান রোপণ করতে দেরি হয়ে যায় এবং তা আগাম বন্যার
ঝুঁকিতে পড়ে। বর্ষাকালে বরাক দিয়ে পানিপ্রবাহ হ্রাস পেলে এই দুটো সমস্যার
কারণে কৃষকেরা যে ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, তা অনেকটা কমে যাবে। পক্ষান্তরে
শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বাড়লে তা সেচের জন্য সুফল বয়ে আনবে। অর্থাৎ উভয়
মৌসুমেই বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের মানুষ লাভবান হবে। হাওর প্রতিবেশ যাঁরা
জানেন, তাঁরা এ বিষয়টি বুঝবেন। না বুঝলে বলতে হবে তাঁরা আসলে যা করছেন, তা
হলো ‘ভাবের ঘরে চুরি’। নদীর উজানে বাঁধ তৈরি ও জলাধার নির্মাণ করে
শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর প্রস্তাব আমাদের পানি বিশেষজ্ঞরা অনেক
বছর যাবৎ দিয়ে আসছেন। এ ধরনের জলাধার নেপাল কিংবা ভুটানে হলে আপত্তি নেই
কিন্তু ভারতে হলেই অনেকের আপত্তি। কারণ, ‘ভারত শত্রু রাষ্ট্র এবং তারা সব
সময় আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।’ সুতরাং দাবি উঠেছে, টিপাইমুখ বাঁধ
তৈরি করা যাবে না। এটা হলো ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ করার মতো। আমার
প্রস্তাব অত্যন্ত স্পষ্ট। এ বাঁধ শুধু ভারতের তৈরি করাই উচিত নয়,
বাংলাদেশের উচিত ভারতকে চাপ দেওয়া, যাতে বাঁধটি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়। আর
বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারত সরকারের কাছে কো-ফাইনান্সিংয়ের সুনির্দিষ্ট
প্রস্তাব দেওয়া, যাতে আমরা ওখান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ আনতে পারি। আমাদের
দেশের একশ্রেণীর রাজনীতিক, আমলা এবং বুদ্ধিজীবী ভারতের সঙ্গে শত্রু-শত্রু
খেলার ফলে প্রতারিত হচ্ছে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ। এখন মানুষকে সত্যটা
জানাতে হবে। কেউ কেউ আছেন সরাসরি বাঁধের বিরুদ্ধে বলেন না, কিন্তু
ভূমিকম্পের জুজুর ভয় দেখান। মানুষ এদের চালাকিটা ধরে ফেলছে। ভারতকেন্দ্রিক
আমাদের যে অপরাজনীতি, পারস্পরিক লেনদেন এবং সহযোগিতা বাড়লে এদের রাজনীতির
পুঁজি নিঃশেষিত হয়ে যাবে। তাই তাঁরা নানা রকম খোঁড়া যুক্তি তুলে এসব
প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন সচেতনভাবেই। আমাদের দেশে অনেকেই ড্যাম আর
ব্যারাজের পার্থক্য বোঝেন না। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির ফলে মরুভূমিটা কোথায়
তৈরি হয়েছে, সেটা তাদের খুঁজে দেখার অনুরোধ করছি। আমি এই লেখায় যেসব
তথ্য উপস্থাপন করেছি, তা আমি কোথায় পেলাম এই প্রশ্ন উঠতে পারে। কানাডীয়
উন্নয়ন সংস্থার (সিডা) সাহায্যে বাংলাদেশ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে
একটি বিশেষ সমীক্ষা চালানো হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। প্রতিবেদনটি পানি উন্নয়ন
বোর্ডের অধীনে ফ্লাড প্ল্যান কো-অর্ডিনেশন অর্গানাইজেশন প্রকাশ করে ১৯৯৫
সালের জুন মাসে। ওই সময় এই অর্গানাইজেশনের প্রধান ছিলেন প্রকৌশলী এম এইচ
সিদ্দিকি বীর উত্তম। ওই সমীক্ষা ও প্রতিবেদন তৈরির কাজে যে কয়েকজন যুক্ত
ছিলেন, আমি ছিলাম তাদের একজন। এর চেয়ে মানসম্মত তথ্য ও উপাত্ত যদি আর কারও
কাছে থেকে থাকে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে আমাদের উচিত হবে, দ্রুত
একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভারত এই বাঁধ
তৈরি করবেই। আমাদের কৌশল হওয়া উচিত এ থেকে আমরা কী সুবিধা নিতে পারব, সেই
চেষ্টা করা। বিরোধিতা করে এই বাঁধ তৈরি আমরা ঠেকাতে পারব না। আর বিরোধিতা
করবই বা কেন?
এ বিষয়ে ভিন্নমত এলে তাও প্রকাশ করা হবে। বি.স. মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক। mohi2005@gmail.com
সাদাসিধে কথা
টিপাইমুখ: একটি প্রতিক্রিয়া
মুহম্মদ জাফর ইকবাল | তারিখ: ০৫-০১-২০১২
১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর পদের জন্য নির্বাচনে
প্রার্থী হয়েছিলেন ক্লেটন উইলিয়ামস নামে এক ব্যক্তি। ভদ্রলোক নির্বাচনে
জিততে পারেননি, কিন্তু পৃথিবীর অনেক মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে তাঁর একটি
উক্তির জন্য। তিনি বলেছিলেন, ধর্ষণ থেকে যদি রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় না
থাকে, তাহলে চেষ্টা করা উচিত সেটা উপভোগ করা। (আমি যা-ই লিখি, ছোট
বাচ্চারা নাকি সেটা পড়ে ফেলে—তাই ওপরের কথাগুলো লিখতে খুব খারাপ লাগছে।)
ক্লেটন উইলিয়ামসের কথার মতো হুবহু একটা কথা ২৯ ডিসেম্বর ২০১১-এর প্রথম
আলোয় পড়েছি। টিপাইমুখ সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, ‘ভারত এই বাঁধ
তৈরি করবেই, আমাদের কৌশল হওয়া উচিত এ থেকে আমরা কী সুবিধা নিতে পারব সেই
চেষ্টা করা।’ এর কিছুদিন আগে গওহর রিজভী পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলেন।
সেই লেখাটিতে নানা রকম ভণিতা ছিল, দেশ, দেশের স্বার্থ—এই সব বড় বড় কথা ছিল
এবং পুরো লেখাটিতে পাঠকদের উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন আবেগের বশবর্তী
হয়ে হঠকারী কাজকর্ম শুরু করে না দেয়। গওহর রিজভী সরকারের মানুষ, তাঁর
লেখাটি পড়ে আমরা সবাই সরকারের ভূমিকাটা কী হবে, তা আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমি
নদী বিশেষজ্ঞ নই, পানি বিশেষজ্ঞ নই, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু আমার গত
৫৯ বছরের অভিজ্ঞতায় একটা জিনিস শিখেছি, সেটা হচ্ছে পৃথিবীর জটিল থেকে
জটিলতম বিষয়টিও কমন সেন্স দিয়ে প্রায় ৯০ ভাগ বুঝে ফেলা যায়। কাজেই
বাংলাদেশের মানুষ টিপাইমুখের বিষয়টি শতকরা ৯০ ভাগ শুধু কমন সেন্স দিয়ে
কিন্তু বুঝে ফেলেছে। বড় বড় বিশেষজ্ঞ কিউসেকের হিসাব, বর্ষা মৌসুম, শুষ্ক
মৌসুম, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচব্যবস্থা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে থাকুন,
আমরা সাধারণ মানুষ কিছু সাধারণ প্রশ্ন করি: আমরা কি প্রকৃতিকে
নিয়ন্ত্রণ করব, নাকি প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করব? একেবারে ছোট শিশুটিও
জানে পৃথিবীতে প্রযুক্তি এখনো প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জায়গায় পৌঁছায়নি,
কোনো ভূমিকম্প থামানো যায় না, কোনো ঘূর্ণিঝড় বন্ধ করা যায় না, পাহাড় থেকে
নেমে আসা পানির ঢল আটকানো যায় না। ঠিক সে রকম একটা নদীকে বন্ধ করা যায় না,
গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না। নির্বোধ মানুষ যে চেষ্টা করে না তা নয়,
পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই করা হয়েছে; কিন্তু সেটা মানুষের ওপর অভিশাপ হয়ে
নেমে এসেছে। ভবদহের কথা আমরা ভুলিনি, ফারাক্কা আমাদের চোখের সামনেই আছে।
কাজেই গওহর রিজভী কিংবা মহিউদ্দিন আহমেদের মতো বিশেষজ্ঞরা যতই বলুন ‘যত
তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাঁধ তৈরি করে’ বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা
করে ফেলতে হবে আমি সেই কথা বিশ্বাস করি না। আমাদের দেশে কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে
বিশাল এলাকা পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অসংখ্য অসহায় আদিবাসী মানুষকে
রাতারাতি গৃহহারা করা হয়েছিল। এখন সেই চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশের মানুষ
কোনো দিন সেটা হতে দিত না, কোনো সরকারের সেই দুঃসাহস দেখানোর সাহস হতো না। কাজেই
বিশেষজ্ঞরা যতই বলতে থাকুন টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শুভ
উদ্যোগ, আমি সেটা বিশ্বাস করি না। যারা প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আসলে
তারা পৃথিবীর ভালো চায় না। তারা বাংলাদেশের মানুষ হোক, ভারত বা চীন যে
দেশেরই হোক, তাদের ধিক্কার দিতে হবে। তারা হচ্ছে পৃথিবীর দুর্বৃত্ত। গওহর
রিজভী এবং মহিউদ্দিন আহমেদ দুজনই টিপাইমুখ বাঁধের সুফল নিয়ে ভালো ভালো কথা
বলেছেন, তার বেশির ভাগ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তর্ক-বিতর্ক করতে থাকুন। আমি শুধু
একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই, সেটা হচ্ছে বন্যা। তাঁরা দুজনেই দাবি করেছেন
এই বাঁধ দিয়ে বন্যার প্রকোপ কমানো যাবে। আমি সিলেটে থাকি, আমার
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুরমা নদীর দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। আমি এখানে ১৭ বছর
ধরে আছি, শুধু একবার (২০০৪ সালে) সুরমা নদীর পানি উপচে এসেছিল, আমি তো আর
কখনো সুরমা নদীর পানিকে তীর ভেঙে আসতে দেখিনি! হাওর অঞ্চল তো প্রতিবছর
পানিতে ডুবে যায়, ডুবে যাওয়ারই কথা, সেটাই হচ্ছে এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য।
সেটা তো বন্যা নয়। তাহলে তাঁরা কোন বন্যাকে ঠেকানোর কথা বলছেন? যে বন্যার
অস্তিত্ব নেই, সেই বন্যার প্রকোপ থামানোর কথা বললে আমরা যদি বিশেষজ্ঞদের
দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাই কেউ আমাকে দোষ দিতে পারবে? এই বন্যা নিয়ে তাঁদের
বিশেষজ্ঞ মতামত আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়—ঠিক সে রকম তাঁদের অন্যান্য
বিশেষজ্ঞ মতামতও যে অর্থহীন নয়, সেই গ্যারান্টি আমাকে কে দেবে? মহিউদ্দিন
আহমেদ বলেছেন, ‘ভারত এই বাঁধ তৈরি করবেই’, তিনি তার বিরোধিতা করতেও রাজি
নন। কোনো রকম চেষ্টা না করে পরাজয় স্বীকার করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই।
টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ করার চেষ্টাকে এ মুহূর্তে তাঁর কাছে এবং সম্ভবত আরও
অনেকের কাছে খুব কঠিন কাজ মনে হচ্ছে। সারা দেশে টিপাইমুখের বিরুদ্ধে একটা
আন্দোলন গড়ে তোলা এই মানুষগুলোর কাছে একটা অযৌক্তিক এবং অসম্ভব কাজ বলে
মনে হচ্ছে। কাজেই তাঁরা এর জন্য চেষ্টা করতেও রাজি নন। তাঁদের সবাইকে
মনে করিয়ে দেওয়া যায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন এই
দেশে গণহত্যা শুরু করেছিল তখন কোনো মানুষ যদি যুক্তিতর্ক দিয়ে বিবেচনা করত
তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই ধরে নিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা একটা
পুরোপুরি অবাস্তব বিষয়। মার্চ মাসে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি পুরো দেশটা
পাকিস্তান সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছিল। এখন যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে
বিচার করা হচ্ছে তারা সেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী অনুচর। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো দেশ পাকিস্তানের পক্ষে, পৃথিবীর মুসলমান
দেশগুলোও পাকিস্তানের পক্ষে, এক কোটি মানুষ দেশছাড়া, যারা দেশে আছে তাদের
বাড়িঘর পুড়িয়ে, খুন করে সারা দেশে হাহাকার। দেশের কিছু কম বয়সী ছেলেমেয়ে
মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়েছে, তাদের হাতে অস্ত্র নেই, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই,
পেশাদার বাহিনী বিশৃঙ্খল, যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন তাঁদের মধ্যেও কোন্দল—এ রকম
একটা পরিবেশ দিয়ে শুরু করে আমরা স্বাধীন একটা দেশ ছিনিয়ে আনতে পারব সেটা
কি কেউ কল্পনা করেছিল? করেনি। কিন্তু তার পরও এই দেশের মানুষ দেশপ্রেমের
যুক্তিহীন আবেগকে মূলধন করে এই দেশকে স্বাধীন করে ছেড়েছিল। কাজেই যাঁরা
এই দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা তাঁরা এই দেশের মানুষের ‘যুক্তিহীন’ আবেগকে
খাটো করে দেখবেন না। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না, তার সঙ্গে সহাবস্থান
করতে হয়। টিপাইমুখের বেলায়ও হুবহু একই কথা বলা যায়—দেশের মানুষের আবেগকে
নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করবেন না, তাদের সঙ্গে সহাবস্থান করুন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিক্রিয়া
‘জরুরি টিপাইমুখে কীটপতঙ্গের দাঙ্গা’
নাহরীন আই খান | তারিখ: ০৭-০১-২০১২
বাঙালি আত্মঘাতী জাতি কি না জানি না, তবে তার রসবোধ প্রবল, তার প্রমাণ
পেলাম ২৯ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে জনাব মহিউদ্দিন আহমদ সাহেবের লেখা পড়ে।
ওনার রসবোধসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক (!) লেখাটির একটা উত্তর দিতে চাই। আপনি
বলেছেন, এই বাঁধ ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। কিন্তু জানেন কি, এই
বাঁধের লোড ফ্যাক্টর ২৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যার অর্থ হলো সারা বছর বাঁধের
সর্বোচ্চ ক্ষমতার (১৫০০ মেগাওয়াট) মাত্র ২৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ বা ৪০১ দশমিক
২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সারা বছর ১২ শতাংশ বিনা মূল্যের বিদ্যুৎ
যদি উত্তরাঞ্চলের অস্থিতিশীল জনগোষ্ঠীকে শান্ত অথবা সমগ্র
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামরিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়, তবে সেটাই
কি ভারতের জন্য লাভজনক হবে না? আর যেখানে নিজেদের চাহিদাই পূরণ করতে পারবে
না, ভারত সেখানে আমাদের ‘সমতাভিত্তিক অংশীদারি’ প্রসঙ্গটাই কি হাস্যকর নয়? ৩.
আপনার রিভার-মরফোলজিক্যাল বর্ণনায় বুঝতে পারলাম না, নদীর গতিপথের বর্ণনা
দিয়ে কী বোঝাতে চাইছেন। না বুঝে যা বুঝলাম তা হলো, যেটুকু পানি এই বরাক
অববাহিকা দিয়ে আসে তা আমাদের পানি, আর আমাদের পানির এই প্রাকৃতিক প্রবাহের
ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা, তাই না? আপনার সূত্রহীন উপাত্তের উৎস
হচ্ছে ফ্লাড অ্যাকশন প্লানের (FAP) রিপোর্ট। নব্বইয়ের দশকের এই ফ্যাপ
রিপোর্টগুলো ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ড. আইনুন নিশাত, যিনি সরাসরি এই
প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তিনি স্বীকার করেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই এই
রিপোর্টের তথ্য/ফলাফল ধারণাপ্রসূত; যা কিনা জনাব মহিউদ্দিন ব্যতীত সবারই
জানা। এ রকম একটা বিতর্কিত রিপোর্টকে ভিত্তি করে সব গবেষক, সুশীল সমাজ বা
আপামর জাতিকে পঙ্গপাল বলাটা কতটা যৌক্তিক, তা বুঝলাম না। আর এই রিপোর্টকে
যদি বিবেচনায় আনিও, তাহলে ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান ৬ (FAP6)-এর ১৯৯২-৯৪
সালের গবেষণায় এই বাঁধ ভেঙে গেলে কীভাবে/কী পরিমাণ বা কতটা সময়ের মধ্যে
পানি আমাদের এখানে প্রবেশ করবে, তার একটি হিসাব দেখানো হয়; যা আমি পাঠকদের
জন্য তুলে দিলাম। সাধারণত বন্যার পানি ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার গতিবেগে
প্রবাহিত হয়, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার বেগেও প্রবাহিত
হতে দেখা যায়। গবেষণায় ১০ কিলোমিটার গতিবেগের হিসাবে বাঁধ থেকে ৮০
কিলোমিটার দূরের পার্বত্য উপত্যকা, ১৪০ কিলোমিটার দূরের শিলচর এবং ২০০
কিলোমিটার দূরের অমলশিদ এলাকায় (অমলশিদ হলো আসাম-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী
একটি গ্রাম। এখানে বরাক দুই ভাগ হয়ে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করে) পানি
পৌঁছার সময়ের একটা হিসাব কষা হয়। দেখা যায়, বাঁধ থেকে পানি অমলশিদ পৌঁছাতে
পৌঁছাতে স্রোতের বেগ কমে এলেও ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে বাঁধের পানি
মোটামুটি পাঁচ মিটার উচ্চতা নিয়ে হাজির হবে এবং ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পানি
তার সর্বোচ্চ উচ্চতা ২৫ মিটারের পৌঁছাবে, যা প্লাবনভূমির উচ্চতার চেয়ে আট
মিটার বেশি উঁচু। ফলে প্লাবনভূমিকে আট মিটার পানির নিচে তলিয়ে রাখবে ১০
দিন বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে! এখন আপনার উল্লিখিত গবেষণার এই দিকটি কেন
এড়িয়ে গেলেন? আপনি বলেছেন ‘ভূমিকম্পের জুজুর ভয়’। বাঁধের কারণে সংঘটিত
সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পটি ১৯৬৭ সালে কোথায় হয়েছিল? বরাক অববাহিকায় ২০০ বছরে
৫ মাত্রা কয়টি বা গত ১৫০ বছরের টিপাইমুখের ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের
মধ্যে ৭+ মাত্রার কয়টি ভূমিকম্প হয়েছে, দয়া করে জেনে নেবেন। ৪. আপনি
নিশ্চয়ই বোঝেন ইকো সিস্টেমের স্বতন্ত্রতা। হাওর এলাকার ভূমিরূপ, ফসল
ফলানোর সময়-অসময় সম্পূর্ণভাবে এই প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল।
প্রতিটি ইকো সিস্টেমের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্যটি থেকে ভিন্ন। আপনি
যে পানি বাড়া-কমার হিসাব দেখাচ্ছেন, তা ওই বিতর্কিত ফ্যাপ রিপোর্টের, যা
কিনা এক যুগের বেশি সময়ের পুরোনো। আপনি জানেন আশা করি, টিপাইমুখের পুরো
জলাধার ভরাট হতে লাগবে ১৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি, যার আট বিলিয়ন কিউবিক
মিটার পানি থাকবে pondage বা dead storage-এ, যা বাঁধের পেছনে জমা রাখা হয়
(টারবাইনের ঘূর্ণন সচল রাখার জন্য)। জলাধার পুরো ভরে গেলে ভারত অবশ্যই
পানি ছাড়বে। কিন্তু বাংলাদেশ এমনকি ভারতের কেউ কি জানেন, কী পরিমাণ পানি
প্রতিদিন ছাড়া হবে? ভারত কি এই water release schedule বাংলাদেশের সঙ্গে
মিলেমিশে করবে? ৫. কো-ফাইন্যান্সিংয়ের কথা বলছেন? যারা কিনা ২২ অক্টোবর
২০১১ আমাদের না জানিয়ে একটি আন্তর্জাতিক নদীর বাঁধের চুক্তি করল, তাদের
সঙ্গে! এ কেমন ‘যৌথ’তা? গঙ্গা চুক্তির অনুচ্ছেদ ৯-এর এই চরম লঙ্ঘন দেখে
আমরা পতঙ্গরা আতঙ্কিত হই। কীভাবে এত বলিষ্ঠভাবে বলছেন বাংলাদেশের লাভের
কথা? ডিসেম্বর ৩, ২০১১এ ভারত সরকার তার পরিবেশছাড়পত্র জারি করেছে। কিন্তু
বাংলাদেশে তো কোনো পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (EPA) হয়নি। সম্পূর্ণ
অবৈজ্ঞানিকভাবে ‘বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না’—এই আশ্বাস দিয়ে ভারত ৪০
মিলিয়ন হাওরবাসীর জীবনকে যে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন, তাকে কেন যে আপনি বা
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবৈজ্ঞানিক ভাবছেন না, তা বুঝলাম না! ৬.
ভারত শুধু টিপাইমুখেই নয়, বরাকের ওপর আরও চারটি, ব্রহ্মপুত্রের ওপর ১২টি
ড্যাম নির্মাণ করবে এবং আমাদের ন্যায্য পানি বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই
বাইপাস করে গঙ্গা, মহানদী হয়ে ভারতের অন্যান্য জায়গায় প্রবাহিত করার মেগা
প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। তখন শুধু মেঘনাই নয়, ব্রহ্মপুত্রও অবরুদ্ধ হয়ে
পড়বে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের water management-এর অধ্যাপক বিজয়
পারাঞ্জেপি এই মেগা প্রজেক্ট পর্যালোচনা করে বলেন, ‘হ্যাঁ, আপনারা
ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, কারণ আপনারা উচ্ছেদ হবেন না। আপনারা বন্যায় ভেসেও
যাবেন না, সত্যি। কিন্তু আপনারা শুকিয়ে যাবেন। কারণ, ব্রহ্মপুত্রের বাড়তি
সব পানি বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে।’ (পাঠক, সময় পেলে লিংকটি দেখুন):
http://www.facebook.com/photo.php?v=2166037388845)। মহিউদ্দিন সাহেব,
বিজয় পারাঞ্জেপি কি পতঙ্গ, তিনি কি আমাদের মতো দাঙ্গাপ্রিয় জনতা, বলবেন কি? সংযুক্তি:
১৯৬৭ ভারতের মহারাষ্ট্রে কোয়েনা বাঁধের কারণে (৬ দশমিক ৩ মাত্রার)
ভূমিকম্প তার কেন্দ্র থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরেও তীব্র আঘাত হেনেছিল। বরাক
অববাহিকার অসংখ্য fault line-এর জন্য সমগ্র এলাকায় গত ২০০ বছরে ৫ মাত্রা
বা তারও বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে ১০০টিরও বেশি। গত ১৫০ বছরের
টিপাইমুখের ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ২টি ৭+ মাত্রার ভূমিকম্প
হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৫৭ সালের ভূমিকম্পটি ছিল প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ
থেকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে। নাহরীন আই খান: জার্মানিতে অধ্যয়নরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন