বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১২

হায় আমাদের দেশপ্রেম! হায় আমাদের সার্বভৌমত্ব বোধ!


এক.
বাংলাদেশের নদী তিতাস নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ উপন্যাস লিখেছিলেন Ñ তিতাস একটি নদীর নাম। এখন দেশের লেখক-কলামিস্ট-বুদ্ধিজীবীরাও তিতাস নিয়ে লেখালেখি করছেন। না, তারা কোনো গল্প উপন্যাস লিখছেন না। তিতাস নিয়ে তারা পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন লিখছেন। তারা এখন লিখছেন Ñ ‘তিতাস ছিল একটি নদীর নাম’। এর অর্থ, তিতাস এখন এক অতীত। অর্থাৎ তিতাস এককালে নদী ছিল বটে Ñ মল্লবর্মণের ভাষায়, “তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস, স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়, ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়, রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না’। আর এখন? এখন তিতাস আর নদী নাই। তিতাস এখন এক খুন হওয়া লাশ।
বাংলাদেশের সকল নদ-নদীর উজানে ভারতীয় ভূখন্ডে ভারত সরকার অসংখ্য বাঁধ দেওয়ার কারণে ইতিমধ্যে আমাদের বহু নদী শুকিয়ে মরে গেছে। বাদবাকি নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় ধুকে ধুকে কোনো রকমে  বেঁছে আছে। কিংবদন্তির তিতাস তেমনিই এক নদী। প্রতিবেশী দেশটির নদী-আগ্রাসনের মধ্যেও এক বছর আগেও তিতাসকে নদীই বলা যেতো। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে আর নদী বলার উপায় নেই। তিতাসের ওপর ভারতের এক নিষ্ঠুর আগ্রাসন ঘটে গেছে। ভারতীয় পরিবহন সংস্থা আসাম বেঙ্গল কেরিয়ার (এবিসি) তিতাস নদীর বুকের ওপর মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে তৈরি করেছে সড়ক। ভারত এতোদিন আমাদের নদ-নদীতে বাঁধ দিয়ে আসছে উজানে, ভারত-ভূখন্ডে। এখন তারা তাদের নানাবিধ প্রয়োজনে বাংলাদেশের ভূখন্ডে এসে নদীর ওপর বাঁধ দেওয়া শুরু করেছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারত সরকারকে সরাসরি বাংলাদেশের ভূখন্ডে ঢুকে এই ধ্বংসাত্মক কাজটি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে আজকের আওয়ামী মহাজোট সরকার। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এক দেশ কর্তৃক আরেক দেশে বাঁধ দিয়ে নদীর পানিপ্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ যেখানে নদী-আগ্রাসন এবং মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়, সেখানে ভারতীয় পরিবহন সংস্থা তিতাস ভরা করে নদীর বুক চিরে সড়ক নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই। বাংলাদেশের সাথে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান তথা ভারত সরকারের এ ধরনের আচরণে এ দেশের সার্বভৌমত্বের লংঘন হলেও ‘ভারতবান্ধব’ সরকারের বদৌলতে তা জায়েজ হয়ে গেছে। ভারতকে দোষ দিয়ে লাভ কী? বাংলাদেশের সরকারই তো ‘বন্ধুত্ব’ চিরস্থায়ী করার জন্য ভারত সরকারকে এ সুযোগ করে দিয়েছে। আর কেবল তিতাসের ওপর সড়ক নির্মাণই নয়। বর্তমান সরকার তো দেশের পুরো স্থল ও জল ভূখন্ডেই ভারতকে করিডর দিয়ে ফেলেছে।
আমরা জানি এবং ইতিহাসে লেখা আছে, মীরজাফর-জগৎশেঠরা ‘বন্ধুত্বের’ জন্য দেশের মাটিতে ব্রিটিশদের ডেকে এনেছিল। বাংলাদেশে আজ যা যা ঘটছে তার ইতিহাস এখন লেখা যাবে না। কেউ সত্য ইতিহাস লিখলে তাকে ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষণা করা হবে। সে ইতিহাস লিখবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
দুই.
ভারতীয় কোম্পানী আমাদের সার্বভৌমত্ব লংঘন করে বহমান তিতাস নদীর বুক চিরে সড়ক নির্মাণ করেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুকেন্দ্রের ভারী যন্ত্র ও যন্ত্রাংশবাহী ১৩০ চাকাবিশিষ্ট ৩৫০ টন ওজনের বিশাল ট্রেইলার চলাচলের জন্য। এরূপ ৯৬টি কনটেইনার প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নৌপথে বাংলাদেশের আশুগঞ্জ বন্দরে পৌঁছে, তারপর সেখান থেকে সড়কপথে আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে ত্রিপুরায় যাওয়া শুরু করে।
নদীর প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে তিতাসের ওপর ভারত এই বাঁধ তথা সড়কটি নির্মাণ করেছে এক বছর আগে। এর অর্থ, তিতাসের বুকের ওপর এই বাঁধ চেপে বসে আছে এক বছর ধরে। বাঁধ বা সড়ক নির্মাণ করে নদী-হত্যার কারণে ইতিমধ্যে তিতাস অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে। সেচের অভাবে অনেক কৃষকের মধ্যে হাহাকার। বাঁধের প্রভাবে দক্ষিণে নদীর ভাটিতে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশের বিপর্যয় ঘটেছে। বাঁধের দক্ষিণে বিস্তীর্ণ এলাকার কয়েকশ’ জেলেপরিবার যেখানে এক বছর আগে নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো, সেখানে নদীর ওপর সড়ক নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে এসব জেলেপরিবারের শত শত মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। মাছ ধরার পেশা ছেড়ে অনেকে দিনমজুরি করছে।
বাঁধের দক্ষিণে ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত শত শত একর কৃষিজমি পতিত হয়ে পড়েছে। নদী-তীরবর্তী এসব জমিতে আগে শুকনো মৌসুমে বোরো-ইরি ধানের চাষ হতো। একবছর আগে ভারতীয় কোম্পানী কর্তৃক তিতাসের বুকে সড়ক নির্মাণের আগে এসব জমিতে বোর-ইরির চাড়া রোপণের পর থেকে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় জোয়ারের সময় দিন-রাত সেচের কাজ চলতো। কিন্তু সড়ক নির্মাণ করে নদীর পানি বন্ধ করে দেওয়ার পর জোয়ার-ভাটার কোনো প্রভাব নেই। ফলে সেচের পানির জন্য গত মৌসুমের মতো চলতি মৌসুমেও কৃষকেরা হাহাকার করছেন।
এদিকে ত্রিপুরার বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারি যন্ত্রপাতি পরিবহনের জন্য তিতাসের ওপর সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার অংশে ১৭টি প্রবাহমান খালের ওপর দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণ করেছে ভারতীয় কোম্পানী। এর ফলে এসব খালের পানিপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে।
প্রতিবেশী দেশের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য নিজ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী ও ১৭টি খালের ওপর বাঁধ তথা সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে এক বছরের জন্য নদী ও খালগুলোর পানিপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে অত্র এলাকার কৃষক, জেলে ও সকল স্তরের জনগণের কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশের যে বিপুল ক্ষতিসাধিত হয়েছে, টাকার অংকে তার পরিমাণ বেসরকারি হিসাব মতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। নিজ দেশের ভূখন্ডের নদী-খালের ওপর অন্য একটি দেশ কর্তৃক ফ্রি-স্টাইলে বাঁধ-সড়ক নির্মাণের এই আগ্রাসনমূলক ঘটনাটি আজ যে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো, তাতে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে দেশবাসীর দুঃশ্চিন্তা ও উদ্বেগ আরেক দফা বাড়লো। কেননা এরপর হয়তো দেখা যাবে মনিপুরের বিদ্রোহ দমনের জন্য ভারত আমাদের ভূখন্ড ও নদী-খালের ওপর দিয়ে ফ্রি-স্টাইলে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও ট্যাংক চালানো শুরু করবে।
আর এরকমভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে নিজ দেশের ভূখন্ডে ভারতকে ‘বন্ধুত্ব’ উপহার দেওয়ার প্রতিদান স্বরূপ দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন ত্রিপুরা সফরে গিয়ে ডি-লিট উপাধির গৌরব নিয়ে ঢাকায় ফেরেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, যে ভূখন্ডে তিনি ফিরলেন সেটি কি ‘রাজ্য’?
আর সরকার ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের কষ্টের অভিমান ব্যক্ত করেই বা লাভ কী? জাতি হিসাবে আমরা সরকারের বাইরের নাগরিকরাও কি কম ‘দেশপ্রেমিক’? খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, এক বছর ধরে তিতাস নদীর বুক চিরে ভারতীয় কোম্পানীর সড়ক নির্মাণের ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যে দেশের কয়েকটি পত্রিকা যেসব রিপোর্ট ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে আমাদের ভূখন্ডে এসে নদী-খালের ওপর ভারতের বাঁধ-সড়ক নির্মাণের সমস্যা যে আমাদের সার্বভৌমত্বের সমস্যা, এই কথাটি একবারও উচ্চারিত হয়নি। বরং দেশবাসীকে আশ্বস্ত করার জন্য, ভারত এখন তিতাসের ওপর নির্মিত সড়কটি অপসারণ করছে Ñ এই খবরটিই তারা গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। তাদের এই ধরনের খবর প্রচারের ধরন দেখে মনে হয়, দেশবাসীকে চিন্তামুক্ত থাকার জন্য তারা বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভারত তার জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশের নদী-খালের ওপর বাঁধ ও সড়ক তৈরি করলেও, এমনকি এর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত প্রদান না করলেও তাদের কাজ শেষ হওয়ার পর এখন সড়ক অপসারণ করে দিয়ে ‘বন্ধুত্বসুলভ’ কাজ করছে। ‘বন্ধুত্বের’ এ এক বিরল নজিরই বটে! এমন ‘বন্ধুত্বের’ বিরুদ্ধে কি সার্বভৌমত্ব লংঘনের অভিযোগ আনা যায় কখনো? কী চমৎকার ‘দেশপ্রেম’ আমাদের!
তাহলে তো ভারতের প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতে ভারত সরকার আবারো আমাদের সরকারের সাথে (সমঝোতা চুক্তি?) করে বাংলাদেশের ভূখন্ডে ঢুকে দুইটা নদীর প্রবাহ বন্ধ করে এক-দেড়বছরের জন্য দুইটা সড়ক নির্মাণ করবে এবং কাজ উদ্ধারের পর বাঁধ ও সড়ক অপসারণ করে আমাদের সাথে ‘বন্ধুত্ব’ অটুট রাখবে। আর তখনো হয়তো আমরা ভারতের ‘বন্ধুত্বে’ মুগ্ধ হয়ে সার্বভৌমত্ব লংঘনের কথা বেমালুম ভুলে যাবো। হায় আমাদের দেশপ্রেম! হায় আমাদের জাতীয় চেতনা! হায় আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বোধ!
রইস্উদ্দিন আরিফ : রাজনীতিক, লেখক, কলামিস্ট

তারিখ : ১৮-০১-২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন