রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১১

সুবনশিরি নদী বাঁধ রুখতে জীবনবাজি শপথ আসামের কৃষক জনতার

বৃহত্ নদীবাঁধ ঠেকাতে জীবনবাজি রেখে শপথ নিয়েছেন আসামের বাঁধ বিরোধী কৃষক-ছাত্র-জনতা। একই সঙ্গে তারা জাতীয় সড়কে রাত জেগে পাহারা বসিয়েছেন-যাতে কর্তৃপক্ষ বাঁধ নির্মাণের সামগ্রী তাদের বুকের ওপর দিয়ে পরিবহন করতে না পারে। দশ দিনব্যাপী এই অবরোধ চলবে।
আসামের একাধিক পত্রিকার খবরে প্রকাশ, পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী গত শুক্রবার আসামের লখিমপুরে হাজার হাজার জনতা শামিল হন বৃহত্ নদীবাঁধ রুখতে। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন আসাম রাজ্য সভার এক সদস্য (বিধায়ক)। আসামের একাধিক পত্রিকায় গতকাল ফলাও করে প্রচার করা হয় বাঁধবিরোধী উত্তাল এই জনপদের খবর। আন্দোলনকারী একাধিক সংগঠন এতদিন আলাদা কর্মসূচি পালন করলেও শুক্রবারের সড়ক অবরোধে সব একাট্টা হয়ে মাঠে নামেন। পরে তাদের সমর্থনে রাজনৈতিক দল অসম গণপরিষদ কর্মসূচিতে শামিল হয়। আগামী দশ দিন পর্যন্ত টানা অবরোধ চলবে জাতীয় সড়কে। রাঙানদীর সেতুর দুই পারে জাতীয় সড়কে পাহারা চৌকিও স্থাপন করা হয়েছে।
এদিকে বৃহত্ নদীবাঁধ বিরোধী ২০ হাজার আন্দোলনকারীকে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির নেতা অখিল গগৈ। ব্রহ্মপুত্রের উপনদী নিম্ন সুবনশিরি নদীতে ২০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত্ প্রকল্পের বিরোধিতায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি। কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি এবং আসাম জাতীয়তাবাদী ছাত্র যুব পরিষদের উদ্যোগে এদিন এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। উত্তর লখিমপুরের রাঙানদীর বালুচরে জড়ো হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। বৃহত্ নদীবাঁধের বিরুদ্ধে আমৃত্যু আন্দোলন চালিয়ে যেতে সমবেত জনতাকে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। নদীবাঁধ বিরোধী আন্দোলনের জেরে ধেমাজিসহ উত্তর লখিমপুরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়ে। বাঁধ তৈরির জন্য সিমেন্টবাহী লরি আটকাতে ৫২ নম্বর জাতীয় সড়কে আন্দোলনকারীরা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। অগপ সভাপতি চন্দ্রমোহন পাটোয়ারিসহ দলের একাধিক নেতাকর্মী বালুচরের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। পাটোয়ারির নেতৃত্বে অগপ-ও নেতাকর্মীরা জাতীয় সড়ক অবরোধেও অংশগ্রহণ করেন।
আসামের পত্রিকার খবরে আরও বলা হয়, নদীবাঁধ ইস্যুতে সরকার অরুণাচল প্রদেশের সঙ্গে সংঘাতের রাস্তায় হাঁটলেও প্রতিবাদের ঢেউ এখনও শান্ত হচ্ছে না। শুক্রবার লখিমপুরে রাঙানদীর তীরে এক বৃহত্ গণসমাবেশে সরকারকে মোটামুটি এই বার্তাই দেয়া হয়েছে, নিম্ন সুবনশিরি বাঁধ নিয়ে আর এগোতে গেলে রক্ত ঝরবে। প্রতিবাদী মানুষের বুকের ওপর দিয়েই এগোতে হবে সরকারকে। সমাবেশে শপথ নেয়া হয়েছে, যে কোনো মূল্যে রুখে দেয়া হবে নিম্ন সুবনশিরি বাঁধের কাজ, প্রয়োজনে প্রাণ দিয়ে হলেও।
আসু, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি প্রভৃতি বাঁধ বিরোধী সংগঠনগুলো আগেই আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে সরকারকে। কিন্তু সরকার সেই আবেদনে গুরুত্ব দেয়নি। তাই সরকারের উপেক্ষায় বিছিন্ন গণপ্রতিবাদ এখন ক্রমেই দানা বাঁধছে। গত কিছু দিন ধরে লখিমপুরে আসু, টিএমপিকে, জাতীয়তাবাদী যুবছাত্র পরিষদ, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি পৃথক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। উদ্দেশ্য একই হলেও প্রতিবাদের ভাষা, পন্থা ছিল ভিন্ন। কিন্তু শুক্রবার রাঙানদীর তীরে একই ছত্রচ্ছায়ায় দেখা গেছে একাধিক প্রতিবাদী সংগঠনকে।
রাঙানদীর শুকনো বালিতে দাঁড়িয়ে বাঁধের বিরুদ্ধে একসঙ্গে প্রতিবাদ করেছে কৃষক মুক্তিসংগ্রাম সমিতি, জাতীয়তাবাদী যুব ছাত্রপরিষদ, টিএমপিকে, তাই-অহোম ছাত্র সংস্থা। চারটি সংগঠনের সম্মিলিত প্রতিবাদী কার্যসূচিতে অংশ নিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। স্থানীয় লোকরাও ছিলেন প্রচুর সংখ্যায়। তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই প্রতিবাদী গণআন্দোলনে হাজির ছিলেন রাজ্যের অন্যতম বিরোধী দল অগপর শীর্ষ নেতৃত্বও। গণসমাবেশের মঞ্চ থেকেই ভাষণ দেন অগপ সভাপতি চন্দ্রমোহন পাটোয়ারি, লখিমপুরের বিধায়ক উত্পল দত্ত। অগপ নেতাদের মধ্যে সমাবেশে দেখা গেছে ধেমাজির সাবেক বিধায়ক দিলীপ সনোয়াল, ঢকুয়াখানার বিধায়ক নব দোলেসহ স্থানীয় নেতাদের। অগপর নেতৃত্বে ৫২নং জাতীয় সড়কে অবরোধও করা হয়। তাই প্রতিবাদকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের মিশেলে বাঁধবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
এদিকে বাঁধ বিরোধীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিহুপুরিয়ার বিধায়কের বাঁধবিরোধী অবস্থানে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে সরকারকে। কিন্তু নিজের বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষের কথা ভেবে এখনও তিনি একই অবস্থানে অটল। তিনি বলেছেন, ‘বাঁধের তাণ্ডব আমি দেখেছি, এনএইপিসি’র ছেড়ে দেয়া জলে তিনটি পরিবারের লোকদের তুলে নিয়ে গেছে আমারই কেন্দ্রে।’ তাই আন্দোলনকারীদের সরার উপেক্ষা করলেও আসু টিএমপিকেসহ বাঁধবিরোধী আন্দোলনের হোতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আজ মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন তিনি। তার মতে, ‘লখিমপুর আসলে পিছিয়ে পড়া জেলা। সেখানকার দিনের পর দিন আন্দোলনে ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মানুষের। জেলার উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, বিঘ্ন্নিত হচ্ছে শান্তিও।’
বিহুপুরিয়ার বিধায়ক প্রকাশ্যে মুখ খুললেও নিম্ন সুবনশিরি বাঁধ নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পারের বিধায়কদের প্রত্যেকেরই এখন এক সুর। গণআবেগ বুঝে কংগ্রেসের বিধায়করাই এখন চাইছেন, ‘স্টিম রুলার’ না চালিয়ে নদীবাঁধ ইস্যুতে মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে এগোক সরকার। ধেমাজির বিধায়ক সুমিত্রা পাটির, নাওবৈচার বিধায়ক সঞ্জয়রাজ সুবারাও এ ব্যাপারে একমত। এমনকি কংগ্রেসের ধেমাজি, লখিমপুর জেলা কমিটির নেতারাও সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ না করলেও ভেতরে ভেতরে বাঁধবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করছেন। তাই শাসক দলের মধ্যেও এখন বাঁধের বিরুদ্ধে আওয়াজ ক্রমে দানা বাঁধছে। কয়েক দিন আগেই ধেমাজির বিধায়ক সুমিত্রা পাটির বলেছেন, ‘বৃহত্ নদীবাঁধের বদলে আমরা ছোট ছোট নদীবাঁধ চাই। বারবার তা বলেছি। কিন্তু আমার কথাটা যেন সরকার বুঝতে পারে না।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন