মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১১

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছায়া, জননেতা আবদুর রাজ্জাক আর ইহজগতে নেই। ২৩ ডিসেম্বর বিকালে পরপারে চলে গেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চার যুবনেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ—এ চারজনের একজন শেখ ফজলুল হক মনি ঘাতকদের হাতে সেই ’৭৫-এর ১৫ আগস্টই সস্ত্রীক নিহত হয়েছিলেন। বাকি ছিলেন তিন—আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং সিরাজুল আলম খান। অনাদরে তিনিও চলে গেলেন। এখন রইলেন পর্দার অন্তরালে সিরাজুল আলম খান ও প্রকাশ্যে তোফায়েল আহমেদ। আশা ছিল আবদুর রাজ্জাক সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবেন। শেষ দেখা দেশেই হবে তার সঙ্গে। কিন্তু সে সাধ পূর্ণ হলো না। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি ও তার পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
গত পর্বে স্মৃতিসৌধে না যাওয়া এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করায় একমাত্র পাঠান মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ খানের পারিবারিক করুণ পরিণতি নিয়ে লিখেছিলাম। লেখাটি নিয়ে অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আমি অভিভূত হয়েছি এত মানুষের সাড়া পেয়ে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা মরণপণ লড়াই করেছি মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে, আজাদীর জন্যে। কিন্তু পাঠান মমতাজ খান কী কারণে আমাদের সমর্থন করেছে? অন্যান্য ব্যবসায়ীর মতো কিংবা পাকিস্তানিদের মতো সেও আমাদের ওপর অত্যাচার করতে পারত। কিংবা গা এলিয়ে দিয়ে আরাম-আয়েশে সময় পার করতে পারত। সামর্থ্যবান মানুষ, ইচ্ছে করলেই এক সকালে সে পাকিস্তান চলে যেতে পারত। কিন্তু এর কোনোটাই সে করেনি। আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর সবসময় গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছে। আমার দলের সঙ্গে সেই চরম সময় কাজ করা আমি যদি অনুমোদন করি আর আমি কেন, বঙ্গবন্ধুর প্রশংসাপত্র, বাংলাদেশ ডিফেন্সের ছাড়পত্র, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং কল্যাণ ট্রাস্টের নানা কাগজপত্র একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার চাইতে মমতাজ খানের অনেক বেশি আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে এত দরদ, এত ভালোবাসা, তাহলে মমতাজ খান বঞ্চিত কেন? আমরা দুই-চার কোটি টাকা দিয়ে বিদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা জানাতে পারি। মমতাজ খানও তো একজন অবাঙালি, তার জন্যে কেন করতে পারি না? আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে কেউ কিছু করতে চায় না। কাউকে করা বা অনুকম্পা করা আর সমমর্যাদা দেয়া এক কথা নয়। দেশের বিত্তশালীরা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দয়া ও অনুকম্পা দেখাতে চায়, সম্মান করতে চায় না। যদি তা-ই চাইতো তাহলে এমন হওয়ার কথা ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চারদিকে কত ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। একটা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা। যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা এবং মুক্তিযোদ্ধা বিবেচনা করা হয়, এভাবে করলে আগামী দিনে মুক্তিযোদ্ধারা নগণ্য হয়ে পড়বে এবং তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কোনো মর্যাদাই থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধ কোনো লাঠিখেলা ছিল না, লাঠিয়াল বাহিনীর কাজও না। এখন যেমন অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে তুলে ধরতে অনেকক্ষেত্রে গর্ব করে বলে পাকিস্তানি হানাদারদের গ্রামেগঞ্জে অনেক মেয়ে শিলপাটা দিয়ে গুঁতিয়ে মেরেছে। এও কি সম্ভব? যে পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে যাওয়া যেত না, বিশ্বের অন্যতম দুর্ধর্ষ এক বাহিনী, তাদের শিলপাটা দিয়ে গুঁতিয়ে মারা যায়? এমন পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা জয়ী হয়েছি? এ সবই দম্ভোক্তি। এ দম্ভের বাইরে না যেতে পারলে পতন অনিবার্য। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম, কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি, লেখালেখি করি, সেইহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে গোড়ার খবর নিতে গিয়ে ইদানীং একেবারে স্তম্ভিত হয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের যে গেজেট বা তালিকা হয়েছে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম না থাকলে শতবছর পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই থাকবে না, তেমন কাজ করে বসে আছি আমরা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় সে সময়ের যুবনেতাদের একজনের নামও নেই। সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ কারও নাম নেই। নাম নেই তখনকার ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নুরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ এদের। নাম নেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বিপ্লবী সরকারের অস্থায়ী প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামানদের। ওইভাবে গেজেটে আমার নাম আছে কিনা বলতে পারি না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করতে গেলে যারা যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন, প্রথম সেসব জাতীয় নেতার নাম থাকা দরকার। পয়সাকড়ির জন্যে তাদের না হয় সার্টিফিকেট না দেয়া হলো, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তাদের পরিবার-পরিজন না হয় চাকরি-বাকরি না-ই পেল; কিন্তু ইতিহাস বিশুদ্ধ রাখার জন্যে নেতাদের নাম সবার উপরে থাকা উচিত ছিল। এখন যদি হুজুর মাওলানা ভাসানীর নাম, বঙ্গবন্ধুর নাম, মণি সিংহের নাম না থাকে, যে গণপ্রতিনিধিরা সরকার বানিয়েছিলেন তাদের নাম না থাকে, যে ছাত্র-যুবক নেতারা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ তাদের নাম না থাকে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ করে কিছু মানুষকে সামনে এনে তাদের ভাগ্যবদল মোটেই সত্যিকারের ইতিহাস হতে পারে না। এজন্যে সেদিন প্রথম আলো-তে বিজ্ঞাপন দিয়ে আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মাননীয় সংসদ সদস্য আশিকুর রহমান লাখ টাকা খরচ করে আমার নামে, কাদেরিয়া বাহিনীর নামে, উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের নামে জঘন্য অভিযোগ এনে এক জবানি ছেপেছেন। পত্রিকায় লেখা দিয়ে প্রতি মাসে আমি বেশকিছু টাকা পাই। আর উনি টাকা দিয়ে ছেপেছেন। আমি এমন টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে জবানি ছাপতে খুব একটা দেখিনি। তবে বিত্তশালীরা খবরের কাগজের পুরো পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে কখনো-সখনো সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আবার কখনও তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তা খণ্ডন করেন। আমি এ নিয়ে পরে ধারাবাহিক দু-একটি পর্ব লিখব। আমার কথা ছিল আশিকুর রহমান যুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, পাকিস্তানের অনুগত কর্মচারী হিসেবে টাঙ্গাইল জেলায় দায়িত্বে ছিলেন। যখন বাংলাদেশ সরকার হলো, তখন যে বাঙালি কর্মচারীরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাল তারা দেশপ্রেমিক, না যারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ছিল তারা দেশপ্রেমিক? এ প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব ভদ্রলোক নিজেই দিয়ে দিয়েছেন। এখন দেশবাসী এবং সরকার বিচার করে দেখবেন। পড়ছে দেশে কলিকাল, ছাগলে চাটে বাঘের গাল। ভদ্রলোক এক জায়গায় বলেছেন, ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত হওয়ার দিন তিনি আমাকে দেখেননি। দেখবেন কী করে! পাকিস্তানি হিসেবে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান তার পাছায় লাথি মেরে জেলা সদরে যে ঘরে ফেলে রেখেছিল, সেখান থেকে বেরুতে পারলে তো দেখবেন! আর তার ইচ্ছায় তখন আমাকে দেখার সুযোগ ছিল না। ইচ্ছাটা আমাদের হওয়ার কথা ছিল। চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে, মিয়া সাহেবরা কোনোদিন ধরা পড়েননি। তাই এত লাফালাফি। এখনও আশিকুর রহমানের পাছার কাপড় তুললে হয়তো ব্রিগেডিয়ার ফজলুর লাথির দাগ খুঁজে পাওয়া যাবে। তারপরও বড় বড় কথা তার শোভা পায় না। কী মনে করে হুট করে বলেছেন, ভুয়াপুরে মাটিকাটায় যে জাহাজ মারা হয়েছে, সেটা হাবিব কমান্ডার মেরেছে। আর আমার নামে নাকি চালিয়ে দিয়েছি। জাহাজটা তো হাবিব কমান্ডারই মেরেছে। কিন্তু সে একা নয়, আরও পাঁচ-ছয়জন কমান্ডার ছিল। আমার দল মারে নাই, আমি মারি নাই, বাহিনীর প্রধান হিসেবে মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার দূরে ছিলাম বলে আমার কোনো ভূমিকা নাই। তাহলে কোনোদিন কেউ যদি প্রশ্ন করে বসে, ১৫শ’ মাইল দূরে বঙ্গবন্ধু তো পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার অবদান কী? এমন গাঁজাখুরি কথা একমাত্র পুরো যুদ্ধের নয় মাস যারা পাকিস্তানের দালালি করেছে, তারাই বলতে পারে।
এ প্রসঙ্গে অন্য পর্বে আসব। আমার প্রসঙ্গ ছিল একজন পাঠান হয়ে মমতাজ খান পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে বিশাল বিত্তের মালিক আজ নিঃস্ব রিক্ত। আর যুদ্ধাপরাধী আশিকুর রহমান এই ভূখণ্ডে জন্মেও যুদ্ধের পুরো নয় মাস পাকিস্তানের সেবাদাস হিসেবে কাজ করে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক। এর বিচার কে করবে? নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচার করতেই হবে। কারণ পাকিস্তানের জন্যে, পাকিস্তানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা অন্যায়-অত্যাচার করেছে, তারা নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধী। সে সময় টাঙ্গাইল জেলায় পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা যে যে ঘটনা ঘটেছে, তার সম্পূর্ণ দায় আশিকুর রহমানের। আশিকুর রহমান নিজেই বলেছেন, টাঙ্গাইলে তার আগের ডিসি আবুল ফজলের বিরুদ্ধে কোলাবরেটর হিসেবে অভিযোগ উঠেছিল; কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। কী চমত্কার যুক্তি! আবুল ফজল ডিসি হলে কোলাবরেটর হয়, আশিকুর রহমান ডিসি হয়ে সে একই কাজ করলেও কোলাবরেটর হয় না! তামাশা আর কাকে বলে। কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ট্রোর অন্যতম সাথী চে গুয়েভারা কিউবা মুক্ত করে সেখানে চুপ করে বসে না থেকে বলিভিয়ার মুক্তি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। আমেরিকার ষড়যন্ত্রে তাকে জীবন দিতে হয়েছিল। আমি মমতাজ খানকে নিয়ে গর্ব করতে পারি; কিন্তু আশিকুর রহমানকে নিয়ে নয়।
এমনিতেই মন বড় অশান্ত। মানুষ বড় বেশি দুশ্চিন্তায়। রাস্তাঘাটে ঠিকভাবে চলা যায় না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সময় হিসাব করে যাওয়া যায় না। এই তো গত ২০ তারিখে ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সড়কে এক দুর্ঘটনায় ৮-১০ ঘণ্টা দেরিতে যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছেছে। বাজারঘাটের হিসাবও মেলে না। বাড়ির গৃহিণীরা আগামীকাল ক’টাকার বাজার করবে, সারারাত হিসাব করে সকালে বাজারে গিয়ে দেখে হিসাব মিলছে না। মানুষের চাকরি নেই, তেমন কোনো কর্মসংস্থানও নেই। নাক-মুখ মুছে মহাজোট বললেও আইনশৃঙ্খলা খুবই খারাপ। জোর যার মুল্লুক তার মতো অবস্থা। গর্ব করে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজের কথা বলছি; কিন্তু তেমন মূল্যবোধ আমাদের কারও মধ্যে নেই। আস্তে আস্তে বিরোধী দলকে, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। সারা জীবন দেখে এলাম শাসক যত শক্ত হয়, তাদের বাঁধন তত টুটে। যে যত জনপ্রিয় হয়, পৃথিবীতে হিমালয়ের উপর উচ্চতা নেই, একদিক দিয়ে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে উঠলে তারপর অন্যদিক দিয়ে আবার নিচের দিকে নামতেই হয়। এটাই নিয়ম। জন্মের পর মৃত্যু, একে সহজভাবে নিতে পারাই ভালো। আজ যে অনাদৃত, কাল সে-ই হতে পারে মধ্যমণি। বিষয়টি মনে না রাখা বোকামির কাজ। এ ধরনের অশান্ত অবস্থায় কোনো বিবেকবান মানুষের হৃদয় শান্ত থাকে না। আরও অস্বস্তি ও অশান্তি বোধ করছি, আমাদের সরকার কেমন যেন জনসাধারণকে অবিশ্বাস করে একের পর এক দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে চলেছে। অন্যদিকে পরিপকস্ফ ভারত সরকার, তারাও কেমন যেন অপকস্ফ আচরণ করছে। সরকার অথবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে খাতির হলেই সেটা গোটা বাংলাদেশের সঙ্গে খাতির এমন বলা যায় না। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক সব থেকে ভালো। কথাটা গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট হতে পারে। গত কয়েক মাস ধরে আমার তো মনে হয় পাকিস্তান জমানার শেষের দিকেও বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে এত অবিশ্বাস করত না, অপছন্দ করত না—যতটা এখন করে। গত তিন বছরে না হলেও এক বছরে বাংলাদেশ-ভারত প্রিয়তায় ধস নেমেছে। যারা এক বছর আগেও ভারতকে সম্মান করত, মর্যাদা দিয়ে কথা বলত, তারা এখন সবাই বিরক্ত। সত্যিকার অর্থেই দেশটা শুধু আওয়ামী লীগের না, বিএনপিরও না। এসবের বাইরেও একটা বিরাট বাংলাদেশ আছে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ভারত হারিয়ে যাচ্ছে। ট্রানজিট অথবা করিডোর এসব লুকোচুরি খেলে কোনো লাভ নেই। মানুষ এখন সব বোঝে। টিপাই বাঁধ নিয়ে সরকার যে নতজানু ভূমিকা নিয়েছে, তাতে সরকারের অর্ধেক জনপ্রিয়তা মাটিতে মিলিয়ে গেছে। আমাদের মাথার চৌদ্দ-পনেরশ’ ফুট উপরে সুতো দিয়ে তলোয়ার ঝুলিয়ে রাখার মতো ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় কোটি কোটি কিউসেক পানি জমা করলে খোদা না করুন একদিনে কেয়ামত হয়ে যাবে। ওই বাঁধ আসাম চায় না, মণিপুর চায় না। আমরা তোতাপাখির মতো ভারতীয়দের কথা বিশ্বাস করে নাচানাচি করছি। ভারতকে তো করিডোর দেয়া হয়েই গেছে। এটা আর লুকিয়ে রাখার দরকার কি? এই করিডোর সবসময়ই ছিল। পাকিস্তান হওয়ার পর কলকাতা থেকে নারায়ণগঞ্জ জাহাজ চলত। সরাসরি গেদে দিয়ে ট্রেন আসত। আরিচা-বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি হয়ে ধুবড়ী, গোয়ালপাড়া দিয়ে সেই ডিব্রুগড় পর্যন্ত নৌপথে ভারতের মালামাল আনা-নেয়া হতো। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর কিছুটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও কলকাতা থেকে আরিচা, বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি-বালাসি হয়ে ধুবড়ী দিয়ে আসামের ডিব্রুগড় পর্যন্ত সবসময় ভারতের নৌ যোগাযোগ ছিল। সেটা এখনও আছে। নতুন নৌ যোগাযোগ হয়েছে কলকাতা কিংবা ডায়মন্ড হারবার থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত। ভৈরবের আশুগঞ্জ নৌবন্দর পর্যন্ত বিশাল বিশাল জাহাজ আসছে। আগরতলায় বিদ্যুত্ প্লান্ট বসানোর জন্যে ভারী ভারী যন্ত্রপাতি নামছে। এই তো সেদিন দেখলাম ৩৫০ টন ওজনের ট্রেইলার পারাপারের জন্যে মাটি ফেলে আখাউড়ার তিতাস নদী ভরে ফেলা হয়েছে। দরিদ্র জেলেদের রুটি রুজি বন্ধ। তাদের পেটে হাত পড়েছে। সত্যিই কি আমরা স্বাধীন দেশ? অন্য দেশের মালামাল পার করার জন্যে আমরা আমাদের নদীর জলপ্রবাহ বন্ধ করে দিই! আর দেশের মালিক জনগণ তারা কিছুই জানে না! এত ডিজিটাল সরকার, তারা এই তিন বছরে কী করলেন? ভারতের অনুগত সেবাদাস হিসেবে যদি এমন নতজানু আচরণ করতেই হয়, একটা বিকল্প রাস্তা করে নিতেন। আধুনিক জমানায় কত আর সময় লাগতো! রাস্তা না করতে চান, বড় বড় পন্টুন বা বার্জ বসিয়ে তা দিয়ে সেতু করতেন। পানির চলাচল অব্যাহত থাকত। মহাজোট সরকারে আছেন বলে দেশটা কি ভারতকে দিয়ে দিতে চান? দাখিলা-পর্চা কিন্তু আপনাদের নামে না। তাই কাউকে সাফকবলা করে দিতে পারবেন না। মানুষ একবার রুখে দাঁড়ালে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। বাঙালিরা যদি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুসলমানের দেশ ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, তাহলে অসহ্য হয়ে গেলে দিল্লির বিরুদ্ধে সিনা টান করে দাঁড়াতে কোনো দ্বিধা করবে না। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে। দখলদারের মতো নয় অথবা মনিবের মতো নয়। ঋত্বিক ঘটক ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বিখ্যাত সিনেমা তৈরি করেছিলেন স্বাধীনতার পরপর। বাংলার আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে সে সিনেমাটি এখনও জ্বলজ্বল করছে। তার শেষপর্বে পানির অভাবে এলাকাটি মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে এমন একটি দৃশ্য দেখিয়েছিলেন। একসময় মিসরের নীল নদে বাঁধ দেয়া হয়েছিল। আশুগঞ্জ থেকে ত্রিপুরায় বিদ্যুত্ প্লান্ট নির্মাণের জন্যে তিতাসের বুকে বাঁধ দেয়া আমার কাছে কিন্তু মনে হয়েছে কোনো মানবসন্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলার মতো। সনাতন ধর্মীদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেমন মথুরার রাজা কংসকে দু’পায়ে ধরে ফেড়ে ফেলে শূন্যে ছুড়ে দিয়েছিলেন, তেমনি ঘটনার মতো। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বাঙালি জাতি যে সব পারে, এর কিন্তু ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। তাই সময় থাকতে সাধু সাবধান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন