বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১১

ভাসানীর ‘খামোশ’ ধ্বনিত হোক নতুন কণ্ঠে


বাংলাদেশের কিংবদন্তি রাজনৈতিক নেতা এবং মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মাতৃভূমির যেকোনো সঙ্কটে রাজপথে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করতেন। ভাসানীর ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিবাদ একটি গুরুগম্ভীর শব্দে উচ্চারিত হতো- ‘খামোশ’। তার এই গুরুগম্ভীর প্রতিবাদী শব্দের সাথে দলের নেতাকর্মীরা ও দেশবাসী পরিচিত ছিলেন। ভাসানী সমাবেশে ‘খামোশ’ উচ্চারণ করলেই জনতা উপলব্ধি করত গণ-আন্দোলনের ডাক আসছে, জনগণকে প্রস'ত হতে হবে, অপশক্তিকে মোকাবেলা করতে হবে। একজন বামপন'ী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এই মহান নেতার অনুপসি'তি এ মুহূর্তে মর্মে মর্মে আমি উপলব্ধি করছি। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে মানুষ দিশেহারা, মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত, জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে জনগণের জীবনে নাভিশ্বাস, বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, ভারত তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দেবে না, বরং ফারাক্কার মতো আমাদের মেরে ফেলার জন্য টিপাইমুখ বাঁধ করতে উদ্যত। শেয়ারবাজারে ধস, রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রা কমে গেছে, এক কঠিন অবস'ায় আমরা জাতি হিসেবে দিনাতিপাত করছি। সমাজ বিপ্লবের নিয়ামক শক্তি তথা বামপন'ীরা বিভক্ত, কেউ কেউ ধনিক শ্রেণীর রাজনৈতিক ধারার সাথে যুক্ত, দৃশ্যমান কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছেন না। কিন' মুক্তির অন্বেষায় দেশবাসী উন্মুখ। সেই সময় বিকল্প রাজনৈতিক আন্দোলনের নতুন ধারা তৈরি করছেন রোডমার্চের নামে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। ২৭ নভেম্বর খুলনায় লাখ লাখ মানুষের সামনে কথা বললেন তিনি। দেশবাসী তথা রাজনৈতিক মহল প্রত্যাশা করে, জনদুর্ভোগের এই চরমতম মুহূর্তে ভাসানীর মতো খালেদা জিয়া দেশী-বিদেশী সব অপশক্তির বিরুদ্ধে স্বদম্ভে উচ্চারণ করবেন ‘খামোশ’।
মনে পড়ে ১৯৭০ সালে বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বেশির ভাগ মানুষ যখন ভোট যুদ্ধে ব্যস্ত, যে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ বেশির ভাগ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হয়েছিলেন। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করি, কমিউনিস্ট পার্টি তখন বেআইনি, আমাদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল তখন মোজাফফর ন্যাপ প্রতীক হচ্ছে কুঁড়েঘর, তখন দাকোপ-বটিয়াঘাটা নির্বাচনী এলাকায় কুঁড়েঘরের প্রার্থী ছিলেন প্রয়াত ডা: নারায়ণ গোলদার। স্বাভাবিকভাবেই সক্রিয় কর্মী হিসেবে আমি সেই নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত। ভোলায় ১২ নভেম্বরের ঝড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ গেল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এতই অমানবিক যে, হেলিকপ্টারে করেও দেখতে এলেন না এই লাখ লাখ মানুষের লাশ। মওলানা ভাসানী নির্বাচন বর্জন ঘোষণা করলেন, পশ্চিম পাকিস্তানকে জানিয়ে দিলেন ‘আসসালামু আলাইকুম’ এবং ঢাকায় বিশাল সমাবেশে ক্রোধে উচ্চারণ করলেন ‘খামোশ’। তার পরের ইতিহাস দেশবাসীর জানা। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর অভূতপূর্ব বিজয়ে, ইয়াহিয়ার নির্বাচনী ফলাফলকে না মানা, জনতার সংগ্রাম, আলোচনার নামে গোলটেবিলে কালক্ষেপণ, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, ঘরে ঘরে বাঙালির প্রস'তি, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউন, বাঙালির সশস্ত্র ৯ মাসের স্বাধীনতার লড়াই ও স্বাধীনতা অর্জন। কিন' ইতিহাসের এই ধারায়- প্রক্রিয়ায় মওলানা ভাসানীর ক্রোধ প্রকাশ ‘খামোশ’ গুরুত্বপূর্ণ।
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশে মওলানা ভাসানী যখন খুলনায় এসেছেন, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। দেশে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত, রক্ষী বাহিনীর ভূমিকায় মানুষ অতিষ্ঠ, চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ, ভারত এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটের সুযোগে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণে উদ্যত। আমরা তখন আওয়ামী লীগের সাথে। ত্রিদলীয় ঐক্যজোটে। ঐক্য ও সংগ্রাম আমাদের তখন রাজনৈতিক কৌশল। বিরোধী দল হিসেবে রাজপথে মূলত জাসদ ও ভাসানী ন্যাপ। জাফর, মেনন, রনোদের ইউপিপি তখন গঠন প্রক্রিয়ায়। সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি ইপিসিপি (এমএল)- এসব মাওবাদী দল তখন গোপনে তৎপর। এরফানুল বারী সম্পাদিত হক কথা তখন ভাসানী ন্যাপের মুখপত্র। মাঠে শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন অনুপসি'ত। ভাসানী সেই কঠিন মুহূর্তে ফারাক্কা প্রশ্নে ভারত এবং তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতায় ক্রোধে হুঙ্কার দিলেন ‘খামোশ’। গাজী শহিদুল্লাহ, নুরুল ইসলাম দাদু ভাই, মালিক আতাহার উদ্দিন, শান্তি ঘোষ- তারা সব ভাসানী ন্যাপের খুলনার নেতা। সেই সময়ে সৈয়দ ঈসা, কাজী ওয়াহিদুজ্জামান, সরদার মঈন উদ্দিন- তারা সব তরুণ নেতৃত্ব। বাহিরদিয়ার মোশাররফ, গিয়াস মোড়ল, ডুমুরিয়ার ফরহাদ, খেজের আহমেদরা তরুণ কর্মী (কোনো নাম বাদ পড়লে ক্ষমাপ্রার্থী)। সেই ‘খামোশ’ উচ্চারণ পরবর্তীকালে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চে পর্যবসিত হয়েছিল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ সারা দেশের মানুষের মতোই খালেদাকেই হাসিনার বিকল্প ভাবেন। শিক্ষায়, ত্যাগে, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় আওয়ামী লীগের বাইরে বহু দল, নেতা বা নেত্রী থাকলেও অন্য কাউকে নয়। সে কারণে অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার এ অঞ্চলের মানুষ খালেদা জিয়ার কণ্ঠে প্রত্যাশার কথা শুনতে চায়। এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপন্নতা, কল-কারখানা খঁঁুঁড়িয়ে চলা, নদীগুলোর অপমৃত্যু, সুন্দরবনের বিপর্যস-তা, মংলা বন্দরের অসহায়ত্ব, স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের দীর্ঘসূত্রতা- সব কিছু মিলিয়ে মানুষ আশ্বস্ততার কথা শুনতে চায় খালেদা জিয়ার মুখে। খালেদা জিয়া তার দলকে, জোটকে শক্তিশালী করার জন্য এবং তৃণমূল মানুষের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে এই রোডমার্চ করেছেন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তার কারণেই ভারত এ দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছিল। এটিও সত্য, বঙ্গবন্ধু ফারাক্কার পানিবণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থে যেটুকু পানির হিস্যা আদায় করেছিলেন, এত বছর পর কোনো সরকার এক কিউসেক পানি বেশি আদায় করতে পারেনি। কিন' এটিই নির্মম বাস্তবতা যে, ভারতের সর্বশেষ টিপাইমুখ বাঁধ কিংবা তিস্তা নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে আমরা দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুরও নেতা ছিলেন। ইতিহাসের নির্মমতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ মওলানা ভাসানীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে অনীহা প্রকাশ করছে। ভাসানীর অনুসারীরাই বিএনপি গঠনে মূল ভূমিকা পালন করছে। ঐতিহাসিক বিবেচনায় ভাসানী আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলেরই নেতা। বঙ্গবন্ধু ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে তিনিও অবশ্য শ্রদ্ধাবনত থাকতেন। মওলানা ভাসানী এখন নেই, ১৭ নভেম্বর তার মৃত্যুবার্ষিকী চলে গেছে; কিন' ঐতিহাসিকভাবে তাকে এখন জাতির প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, মওলানা ভাসানীর মতো খালেদা জিয়া দেশী-বিদেশী সব অপশক্তির বিরুদ্ধে উচ্চারণ করতে পারবেন কি না ‘খামোশ’। ইতিহাস প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু রেডকোর্সের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলতে ভুল করেননি, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি, খালেদা ‘খামোশ’ উচ্চারণ করতে পারলে ইতিহাস তাকে স্যালুট করবে।
লেখক : ফিরোজ আহমেদ আইনজীবী, খুলনা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন