বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১১

কিষেণজির মৃত্যু ও মমতার স্বপ্নভঙ্গ

মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজির মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি দাঁড়িয়েছে ভারতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ‘একক অভ্যন্তরীণ সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি’ মাওবাদী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কি? এ প্রশ্নের উত্তরের আগে কিষেণজির মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক ও মাওবাদীদের বর্তমান অবস্থানের একটি সারসংক্ষেপ প্রয়োজন। প্রথম বিতর্কটি হচ্ছে কিষেণজী কি কথিত এনকাউন্টার কিংবা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় মারা গেছেন? কিংবা মাওবাদীসহ বিভিন্ন বেসরকারি পর্যায় থেকে অভিযোগ উঠেছে যে তাকে আটক অবস্থায় ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে তা সঠিক? এই প্রশ্নটির মীমাংসার আগেই ভারতের মূল ধারার মিডিয়া এবং কাউন্টার ইনসারজেন্সি মহলে ডক্কানিনাদে সন্তোষ প্রকাশের ধারা দেখে মনে হয় কিষেণজিকে খুনই করা হয়েছে। তারা প্রচার করছে যে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মাওবাদী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বে।

কিন্তু কিষেণজি যে পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন এবং যে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহালে তার মৃত্যু হয়েছে সেই পূর্বাঞ্চলের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রতিক্রিয়া কিন্তু তা বলে না। তিনি কিষেণজির মৃত্যুর সংবাদটি তাৎক্ষণিকভাবে পান দিল্লিতে বসে। ধারণা করা হয়েছিল, সংবাদটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি টিভি ক্যামেরার সামনে ধরা দেবেন এবং হর্ষোৎফুল্ল অবস্থায় এই ‘সফল’ এনকাউন্টারের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করবেন। কিন্তু না, ‘দিদি’ এই প্রথমবারের মতো নির্বাক থাকলেন। সন্তোষ প্রকাশের বদলে তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্তই দেখা গেছে। অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার! যেখানে তার নিরাপত্তা বাহিনী, রাজনীতিবিদ এবং গণমাধ্যমগুলো তার ছয় মাসের ক্ষমতাকালে সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে এ ঘটনাটিকে ফলাও করছে সেখানে তিনি নিশ্চুপ।

কেন তার কপালে এই ভাজ? এ থেকেই সন্দেহের সৃষ্টি হয় কিষেণজির মৃত্যু বা হত্যাকান্ড যাই হোক তা তার কাম্য ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন কিষেণজিকে জীবিত রেখে মাওবাদীদের সঙ্গে একটি আপস রফায় আসতে। কারণ তার তৃণমূল কংগ্রেস মেদিনিপুর, পুরুলিয়া, বীরভূম অর্থাৎ জঙ্গলমহালে যে সিপিএমের বিরুদ্ধে পা রাখতে পেরেছিল এবং নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে তার কারণ মাওবাদীদের সমর্থন। নন্দীগ্রামের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তার উত্থান ঘটে, সেও মাওবাদী অর্থাৎ কিষেণজির রণকৌশলের কারণেই। ভারত রাষ্ট্রের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এবং তিনি যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন সেই শ্রেণী চেতনায় প্রকাশ্যে মাওবাদীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন না। এজন্যই রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ও পরে তার চেহারার বিপ্রতীপ ছবি স্পষ্ট। ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে তিনি মাওবাদীদের কাছে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি তাদের কাজে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবেন না। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তিনি তার কথা রাখতে পারেননি। এটাও স্মরণীয় যে, মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে যে কেন্দ্রীয় সরকার তিনি তার শরিক। এসব কারণে কিষেণজি বিরক্ত ছিলেন মমতা ব্যানার্জি ও তার সরকারের ওপর। একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি মমতাকে ‘অকৃতজ্ঞ’ও বলেছেন- রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন না করায়। মমতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মাওবাদীরা তাদের সশস্ত্র আন্দোলন বন্ধ করলে তিনি তাদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে একটি সমাধানের পথ খুঁজে নেবেন।


২০১১ সালের মে’র নির্বাচনে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর চার মাসের একটি যুদ্ধ বিরতি আপস হয়। কিন্তু তারপর ছয় মাস পার হলেও মাওবাদীদের কাছে দেওয়া যৌথ বাহিনী তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা দূরের কথা বরং নতুন করে অপারেশন শুরু হয়। মাওবাদীরা মমতার এই ‘অকৃতজ্ঞতায়’ অধৈর্য হয়ে পড়ে এবং মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের যেসব নেতা ও কর্মী যৌথ বাহিনীর সোর্স হিসেবে কাজ করছে বলে তাদের সন্দেহ তাদের হত্যা করতে শুরু করে। এই পরিস্থিতি তাদের মধ্যে বিশ্বাসের বড় ধরনের ফাঁক সৃষ্টি করে। যুদ্ধ বিরতির এই সময়কালে মাওবাদীরাও যেমন নিজেদের সংগঠিত করার কৌশল নেয় তেমনি যৌথ বাহিনীও রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের মাধ্যমে মাওবাদীদের চলাচলের তথ্য সংগ্রহ করে। কিষেণজিও এই তৎপরতায় তাদের দৃষ্টিসীমায় থেকে যান। এই পরিস্থিতিতেই তিনি হত্যার শিকার হন।

মমতা নানা কারণেই কিষেণজিকে হত্যা করা হোক তা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন তার অস্ত্র সংবরণ। কিন্তু তিনি জানেননি যে, মাওবাদীদের অস্ত্র সংবরণ মানে তাদের দর্শন থেকে বিচ্যুত হওয়া- যা অসম্ভব। যেভাবেই হোক তার পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর হাতে কিষেণজির মৃত্যু তাকে বিচলিতই করেছে। কারণ তিনি এটা জানেন যে, এই ঘটনার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে মাওবাদী আন্দোলনের প্রথমসারির (দলে তার অবস্থান তৃতীয়) নেতা ও স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞের মৃত্যুতে মাওবাদীরা স্তিমিত হয়ে পড়বে। একথা ঠিক যে, কিষেণজির মতো একজন নেতার অবর্তমানে দল বড় ধরনের ক্ষতির শিকার। কিন্তু একটি আদর্শবাদী দলের জন্য এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া তেমন কঠিন নয়। ইতোমধ্যে এই দলের (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মাওবাদীর) ১৫ জন পলিটব্যুরো সদস্যের ৮ জনের মৃত্যু ও জেলে থাকার কারণে অবর্তমান। তারপরও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দলটি ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে বিবেচিত। কিষেণজির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আপস করার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আর মমতার দুশ্চিন্তা এখানেই।


মমতার দুশ্চিন্তার আরো কারণ রয়েছে। নির্বাচনের আগে জঙ্গলমহালের জন্য তিনি যেসব বিশেষ করে এলাকার উন্নয়ন ও যৌথ বাহিনী তুলে নেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা রক্ষা করতে না পারলেও তিনি বিধানসভার সদস্যদের বেতন-ভাতা বাড়িয়েছেন এবং তাদের পাওনা-গন্ডা বুঝিয়ে দিয়েছেন। ফলে বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচনের আগে যারা তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন তারাও ক্ষুব্ধ। তার দলের বিধানসভা সদস্য প্রখ্যাত গায়ক কবির সুমন তো বিদ্রোহ করেই বসেছেন। প্রখ্যাত লেখিকা ও মানবাধিকার কর্মী মহাশ্বেতা দেবীও প্রকাশ্যে ফ্যাসিস্ট বলে তার সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর এবং মাওবাদী ও সরকারের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতাকারী স্বামী অগ্নিবেশের মতো ব্যক্তিত্ব কিষেণজির মৃত্যু সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা সরাসরি একে ‘ভুয়া এনকাউন্টার’ হিসেবে অভিযোগ তুলেছেন। তারা আরো বলেছেন, ‘এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকার পুনরায় হানাহানির পথই প্রশস্ত করল।’

ভারত রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের মাওবাদী অপারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিষেণজির মৃত্যু এই অঞ্চলে মাওবাদীদের তৎপরতায় ভাটার সৃষ্টি করে কিনা তা ভবিষ্যতের বিষয়। তবে একথা বলা যায়, যদি ভাটাও পড়ে তা হবে সাময়িক এবং তা কোনোক্রমেই একেবারে শেষ হওয়ার নয়। তবে এটা পরিষ্কার পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি সমাধানে আসার যে স্বপ্ন মমতা দেখেছিলেন তা আর সম্ভব নয়। আর মমতা যে তার শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই মাওবাদী তথা স্থানীয় দরিদ্র ও নির্যাতিত আদিবাসীদের বন্ধু হতে পারেন না সেটাও স্পষ্ট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন