বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১২

সিরাজ সিকদারের রাজনীতি ও হত্যাকাণ্ড


১৯৭৫ সালের পহেলা জানুয়ারি। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির চেয়ারম্যান সিরাজ সিকদার দাঁড়িয়ে আছেন চট্টগ্রামের হালিশহরে। একটু আগেই তিনি পার্টির উচ্চ পর্যায়ের এক সভার সমাপ্তি টেনেছেন। এবার তার ফিরে যাওয়ার পালা। ওই দিনগুলোতে কিছুটা বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছিলেন তিনি। কারণ, দেশজুড়ে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিলেন বলে আওয়ামী লীগ সরকার তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানও তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার এবং তার পার্টিকে নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সে কারণে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দাদেরও জোর তত্পরতা চলছিল। সিরাজ সিকদার কিন্তু একটি বিষয়ে অসতর্ক ছিলেন : ক্ষমতাসীনদের কতজন এজেন্ট তার দলে অনুপ্রবেশ করেছে তা তিনি লক্ষ্য করেননি। এই অসতর্কতার কারণে হালিশহরের সভার খবরও গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সভা চলাকালে নিয়ম ভঙ্গ করে একজন সদস্য বাইরে চলে যান। তিনি আর ফিরে আসেননি। এ থেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন সিরাজ সিকদার। দ্রুত সভা শেষ করেছিলেন তিনি।
রাস্তায় এসে একটি বেবিট্যাক্সিতে উঠেছিলেন সিরাজ সিকদার। ওঠার পর মুহূর্তে অচেনা এক ব্যক্তি তার কাছে লিফট চেয়েছিল। প্রথমে অসম্মতি জানালেও উপর্যুপরি অনুরোধে তাকে উঠতে দিয়েছিলেন তিনি। লোকটি বসেছিল চালকের পাশে। চট্টগ্রাম বিপণি বিতানের সামনে আসামাত্র লোকটি হঠাত্ পিস্তল উঁচিয়ে ধরে এবং বেবিট্যাক্সি থামাতে বাধ্য করে। মুহূর্তে ঘিরে ফেলে সাদা পোশাকধারী সশস্ত্র গোয়েন্দারা। জীবনে প্রথম ধরা পড়ে যান সিরাজ সিকদার। তাকে হাতকড়া পরিয়ে এবং চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় ডাবলমুড়িং থানায়। এরপর বিশেষ আয়োজনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি বিমানে উঠিয়ে দেয়া হয় এবং পাইলটের আপত্তি সত্ত্বেও হাতকড়া বাঁধা অবস্থাতেই সিরাজ সিকদারকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সশস্ত্র পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিরাট একটি দল বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল। একজন অতি উত্সাহী পুলিশ ইন্সপেক্টর সোজা লাথি মেরে বসে সিরাজ সিকদারের বুকের ওপর। জানতে চায়, ‘তোর বিপ্লব কোথায় গেল হারামজাদা?’
তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে নিয়ে আসা হয় সিরাজ সিকদারকে। প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি অফিসাররা তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। সিরাজ সিকদার তার ভাষায় ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের’ কাছে ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকাকালেই টেলিফোনে নির্দেশ এসে যায়, তাকে গণভবনে নিয়ে যাওয়ার জন্য—যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব অপেক্ষা করছিলেন। তার সামনে হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করানো হয় সিরাজ সিকদারকে। শেখ মুজিব ব্যস্ততার ভান করেন, বসতে পর্যন্ত দেয়া হয় না বন্দি নেতাকে। প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন সিরাজ সিকদার। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করা হয়। এরপর কথা কাটাকাটি চলে কিছুক্ষণ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে মাথানত করতে অস্বীকার করেন সিরাজ সিকদার। মধ্যরাতে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে আসা হয় সিরাজ সিকদারকে। রাতভর অকথ্য নির্যাতন চলে তার ওপর, অভুক্ত রাখা হয় তাকে। পরদিন, ২ জানুয়ারি তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সাভারে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর বিশেষ ঘাঁটিতে। দিনব্যাপী সেখানেও চলে নির্যাতন। ঢাকা থেকে উপস্থিত হন রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা। বন্দি এবং অর্ধমৃত সিরাজ সিকদারকে দাঁড় করানো হয় সাভার থানার কাছাকাছি তালবাগের এক রাস্তায়। সেখানেই গুলির পর গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৯ মে, ১৯৭৮ সংখ্যায় প্রকাশিত রিপোর্ট ‘সিরাজ সিকদার হত্যার নেপথ্য কাহিনী’)
পরদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় অন্য রকম বিবরণী। ‘সিরাজ সিকদার গ্রেফতার : পালাতে গিয়ে নিহত’ শিরোনামে পুলিশের বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ‘জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি (সিরাজ সিকদার) স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দেন এবং তার দলীয় কর্মীদের কিছু আস্তানা ও তাদের বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ দেখিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশের সঙ্গে যেতেও সম্মত হন। তদনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) রাতে একদল পুলিশ যখন তাকে ভ্যানে করে গোপন আস্তানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি সাভারের কাছে পুলিশের ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। পুলিশ তার পলায়ন রোধের জন্য গুলিবর্ষণ করে। ফলে সিরাজ সিকদারের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়।’
আওয়ামী সন্ত্রাস ও দুঃশাসনের ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে তো বটেই, এমনকি ৩৬ বছরের ব্যবধানে আজও পর্যন্ত পুলিশ তথা সরকারের এ বক্তব্যটুকু গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্রতিটি সংবাদপত্রে সেদিন একই ভাষায় একই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। একদলীয় শাসন ও শেখ মুজিবের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি ততদিনে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল বলে দ্বিতীয় কোনো ভাষ্য প্রকাশ করার সাধ্য ছিল না কারও। পরবর্তীকালে মুখ খুলেছেন অনেকে, এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদেরও কেউ কেউ। তাদের বক্তব্য থেকে শুধু নয়, বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার বিশ্লেষণেও পরিষ্কার হয়েছে, সিরাজ সিকদারের মতো একজন কঠোর প্রহরাধীন, হাত-পা বাঁধা এবং মৃতপ্রায় বন্দির পক্ষে চলন্ত পুলিশ ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়া বা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার প্রশ্ন উঠতে পারে না। তাকে বরং সুপরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছিল। দুটি তথ্যের উল্লেখ করলেও এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। প্রথম তথ্যটি হলো, শেখ মুজিবের ভাগ্নে এবং আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণির মালিকানাধীন ও সম্পাদিত দৈনিক বাংলার বাণীতে ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল, ‘বিপ্লব করিবার জন্য চারু মজুমদারকে যে কল্পনা পাইয়া বসিয়াছিল তাহার পরিণতি সকলের জানা থাকিবার কথা। সিরাজ সিকদারের পরিণতি তাহার চাইতে ভিন্নতর কিছু হয় নাই। সিরাজ সিকদার ধৃত হইয়া মৃত্যুবরণ করিবার পর আশা করা যায়, যাহারা এই দেশে সন্ত্রাসবাদী তত্পরতাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহারা অতঃপর নিজেদের ভুল ধরিতে পারিয়াছেন।’
প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব নিজেও কিছুটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হত্যাকাণ্ডের সত্যতা স্বীকার করেছিলেন। একদলীয় শাসন তথা বাকশালের প্রতিষ্ঠালগ্নে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের ভাষণে তিনি সিরাজ সিকদার সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছিলেন দম্ভ ও গর্বের সঙ্গে। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্ত ও উল্লসিত কণ্ঠে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ সংসদের মতো সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে ভাষণের নামে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সেই উল্লাস ও আস্ফাালন স্তম্ভিত করেছিল সমগ্র জাতিকে। প্রচণ্ড দমন-পীড়ন আর হত্যা-সন্ত্রাসের মধ্যে বন্দি জনগণের কাছে একথাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, সিরাজ সিকদার পালাতে গিয়ে নিহত হননি, তাকে হত্যা করা হয়েছিল এবং হত্যার নির্দেশ এসেছিল সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।
সিরাজ সিকদারের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড এবং শেখ মুজিবের উল্লাস ও আস্ফাালনের মূল কারণ নিহিত ছিল দু’জনের দেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মধ্যে। সিরাজ সিকদার বিশ্বাস করতেন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে। পূর্ববাংলার, আজকের বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি নিজের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম ঘোষণাতেই পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন সিরাজ সিকদার। প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণার সূত্র ধরে ১৯৭০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ‘স্বাধীন গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ প্রগতিশীল পূর্ববাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের’ বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির মূল্যায়নকালে সিরাজ সিকদারের সংগঠন শ্রমিক আন্দোলন বলেছিল, ‘পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় স্বাধীনতা, মুক্তি ও বিচ্ছিন্নতার সংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের কানাগলিতে পরিচালনার ষড়যন্ত্র করছে। আওয়ামী লীগ জনতাকে এর বিরুদ্ধে পরিচালিত না করে এই ষড়যন্ত্রে হাত মিলিয়েছে। আওয়ামী লীগের শ্রেণীভিত্তি প্রমাণ করে, এটা শেষোক্ত (আপসের) পথ অনুসরণ করছে, যার পরিণতি হলো জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।’
১৯৭১ সালের ২ মার্চ শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের উদ্দেশে প্রচারিত ‘খোলা চিঠি’তে সিরাজ সিকদার ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ববাংলার প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ৬ দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দেয়া এবং প্রকাশ্য ও গোপন দেশপ্রেমিক সব দল ও ব্যক্তিকে নিয়ে একটি অস্থায়ী সরকার এবং জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন ছিল এই প্রস্তাবের মূল কথা। স্বাধীনতার জন্য জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে শেখ মুজিবকে সিরাজ সিকদার বলেছিলেন, ‘অন্যথায় পূর্ববাংলার জনগণ কখনই আপনাকে ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করবে না।’ বলা বাহুল্য, সিরাজ সিকদার দূরে থাকুন, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ঐক্যের আহ্বানেও সে সময় সাড়া দেননি শেখ মুজিব। তিনি বরং সব মহলের প্রতিবাদ ও আপত্তি উপেক্ষা করে সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থের ধারক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেছেন, জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক হামলা ও গণহত্যার মুখে গ্রেফতার বরণ করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পরিবর্তে দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখার ব্যাপারেই বেশি ব্যস্ত থেকেছে।
অন্যদিকে সিরাজ সিকদার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন দেশের ভেতরে থেকে। ১৯৭১-এর এপ্রিলেই তিনি পৃথক একটি নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেছিলেন। চলমান স্বাধীনতাযুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার এবং তার ওপর সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ৩ জুন সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’। জাতীয় ঐক্যের বদলে ভারতের নির্দেশে কলকাতায় গঠিত অস্থায়ী সরকারকে সিরাজ সিকদার ‘পুতুল সরকার’ নামে অভিহিত করেছিলেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ‘প্রধান শত্রু’ এবং স্বাধীনতাবিরোধী দল ও ব্যক্তিদের ‘জাতীয় শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও খতম অভিযান পরিচালনাকে তিনি ‘প্রধান কর্তব্য’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই নীতি-অবস্থান ও কৌশলের কারণে স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে তাকে একই সঙ্গে দ্বিমুখী আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। একদিকে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুক্তি বাহিনী এবং অন্যদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এই যুদ্ধে সর্বহারা পার্টির অনেক বিপ্লবী মারা গেছেন। সে কারণে সিরাজ সিকদার আওয়ামী লীগকে একটি ‘ফ্যাসিস্ট শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় অর্জিত হয়েছিল বলে সিরাজ সিকদার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণরূপে মেনে নিতে রাজি হননি। তার মতে স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ‘ভারতের উপনিবেশে’ পরিণত হয়েছিল, বাংলাদেশের জনগণও সমপ্রসারণবাদী ভারতের পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে পড়েছিল। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সিরাজ সিকদার বলেছিলেন, ‘প্রতিক্রিয়াশীল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী ও সামন্তবাদীদের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ ও (রুশপন্থী নেতা) মণি-মোজাফফর বিশ্বাসঘাতক চক্র ক্ষমতার লোভে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং জাতীয় আত্মমর্যাদা পদদলিত করেছে।’ সিরাজ সিকদারের মতে তাই লাখ লাখ মানুষের জীবনদান ব্যর্থ হয়েছে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। এজন্য তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে উত্খাত করে ‘স্বাধীন গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ প্রগতিশীল পূর্ববাংলার প্রজাতন্ত্র’ এবং তার সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। (মার্চ, ১৯৭২)
এই বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সিরাজ সিকদার তার ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’কে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সে কারণে স্বাধীনতার পরও সর্বহারা পার্টির গেরিলাযুদ্ধ ও সশস্ত্র কর্মকাণ্ড অব্যাহত ছিল। ১৯৭৩ সালের ২০ এপ্রিল সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’। ১৯৭৩-৭৪ সময়কালে সর্বহারা পার্টির কর্মকাণ্ড সর্বাত্মক হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, দমন-পীড়ন এবং গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সিরাজ সিকদার দ্রুত এক জনপ্রিয় বিপ্লবী নেতা হিসেবে নন্দিত হতে থাকেন। তার আহ্বানে ১৯৭৪ সালের বিজয় দিবসে আংশিকভাবে হলেও হরতাল পর্যন্ত পালিত হয়েছে। সিরাজ সিকদারের এই বিচিত্র কিন্তু অসাধারণ সাফল্য ও জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করেছিল। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। একই কারণে সিরাজ সিকদারকে শুধু হত্যা করা হয়নি, শেখ মুজিব নিজেও উল্লাস প্রকাশ করতে লজ্জা বোধ করেননি। তিনি বরং এই হত্যাকাণ্ডকে তার সাফল্য ও কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করেছিলেন।
একথা সত্য, স্বাধীনতা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সিরাজ সিকদার সঠিক ছিলেন না; কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তিনি তার সিদ্ধান্তগত ভুল-ত্রুটিকে সাফল্যের সঙ্গেই অতিক্রম করেছিলেন। জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতাকে নিশ্চিত এবং সমুন্নত করতে গিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত জীবনও উত্সর্গ করেছেন। এজন্যই সিরাজ সিকদার পেয়েছেন মহান দেশপ্রেমিক বিপ্লবীর সম্মান। অন্যদিকে হত্যার পর উল্লাস করলেও শেখ মুজিব হয়েছেন নিন্দিত। ১৯৭৫-পরবর্তীকালে মুজিব হত্যার বিচারের পাশাপাশি সিরাজ সিকদার হত্যার বিচারের দাবিটি তাই যথেষ্ট জোরের সঙ্গে উঠে এসেছে। দেশপ্রেমিকরা মনে করেন, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার হওয়া দরকার। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন একজন দেশপ্রেমিক বিপ্লবী নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে, অন্যদিকে তেমনি গণতন্ত্রের পূজারী নামধারীদের স্বরূপও উন্মোচন করা যাবে। হত্যার রাজনীতি বন্ধ করতে হলেও এই বিচার করা জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
shahahmadreza@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন