সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১১

ব্রহ্মপুত্রের উপনদীতেও ভারতের বাঁধ নির্মাণ

তারিক মাহমুদ ভারত বাংলাদেশের উজানে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ এবং এর কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বরাক নদীর উপরে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে ভারত যখন এগিয়ে চলছে, তখনই অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী ব্রহ্মপুত্রের উপনদী সুবনসিরিতে অরুনাচল-আসাম সীমান্তে আর একটি বাঁধ নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। সুবনসিরি উপনদী ব্রহ্মপুত্র নদের কমপক্ষে ১০ শতাংশ পানি প্রবাহের উৎস। এ নিয়ে ভারতের সাত বোন বলে পরিচিত সাত রাজ্যের বেশ কয়েকটি রাজ্যের জনগণ ব্যাপক আন্দোলন করছে। এই বাঁধ নির্মাণে বাংলাদেশ আরেক মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কারণ ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে এই বাঁধের কারণে।

তিববতের পশ্চিমাঞ্চলে হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের কাছে জিমা ইয়ংজং হিমবাহে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি। সাং পো নামে তিববতে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে এটি অরুণাচল প্রদেশে ভারতে প্রবেশ করলে এর নাম হয় সিয়ং। আসামের ওপর দিয়ে বয়ে সমতলে এসে চওড়া হয়ে এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। এটি ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মেশে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য ২৯০০ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা হচ্ছে যমুনা। সুবনসিরি ব্রহ্মপুত্র নদের অন্যতম এক উপনদী। এর সর্বাধিক পর্যবেক্ষিত প্রবাহ ১৮.৭৯৯ ঘন মিটার প্রতি সেকেন্ডে। ব্রহ্মপুত্র নদের ১০ ভাগ পানির উৎস এই সুবনসিরি উপনদীটি।

অরুণাচল-আসাম সীমান্তের গেরুকামুখে এই সুবনসিরি নদীতেই ভারত ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এক বিশাল বাঁধ নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এটি ভারতের অন্যতম হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট। নদী সংক্রান্ত বিষয়ে এমনিতেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভরতের বিরোধের কমতি নেই। ফারাক্কা ব্যারেজ, তিস্তার পানি বণ্টন এবং টিপাইমুখের বাঁধ নির্মাণের সূত্রে এই বিষয় ইতোমধ্যেই সচেতন জনগণের মাঝে ব্যাপক আলোচিত বিষয়।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়েই ভারতে কমবেশি ৩০০টি বৃহৎ বাঁধ নির্মিত ছিল। ২০০০ সালের মধ্যে নির্মিত এই বাঁধের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজারের বেশি। আর এসব বাঁধের অনেকগুলোই বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন নদীতে। যার অর্ধেকেরও বেশি নির্মাণ করা হয় ১৯৭১ থেকে ১৯৮৯ সময়ের মধ্যে। বিশ্বে নদীগুলোর ওপরে নানা ধরনের বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণে ভারতের অবস্থান তিন নম্বরে।

অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ওপর ভারতীয় শাসক শ্রেণীর এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেরই সচেতন জনগণ প্রতিবাদ প্রতিরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছে। এখন ভারত প্রধান নদীগুলোর সঙ্গে সঙ্গে এসব নদীর প্রধান প্রধান উপনদীগুলোতেও বাঁধ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় জনগণের মতামত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। আর এর বিরূপ ফলাফল বাংলাদেশ ও ভারতের দুই দেশের মানুষই ভোগ করবে।

নির্মাণাধীন সুবনসিরি বাঁধের বিরুদ্ধে আসামের কৃষক-ছাত্র-জনতা ইতোমধ্যেই প্রতিরোধ প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহে জনরোষ উত্তাল হয়ে উঠলে বাঁধের ভারি যন্ত্রপাতি পরিবহন ব্যাহত হয়। ভারি যন্ত্রপাতিবাহী ট্রাকের গতিরোধ করে স্থানীয় জনতা। আসাম সরকার যে কোনো মূল্যে টার্বাইন পরিবহনের হুঙ্কার দিলেও কৃষক-জনতার অনমনীয় মনোভাবে তা সফল হয়নি। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে টার্বাইনবাহী ট্রাক আটকাতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন। ৩ ডিসেম্বর সেখানে ২৫টি সংগঠনের সমন্বয়ে বিশাল বাঁধবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আসাম গণপরিষদ সদস্যরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, নিম্ন সুবনসিরি প্রকল্পস্থলটি অতিশয় ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চল বলে সেখানে বৃহৎ নদীবাঁধ নির্মাণ করা হলে প্রকৃতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশেষজ্ঞ কমিটি সরকারকে এরই মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করে সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন নস্যাৎ করে প্রকল্প নির্মাণের কাজ অব্যাহত রেখেছে সরকার। রাজ্য পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের পর কেন্দ্রীয় সরকার আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটির রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত নিম্ন সুবনসিরি প্রকল্পের নির্মাণ কাজ স্থগিত রাখার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকপত্রও প্রদান করেছেন আসাম গণপরিষদ সদস্যরা।

সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, আসামের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ জরুরি। তাই এই বাঁধ নির্মাণ করতেই হবে। দীর্ঘদিন এই বাঁধের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে থাকলেও সম্প্রতি বাঁধের ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহন শুরু হলে আসামের কৃষক-ছাত্র-জনতা তুমুল আন্দোলন শুরু করেছেন। আসাম রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎমন্ত্রী প্রদ্যোৎ বরদলৈ বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়নে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে ন্যাশনাল হাইড্রো ইলেক্ট্রিক কোম্পানি লিমিটেড (এনএইচপিসি) বাঁধের ৪৫ ভাগ কাজ শেষ করেছে। তাই বাঁধের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। অপর দিকে রক্তপাত এড়াতে আসাম সরকার বিষয়টি দেখভাল করার জন্য মন্ত্রীদের দায়িত্ব দিয়েছে।

আসামের পত্রিকায় আরো বলা হয়, বৃহৎ নদীবাঁধবিরোধী আন্দোলনে কার্যত পিছু হটেছে প্রশাসন। টার্বাইনবাহী লরি আটকাতে বৃহস্পতিবার উত্তর লখিমপুরে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী সারাদিন জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখেন। গেরুকামুখে এদিন টার্বাইন নেওয়া হবে না বলে আশ্বস্ত করেন লখিমপুরের জেলা প্রশাসক। টার্বাইনবাহী লরি রাস্তার পাশে রাখার সুযোগ করে দিতে তিনি আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করেন। তার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও আসু এবং কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির সদস্যরা অবরোধ প্রত্যাহার করেননি। এদিকে মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ জানিয়েছেন, যতই প্রতিবাদ হোক না কেন বাঁধ তৈরির কাজ বন্ধ হবে না। টার্বাইনবাহী লরি গেরুকামুখে নিয়ে যাওয়া হবে।

এদিকে তেজপুর থেকে গেরুকামুখের পথে সারা রাস্তায় প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়লেও রোখা যায়নি; বরং প্রতিবাদ গুঁড়িয়ে দিয়ে গেরুকামুখের দিকে এগুতে থাকে টার্বাইন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য লখিমপুর শহরে পৌঁছে আর এগোনো সম্ভব হয়নি। গণপ্রতিবাদের ফলে সেখানেই সারাদিন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে টার্বাইনবাহী ট্রাক। লখিমপুর গভর্নমেন্ট হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের মাঠে (এতিম ফিল্ড) রাখা হয়েছে দৈত্যাকৃতি টার্বাইন।

গত বুধবার সন্ধ্যা নাগাদ লখিমপুর জেলার ঢলপুরে পুলিশ-প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। টার্বাইনবাহী ট্রাক রুখতে পথে নেমে আসা হাজার হাজার অবরোধকারীকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ এবং ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। রাজপথ অবরোধের পুরোভাগে তখন দাঁড়িয়ে থাকেন কৃষক নেতা অখিল গগৈ। পেছনে হাজার হাজার অবরোধকারী মানুষ। তাই ক্ষণিকের জন্য হলেও পিছু হটে পুলিশ প্রশাসন। গেরুকামুখে বৃহৎ নদীবাঁধ আটকাতে শেষ লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক অখিল গগৈ। তার আহবানে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে নদীবাঁধবিরোধী সপ্তাহ পালন করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে অখিল বলেন, গেরুকামুখে টার্বাইন নিয়ে যাওয়া হলে গোটা রাজ্যে প্রতিবাদের আগুন জ্বলবে। অখিলের দাবি, গোটা রাজ্যের মানুষ নদী বাঁধের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু বাঁধবিরোধী জনমত উপেক্ষা করে বাঁধ তৈরি করতে চাইছে প্রশাসন। বাঁধ তৈরির পক্ষে সরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে গোটা রাজ্যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে অখিল হুশিয়ারি দেন। কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি, আসাম ছাত্রপরিষদ (আসু), জাতীয়তাবাদী যুবছাত্র পরিষদ ও টিএপিকের কয়েক হাজার কর্মী অবরোধ করেছেন টার্বাইনবাহী ট্রাকের পথ। জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লখিমপুর গভর্মেন্ট হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের মাঠে নিয়ে গিয়ে পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে ট্রাক।

অরুণাচল প্রদেশে নির্মীয়মাণ নিম্নসুবনসিরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য টার্বাইন নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পাড়ে যে হিংসাত্মক কান্ড সংঘটিত হয়েছে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছে বিরোধী দল আগপ (আসাম গণপরিষদ)। বৃহৎ নদীবাঁধবিরোধী উত্তাল আন্দোলন ও রাজ্যের জনসাধারণের আশঙ্কাকে নস্যাৎ করে সরকার এখনো নীরব কেন সেই প্রশ্নই আগপ (আসাম গণপরিষদ) নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করেছেন।

আসাম জাতীয়তাবাদী যুবছাত্র পরিষদ (এজেওয়াইসিপি) বৃহৎ নদীবাঁধ সমস্যা নিয়ে শনিবার হাইলাকান্দি জেলাশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণে কালো ব্যাজ পরিধান করে ২ ঘণ্টার অবস্থান ধর্মঘটে বসে। সদস্যরা এদিন কালো ব্যাজ পরিধান করে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। আসুর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমরা উন্নয়নবিরোধী নই। উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার। তার জন্য আসাম ধ্বংস করে বৃহৎ নদীবাঁধ নির্মাণের পরিবর্তে বিকল্প কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে এসেছি।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন