রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১১

ব্যাংকারেরা পাশ্চাত্যের একনায়ক

আমি কখনো আবর্জনাতুল্য এত আজেবাজে কথা ও অর্থহীন বক্তব্য পড়িনি, যতটা পড়ছি বিশ্বের অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রসঙ্গে। আমার ক্ষোভকে প্রকাশ করতে হচ্ছে। এ দিকে পুঁজিবাদের পতনের ক্ষেত্রে যে নতুন চাপ সৃষ্টি হয়েছে, এটাকে এমনকি মধ্যপ্রাচ্যও কাটিয়ে উঠতে পারবে না। এর কারণ, ওই সব প্রতিষ্ঠান এবং হার্ভার্ডের ‘বিশেষজ্ঞ’দের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভেজাল আনুগত্য। অথচ এই প্রতিষ্ঠানগুলো আর বিশেষজ্ঞরাই অর্থনীতির এই বিপর্যয়রূপী অপরাধ ঘটিয়েছেন।
‘আরব বসন্ত’ কথাটা দিয়েই শুরু করা যাক। আরব বা মুসলমানদের যে মহান জাগরণ মধ্যপ্রাচ্যকে নাড়া দিচ্ছে, তার উদ্ভট বিকৃত অভিধা এই পরিভাষা। সামাজিক প্রতিবাদের কিঞ্চিৎ ঘটছে পাশ্চাত্যের রাজধানীগুলোতেও। পাশ্চাত্যে গরিব আর বঞ্চিতরা কিভাবে ‘আরব বসন্ত’ থেকে প্রেরণা পেয়েছে; কেমন করে আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, স্পেন আর গ্রিসের বিক্ষোভকারীরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে মিসর, তিউনিসিয়া এবং একটা মাত্রা পর্যন্ত লিবিয়ার ব্যাপক গণ-আন্দোলন দ্বারা এসব রিপোর্টে আমরা সয়লাব হয়ে গেছি। কিন' এ সব কিছু পাগলের প্রলাপ।
যার সাথে এ সব কিছুর তুলনা চলে, তা এড়িয়ে গেছেন পশ্চিমা সাংবাদিকেরা। তারা আরব জগতের একনায়কবিরোধী গণবিদ্রোহের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অথচ পাশ্চাত্যের ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারগুলোর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, তাকে অবজ্ঞা ও অবমূল্যায়ন করার জন্য তারা কতই না অসি'র হয়ে পড়েছেন। তারা আবার এমন ধারণা দিতে চান যে, আরব বিশ্বে যা ঘটেছে, হুজুগের সে পরিবর্তন টেকসই না-ও হতে পারে। কিন' বাস্তবতা ভিন্ন। আরব জনগণ প্রথমে হাজারে হাজারে, এরপর লাখে লাখে নেমে এসেছে নিজ নিজ দেশের রাজধানীর রাজপথে। এর পেছনে কারণ ছিল, তারা মর্যাদাপূর্ণ জীবন চেয়েছে এবং তারা সেসব একনায়কের পরিবারতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করেছে, যারা নিজেদের দেশের মালিক মনে করত। মোবারক, বেন আলী, গাদ্দাফি, জর্ডানসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজা ও আমিররা এবং আসাদ- সবার বিশ্বাস, গোটা দেশ তাদের একান্ত সম্পত্তি। মিসর যেন ছিল মোবারক অ্যান্ড কোম্পানি, তিউনিসিয়া বেন আলী অ্যান্ড কোং এবং লিবিয়া গাদ্দাফি ইনকরপোরেটেডের। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আরবরা জীবন দিয়েছেন এটা প্রমাণ করতে যে, তাদের দেশ জনগণের।
এখানেই পাশ্চাত্যের বর্তমান পরিসি'তির মিল আরব বিশ্বের সাথে। সেখানে আন্দোলন চলছে ‘বিগ বিজনেস’ আর সরকারের বিরুদ্ধে। এই আন্দোলন অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। তবে পাশ্চাত্যের মানুষ কিছুটা দেরিতে বুঝতে পেরেছে যে, তারা দশকের পর দশক পেয়েছে ভুয়া গণতন্ত্র। তারা দায়িত্ববোধের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দিয়েছে। অথচ দলগুলো তাদের গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট আর জনগণের ক্ষমতা ব্যাংক, ব্যবসায়ী ও রেটিং অ্যাজেন্সির হাতে তুলে দিয়েছে। আর এই ‘ত্রয়ী’র শক্তি জুগিয়েছে আমেরিকার সেরা ভার্সিটিগুলো এবং ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’-এর নোংরা ও অসৎ কোটারি। এরা এই কল্পকথা প্রচার করছে যে, পাশ্চাত্যের চলমান সঙ্কট বিশ্বায়নের সঙ্কট মাত্র এবং এটা ভোটারদের বিরুদ্ধে ব্যাপক কোনো আর্থিক অপকৌশল নয়।
ব্যাংক আর রেটিং অ্যাজেন্সি পাশ্চাত্যের একনায়কে পরিণত হয়েছে। মোবারক ও বেন আলীদের মতো এই ব্যাংকগুলো বিশ্বাস করে এসেছে, এখনো করছে যে, তারাই দেশের মালিক-মোখতার। অথর্ব সরকারের যোগসাজশে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এরা ক্ষমতা অর্জন করে। তাই এই নির্বাচন আরব দেশগুলোর অতীত নির্বাচনগুলোর মতোই ভুয়া। নির্বাচনের নামে আরবদের বাধ্য করা হতো, যাতে তারা দলে দলে গিয়ে তাদের ‘জাতীয় সম্পদের মালিক’দের তেলমর্দন করে আসে। গোল্ডম্যান স্যাক্স এবং রয়েল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মোবারক বা বেন আলীর রূপ নিয়েছে। উভয়েই তাদের ভয়ঙ্কর বড়কর্তাদের জন্য বানোয়াট পুরস্কার ও বোনাসের নামে জনগণের সম্পদ গিলে খেয়েছে। আর এটা এত বেশি পরিমাণে ঘটেছে, যা আরবের লোভী একনায়কেরা পর্যন্ত কল্পনাও করতে পারেননি।
মার্কিন ব্যাংকগুলো আর রেটিং অ্যাজেন্সিগুলোর মাঝে ফারাক নেই। ব্যাংক, অ্যাজেন্সি আর মার্কিন সরকারের কর্মচারীরা এই তিনটি কর্মক্ষেত্রে অবিরাম আসা-যাওয়া করে থাকে। রেটিং জগতের ‘বালক’রা বাজারের ওপর বিষাক্ত প্রভাব ফেলে ইউরোপের জনগণকে তাদের নখরে আবদ্ধ করছে। এই হুমকি দিয়ে করা এটা হচ্ছে যে, কথা না শুনলে ট্রিপল ‘এ’ রেটিং নামিয়ে দেয়া কিংবা প্রত্যাহার করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক ধস নামার আগে তারা অপরাধীদের ভূষিত করেছিল ‘এএএ’ রেটিং দিয়ে। এসব প্রাণী কারা, যাদের রেটিং অ্যাজেন্সিগুলো ফরাসিদের মনে এত ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে, যা ১৯৪০ সালে (নাৎসি সেনাপতি) রোমেলও ফ্রান্সের মধ্যে সঞ্চার করতে পারেনি।
কিন' ওয়াল স্ট্রিটে আমার যেসব সাংবাদিক সাথী আছেন, তারা নীরব কেন? বিবিসি, সিএনএন, এমনকি আলজাজিরা পর্যন্ত কেন এসব অপরাধীকে মনে করছে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান? এসব দুমুখো লোকের কেলেঙ্কারির ব্যাপারে কোনো তদন্ত নেই কেন? এতে মনে পড়ে যায় যে বিষয়টি, তা হলো- বেশির ভাগ মার্কিন সাংবাদিক ইসরাইলের প্রত্যক্ষ সমালোচনা ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্যের খবর পরিবেশন করে থাকেন। সেখানকার লিকুদ পার্টির সমর্থক লবি তাদের প্রলুব্ধ করে এটা বলতে যে, ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি সঙ্ঘাতে আমেরিকার শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের ওপর আস'া রাখা যায়। এ কারণে পছন্দের মানুষ ‘মধ্যপন'ী’ এবং অপছন্দের হলে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেয়া হয়। আরবরা এত দিনে এসব বাজে কথা ছুড়ে ফেলতে শুরু করেছে। যখন ওয়াল স্ট্রিটের প্রতিবাদকারীরা একই কাজ করে, তখন তাদের বলা হয় ‘নৈরাজ্যবাদী।’ আমেরিকার এসব সামাজিক ‘সন্ত্রাসী’র এত বড় সাহস যে, তারা হোসনি মোবারকের মতো বার্ন্যানকে ও গেইথনারদের বিচার দাবি করছে। পাশ্চাত্যে আমরা এবং সরকারগুলো আমাদের একনায়কদের বানিয়েছি। আরবরা তাদের একনায়কদের ধরেছে, কিন' আমরা আমাদের একনায়কগুলোকে ছোঁয়ার সাধ্যও নেই।
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের সৌজন্যে
ভাষান্তর-মীযানুল করীম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন