মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১২

একটি টাকাও দেয়নি ভারত : চুক্তি এখন গলার কাঁটা


ভারতের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তার দিল্লি সফরের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এই ঋণ পাওয়া। তারপর আবেগে আনন্দে গদগদ হয়ে, সরকারের নানা স্তরের নীতিনির্ধারক ও হর্তাকর্তারা সামাল-বেসামাল নানামাত্রিক উচ্চারণ করে বন্ধুত্বের মহিমা বর্ণনা করেছেন। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো এই নব কর্তারা হয়তো এখনও অনুধাবন করেননি ভারতের ‘বন্ধুত্ব’ কী জিনিস। অথবা জানলেও তারা ভারত নিয়ন্ত্রিত পাপেট বা রোবটের মতো ‘যেমনি নাচাও তেমনই নেচেছিলেন।’ এরপর দেখতে দেখতে কেটে গেছে দু’বছর। আমাদের সরকারের ফোলানো প্রত্যাশার বেলুন এখন ফুলে ফুলে ক্লান্ত হয়ে ফুটো হয়ে পড়ে আছে তাদেরই টেবিলে। কিন্তু ১০০ কোটি ডলার তো দূরের কথা, একটি ডলারও ভারত আজ পর্যন্ত ছাড় দেয়নি। যদিও অত্যন্ত অপমানজনক ও অযৌক্তিক শর্তে এই ঋণ চুক্তির মুলা নাকের ওপর ঝুলিয়ে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে ট্রানজিট, করিডোর, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা, বন্দর ব্যবহার, ট্রানজিট কার্যকর করার জন্য অন্তর্গত নৌবন্দরকে পোর্ট অব কল ঘোষণা, যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের সম্মতিসহ নানা কিছু। এদিকে ভারতের এই রকম দ্বিমুখী আচরণের ফলে অনেক প্রকল্প যেমন বন্ধ করে নতুন প্রকল্প তৈরি করতে হবে, তেমনি অনেক ব্যয়ও বেড়ে যাবে। নষ্ট হবে আরও অনেক মূল্যবান সময়।
২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হাসিনা-মনমোহন বৈঠকে ৫০ দফা যৌথ ঘোষণা চূড়ান্ত হয়। এর আলোকে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির উপস্থিতিতে এক্সিম ব্যাংক নামের একটি ভারতীয় ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ভারত তাদের চরিত্র অনুযায়ী একের পর এক জুড়ে দেয় নানা শর্ত। এই শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশকে ৮৫ শতাংশ পণ্য ভারত থেকে কিনতে হবে। দরপত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান অংশ নেবে সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে হবে ভারতীয় নাগরিক। আবার খালি মালিকানা থাকলেই হবে না, মালিকানা হতে হবে কমপক্ষে ৫১ শতাংশের। বাকি থাকে ১৫ ভাগ। সেক্ষেত্রেও সুদখোর সুবিধাভোগী শাইলকের মতো জুড়ে দেয়া হয়েছে নানা শর্ত।
বাংলাদেশের জন্য আরও যেগুলো লজ্জার, তা হলো, ৮৫ শতাংশ পণ্য তো ভারত থেকেই যাবে। বাকি ১৫ শতাংশ পণ্য কোথা থেকে ক্রয় করা হবে তাও ঠিক করে দেবে ভারতীয় ঠিকাদাররা। তাছাড়া এই ঋণের আওতায় প্রাপ্ত অর্থে যে সব প্রকল্পের কাজ করা হবে, তাতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে বাংলাদেশকে। একই সঙ্গে প্রকল্প নির্বাচন করে ভারতীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো শর্তও সংযুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদা ও সম্মানকে ধূলিতে নিক্ষেপ করা এই শর্তের পুরো ফায়দা তুলছে এখন ভারত। বাংলাদেশ একটি একটি করে ভারতের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে ২১টি প্রকল্প। এগুলো পাঠিয়ে আমাদের কর্তারা জোড়হস্তে কাতর ভিখারির মতো অনুমোদনের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পার করেছে ২ বছর।
এর মধ্যে দুটির ভাগ্যে জুটেছে বাণিজ্যিক চুক্তি। ১৩টি কোনো রকমে অনুমোদন করেছে। বাকিগুলো এখনও অথৈ অন্ধকারে। যেগুলোর অনুমোদন দয়া করে ভারত দিয়েছে, সেগুলোরও কাজ করা যাচ্ছে না। কারণ শর্ত অনুযায়ী ৮৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা সরবরাহ করার মুরোদ নেই সে দেশের কোনো কোম্পানির। কিন্তু শর্ত মতো সেগুলো অন্য কোনো খান থেকে জোগাড় করারও অধিকার রাখে না বাংলাদেশ। ফলে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থার। অনেক প্রকল্প এখন সেই ভারতের আপত্তির মুখেই নতুন করে যাচাই-বাছাই করা শুরু হয়েছে। অনেক প্রকল্প বাদ পড়বে। কারণ ভারত কর্তৃক প্রদত্ত শর্ত বাংলাদেশ মানলেও ওদিককার কোম্পানিগুলো হয়ে পড়েছে লাজওয়াব। অন্যদিকে সকলই গরল ভেলের মতো অপচয় হচ্ছে সময়ের। আর নতুনভাবে ভারতের কোম্পানিগুলোর সামর্থ্যের দিকে তাকিয়ে প্রকল্পগুলো ঢেলে সাজানোর ফলে ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ।
সবদিক বিবেচনা করেই এ কথা এখন দিবালোকের মতো সত্য যে ভারতীয় ঋণ বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়েছে শাখের করাতে। ভারতীয় প্রতিবন্ধকতার কারণে সরকার এ ঋণের অর্থ ব্যবহার করতে পারছে না। আবার চুক্তি হয়ে যাওয়ায় উচ্চহারে সুদের এ ঋণ বাতিল করার মতো সাহস এবং শক্তিও আমাদের সরকারের নেই। বন্ধুত্ব ও প্রেমে অন্ধ হয়ে অগ্র-পশ্চাত্ বিবেচনা না করে যেনতেন প্রকারে ভারতকে খুশি করার জন্য ঋণ চুক্তি করে সরকার নিজেই নিজের গলায় একটা ‘আপদ’ ঝুলিয়ে নিয়েছে। এই আপদের হাত থেকে এখন পরিত্রাণের পথ পাচ্ছে না সরকার। যদি আমাদের ‘ভারত প্রেমিক উপদেষ্টাদের’ উপদেশকে গুরুত্ব না দিয়ে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে, বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকার এই চুক্তি করত তাহলে হয়তো এই রকম মারাত্মক ঝামেলায় পড়ত না। এই ‘আপদ’ থেকে সরকারের মধ্যে কোনো শুভবুদ্ধির উদয় হবে কিনা জানি না। হলে দেশও বাঁচতো ঝামেলা থেকে আর সরকারও দম নেয়ার ফুরসত পেত।

1 টি মন্তব্য: