সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১১

স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম উচ্চারণ

  বাংলাদেশ নামের এই জনপদে যে মানুষেরা বাস করেন তাদের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা কি অতি সাম্প্রতিক অথবা কয়েক দশকের মধ্যে সীমাবদ্ধ? এভাবে দেখলে বিষয়টির অত্যন্ত সরলীকরণ হয়ে যাবে। কিন্তু সরলীকরণ ইতিহাসের ব্যাখ্যা হতে পারে না। ইতিহাস তার আপন গতিতে চলে এবং কখনো কখনো ইতিহাসকে ঘিরে আবেগাশ্রিত যে উত্তেজনা তৈরি হয় তা সময়ে সংশোধিত হয়। এ প্রক্রিয়াটি খুব সহজ নয়। কেননা ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং সময়ের বিবর্তনে ইতিহাসের অনেক তথ্য হারিয়ে যায় বিধায় তা উদ্ধারের প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তারপরেও মানুষ ইতিহাসের তথ্য সন্ধান করে এবং চেষ্টা করে তাকে একটি সত্য ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে। কিন্তু সত্যের ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর কাজটিও সহজ নয়। কেননা সত্য সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই আপেক্ষিক হতে পারে এবং ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি প্রযোজ্য। বিষয়টি আরো জটিল হয়ে দাঁড়ায় কারণ, ইতিহাস নির্মাণের প্রক্রিয়ায় একটি সমাজ বা জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষেরা জড়িত থাকেন। এখানে উচ্চবর্গের মানুষ যেমন থাকেন তেমনি থাকেন নিম্নবর্গের মানুষেরা। একজন ইতিহাসবিদ যে শ্রেণীর মানুষকে গৌরবান্বিত করতে চান তারাই সে শ্রেণীকে ইতিহাসের নির্মাতা বলে দাবি করেন। এক্ষেত্রে বিষয়টি বোঝার জন্য দুটি উদাহরণই যথেষ্ট। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর এমনভাবে ইতিহাস লেখা হয়েছিল যাতে মনে হতে পারে একমাত্র মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসই ভারতবর্ষে স্বাধীনতার জন্য ইংরেজবিরোধী লড়াই করেছে। কিন্তু এটাই ইংরেজবিরোধী সংগ্রামের সম্পূর্ণ চিত্র নয়। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। একই বিষয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এখানেও স্বাধীনতার ইতিহাসকে এমনভাবে নির্মাণের চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে মনে হতে পারে এই দেশটির স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগ ভিন্ন অন্য কারো কোনো ভূমিকা ছিল না। আবার এমনও বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে যাতে মনে হতে পারে একজন ব্যক্তি পুরো স্বাধীনতা সংগ্রামকে নির্মাণ করেছেন ও সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্ত এটিও ইতিহাসে অত্যন্ত সরলীকৃত ব্যাখ্যা।

ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষ দখল করে তখন এই সমাজ ছিল কৃষি নির্ভর এবং এখানে সভ্যতা নির্মাণের পেছনে পানির অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ভারতীয় সভ্যতাকে হাইড্রোলিক সভ্যতা বললেও ভুল হবে না। ব্রিটিশরা এই দেশে আসার পর এই সমাজের যেসব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে তার ফলে প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি ব্যবস্থা। পরবর্তী পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষিনির্ভর শিল্প। ইংরেজদের শাসনের প্রক্রিয়ার চরিত্রটি উপলব্ধি করতে কিছুটা সময় লাগলেও এদেশের কৃষকরা খুব শিগগিরই ব্রিটিশবিরোধী গণতান্ত্রিক ও শ্রেণী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এসব সংগ্রামে ধর্মীয় বিশ্বাস সর্বক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন না করলেও কোথাও কোথাও তা ইংরেজ শাসনবিরোধী আন্দোলনে প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে।

ইংরেজ শাসনাধীন বাংলাদেশের কৃষকের গণতান্ত্রিক ও ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সম্ভবত এই কারণেই পরবর্তী পর্যায়ে শ্রেণী আন্দোলনকে ভিত্তি করে ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন আন্দোলনে কৃষক আন্দোলনই মূল ভূমিকা পালন করেছিল। ইংরেজ আমলে জাতীয় অর্থনীতি কোনো মৌলিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়নি। তাই কৃষকরাই হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের মূলশক্তি। মূলত সর্বভারতীয় কৃষক সভা যে ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল তাকে পরবর্তী পর্যায়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো সে আন্দোলনকে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ইংরেজ শাসনের শুরুতে ইংরেজরা এদেশের সমৃদ্ধিশালী কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবার জন্য বিভিন্ন পন্থার আশ্রয় নেয়। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে বিলাতি ধাঁচের জমিদার-রাইয়ত ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। এটি ভিন্ন একটি আলোচনার বিষয়।

কিন্তু এখানে যে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য তা হচ্ছে, এই অঞ্চলের ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানবিরোধী লড়াইয়ে যে মানুষেরা সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা কৃষক সমাজের প্রতিনিধি। অবশ্য এ ভিন্ন গত্যন্তরও ছিল না। কারণ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর পূর্ব বাংলা এবং পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-উপনিবেশিক একটি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে কৃষকের মুক্তির সংগ্রাম ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সময় এখানে যে আন্দোলন হয়েছে তার প্রায় প্রত্যেকটিতে কৃষকের অংশগ্রহণ ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারী কৃষকরা তাদের অতীত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের আলোকে উপলব্ধি করেছিলেন নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা খুব সীমিত।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে কৃষক ও শ্রমিকদের আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল প্রগতিশীল শক্তি বা কমিউনিস্টদের হাতে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের প্রয়োজন ছিল প্রকাশ্য গণসংগঠন। তবে একটা সময় পর্যন্ত গণসংগঠনের অনুপস্থিতির কারণে এদেশে কৃষকরা বিভিন্ন সংগঠনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন আর এদেশের কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের শীর্ষে অবস্থান ছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর।

নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মতো কৃষকেরও হতাশ করেছিল। কিন্তু সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিবর্তন এলেও কৃষকের ওপর শোষণের যে বোঝা চেপে বসেছিল তাতে সেখানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কৃষকরা ইংরেজ আমলে যেসব শোষণের নির্যাতন ভোগ করেছিলেন তার অবসান অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক তারা উপলব্ধি করেছিলেন এ বিষয়টি তাদের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয় এবং পাকিস্তানের সঙ্গেও তাদের একত্রিত থাকা সম্ভব নয়। কৃষকের নেতা মওলানা ভাসানী বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন এবং এ কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে পাকিস্তানের অস্তিত্ব সম্পর্কে তার যে স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল তার বহির্প্রকাশ ঘটে ১৯৫৭ সালে তার বিখ্যাত ‘আসসালামুআলাইকুম’ উক্তির মধ্যে। এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চারিত প্রথম কৌশলি অবস্থান। তিনি অবশ্য শুধু পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন না, পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধীকারের প্রশ্নটিও তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে তখন পর্যন্ত তিনি যাদের সঙ্গে রাজনীতি করতেন তারা কেউ পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে কোনো কিছুই উচ্চারণ করেননি। মওলানা ভাসানীর সেদিনের সেই উচ্চারণ অনেকের কাছেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে মনে হয়েছিল। এমনকি পরবর্তী পর্যায়ে যারা নিজেদের স্বাধীনতার অগ্রগামী সৈনিক বলে দাবি করেন তাদের কাছেও সে সময় বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ছিল না।

মওলানা ভাসানী কৃষক আন্দোলনের সন্তান ও নায়ক বলে তিনি কৃষকের মুক্তির আন্দোলনকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার আন্দোলন হিসেবেও দেখেছিলেন। এ কারণেই বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় স্বাধীনতার সৈনিকদের নেতৃত্বের প্রথমেই উচ্চারিত হয় মওলানা ভাসানীর নাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন