মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১১

রঙ-বেরঙের কালবেলা


আমাদের জাতির অন্তর্গত মানস তৈরি হয়েছিল পেণ্ডুলামের চরিত্রের আদলে। আমাদের গতি সামনের দিকে নয়, পাশাপাশি। পাশাপাশি গতি অগ্রসরমান নয়- একই বন্ধ পরিসরে শুধু এপাশ আর ওপাশ। একবার আবেগে আপ্লুত, একবার ঘৃণায় আকুঞ্চন। একবার কাউকে মাথার ওপরে, একবার তাকেই পদতলে। একবার প্রশংসা, তো একটু পরেই কুৎসা। একবার বিদ্রোহ তো পরপরই আনুগত্য। একবার অন্ধ বিশ্বাস, আরেকবার অন্ধ অপ্রত্যয়। সকালে অর্ঘ্য তো সন্ধ্যায় অবজ্ঞা, দুপুরে সখ্য তো রাতে প্রতিহিংসা। ঠিক যেন ঘড়ির পেণ্ডুলাম। এক চরম যাত্রা থেকে ঠিক তার বিপরীতের অর্ধবৃত্তের চরম সীমায়। জন্মলগ্ন থেকেই ডিঅক্সিরিবোনিউক্লেইক অ্যাসিডের (ডিএনএ) মধ্যে পেণ্ডুলামের ক্রোমোজোম ঢুকিয়ে বিধাতা আমাদের নির্মাণ করেছেন বলে মাঝে মাঝে মনে হয়। সেই সাথে যোগ হয়েছে মিথ্যাচার আর ঈর্ষার বিষের দুরন্ত মিশ্রণ। আমাদের স্পর্শ করবে যে, অনিবার্য মৃত্যু হবে তার।
আমাদের অধিকাংশ মাসের বুকিং হয়ে গেছে, অবশিষ্ট আছে মাত্র কয়েকটি। জানুয়ারি মাস শেখ মুজিবের দেশে প্রত্যাবর্তনের মাস, ফেব্রুয়ারি হচ্ছে ভাষার মাস, মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতার, এপ্রিল বেচারা ‘ফুল’ ছাড়া এখনো আর কিছু নয়, মে হচ্ছে শ্রমিকদের, জুন এখনো বুক্ড হয়নি, বুক্ড হয়নি জুলাই, শোক বুক করেছে আগস্ট, সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর এখনো প্রতীক্ষায়, নভেম্বর সিপাহি-জনতার, ডিসেম্বর বিজয়ের মাস।
প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, ইরাককে ইরাকিদের হাতে ফেরত দিয়ে বিজয়ের গৌরব নিয়ে ইরাক ছেড়ে যাচ্ছে আমেরিকা। দীর্ঘ ৯ বছর একটি প্রমাণিত মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে, জাতিসঙ্ঘের প্রতি স্পর্ধার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ৯ লাখ ইরাকি শিশু-নর-নারী হত্যা করে প্রায় এক দশক ঔপনিবেশিক দখলদারি কায়েম রেখে আমেরিকা পালিয়ে যাচ্ছে একটি গর্বিত জাতিকে ধ্বংস করে, তাদের অগ্রযাত্রাকে ৫০ বছর পিছিয়ে দিয়ে। এক সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তের হাসি হেসে পালালেন ওবামা। কত আবু গারিব, কত গুয়ান্তানামো। ওষুধের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল দুই লাখ নিষ্পাপ শিশু। এমনিভাবে পাথরের যুগে ফিরে যাবে আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়া। অথচ যারা এই বর্বরতা চরিতার্থ করছে, তারাই বিশ্বে অলঙ্ঘনীয়, তারাই প্রভুর ভূমিকায়। তাদের অনুগ্রহ পাওয়ার প্রত্যাশায় গোটা বিশ্বই ব্যাকুল।
কিছু দিন ধরে গুম, উধাও, খুন ও ভাসমান লাশ যেন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন' স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? ঘুম ভেঙে বলে উঠলেন : ‘খবরের কাগজে দেখলাম গুম ও খুনের সংবাদ। আমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয়ই বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।’ সবাইকে চমকে দিয়ে এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মহিলা বললেন, ‘এসব খুন করাচ্ছেন বেগম জিয়া।’ তেলের দাম বাড়ছে নাকি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের ষড়যন্ত্রে। এক জ্ঞানপাপী তো টিভি টকশোতে বলেই ফেললেন, দেশের বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির পেছনেও ঘাতক-দালালদের বিচার বিঘ্ন করার চক্রান্ত কাজ করছে।

বহু দিন ধরে দেখে আসছি, ভারত বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু নয়। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম কথা দিয়ে গেলেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি করে আর কোনো বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না; ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকায় এসে আশ্বস্ত করলেন, সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা অবশ্যই বন্ধ হবে। এতশত প্রতিশ্রুতির পরে গত এক সপ্তাহে পাঁচজন বাংলাদেশী নাগরিককে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নির্বিচারে হত্যা করেছে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। চারজনকে গুলি করে, আর একজনকে বোমা মেরে। অথচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের এমন মানবতাবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একটি উত্তপ্ত বিবৃতি দিতেও অক্ষম। এমনকি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানোর সাহস পর্যন্ত আজ আমাদের নেই। আজো তিস্তা নদীর প্রবাহ বণ্টনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সমপ্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, ভারত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ ‘করবেই’। আমাদের দীপু কি শুধু এপাশ থেকে ওপাশ ঘাড় নাড়িয়েই সম্পন্ন করতে থাকবেন জাতির প্রতি তার দায়িত্ব?
ঢালাও রাজনৈতিক গ্রেফতার, দমন-পীড়নের পরিচিত চালচিত্রের কথা যদি বাদও দিই, তাহলেও আইনশৃঙ্খলার দৈনন্দিন পরিসি'তি কেমন? ২০ ডিসেম্বরের একটি বাংলা জাতীয় দৈনিক পত্রিকা থেকে পাওয়া : পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য, র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতায় আতঙ্কিত পথচারী, ঢাকায় এসে সব খুইয়েছেন জাপানি অধ্যাপক, এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে গুপ্তহত্যা, সাভারে স্কুলছাত্র খুন, চারঘাটে যুবকের লাশ উদ্ধার, ২৫ কোটি টাকার টেন্ডার ভাগাভাগি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী এবং মেয়র-চেয়ারম্যানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, ভালুকায় ট্রাক উল্টে পাঁচজন নিহত, রাজধানীর খিলক্ষেত থানার সামনে দুজনকে গুলি করে ১০ লাখ টাকা ছিনতাই, নিখোঁজের ২৫ দিনেও সন্ধান নেই হাফেজ ইমন চৌধুরীর, মান্দায় গৃহবধূকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, টাকা ছাড়া কাজ হয় না দালালদের উৎপাতে, রাজধানীর শাঁখারীবাজারে তিন ট্রাক বিস্ফোরক উদ্ধার, গভীর রাতে সাতটি তাজা বোমা উদ্ধার, আজ থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ১৯ রুটে পরিবহন ধর্মঘট, রাজধানীতে বিএনপির মিছিলে পুলিশের বাধা। কেমন মনে হচ্ছে? অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তার স্বভাবসুলভ নির্লিপ্ততার সাথে বলে থাকেন : ‘কেন, আমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে নিরাপত্তা সমস্যা। আমি তো খবরের কাগজে দেখলাম, গুম আর ভাসমান লাশের সংবাদ। ঘটনার তদন্ত করবে আমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্তে কী প্রকাশ পায় দেখা যাক।’ কী নিশ্চিন্ত নির্মমতা!
অর্থনীতির খবর কী? আমাদের অর্থমন্ত্রী এসকাপের সেমিনারে বলেছেন, চরম মুদ্রাস্ফীতির কারণে দেশের অর্থনীতি গভীর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, অর্থনীতি তো খুব শক্তিশালী অবস'ানে রয়েছে- কোনো সমস্যা নেই। শেয়ারবাজারের বিপন্ন অবস'া দূর হচ্ছে না। গ্যাস সঙ্কটে শিল্পোৎপাদন স'বির। বিদেশী বিনিয়োগ শূন্যের কোটায়। টাকার বিপরীতে ডলারের দামও ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ’ পর্যায়ে, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকার নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ। অথচ এ ঋণের দায় কিভাবে পরিশোধ হবে, কেউ বলতে পারে না। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানও প্রায় বন্ধ। এ অবস'ায় দেশের উন্নয়ন ভাবনা নতুন অশনি সঙ্কেতের বলয়ে।
এ দিকে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের রাজনীতি আগামীর জন্য সঙ্ঘাত ছাড়া আর কোনো সংবাদ দিচ্ছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া বাতিল, ঢাকা কেটে দু’ভাগ করা, জেলা পরিষদে পুরোপুরি দলীয় কর্মী দিয়ে প্রশাসক নিয়োগের অসাংবিধানিক ব্যবস'া গ্রহণ, স'ানীয় সরকারপর্যায়ে অনির্বাচিত আধিকারিকদের নিয়োগের স্বেচ্ছাচার (তা হলে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিপক্ষের যুক্তি কি নীতির বিচারে ভীষণভাবে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে না?)- এসবই বারবার প্রমাণ করে, গণতন্ত্রে নির্বাচনই অন্তিম কথা নয়। একবার ভোটে যেকোনোভাবে নির্বাচিত হলে তারপর ‘আমি তা-ই করব, যা আমার ইচ্ছা'- এ ধরনের স্পৃহা যে ভীষণভাবে অগণতান্ত্রিক এবং স্পর্ধিত স্বেচ্ছাচারীর জন্ম দেয়, পৃথিবীতে বাংলাদেশ তার এক নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। আমরা স্বেচ্ছাচারীদের প্রশ্রয় বা সমর্থন দেয়ার জন্য গণতন্ত্রের চর্চা করতে চাই না। এ জন্য আজকে যে কথাটি সব কথার আগে ভাবা দরকার, তা হচ্ছে- সরকার প্রধানের স্বেচ্ছাচার করার ক্ষমতার ডানা কর্তন করা- ক্ষমতার রাষ্ট্রীয় ব্যবস'াপনায় ক্ষমতার একটা সভ্য ভারসাম্য সৃষ্টি করা। নইলে রচিত হবে আরেকটি বাকশালী একনায়কত্বের পাণ্ডুলিপি।
প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে এই- কেউ পরপর মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তাতে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য বাগান সাজাতে হবে না।
লেখক : সাবেক সচিব ও সম্পাদক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন