সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১১

মানুষ যেভাবে বদলায়-

বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র এবং বাঙালির স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পেছনে বঙ্গবন্ধুর যেসব শিষ্যের অবদান অনস্বীকার্য জননেতা আবদুর রাজ্জাক তাদেরই একজন। রাজ্জাক ভাই আজ নেই। ২০০০ সালে এক বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম তার মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে। সে সময়ের পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক গল্পছলে বলেছিলেন, রাজনীতিতে আসবেন এমন কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না। ইচ্ছা ছিল কুস্তিগীর হবেন। কিশোর বেলা থেকেই শরীর গঠনে যত্নবান ছিলেন তিনি। এমনকি মি. ইস্ট পাকিস্তানও হয়েছিলেন একবার। কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা তাকে নিয়ে আসে রাজনীতিতে। কুস্তিগীরের বদলে আপদমস্তক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি।

মানুষের চিন্তার রাজ্যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে। এ প্রতিক্রিয়ার কারণে আজ যিনি চিন্তার রাজ্যে উত্তর মেরুতে অবস্থান করছেন কাল তিনি দক্ষিণ মেরুর বাসিন্দা হবেন না_ তার নিশ্চয়তা নেই। কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো মার্কিনবিরোধী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সারা দুনিয়ায় পরিচিত। কিন্তু এহেন ক্যাস্ট্রো ১৪ বছর বয়সে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের কাছে ১০ ডলার চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। রোমান ক্যাথলিক মিশন পরিচালিত মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র ছিলেন ক্যাস্ট্রো। সেখান থেকে তিনি চিঠি লিখেন ১৯৪০ সালের ২৫ নভেম্বর। ছোট-বড় অসংলগ্ন অক্ষরে চিঠির নিচে নিজের নাম লিখতে গিয়ে ক্যাস্ট্রো লিখেন 'আপনার বন্ধু'। অথচ ১৯৫৯ সালে কিউবার বিপ্লবের পর থেকে এ ক্যাস্ট্রোই পরিণত হন যুক্তরাষ্ট্রের চিরশত্রুতে। অন্তত ৯ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাকে সেভাবেই দেখেছেন। কিশোর বয়সে আক্ষরিক অর্থেই ক্যাস্ট্রো ছিলেন রুজভেল্টের প্রতি বিস্ময়কর রকমের শ্রদ্ধাশীল। রুজভেল্টের কথা উঠলেই প্রশংসা ঝরে পড়ত তার কণ্ঠে। তার প্রমাণ মেলে ওই চিঠিতেই। তিনি লিখেন, আমি রেডিও শুনতে খুব ভালোবাসি। রেডিওতে আপনি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন শুনে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। এরপর রুজভেল্টের কাছে ১০ ডলার চাইতে গিয়ে তিনি লিখেন, আমি কখনও ১০ ডলারের নোট দেখিনি এবং আমি ওসব নোটের একটি পেতে চাই। এ চিঠি লেখার ১৯ বছর পর ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে সফল হয় কিউবার কমিউনিস্ট বিপ্লব। উৎখাত করা হয় একনায়ক ফুলজেনিও বাতিস্তাকে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। বরাবরই যিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টদের চক্ষুশূল বলে বিবেচিত হয়েছেন। ১৯৬২ সালে বিরোধ এমন পর্যায়ে পেঁৗছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় হামলা করতে উদ্যত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রেকর্ডস দপ্তরের কর্মকর্তা সারডিন রাসেল এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ক্যাস্ট্রো যখন চিঠি লিখেছিলেন তখন তিনি কিশোর। কিন্তু বড় হয়ে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তিনি যে ধারণা পোষণ করেছেন, তা কিশোর বয়সের একবারে উল্টো। যা রীতিমত বিস্ময়কর। তিনি বলেন, ১৯৭০-এর দশকের নথিপত্র বাছাই করতে গিয়ে আকস্মিকভাবে ক্যাস্ট্রোর লেখা চিঠিটি পাওয়া যায়। আবিষ্কৃত হয় ক্যাস্ট্রোর জীবনের না জানা এক অধ্যায়। দার্শনিকরা বলেন, মানুষের মন সদা পরিবর্তনশীল। বিশেষত মানুষের চিন্তার জগতে পরিবর্তন এক অনিবার্য সত্য। কিশোর বয়সে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ছিলেন ক্যাথলিক স্কুলের ছাত্র। গোঁড়া ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যেই কেটেছে তার কৈশোর। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনন জগতেও পরিবর্তন ঘটে। বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। এ শিক্ষাই তাকে সমাজতন্ত্রী হতে উদ্বুদ্ধ করে। একসময় আমেরিকাকে স্বপ্নের দেশ বলে ভাবতেন তিনি। সে দেশের রাষ্ট্রনায়কদের দেখতেন শ্রদ্ধার চোখে। কিন্তু শীঘ্রই সে ভুলের অবসান ঘটে। ক্যাস্ট্রো উপলব্ধি করেন কিউবার মানুষ যে দরিদ্রতার অভিশাপে ভুগছে, তার নেপথ্যে রয়েছে আমেরিকার হাত। কিউবার শাসকরা আমেরিকান শোষকদের হুকুম বরদার হিসেবে কাজ করছে। দৃশ্যত স্বাধীন হলেও এ দ্বীপ দেশটির স্বাধীনতা মার্কিনীদের কাছেই জিম্মি। নিজের দেশ, জাতি ও জনগণের প্রতি ভালোবাসাই ক্যাস্ট্রোকে বিদ্রোহী করে তোলে। মার্কিনীদের প্রতি ভালোবাসা পরিণত হয় ঘৃণায়। দেশের মাটি ও মানুষকে সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করার শপথ নেন ক্যাস্ট্রো। মার্কিন তাঁবেদার বাতিস্তাকে উৎখাত করতে গড়ে তোলেন সংগঠন। গড়ে তোলেন জনগণের গেরিলা বাহিনী। ক্যাস্ট্রোর এ মুক্তির লড়াইয়ে যোগ দেন লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের বেশকিছু বিপ্লবী। যাদের অন্যতম আর্জেন্টিনার তরুণ চিকিৎসক চে গুয়েভারা। ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করে। প্রতিষ্ঠিত হয় বিপ্লবী সরকার। মানুষের মনন জগতে পরিবর্তন কোনো বিচিত্র ঘটনা নয়। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন পড়তেন গির্জার স্কুলে। তার মায়ের ইচ্ছা ছিল স্তালিন ধর্মযাজক হবেন। কিন্তু তিনি কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের তিনি ছিলেন অন্যতম কাণ্ডারি। দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের হাল ধরেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ও মিত্রশক্তির জয়ের মহানায়কও ছিলেন তিনি। আফ্রিকার দেশে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে। মুগাবেও একসময় ছিলেন ধর্মযাজক। শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে তিনি গড়ে তোলেন মুক্তি আন্দোলন। ধর্মযাজক থেকে পরিণত হন সমাজতান্ত্রিক নেতা। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে কতটা পরিবর্তন ঘটতে পারে তার প্রমাণ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী।

যুবক বয়সে বাজপেয়ী যোগ দেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। পরবর্তীতে তিনিই বিপরীত ধারার দল রাষ্ট্রীয় সেবকসংঘের সদস্য হন। অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে আত্মসমর্পণ করেন সংকীর্ণ ধর্মীয় চেতনার কাছে। বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজ একসময় ছিলেন ভারতের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের কাতারের নেতা। ফার্নান্দেজ শ্বশুরবাড়ি সূত্রে বাংলাদেশিদেরও আত্মীয়। তিনি বিয়ে করেন নেহেরুর মন্ত্রী ও ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ফরিদপুরের সন্তান খ্যাতনামা কবি হুমায়ুন কবীরের কন্যাকে। সে সূত্রে তিনি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ভায়রা। মানবাধিকার নেত্রী সিগমা হুদা ও এনজিও নেত্রী খুশি কবিরের দুলাভাই! ভারতের কমিউনিস্টপন্থী তাত্তি্বক লেখক রাহুল সাংস্কৃতিয়ন একসময় ছিলেন সাধু! আধ্যা@ি@@@ক সাধনায় তিনি হিমালয়ের দুর্গম এলাকায় মাসের পর মাস কাটিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত এই সাধক পুরুষ কমিউনিস্ট আন্দোলনের দীক্ষা নেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণপুরুষ কমরেড আব্দুল হকের জীবনও প্রায় অভিন্ন। পীরপুত্র আব্দুল হক ধর্মীয় গণ্ডি ছেড়ে একসময় নিরশ্বরবাদী কমিউনিস্টদের সঙ্গে একাত্ম হন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন তার বিশ্বাসে অটল। কবি আল মাহমুদ দেশের শীর্ষ কবির একজন। একসময় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে এ জন্য জেলও খাটেন। আল মাহমুদের কবিতায় একসময় লেখা হয়েছে, 'আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন'। জেলে থাকাবস্থায় তিনি নাকি ধর্মীয় রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হন।

মানুষের মনন জগতে রাতারাতি কতটা যে পরিবর্তন ঘটতে পারে তার প্রমাণ উপমহাদেশের সংগীত জগতের অসামান্য প্রতিভা ভূপেন হাজারিকা। সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না এ খ্যাতনামা গায়ক। কিন্তু তারপরও তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীদের আপন লোক। তার লেখা ও গাওয়া গান মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে। শোষণমুক্তির সংগ্রামকে করেছে বেগবান। ভারতের আসামে দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষের কাছেই তিনি ছিলেন প্রিয় ও সমানভাবে গ্রহণীয়। এই ভূপেন হাজারিকাই ২০০৫ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে হুট করে যোগ দেন বিজেপিতে। একজন খ্যাতনামা বাম বুদ্ধিজীবী এবং সংগীতশিল্পীর বিজেপিতে যোগদান ছিল সে দলের জন্য প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু আসামের মানুষ আদর্শের এই জলাঞ্জলিকে মেনে নিতে পারেননি। তার প্রমাণ সে নির্বাচনে ভূপেন হাজারিকার লজ্জাজনক পরাজয়। অথচ তিনি যদি স্বতন্ত্র প্রার্থীও হতেন তবে তার জয় ছিল অনিবার্য। তার বিরুদ্ধে প্রার্থী দিতে রাজনৈতিক দলগুলো ইতঃস্ততই করত। ভূপেন হাজারিকা যেসব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন তার প্রমাণ হলো একবার তাকে সর্বসম্মতভাবে রাজ্যসভার সদস্য করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি অবিস্মরণীয় নাম তাজউদ্দিন আহমেদ। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দিন যুব বয়সে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। আওয়ামী লীগে আসেন কমিউনিস্ট পার্টিরই সিদ্ধান্তে। তাদের হয়ে কাজ করার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন আওয়ামী লীগারে পরিণত হন তিনি। ডানপন্থী বলে বিবেচিত ভাষাসৈনিক অলি আহাদ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন যুবলীগের শীর্ষ নেতা। ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিরই নির্দেশে। ফররুখ আহমদ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। তার কবিতায় ইসলামী ভাবধারার প্রভাব সুবিদিত। ফররুখ আহমদও যুবক বয়সে কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। সে প্রভাব ছেড়ে তিনি সম্পর্কিত হন বিপরীত ধারার সঙ্গে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিশোর বয়সে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে আদর্শ পুরুষ হিসেবে ভাবতেন। তার এই ভাবের জগতে পরিবর্তন আসে যুবক বয়সেই। যে ক্যাস্ট্রো রুজভেল্টের কাছে ১০ ডলারের নোট উপহার হিসেবে চেয়েছিলেন তিনি পরবর্তীতে মার্কিনীদের কোটি কোটি ডলার উপহারের প্রলোভনেও পা দেননি। ২০০১-এর আগে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান টার্গেট ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। তাকে হত্যা করার জন্য বারবার ফন্দি আঁটা হয়েছে। এমনকি কিউবার নেতার চুল-দাড়ি নষ্ট করার ব্যর্থ চেষ্টায় সিআইএ শত শত কোটি ডলার খরচও করেছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটির নাম ওসামা বিন লাদেন। অথচ এ লাদেন ছিলেন একসময় তাদের প্রিয়ভাজনদেরই একজন। সবার প্রিয় জননেতা আবদুর রাজ্জাক কুস্তিগীর হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে জীবন শুরু করলেও হয়ে যান নিখাদ রাজনীতিবিদ। রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে ভাবা হতো তাকে। দার্শনিকরা মানুষের মনোজগতের পরিবর্তনকে দু'ভাগে মূল্যায়ন করেছেন। তাদের মতে, মানুষ যত বেশি অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পায় সনাতন ধারণা থেকে সে তত বেশি সরে আসে। কোনো কোনো পরিবর্তনের সঙ্গে অবশ্য অপরাধ মনস্কতাও জড়িত। লোভ ও হীনস্বার্থের কাছে মানুষ যখন নিজের বিবেককে জিম্মি করে তখন তা করে অপরাধ মনস্কতা থেকেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ই-মেইল : sumonpalit@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন