বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১২

নদী হত্যা! হায় ট্রানজিট!!

ট্রানজিট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, সেই সাথে অনেক তথ্য উপাত্ত নিয়ে অনেক অলোচনা হয়েছে, তিতাস নদীর করুন পরিনতি আমরা যেমন মেনে নিতে পারিনি, তেমনি সাধারণ মানুষ আজ শংকিত। অথচ সরকার এই বিষয়ে সরাসরি বাংলাদেশের জনগনের বিরুদ্ধে। সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া নেই, কারণ আমরা জেনে গেছি সরকার ট্রানজিটের বিরুদ্ধে যাবেনা তথা ভারতের আগ্রসন ও অনৈতিক কাজে  বাধা দেবেনা। সেহেতু জনগনই শেষ ভরসা, তাই আমাদের পক্ষ থেকে সবাইকে জোড়ালো সোচ্চার হওয়ার অনুরোধ করছি। সেই সাথে গত সপ্তাহে ‘সাপ্তাহিক” পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হলো।
মূখপাত্র
মুক্তিআন্দোলন

নদী হত্যা! হায় ট্রানজিট!!

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া পৌরসভার শুরুতেই তিতাস নদীর ওপর কড্ডা এলাকায় পাশাপাশি দুটি সেতু। একটি সড়ক ও জনপথের, আরেকটি রেলওয়ের। এই দুই সেতুর মাঝ বরাবর নদীর বুকে মাটি ফেলে তৈরি করা হয়েছে বিকল্প রাস্তা! ভয়ানক বিপদের হাতছানি উপেক্ষা করে, কোটি মানুষের জীবন বিপণœ করে এ রাস্তাটি তৈরি করা হলো। কড্ডা সড়ক সেতুটি সাধারণ মানের। আশুগঞ্জ থেকে ভারতমুখী ট্রানজিটের অতি ভারী যানবাহনের ভার নিতে সক্ষম নয় এই সেতুটি। তাই বিকল্প হিসেবে নদীর মাঝখান দিয়ে রাস্তা করে দেয়া হয়েছে। সেই রাস্তা দিয়েই এখন নিয়মিত যাচ্ছে ভারতীয় মালামাল বহনকারী যানবাহন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হাজার বছরের ইতিহাস বুকে বয়ে চলা তিতাস নদীকে হাতে ধরে কবর দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত অর্জিত সমস্ত প্রকৌশল জ্ঞানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাল সরকার। সাধারণত নদীর ওপর কোনো স্থাপনা করতে গেলে প্রকৌশলীরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। হিসেব কষে দেখা হয়, এর ফলে নদী অন্য কোনো দিকে বাঁক নিবে কিনা, বর্ষাকালে পানি বেড়ে যাবে কিনা, ভাটি অঞ্চলে পানি প্রবাহ কমে যাবে কিনাÑ এরকম আরো অনেক বিষয়। এত হিসেব করে একটি সেতু করার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু তিতাসে কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়েনি। সোজাসুজি নদীর মধ্যখান দিয়ে একটা রাস্তা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সিমেন্টের বস্তা, বাঁশের খুঁটি, ইট-বালু ও মাটি ফেলে নদীর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দেয়া হয়েছে। মাঝে মধ্যে শক্ত করে পুঁতে দেয়া হয়েছে পাকা খুঁটি। নদীর পানিতে যাতে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য রাস্তার নিচ দিয়ে তিন ফুট ব্যাসের কয়েকটি পাইপ বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
মাঝখানে রাস্তা হওয়ায় তিতাস এখন এক স্রোতহীন জলাশয়। পলিপতনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ যা বদ্ধ জলাশয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। তিতাস নদীর দৈর্ঘ্য ৯৮ কি.মি.। প্রায় অর্ধকোটি মানুষের বসবাস এ নদীর চারপাশে। নদীর মাঝখানে বানানো রাস্তা এসকল জনগোষ্ঠীর জীবনে আর্থ-সামাজিক দুর্গতি ডেকে আনছে। স্থানীয় অধিবাসীরা তো নদীর মাঝখানে এমন বাঁধ হতে দেখে হতবাক। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেকেই এই নদী দিয়ে নৌকা করে আখাউড়া বাজারে যান। এই এলাকার জমিতে উৎপাদিত সকল শস্যই নদীপথে আনানেয়া করা হতো। এই বাঁধের ফলে এখন নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
নদীতে রাস্তার ফলে স্থানীয় মৎসজীবীরাও পড়েছেন মহাবিপদে। তিতাস সংলগ্ন হরুমপুর গ্রামের অধিবাসী আফজাল হোসেন জানান, এই এলাকা এবং আশপাশের গ্রামের হাজারেরও বেশি পরিবার নদীতে মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত। নদীর মাঝখানে রাস্তা হওয়ায় এখন তারা চাইলেও আর আগের মতো নদীর এমাথা থেকে ওমাথা চষে বেড়াতে পারছেন না। ভাটি এলাকায় দেখা দিয়েছে আলাদা সমস্যা। এমনিতেই শীতে নদীতে পানি কমে যায়। আগে যাও থাকত এবার নদীতে রাস্তা হওয়ায় ভাটি এলাকা ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে ইরি ধানে পানি না পাওয়ার আশঙ্কায় পড়েছেন কৃষকরা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এ রাস্তাটি তৈরি হয়েছে গত বছরের শুরুতে। গত বর্ষায় নদীর পানিতে রাস্তাটি তলিয়ে যায়। সাধারণত নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় যতটা পানি দেখা যায়, গত বর্ষায় তার চেয়ে বেশি পানি দেখা গেছে। আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিভিন্ন এলাকার কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। চাষাবাদেও ব্যাঘাত ঘটেছে। গত আগস্টে ত্রিপুরার পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও বাড়তি বৃষ্টিপাতের পানিতে আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের আবদুল্লাহপুর, কালিকাপুর, বীরচন্দ্রপুর ও বঙ্গেরচর গ্রামের অনেক বাসিন্দা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতে বাঁধ থাকায় পানির উচ্চতার এই তারতম্য ঘটেছে।

যেভাবে রাস্তা হলো
বাংলাদেশের কাছে দীর্ঘদিন যাবৎ ট্রানজিট চেয়ে আসছে ভারত। অবকাঠামোগত কারণে এখনই পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেয়া সম্ভব নয় জানিয়ে গত বছর ট্রান্সশিপমেন্ট নামে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট চালু করে বাংলাদেশ সরকার। এর আগে এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১১ জানুয়ারি ২০১০ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ঘোষিত ৫০ দফা যৌথ ইশতেহারে। ট্রানশিপমেন্টের আওতায় ভারতের ত্রিপুরার পালাটানায় ৭২৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রয়োজনীয় ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনের জন্য ৩০ নভেম্বর ২০১০ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতায় বলা হয়, কোনো ধরনের ট্রানজিট ফি ছাড়াই ভারতীয় কনটেইনার পশ্চিমবঙ্গের রায় মঙ্গল থেকে নদীপথে সাতক্ষীরা হয়ে আশুগঞ্জ নদী বন্দরে আসবে এবং তারপর আশুগঞ্জ থেকে সড়কপথে আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় যাবে। এজন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে বাংলাদেশকে ভারত সরকার এককালীন ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রদানের আশ্বাস দেয়।
এই স্বল্প বাজেটে পুরো অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব ছিল না। কিন্তু তা নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তখন কিছু বলা হয়নি। এই টাকা দিয়ে আশুগঞ্জ বন্দর উন্নয়ন, রাস্তা মেরামত ও প্রশস্ত করা হয়। কিন্তু রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় থাকা সেতু ও কালভার্টগুলো থেকে যায় আগের অবস্থাতেই। এগুলোর সর্বোচ্চ ভারবহন ক্ষমতা ১৫ টন। ফলে দেখা গেল, ভারতের ৩২৫ টন ওজনের ওডিসি পরিবহনে সক্ষম ১২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে বিশাল ভারতীয় ট্রেইলার পরিবহনে এসব কালভার্ট ও সেতু কোনোক্রমেই সক্ষম নয়। তাই ভারতের আসাম বেঙ্গল কেরিয়ার বা এবিসি ইন্ডিয়াকে সেতু ও কালভার্টগুলোর পাশ দিয়ে বিকল্প রাস্তা তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা সেতু ও কালভার্টের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদী ও তার খালগুলোর মধ্য দিয়েই বালু ও সিমেন্টের বস্তা দিয়ে রাস্তা তৈরি করে। এবিসি তাদের বাংলাদেশি সাবকন্ট্রাক্টর গালফ ওরিয়েন্ট সিওয়েজ-এর মাধ্যমে এ কাজ করায়। এখন এসব রাস্তা দিয়ে নিয়মিত ভারতীয় লরিগুলো যাওয়া আসা করছে।

সুপ্রস্তাব নেয়নি সরকার
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩০ নভেম্বর ২০১০ সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ-এর ওপর ট্রানজিটের রুট নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিআইডব্লিউটিএ-এর পক্ষ থেকে তখন সরকারকে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া সত্ত্বেও ওই প্রস্তাবনাটি গ্রহণ করেনি সরকার। ওই প্রস্তাবনায় বলা হয়, সড়কপথে না দিয়ে ট্রানজিট নৌপথে দেয়া হোক। আশুগঞ্জ থেকে সরাসরি নদীপথে আখাউড়া পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার জাহাজের মাধ্যমে ট্রানজিটের মালামাল যাবে। সেখান থেকে গাড়ি মাত্র ৫০০ মিটার বা আধা কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিলেই ভারত সীমান্তে পৌঁছে যাবে। এজন্য নদী খনন ছাড়া আর তেমন কোনো অবকাঠামোগত কাজের দরকার পড়বে না। প্রস্তাবনায় বলা হয়, নদীপথে ট্রানজিট হলে মানুষ জানবেও না যে, ট্রানজিটের গাড়ি যাচ্ছে। এতে সারুলিয়া এলাকায় তিতাস নদীর যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠা যাবে। নদী বাঁচবে। স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থায় নদী বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ভারত যদি নদী খননে বিনিয়োগ করে সব মিলিয়ে এতে বাংলাদেশের লাভই হবে।
বিআইডব্লিউটিএ-এর এই সুপ্রস্তাবে সরকারপক্ষ সাড়া দেয়নি। নদী বাঁচানোর প্রস্তাবনায় কান না দিয়ে সরকার শেষ পর্যন্ত নদী হত্যার পক্ষেই রায় দেয়।
কারো দায় নেই!
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, পানিসম্পদ, নদী, নৌপরিবহন সম্পর্কিত বিভিন্ন সংস্থা আছে। সংশ্লিষ্ট অনেক কর্তৃপক্ষ আছে। এছাড়া প্রতিটি জেলার প্রশাসক আছে। কিন্তু একটি নদী ও ১৮টি খাল হত্যা এবং আরেকটি নদীর গলা টিপে ধরা নিয়ে এই কর্তারা কেউই কিছু বলতে পারছেন না।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে কমপ্লেইন করেছি। এর বেশি আর একটি কথাও এখন আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। এমনিতেই আমি অ্যাকশনের মধ্যে আছি।’
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘ওই নদী দিয়ে কোনো পরিবহন ব্যবস্থা চালু নেই। নদীটির বিভিন্ন জায়গায় চর পড়ে গেছে। নদীটা খনন করা দরকার, এটা আমরা সরকারকে বলেছি। শীতকালে এমনিতেই এই নদীতে পানি থাকে না। তাই খুবই সাময়িকভাবে রাস্তাটি করা হয়েছে বলে শুনেছি। এ মাসের মধ্যেই বাঁধটি কেটে দেয়ার কথা। অল্প সময়ের জন্য করা এই রাস্তার কারণে নদীর কোনো ক্ষতি হবে না।’
বন ও পরিবেশমন্ত্রী হাসান মাহমুদকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি রেগে যান। মন্ত্রী বলেন, ‘আপনি কিভাবে মনে করলেন হঠাৎ করে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন আর আমি উত্তর দিব? এখন এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তিতাসে কোথায় রাস্তা হলো আমি তো জানি না! আর রাস্তার ব্যাপার তো আমাদের না। এটা যোগাযোগ মন্ত্রণালয় করে। রাস্তা করা যাবে কিনা এটা জানে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। তারা ছাড়পত্র দিলেই কেবল যোগাযোগ মন্ত্রণালয় রাস্তা বানাতে পারে। এটা আমাদের জানার বিষয় না। এ বিষয়ে তাই আমি কিছু বলতে পারব না।’
‘আমরা এমন অসভ্য নই যে ভারতের কাছে ট্রানজিটের জন্য ফি চাইব’ উক্তি করে খ্যাতি পাওয়া প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমানকে তিতাস নদী হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘নদীতে রাস্তা তো সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ব্যাপার। তাদের প্রকৌশলীরাই কেবল এটা করতে পারে। বিষয়টা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করুন। আমি কিছু জানি না।’ কিন্তু সড়ক ও জনপথের কর্মকর্তারা বলছে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের স্মারকের ওপর ভিত্তি করে রাস্তাটি করা হয়েছে। এতে তাদের কোনো হাত নেই। এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে উপদেষ্টা বলেন, এটা খুবই দায়িত্বহীন কথা। সড়ক ও জনপথ কি দুই প্রধানমন্ত্রীকে প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে? যদি না দেয়, তাহলে দুই প্রধানমন্ত্রী রাস্তা বানানোর কে? এর দায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরেরই। আমি যতটা শুনেছি, এটা অস্থায়ীভাবে করা হয়েছে। এ নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’
তিতাসের এ রাস্তা হয়েছে বাংলাদেশে বিদ্যমান এ সংক্রান্ত সকল আইন ভঙ্গ করে। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলোর ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপক জনগণ। প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিতাস নদীর মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তা করা হয়েছে। এটি কেন, কিভাবে করা হয়েছে, এ বিষয়ে আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি? উত্তরে তিনি বলেন, ‘হোয়াই মি? আমাকে কেন প্রশ্ন করছেন? জার্নালিজম ইজ নট সো হেলদি টু টক ইউ।’ আপনি প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা। যেহেতু এর সঙ্গে জনস্বার্থ জড়িত সে কারণেই আপনার সঙ্গে কথা বলছি। ‘আমার এখন ৭৭ বছর বয়স হয়ে গেছে। এখন আর এত খোঁজখবর রাখতে পারি না। এসব বিষয়ে কথা বলতে পারব না।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নানকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ কোনো অনুমতি নিতে আসেনি। আমরা কাউকে অনুমতি দেই নাই।’ তাহলে কিভাবে নদীতে রাস্তা করা হলো এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এখানে আমাদের কিছু বলার নেই।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমাদের জানানো হয়েছে যে, সরকারের শীর্ষপর্যায়ে একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে। স্মারক অনুযায়ী আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সড়কে সড়ক মেরামত হবে। যেসব সেতু ভারী যানবাহন চলার উপযোগী নয়, তার পাশ দিয়ে বাইপাস সড়ক হবে। এর বেশি কিছু আমাদের জানানো হয়নি। আমরা লিখিত কোনো অনুমতি কাউকে দেই নাই।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের বলে দেয়া হয়েছে এ বিষয়ে কোনো কথা না বলার জন্য।’ তিনি আরো যোগ করেন, ‘শীতে তিতাসে এমনিতেই পানি থাকে না। তাই বাঁধ দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। বর্ষা এলে এই রাস্তা এমনিতেই তলিয়ে যাবে।’ এই রাস্তার ফলে কোনো ক্ষতি হবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আগেই তো বলেছি, কিছু বলতে পারব না।’
আখাউড়া উপজেলার চেয়ারম্যান শেখ বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘রাস্তাগুলো করা হয়েছে ট্রানজিটের পণ্য নেয়ার জন্য। রাস্তার নিচে পাইপ বসানো হয়েছে। তাই কোনো ক্ষতি হবে না। এরপর আরো প্রশ্ন করতে গেলে তিনি ফোন রেখে দেন। এরপর আর তিনি ফোন ধরেননি।
তিতাসের যেখানটায় রাস্তা করা হয়েছে সেই বাসুদেব ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান নেসারউদ্দিনকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কেউ কোনো কথা বলেনি। শুনেছি এগুলো অস্থায়ীভাবে করা হয়েছে। আমরা ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছি, তাও তো দেখতে হবে।’ ট্রানজিট দেয়া হয়েছে বিনামূল্যে, টাকা পাচ্ছি কোথা থেকে শুনলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য ক্ষতিকর হলে তো আর সরকার এটা করত না।
দেশের বুদ্ধিজীবী এবং পরিবেশ আন্দোলনের নেতাকর্মীদের কাছে তিতাসে রাস্তা বানানো সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, ‘কোন মন্ত্রণালয় নদী হত্যা করে এই রাস্তা করার অনুমতি দিল আমি তা জানতে চাই। এটা দেশের স্বার্থ ও আমাদের সার্বভৌমত্ববিরোধী। যারা এটা করেছে তারা দেশের শত্রু। সরকার এতটাই ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে যে, দেশের স্বার্থ ক্ষুণœ হচ্ছে কিনা তা তারা আমলে নিচ্ছে না। খুবই বিস্ময়ের যে, একজন মন্ত্রীও এ নিয়ে কথা বলল না। তিস্তার পানি নিয়ে মমতা পারে, আর আমাদের স্বাধীন মন্ত্রিসভা একটি নদীকে বাঁচানোর স্বার্থে অবস্থান নিতে পারে না। এটা খুবই হতাশার।’
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এ প্রসঙ্গে বলেন, যে কোনোভাবে নদীর প্রবাহকে বন্ধ করা আসলে নদীকে খুন করার শামিল। এই রাস্তা যদি একসময় তুলেও দেয়া হয়, এই যে রাস্তাটা করা হলো, এই ক্ষতি তো পূরণ হবে না। মাটি ফেলা সহজ। কিন্তু তুলে ফেলা কঠিন। কিছু না কিছু রয়েই যাবে। এর মধ্য দিয়ে নদীটির একটা বিরাট মাপের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা আমাদের নদীগুলোকে গলাটিপে হত্যা করছি। এটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত। নির্বোধের মতো নেয়া সিদ্ধান্ত।’
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যে কোনো সেতু বানাতে গেলে প্রকৌশলীরা তা দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করেন। নদীর গতি প্রবাহ, বিভিন্ন সময়ে পানির উচ্চতার তারতম্য, পলির পরিমাণসহ আরো অনেক কিছুর ওপর স্টাডি করা হয়। তার ভিত্তিতে ঠিক হয় কোনদিক দিয়ে সেতু হলে পরিবেশের জন্য ভালো হবে। তারপর সেতুর ডিজাইন করা হয়, তাও পরিবেশের কথা বিবেচনা করে। তিতাসে যেভাবে রাস্তা করা হলো, এটা শুধু দেখা যায় যুদ্ধ চলাকালে। কোনো দেশে যুদ্ধ চললে, মারাত্মক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে যুদ্ধযান আনানেয়ার জন্য নদীতে কখনো কখনো এভাবে রাস্তা করা হয়। আমাদের দেশেও ছোট ছোট খালে কালভার্ট বানানোর সময় এরকম রাস্তা করা হয়। কিন্তু এখন তো দেশে যুদ্ধ চলছে না। তাহলে কেন এভাবে নদীর মাঝখান দিয়ে রাস্তা? কোনো রকমে পানি যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, এটাও নদীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রক্ষার জন্য করা হয়নি। করা হয়েছে নদীর পানি থেকে রাস্তাটি বাঁচানোর জন্য। এটা কোনো রাষ্ট্র করতে পারে না। আর আমাদের দেশে তো সরকার এটা করল, নিজেদের স্বার্থেও নয়, ভারতের স্বার্থে। এটা কিছুতেই হতে পারে না। এটা একেবারে আত্মঘাতী। এই কাজের মধ্য দিয়ে সরকার প্রমাণ করেছে, দেশের মানুষের স্বার্থ কিসে তা তারা বোঝে না। দেশ চালানোর যোগ্যতা তাদের নেই।’
প্রফেসর এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার। একেবারেই অবিশ্বাস্য। নদী ছাড়া আমরা বাঁচব কি করে? সরকার কি কিছুই ভাবল না। তাও নিজেদের নয়, ভারতের স্বার্থে এরকম আত্মঘাতী কাজ! এটা মেনে নেয়া যায় না। এই অপকর্মের পুরো দায় সরকারের। এখন জনগণই একমাত্র ভরসা। জনগণকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।’
প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নদীতে রাস্তা করলে কী ক্ষতি হবে তা সরকারের ভালোই জানা আছে। ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসেব এ সরকারের মাথায় ঢুকবে না। ভারতের সেবা করার জন্য তারা মাতাল হয়ে আছে। জনগণ বা বিশেষজ্ঞ, কারো মতের তোয়াক্কা তারা করছে না। এর শাস্তি তারা পাবে। কিন্তু তার আগে দেশের যে ক্ষতি হয়ে গেল তা আর মিটবে না। এই রাস্তা বেশিদিন থাকলে নদীটির মৃত্যু অবধারিত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, ভারতের পক্ষ থেকে আমাদের নদীগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা হচ্ছে। তারা দখলদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা আজ আক্রান্ত। তাদের যে জাতীয় পানি পরিকল্পনা তা রীতিমতো আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। এক ফারাক্কার জন্য আমাদের দেড় ডজন নদীতে পানি নেই, মাছ নেই, জেলেরা বেকার। সুন্দরবনের ওদিকে তারা কী করেছে, এখন সুন্দরবন এলাকার জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে। তিস্তা নিয়ে যা হচ্ছে, তাতে ওই অঞ্চলে আমাদের সেচ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। টিপাইমুখ নিয়ে সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন, আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু এটা তারা বলছে না যে, টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে তারা পানি টেনে নেবে ফুলেরতল এলাকায় থাকা একটি জলাধারে। সেখানে পানি মজুদ করে তা আসামের সেচ কাজে ব্যবহার করা হবে। তিতাস নিয়ে কী বলব? কিছু বলতে গেলে বলবে এরা শত্রুপক্ষ। যেভাবে ভারতের স্বার্থে নদীটিকে হত্যা করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, আমরা ভারতের কোনো করদরাজ্য।’
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তিতাস নদীর ওপর  বাঁধ দিয়ে একটা নদীকে খুন করা হলো। এটা করে সরকার নিজের আইন নিজেই ভঙ্গ করল। বাংলাদেশ এমনিতেই পরিবেশ বিপর্যয়মুখীন দেশ। দেশব্যাপী এখন নদী রক্ষার কথা জোরেশোরে বলা হচ্ছে। ঠিক এমন একটা সময়ে এ রকম হঠকারী কাজ করা মোটেই উচিত হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘ট্রানজিট বিষয়ে এমনিতেই জনমনে বিভ্রান্তি হয়েছে। এ নিয়ে সরকার কম বিতর্কিত নয়। ট্রানজিটের জন্য নদীতে বাঁধ দেয়ার ফলে ট্রানজিটের ব্যাপারটা আরো বেশি বিতর্কিত হয়ে পড়ল। জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হলোÑ সরকার বুঝি সত্যিকারার্থেই ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে যাচ্ছে। আমি জানি না, তিতাস নদীর ওপর বাঁধ দেয়ায় সিদ্ধান্ত সরকারের শীর্ষ মহল থেকে হয়েছে কিনা, যদি তা হয়ে থাকে তবে এটা করে সরকার তাদেরকেই উৎসাহিত করল, যারা পরিবেশ ধ্বংস করে নদী দখল করে নদীকে হত্যা করে। সরকার দেখিয়ে দিল যে আপনারাও করুন। এ ধরনের কাজ নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। এর ফলাফল ইতিবাচক হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না।’
অধ্যাপক আইনুন নিশাত এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখানে আমার কিছু বলার নেই। নদীকে নদীর কাছে ফিরিয়ে দাও- এই দাবিতে গত ২৫ বছর ধরে আমি কথা বলে আসছি। তিতাসে যা হলো এটা খুবই হতাশার। একটা নদীর মৃত্যু মানে তো প্রকৃতির মৃত্যু। আর প্রকৃতির মৃত্যু হলে তো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কোনোদিন টেকসই হবে না।’
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নদীতে কখনো কখনো এভাবে রাস্তা করা যায়। তবে তা একেবারেই আপদকালীন ব্যাপার। এভাবে রাস্তা করলে দ্রুত তা আবার পরিপূর্ণভাবে তুলে ফেলতে হয়। তারপরও এতে বিশাল ক্ষতি হয়। আর তিতাসে এখন যে অবস্থা, তাতে পরিবেশ, অর্থনীতির যে বিশাল ক্ষতি হলো তা বলার নয়। এই রাস্তা করার মধ্য দিয়ে আমাদের পানিসম্পদ, সড়ক, পরিবেশ, নৌপরিবহনÑ সকল ক্ষেত্রের আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। এখন এই মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত মামলা করা। নইলে সাধারণ নিয়মে তারা নিজেরাই মামলায় পড়ে যাবে। মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত মামলার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা দিয়ে নদীটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া। এটা যদি তারা না করে তাহলে প্রমাণ হবে যে, আসলে আমাদের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই।’
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘একে তো দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। এতবড় পরিবেশবিরোধী, বেআইনি একটা কাজ হয়ে গেল, সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় একটা টু শব্দও করল না। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। স্বাধীন দেশে এটা কিভাবে সম্ভব। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রচলিত আইনেই বিচারের সম্মুখীন করা যায়। এই কাজের মাধ্যমে সরকারের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় বসে তারা যে এদেশের জনগণের স্বার্থ নয় বরং ভারতের স্বার্থ দেখভাল করছে তা এখন একেবারে স্পষ্ট।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নদীর মাঝে এভাবে রাস্তা করাটা একটা হঠকারী কাজ হয়েছে। যদি এই রাস্তা তারা ভেঙেও ফেলে তারপরও যে ক্ষতি হয়ে গেল তার কোনো সুরাহা হবে না। এরা যদি ভাঙেও, দেখা যাবে অর্ধেক ভেঙেছে, অর্ধেক রয়ে গেছে। এতে করে নদীটি আর আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে না। ইকো সিস্টেম একদিনে গড়ে ওঠে না। যেসব মাছ এই এলাকায় ছিল সেগুলো আর এদিকে আসবে না এই রাস্তার কারণে। নদীর অভ্যন্তরীণ এবং এর দু’পাড়ের জীববৈচিত্র্য চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করছি।’
এই নদী হত্যা নিয়ে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন হিসেবে আপনারা কী করলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে পবা সভাপতি বলেন, ‘আমরা মানববন্ধন করেছি। বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য রাখছি, মানুষকে সোচ্চার হওয়ার জন্য ডাক পাঠাচ্ছি। রাস্তা পরিপূর্ণভাবে তুলে নেয়ার জন্য সরকারকে একটা চিঠি দিয়েছি। যদি সরকার এটা না ভাঙে আমরা কর্মসূচিতে যাব।’ সরকার কর্তৃক রাস্তা ভাঙার জন্য আপনারা কতদিন অপেক্ষা করবেন। সরকার যদি বলে এই বছরটা থাক। আগামী বছরে ভাঙব। তখন আপনারা কী করবেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা এই মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত দেখব। এর মধ্যে রাস্তা না ভাঙা হলে আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল মতিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা খুবই মারাত্মক একটি বিষয়। তিতাস তো বিশাল এক নদী। এ নদীর দুই পাড়ের লাখ লাখ গরিব মানুষ এ নদীর ওপর নির্ভরশীল। নদী কিন্তু সবসময় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উৎস। সেই নদীর মাঝখানে রাস্তা। তাও আবার ভারতের জন্য। এটা কিছুতেই মানা যায় না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন এসেছিলেন তখন আমরা দুই প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১৪টি দাবিনামা পেশ করেছিলাম। এই ১৪টি দাবি দুই দেশের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। এর কোনো একটিতে টান পড়লে দুই দেশের স্বার্থই প্রভাবিত হয়। এর মধ্যে একটি ছিল কোনো নদীতে বাঁধ দেয়া যাবে না। পুরনো বাঁধগুলো ক্রমান্বয়ে তুলে ফেলতে হবে। আমরা তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষভাবে বলেছিলাম যে, ট্রানজিট বিষয়টা ভীষণভাবে পরিবেশের সঙ্গে জড়িত। ট্রানজিট নিয়ে আমরা ভারতের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারি। আমরা দাবি করতে পারি, ট্রানজিট দেয়া হবে, বিনিময়ে তোমরা আমাদের দেশের সঙ্গে যুক্ত নদীগুলো থেকে বাঁধ তুলে নাও। এটা করতে পারলে আমরা বাঁচতাম। কিন্তু সরকার ট্রানজিট দিয়ে নদী বাঁচানোর পথে হাঁটেনি। বরং ট্রানজিটের জন্য নদী হত্যা করছে।’
তিতাসে এত বড় একটা বিপর্যয় হয়ে গেল আপনারা কী করলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বাপা সম্পাদক বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমরা বিশেষ কিছু করতে পারিনি। আমাদের দুই-এক মাসের শিডিউল আগে থেকে ঠিক করা থাকে। তাই হুট করে অনেক কিছু করা যায় না। তারপরও ইতোমধ্যে আমরা নাগরিক সমাবেশ করেছি। বিভিন্ন মাধ্যমে বক্তব্য রাখছি। মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। খুব দ্রুতই তিতাসে আমরা একটি টিম পাঠাব। সেই টিমের প্রতিবেদন অনুযায়ী আমরা কর্মসূচিতে যাব।’

১৮টি খাল শেষ
শুধু তিতাস নদীতে নয় আশুগঞ্জ থেকে শুরু করে আখাউড়া পর্যন্ত রাস্তা টেনে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আরো ১৮টি খাল। বন্ধ হওয়া খালগুলো হচ্ছে, আশুগঞ্জের দিক থেকে সোনারামপুর খাল, সুহিলপুর হলাপাড়া খাল, মিরাহাটি খাল, ঘাটুরা তিতাস খাল, পৈরতলা গোপন খাল, এন্ডারসন খাল, রামরাইল খাল (উত্তর), রামরাইল (দক্ষিণ) খাল, সুলতানপুরের রাধিকা উশিওড়া খাল, সুলতানপুর পূর্বপাড় খাল, চিনাইর হন্তা খাল, ভাতশালা রেলসেতু খাল, বাসুদেব দুবলার খাল, কোড্ডা খাল, চান্দি কোড্ডা খাল, আখাউড়া পৌরসভার নূরপুর খাল, কালুন্দি খাল, জাজিরপুর খাল। এগুলোর অধিকাংশ বালির বস্তা, কনক্রিট ও পাথরের বাঁধ সদৃশ হলেও এর মধ্যে কয়েকটিতে দেখা গেছে পিচ ঢালাই করা স্থায়ী রাস্তা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মধ্যে অবস্থিত পৈরতলা খাল, সুলতানপুরের রাধিকা উশিওড়া খালসহ আরো কয়েকটি খালে স্থায়ী পাকা সড়ক দেখা গেছে।
আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত কুরুলিয়া নদী একমাত্র ব্যতিক্রম। এই নদীর মধ্য দিয়ে রাস্তা করা হয়নি। স্থানীয়দের মতে, কুরুলিয়া একেবারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়ায় প্রতিবাদের ভয়ে সরকার রাস্তা বানাতে সাহস করেনি। তবে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কুরুলিয়া নদীর মধ্য দিয়ে রাস্তা না করা হলেও ভারতীয় লরি চলাচলের উদ্দেশ্যে নদীটি মারাত্মকভাবে শাসন করা হয়েছে।  দু’পাশে বালির বস্তা ফেলে নদীর প্রস্থ কমানো হয়েছে। এমন অবস্থা তৈরি করা হয়েছে যে, লরি ওঠার পর ফেরি শুধু চালু করে বন্ধ করে দিলেই অন্য পাড়ে চলে যাওয়া যায়। কুরুলিয়ার দু’পাশে এই বালি ফেলার কাজ এখনো চলছে। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, এভাবে বালি ফেলতে থাকলে একদিন হয়ত নদীই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ক্ষোভ আছে প্রকাশ নেই
তিতাস নদীর মাঝখানে রাস্তা করে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ঘটনা সারা দেশের আনাচে-কানাচে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নদীর প্রতি গভীর ভালোবাসা রয়েছে। অসংখ্য মানুষের ছেলেবেলার অনেক গল্প নদী নিয়ে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্র, উপন্যাস- উভয়ই বাংলাদেশের মানুষের মনন ও চেতনায় গভীর রেখাপাত করে আসছে। সেই তিতাস নদীকে আজ বাংলাদেশ সরকারই হাতে ধরে হত্যা করেছে, এটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। স্থানীয়রা পুলিশের ভয়ে কিছু বলতে পারছেন না। তবে মানুষ ক্রমশ সংগঠিত হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কৃষক সমিতির আহ্বায়ক শাহরিয়ার মো. ফিরোজ বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তিতাস নদী খননের দাবি জানিয়ে আসছি। সরকার তা না করে ভারতের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে এই নদীর ওপর দিয়ে রাস্তা করেছে। এটা এই এলাকাকে ধ্বংস করে দেবে। আমরা স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি। সকলেই এই বাঁধের বিপক্ষে। কিন্তু কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। সরকারের উচিত দ্রুত আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত খাল ও নদীর ওপর বানানো রাস্তাগুলো ভেঙে এই এলাকাকে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচানো। সরকার যদি তা না করতে চায় তাহলে এই তিতাসের পানিতেই সরকার ডুবে মরবে।’
ট্রানজিট নিয়ে এক সময় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রচন্ড ভারত বিরোধী মনোভাব ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের ইতিবাচক প্রচারণার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে এ সংক্রান্ত সন্দেহভাব অনেকটাই মোচন হয়েছে। রাজনীতিক, বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা, বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম, বিভিন্ন স্তরের প্রচারণার মধ্য দিয়ে মানুষ বিশ্বাস করেছে যে, ট্রানজিট দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে না। আর্থিকভাবে বড় রকমের লাভজনক ব্যাপার হবে। কিন্তু এখন সেই বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, লাভ দূরে থাক আমরা ভর্তুকি দিয়ে ট্রানজিট দিচ্ছি। এছাড়া ইদানিং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নদী, পরিবেশ, প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। এরকম একটি সময়ে জনমতের প্রতি এক প্রকার অশ্রদ্ধা দেখিয়েই তিতাসের মাঝখান দিয়ে এই রাস্তা করা হলো।
এর প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতিবিদ, সুশিল সমাজ, বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ কারও কাছ থেকেই প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায়নি। মিডিয়াও এক অর্থে নিরব।
ট্রানজিট নিয়ে এ ধরনের কিছু আচরণের কারণে ভারত প্রসঙ্গে, ট্রানজিট প্রসঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কোথায় দিয়ে দাঁড়াবে তাই এখন দেখার বিষয়।
ক্ষতি
যদি তিতাসের মাঝে বানানো এই রাস্তা স্বল্প সময়ের মধ্যে কেটেও দেয়া হয় তারপরও এর কারণে নদীটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নদীর মাঝখানে এই রাস্তা করার কারণে
* জলাবদ্ধতা দেখা দেবে
* খাদ্যচক্র, বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে
* পানির স্তর নিচে নেমে যাবে
* নদী থেকে মাছ হারিয়ে যাবে
* বর্ষায় লোকালয় প্লাবিত হবে
* গ্রীষ্মে ফসলের জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে
* ধীরে ধীরে এই এলাকার তাপমাত্রা বাড়বে
* বিশাল অঞ্চলজুড়ে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়বে
* প্রথমে ভাটিতে, পরে উজানে চর পড়া শুরু হবে
* আস্তে আস্তে পুরো নদীটি মারা যাবে
* নদীকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে
* নদী পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পরিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসবে
আনিস রায়হান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন