বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১১

রাষ্ট্রবিনাশী করিডোর : রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ



রাষ্ট্রবিনাশী করিডোর : রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ

ভারতকে রাষ্ট্রবিনাশী করিডোর প্রদানের কারণে উদ্বেগে আচ্ছন্ন আজ সারাদেশ। উদ্বিগ্ন দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজও। তারা তাদের উদ্বেগের কথা ও দেশবাসীর করণীয় সম্পর্কে জানিয়েছেন আমার দেশকে।

মাহমুদুর রহমান
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, আমার দেশ
ঢাকা সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের চাহিদা পূরণ হয়েছে। ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরের মাধ্যমে ট্রানজিটের নামে করিডোর তিনি পেয়েছেন। ওই এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী করিডোর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে তিস্তার পানির বিনিময়ে করিডোর প্রদানের প্রচারণা চালানো হলেও আমরা এর বিরোধিতা করেছি। আমরা বলেছি, ‘তিস্তার পানি আমাদের অধিকার আর ট্রানজিট ওদের আবদার। অধিকার ও আবদার এক হতে পারে না।’ ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ও ৬৫ দফা যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে ভারতের আবদার (করিডোর) পূরণ হলেও বাংলাদেশ তার অধিকার পায়নি। এগ্রিমেন্টের আর্টিকেল ৯-এ নিরাপত্তা, ১০-এ যৌথ কমিশন এবং ১২-তে সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় জুড়ে দেয়া হয়েছে। এই এগ্রিমেন্ট অনাদি-অনন্ত কাল ধরে চলবে। এর কোনো মেয়াদ নেই। শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে এমন এগ্রিমেন্ট করে চাক্ষুষ করিডোর প্রদান করা হলেও মূলত এটি বাংলাদেশকে একটি পরাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এতে বিষয়টি এমন হবে—‘একটি সুপার গভর্নমেন্ট ইন টু কান্ট্রিজ’।
২০১০ সালে দিল্লি থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আশুগঞ্জ হবে কেবল ওয়ান শট ডিল। পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য কেবল মালামাল পরিবহন করবে। আর এ প্লান্ট থেকে আমরাও বিদ্যুত্ পাব। একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারতকে ‘ট্রানজিট’ সুবিধা প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ড. মনমোহনের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে সম্মতিপত্র স্বাক্ষর না করে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ও যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাপ্তির সবকিছু বাতিল করে বরং বাধ্যবাধকতার দেয়ালে বেঁধে ফেলা হয়েছে। এভাবে জনগণের চোখ ফাঁকি দিয়ে করিডোর প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বস্তুত পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়েছে। এদেশের জনগণ এটা হতে দিতে চায় না। দেশের অস্তিত্ববিরোধী ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট, যৌথ বিবৃতি এবং করিডোর প্রদানের সব অপচেষ্টা রুখে দেয়া আজ তাই জাতীয় কর্তব্য। লাখ লাখ শহীদের বুকের রক্তে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশকে একটি ক্ষমতান্ধ তাঁবেদার সরকারের জন্য সাম্রাজ্যবাদী ভারতের লীলাভূমি হতে দেয়া যায় না। সে জন্য দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিকালে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আশুগঞ্জ টু আখাউড়া যাচ্ছি, পুরো পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য।

অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের সব চিন্তা ও কাজের মূল কেন্দ্র আমাদের মাতৃভূমির কল্যাণ। সেই কল্যাণ কামনা থেকেই, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে দেশের সঙ্কটকালে ঘরে বসে থাকাটা অন্যায় মনে করি। সে জন্যই দেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য, বিশেষ করে করিডোরের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি। এই উদ্যোগকে সেজন্যই একটি আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। সেই আন্দোলনকে গণমানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সভা, সেমিনার ও গোলটেবিল করতে হবে। এজন্য অভিজ্ঞ ও তরুণদের সমন্বয়ে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা জরুরি। তারপর ভেন্যুগুলো ঠিক করে নেমে যেতে হবে কাজে। ইসপাতদৃঢ় ঐক্য সৃষ্টি করে রুখে দিতে হবে এই করিডোর।

আতাউস সামাদ
বিবিসিখ্যাত সাংবাদিক
আন্তর্জাতিক শক্তি সবসময় তাদের অধিকতর লাভের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে সহায়তা করে। আবার অভ্যন্তরীণ শক্তিকেও তারা সমীহ করে। এজন্য জনগণকে সম্পৃক্ত করে সারা দেশে একটি আওয়াজ তুলতে হবে, ‘ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ও যৌথ বিবৃতি আমরা মানি না। করিডোর দিয়ে দেশের স্বাধীনতা খর্ব করতে দেব না।’ ক্ষতিকর বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে হবে। সরকারকেও ফিরে আসার আহ্বান জানাতে হবে। যেহেতু জাতীয় সংসদে এসব চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, সেজন্য এই রাষ্ট্রবিনাশী চুক্তি বাতিল করতে হবে।

শফিক রেহমান
সম্পাদক, মৌচাকে ঢিল
আধিপত্যবাদের আগ্রাসনে আমাদের পুরনো দুর্ভোগ ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। এই বিপদ থেকে দেশকে বাঁচাতে পারে দেশের জনগণ। সেই জনগণকে জাগিয়ে তুলুন। গালাগাল না করে তাদের বাস্তব চরিত্র মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। হিন্দু-মুসলিম রায়টের নামে ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার সুযোগ ভবিষ্যতে নিতে পারে। এজন্য সচেতন থাকতে হবে। সেজন্য যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই তৃণমূলে গিয়ে এসব আশঙ্কার বিষয়ে জনগণকে জানান। এজন্য যুব টিম তৈরি করা জরুরি। ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারসহ সামাজিক নেটওয়ার্কে এর প্রচারণা চালাতে হবে।

ফরহাদ মজহার
কবি ও গবেষক
করিডোরের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে লড়তে হবে। দলীয় চরিত্রের বাইরে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্লাটফর্ম গড়া জরুরি। বিভাজনের জায়গা দূর করে সামনে এগোতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে। এজন্য সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, লংমার্চ ও জেলায় জেলায় গিয়ে গণসংযোগ করতে হবে। কারণ একমাত্র ঐক্যবদ্ধ জনশক্তিই পারে এই মুহূর্তে করিডোরের মতো বিপদ থেকে দেশকে বাঁচাতে।

মোহাম্মদ আসফউদদৌলাহ
সাংবাদিক ও সাবেক সচিব
১৯০৫ সাল থেকেই আমাদের তোষণের খেলা চলছে। গ্রামের মানুষ ট্রানজিট-করিডোর বোঝে না। ভারতকে এসব দিলে ক্ষতি কী তাও তারা বোঝে না। সেজন্য আজ জাতীয় দুর্দিনে দেশের মানুষকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে অসুবিধার বিষয় হলো, বুদ্ধিজীবী নামে যাদের মানুষ চেনেন তারা বিভিন্ন সংস্থার পেমেন্ট পান। এ পরিস্থিতিতে লড়াইটা অনেক কঠিন। দেশের যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের লড়াইয়ের অগ্রভাগে থাকতে হবে। যুব-তরুণরা সংঘবদ্ধ ও প্রশিক্ষিত হলে যত শক্তিশালীরাই আগ্রাসন চালাতে চাক, তা প্রতিরোধ করা সহজ। ব্যক্তিগত জীবনে ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ করাতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে সংঘবদ্ধ লড়াইয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিকল্পিত প্রচারণা জরুরি।

অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন
সাবেক সভাপতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চুক্তি করলেও মূলত একটি দেশের সঙ্গে একটি পার্টির চুক্তি হয়েছে। এটা আইনিভাবে হতে পারে না। ট্রানজিট নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। বিরোধী দল, গণমাধ্যম কোথাও সরকারি উদ্যোগে কোনো আলোচনা নেই। এজন্য ভারতের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা জোরালো করতে হবে।

অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান
আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জনগণ ও দেশের প্রতি অঙ্গীকার রাখছে না সরকার। ‘ট্রানজিট দেয়া হয়নি’—সরকার এমন প্রচারণা চালালেও প্রকৃতপক্ষে করিডোর বাস্তবায়ন চলছে। দেশবাসীর সামনে এখন অনেক কাজ। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি দেশের বাইরে আমাদের বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র ও বিশেষজ্ঞদের কাছেও প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে গবেষণাপত্র পাঠাতে হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া আক্তার বানু
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভারতকে বিভক্ত করে রাখার সুযোগে নেগোসিয়েশনের জায়গাটা বাংলাদেশের বেশি। আসামসহ ৭ রাজ্যে সহজভাবে যাতায়াতে তাদের বাংলাদেশের সহযোগিতা দরকার, কিন্তু সে সহযোগিতার ধরন কী হতে পারে—সেটা নিয়ে কোনো গবেষণা-পর্যালোচনা করা হচ্ছে না। কেবল সুবিধা দেয়ার চেষ্টা চলছে। এ সুযোগ তো ভারত নেবেই। অবশ্যই আজ সর্বশক্তি দিয়ে দেশ ধ্বংসের করিডোর রুখতে হবে। এজন্য দেশবাসীকে একটি ইউনিফাইড শক্তিতে পরিণত করতে হবে। ভারতের সঙ্গে নেগোসিয়েশনে টিকে থাকতে সিটিজেন আর্মি গড়ে তুলতে হবে।

অধ্যাপক পিয়াস করিম
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
করিডোর রুখতে নাগরিক উদ্যোগ তৈরি করতে হবে। এসব উদ্যোগ দলীয় নয়, তবে রাজনৈতিক হবে। দুর্যোগের মাঝেও ইতিবাচক দিক আছে। আর সেটা হলো নিজের অধিকার নিয়ে জনগণ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। এজন্য জাতীয় ঐক্য গড়ার বিশাল সুযোগ রয়েছে। আন্দোলনকে সফল করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রভাবিত করতে হবে।

অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান
নির্বাহী পরিচালক, অধিকার
‘ভারতীয় শক্তির কাছে বাংলাদেশ নেহায়েত্ সামান্য’—এই বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেয়া চলবে না। মনে রাখতে হবে, কাশ্মীর থেকে মণিপুরে যে সংগ্রাম চলছে, আমরাও সে আদলে সংগ্রাম করে যাব। এজন্য রাজনৈতিক দলভিত্তিক নয়, তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের একটি প্লাটফর্ম দরকার।

রুহুল আমিন গাজী
সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন
সরকার নানাভাবে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের জালে বাঁধা পড়েছে। সেজন্য যে কোনো মূল্যে করিডোর দিতে সরকার উত্সাহী। যে কারণে লড়াইটা হতে হবে দেশের জনগণের। সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

সৈয়দ আবদাল আহমদ
সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব
বাংলাদেশের স্বার্থে যে কোনো মূল্যে করিডোর রুখতে হবে। এজন্য লড়াইয়ের প্লাটফর্ম ও কাঠামো দাঁড় করিয়ে পরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। জনগণকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যাকে যেভাবে জড়ানো সম্ভব, সেভাবেই তাদের কাছে আন্দোলনের আহ্বান উপস্থাপন করতে হবে।

অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান চৌধুরী
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভারত সবকিছু আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। এই আগ্রাসী অপতত্পরতা সম্পর্কে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এসব তুলে ধরা জরুরি। সরকার যেহেতু মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেহেতু আমরা যে যেখানে আছি—ক্লাসে, চায়ের টেবিলে, স্যুভেনির-সেমিনারে ভারতের আগ্রাসনের চিত্র তুলে ধরতে হবে।

আবদুল হাই শিকদার
কবি ও সাংবাদিক
লাখো শহীদের রক্তে ভেজা এই বাংলাদেশের মাটি আমাদের মায়ের পবিত্র জায়নামাজ। সেই জায়নামাজকে আমরা ভারতীয় বুটের নিচে পিষ্ট হতে দিতে পারি না। যে কোনো মূল্যে এই রাষ্ট্রবিনাশী করিডোর চক্রান্ত রুখতে হবে। দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসতে হবে এক প্লাটফর্মে। শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এদেশের মানুষ বুদ্ধিজীবীদের সম্মান করে। তাদের সামনে নিয়ে যখন আমরা শহরে-গ্রামে ছড়িয়ে পড়ব, তখন সারা দেশে এক আলোড়ন পড়ে যাবে। মানুষ জেগে উঠবে। আওয়াজ তুলতে হবে, জান দেব তবু করিডোর দেব না। রুখো করিডোর, বাঁচাও দেশ।

অধ্যাপক আবদুর রহমান সিদ্দিকী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সরকারের বক্তব্য যা-ই হোক, সচেতন মানুষ এরই মধ্যে বুঝে গেছে, ভারত করিডোর নিয়ে গেছে। এটার ফলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আমাদের উচিত হবে, সারা দেশে চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী ও তরুণদের মধ্যে একটি উদ্দীপনা তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া। এটা বোঝাতে হবে, ‘ভারতকে করিডোর প্রদানের ফলে আমাদের মানচিত্র ও পতাকা থাকবে, অর্থবহ স্বাধীনতা থাকবে না।’

অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
করিডোর রুখতে হবে আমাদের জাতীয় সার্থে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে আমরা সাম্রাজ্যবাদী ভারতকে কোনো অবস্থায়ই করিডোর দিতে পারি না।

অ্যাডভোকেট নাসিম আহমেদ
সুপ্রিমকোর্ট
দেশ আজ এক ক্রান্তিকালে। জনগণকে বলব, যেখানেই করিডোর সেখানেই দাঁড় করান প্রতিরোধ।

দিল্লি রাস্তা চায় : উপ-আঞ্চলিক যুদ্ধব্যবস্থার প্রস্তুতি

ফ র হা দ ম জ হা র
দিল্লি বাংলাদেশের বুক ভেদ করে ভারতীয় ভূখণ্ডের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সোজা ও সংক্ষিপ্ত রাস্তা চায়। এটাকে দিল্লি বলছে ‘ট্রানজিট’। ‘ট্রানজিট’ মানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সময় তৃতীয় কোনো দেশের মধ্য দিয়ে যাওয়া। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। নিজের দেশেরই মাল নিজের দেশে নিতে চায় দিল্লি, কিন্তু যেতে চায় অন্য দেশের ওপর দিয়ে। কিন্তু সেটাকে সে বলছে ‘ট্রানজিট’।
এটা যে ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ নয়, সেটা বোঝা কঠিন নয়। ভারতীয় মালপত্র বা পণ্য বাংলাদেশের স্থলপথ, জলপথ বা রেলপথের সঙ্গে যুক্ত যে কোনো বন্দরে যদি আসে তাহলে সেখান থেকে বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতেরই অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য সীমান্তের অন্য আরেকটি বন্দরে যেতে পারে। এই চলাচলে পণ্য বিচলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বা অভ্যন্তরীণ নিয়ম-কানুন খাটবে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এক পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় পণ্য আরেক পয়েন্টে এনে ভারতীয় পরিবহনের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। এটা ট্রান্সশিপমেন্টে। কিন্তু কোনো ধরনের ঝক্কিঝামেলা বাদ দিয়ে ভারতীয় পরিবহনেই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মাল নিতে চায় দিল্লি। এখন জলপথে নদী দিয়ে ভারতীয় মাল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পরিবহন করা যায়। কিন্তু দিল্লি চাইছে বাংলাদেশ তাকে রাস্তা দিক। ভারতের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পণ্য বা অন্য কোনো মালামাল পরিবহন করতে হলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড যদি মাঝখানে পড়ে তখন ঘুরপথে না গিয়ে দিল্লি সোজা যেতে চায়। যাওয়ার যে যুক্তি দিল্লি দেখায় সেটা অর্থনৈতিক যুক্তি। দিল্লির রাস্তা চাওয়ার দাবির অর্থনৈতিক যুক্তির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশেও অনেক অর্থনীতিবিদ বলে আসছেন, নিজের ভূখণ্ড দিল্লির মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করতে দিয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশের আয় করা উচিত। এখান থেকে নাকি আমরা বহু কোটি ডলার আয় করতে পারব। পরে দেখা গেল, তারা আমাদের ডাহা মিথ্যা বলেছেন। এক সময় প্রকাশিত হয়ে পড়ল যে, এখান থেকে আয় দূরের কথা এমনকি কোনো মাশুলও নাকি আদায় করা হবে না। তখন তারা হঠাত্ সুর বদলিয়ে বললেন, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট খারাপ। অবকাঠামো ঠিক নেই। দিল্লিকে রাস্তা দেয়ার জন্য ঠিকভাবে দেন-দরবার ও দরাদরির লোকজন নেই। এখন দিল্লিকে এই সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। বোঝা গেল জেনেশুনে মিথ্যা বলায় এখন তারা নিজেদের মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
রাস্তা ছাড়াও তো মাল রেলপথে যেতে পারে। যদি ভারতীয় পণ্য পরিবহনের খরচ কমানোই উদ্দেশ্য হয় তাহলে রেলপথেই খরচ সবচেয়ে কম হওয়ার কথা। প্রাণ ও পরিবেশের দিক থেকেও ক্ষতি কম। বড় বড় রাস্তা বানানোর জন্য জমিও নষ্ট করার প্রয়োজন হতো না। ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা তদারকির জন্যও সহজ হতো। কিন্তু দিল্লি শুধু রেলপথ চাইছে না, চাইছে শুকনা রাস্তা। রেলের বগি করে সীমান্তের রেলবন্দরে ভারতীয় মাল যদি আনা হয়, সেই বগি বাংলাদেশের ইঞ্জিন সীমান্তের আরেক রেলবন্দরে টেনে নিয়ে গিয়ে ভারতীয় রেলের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। যদি এই ট্রান্সশিপমেন্টে আপত্তি থাকে তাহলে ভারতীয় ইঞ্জিনই না হয় টেনে নিক। কিন্তু দিল্লি সেটা চাইছে না। দিল্লি চায় বাংলাদেশের শুকনা ভূখণ্ড দিয়ে ভারি ভারি বিশাল সব ট্রাক দিয়ে মাল আনা-নেয়ার ব্যবস্থা। সে ট্রাকগুলো কত বিশাল ও বিপুল হতে পারে তার নমুনা সম্প্রতি আমরা দেখেছি। পরীক্ষামূলক (তথাকথিত) ‘ট্রানজিট’ হিসেবে যে ট্রাকগুলো বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সম্প্রতি গিয়েছে তাদের দেখেই আমরা ধারণা করতে পারি দিল্লি আসলে কি চাইছে।
তাহলে ‘ট্রানজিট’ চাই বলে দিল্লি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা চায়, যা ভারি যানবাহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত। সে রাস্তা দিয়ে শুধু ব্যবসায়িক পণ্য আনা-নেয়া করা হবে না। বরং সামরিক যানবাহন ও সরঞ্জামও যেন এই রাস্তা দিয়ে আনা-নেয়া করা যায় সে ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে চাইছে দিল্লি। প্রয়োজনে সাজ-সরঞ্জামসহ সেনা বহরও যেন এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারে। এটাই দিল্লির মুখ্য উদ্দেশ্য। দিল্লি বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিচার করে একটি যুদ্ধব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি বলে মনে করে। ভূখণ্ডকেন্দ্রিক একটি উপ-আঞ্চলিক যুদ্ধ পরিকাঠামো ও যুদ্ধব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি ও তা বাস্তবায়নের সংকল্প দিল্লির শাসকদের দূরদর্শিতা প্রমাণ করে। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো, যারা ‘সেভেন সিস্টার’ হিসেবে পরিচিত, তারা নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের জন্য লড়ছে দীর্ঘদিন ধরে। বিদ্রোহ দমন করা এবং এই রাজ্যগুলোকে সামরিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে রাখা দিল্লির দরকার। ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে তাদের আরও ঘনিষ্ঠ ও সম্পৃক্ত করাও দিল্লির নিরাপত্তা নীতির অংশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শক্তিশালী দেশ হিসেবে চীনের আবির্ভাব। চীনের সঙ্গে সামরিক শত্রুতার সম্ভাবনাও দিল্লিকে এখন বিবেচনা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত থেকে চীন খুব কাছে। মাঝখানে সঙ্কীর্ণ একটি ভারতীয় ভূখণ্ড। চীন চাইলে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলকে আলাদা করতে পারে। বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিল্লির প্রতিরক্ষা চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে—সেটাই স্বাভাবিক।
অতএব দিল্লি যদি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি উপ-আঞ্চলিক যুদ্ধব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তাগিদ বোধ করে এবং তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে তাহলে সেখানে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এখানে দিল্লির কোনো গোপন ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, বাংলাদেশের সীমান্ত-সংশ্লিষ্ট ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর রাজনীতি, শক্তিশালী দেশ হিসেবে চীনের আবির্ভাব ও ভারতের সঙ্গে চীনের সামরিক-অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার বাস্তবতাকে মনে না রেখে দিল্লির ‘ট্রানজিট’ চাওয়াকে নিছকই পণ্য পরিবহন, বাণিজ্য বা অর্থনীতির ব্যাপার বলে ক্রমাগত প্রচার করা হয়েছে। এখনও ক্রমাগত এই প্রচারটাই চলে। বাংলাদেশে এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশকে মুখ্য করে তোলার উদ্দেশ্য হচ্ছে দিল্লির সামরিক উদ্দেশ্যকে আড়াল করা। দিল্লি বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে তার সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি দ্রুত সম্পন্ন করতে চাইছে। একটি যুদ্ধব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রেল বা নদীপথ নির্ণায়ক নয়। শুকনা মৌসুম ছাড়াও ভারি সাজ-সরঞ্জাম বহনের দিক থেকে নদীর নাব্য নিশ্চিত রাখা কঠিন এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অসম্ভবও। অতএব বাংলাদেশের বুক ভেদ করে দিল্লির রাস্তা দরকার যাতে ভারতের ভূখণ্ডকে পূর্ব-পশ্চিমে যেভাবে কার্যত ভাগ করে বাংলাদেশ ভূকৌশলগত আপদ হয়ে আছে তার একটা ব্যবস্থা করা যায়।
বাংলাদেশে দিল্লিকে ‘ট্রানজিট’ দেয়ার যারা বিরোধিতা করেন তাদের প্রচারের ধারা হচ্ছে এই যে, এটা আসলে ‘ট্রানজিট’ নয়, এটা আসলে ‘করিডোর’। কিন্তু আমরা যেদিকে দৃষ্টি দিতে চাইছি সেদিকে নজর ঠিক না রেখে শব্দ, পরিভাষা বা সংজ্ঞা নিয়ে টানাহেঁচড়া অর্থহীন। ট্রানজিটকে করিডোর বা করিডোরকে ট্রানজিট বললে উপ-আঞ্চলিক যুদ্ধব্যবস্থার গড়ে তোলার যে তাগিদ ও পরিকল্পনার কথা ভেবে দিল্লি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রাস্তা চাইছে, তার গুরুত্ব আমরা বুঝব না। শব্দের ব্যবহার সেই গুরুত্বে কোনো হেরফের ঘটায় না। বিষয়টিকে আমাদের অবশ্যই দিল্লির সামরিক ও নিরাপত্তা চিন্তার দিক থেকে বোঝাই সমীচীন। সেই আলোকে বাংলাদেশের সামরিক ও নিরাপত্তার প্রশ্নকে মুখ্য ধরে নিয়ে তার অধীনে পণ্য, বাণিজ্য বা সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ বা লাভালাভ বিবেচনা করাটাই বাংলাদেশের নীতি হওয়া উচিত।
দিল্লিকে রাস্তা দেয়া ‘ট্রানজিট’ নয় সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই, কিন্তু এটা যে ‘করিডোর’ নয় সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলছেন, ‘ভারতকে আমরা করিডোর দিচ্ছি বলে যারা অপপ্রচার চালান, তারা করিডোরের সুনির্দিষ্ট অর্থ না বুঝেই মন্তব্য করেন। করিডোর দেয়ার মানে কোনো দেশকে বিশেষ কোনো অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয়া। দেশের সার্বভৌমত্ব দিয়ে দেয়া। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তো আমরা তা করছি না। কাজেই এসব কথা যারা বলেন, তারা বিতর্ক উস্কে দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেন। আর আমরা তো আমাদের বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ করে ভারতকে ট্রানজিট দেব না’ (দেখুন, প্রথম আলো ৪/১৯/২০১১)।
গওহর রিজভী রাস্তার ওপর সার্বভৌম এখতিয়ার বা আইনি দখলদারি নিয়ে কথা তুলে মূল প্রশ্ন অনায়াসেই এড়িয়ে যেতে পেরেছেন। সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক করলে এই ধরনের কুতর্কেই খামাখা জড়াতে হবে। আসলে তো ভারত বাংলাদেশে নিছক ‘করিডোর’ চাইছে না। বরং পুরা বাংলাদেশকেই দিল্লির সামরিক ও নিরাপত্তা বলয়ের অধীনে করতে চাইছে। তার জন্যই রাস্তা দরকার। একই সঙ্গে দরকার নদীপথ, রেলপথ ও সমুদ্রবন্দর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরের সময় (২০১০-এর ১১ জানুয়ারি) ৫০ দফার যে যৌথ ইশতেহার ঘোষিত হয় তার ২২ নম্বর দফায় আশুগঞ্জ বন্দরকে শুধু বিশাল আয়তন ও ওজনের (over dimensional cargo) মালামাল পরিবহনের জন্যই নয় বরং ‘পোর্ট অব কল’ ঘোষণা করে সার্বক্ষণিক পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই দফার বাস্তবায়ন করতে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান নদীপথে ট্রানজিটের প্রটোকল সংশোধন করা হয়েছে খুবই তাড়াতাড়ি। বিশাল আয়তন ও ওজনের মালামাল পরিবহনের জন্য আশুগঞ্জ থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত রাস্তা তৈরি হচ্ছে। যৌথ ইশতেহারের ২৩ নম্বর দফায় ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দেয়া হয়েছে। পণ্য পরিবহন করতে ভারতকে সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের অনুমতি দেয়ার কথাও এই দফায় বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং আশুগঞ্জ নদীবন্দর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দিল্লি যেন বাংলাদেশের রাস্তা ব্যবহার করতে পারে সে কথাও বলা আছে ইশতেহারে। অর্থাত্ সমুদ্রবন্দরসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক ভূখণ্ড ব্যবহারেরই অনুমতি দেয়া হয়েছে দিল্লিকে। দিল্লি তার সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ডালপালা বঙ্গোপসাগর অবধি বিস্তৃত রাখতে চায়। যদি সমুদ্রসহ পুরো বাংলাদেশই দিল্লির রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ের অধীন একটি পরাধীন রাষ্ট্র হয়ে থাকে, তাহলে একটি রাস্তার ওপর ভারতের সার্বভৌম অধিকার থাকুক বা না থাকুক তাতে কী এসে যায়? রিজভী নিশ্চিত করেছেন, দিল্লিকে আগে নৌপথ ও রেলপথ ব্যবহার করতে দেয়া হবে, তারপর রাস্তা ঠিক করে রাস্তা দেয়া হবে। তবে নতুন যে কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছেন সেটা হচ্ছে এসবের জন্য ভারতের সঙ্গে নতুন কোনো চুক্তিরও দরকার নেই। কারণ ’৭২-এ সম্পাদিত দুই দেশের বাণিজ্য চুক্তিতেই ট্রানজিটের সুরাহা হয়েছে। এখন দিল্লিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার নেটওয়ার্ক করে দেয়াই কাজ। ’৭২-এর চুক্তি ধরে এখন শুধু রাস্তার রুট কী হবে, কোন প্রক্রিয়ায় পণ্য পরিবহন হবে—এসব নির্ধারণের জন্য কাজ করছে সরকার। এই যখন অবস্থা তখন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে উত্কণ্ঠা ফাঁপা বেলুনের অধিক কিছু অর্থ বহন করে না। করিডোর/ট্রানজিটের তর্কও অর্থহীন মনে হয়। বাংলাদেশ তো দিল্লিকে তাহলে বাহাত্তর সালেই সব দিয়ে দিয়েছে। তাই কি?
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে দিল্লির রাস্তা চাওয়াকে সামরিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে বিচার করার ওপর জোর দিচ্ছি যেন আমরা হুঁশে আসতে পারি। বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর জনগণের বিরুদ্ধে দিল্লি সামরিক দমনপীড়ন চালাক এটা বাংলাদেশ চাইতে পারে না। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো শত্রুতার সম্পর্ক নেই যে ভারতের উপ-আঞ্চলিক যুদ্ধব্যবস্থার অধীনে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে আমাদের বিকিয়ে দিতে হবে। এই অঞ্চলে চীন-ভারত সামরিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে ভারতের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দেব কেন আমরা? বাংলাদেশকে সব সময়ের জন্য সম্ভাব্য যুদ্ধের ময়দান বানিয়ে রাখা আমাদের নীতি হতে পারে না। এ অবস্থান থেকেই দিল্লিকে বাংলাদেশে রাস্তা বানিয়ে তা ব্যবহার করতে দেয়ার বিরোধিতা করতে হবে আমাদের।
এই বিরোধিতাকে যারা কুতর্কে পর্যবসিত করতে চান তারা বলবেন ভারতের সঙ্গে কি বাংলাদেশ কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না? অবশ্যই করবে। সেটা কি তর্কের বিষয়? কিন্তু দিল্লি কি সেটা করতে দিয়েছে বা করতে দেবে? বাংলাদেশের পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে। যে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তা পূরণের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনের জন্য দিল্লি রাস্তা চাইছে না। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলে ভারতেরই পণ্য পরিবহনের জন্য রাস্তা চাইছে।
শুধু ভারত কেন, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে চীনের সঙ্গে। কিংবা চীনের সঙ্গেও বা শুধু কেন, সেটা মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও অন্য যে কোনো দেশের সঙ্গে। দিল্লিকে রাস্তা দেয়াকে যারা ‘কানেকটিভিটি’ বলে আওয়াজ তুলতে পছন্দ করেন তারা তাদের নতুন পরিভাষার সাফাই গাইতে গিয়ে বলেন আমরা ভুটান ও নেপালকেও ‘কানেকটিভিটি’ দেব। দিল্লি আমাদের নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেবে। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে রাজনৈতিক কারণেই। কিন্তু টাকার হিসাবে ব্যবসার পরিসর এই দেশগুলোতে খুব সীমিত। এই দেশগুলোতে পণ্য ও মানুষ চলাচলের ওপর বাধাই এখন অপসারিত হয়নি, সেখানে দিল্লিকে রাস্তা দেয়ার ব্যাপারকে ‘কানেকটিভিটি’ বললে দারুণ হাস্যকর শোনায়। ডিম ভাজাকে ওমলেট বললে সেটা ডিম ভাজাই থাকে, সেখান থেকে কোনো ঐশ্বরিক শক্তিতে মুরগির বাচ্চা পয়দা হয় না।
আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেই দিল্লির এই উপ-আঞ্চলিক যুদ্ধাবস্থার প্রস্তুতি, তার তাগিদ এই বাস্তবতার মধ্যেই নিহিত। এ অঞ্চলে দিল্লি চীনের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের প্রতিরক্ষা নীতির সহায়ক। সে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলো করিডোর বা ট্রানজিটের পক্ষে থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। দিল্লি এটা অর্জন করতে চায় বাংলাদেশকে তার বন্ধু হিসেবে নয়, বরং একটি দখলদার শক্তি হিসেবে। বাংলাদেশের চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া এবং নির্বিচারে সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যার মধ্য দিয়ে দিল্লিকে চেনা যায়। এমনকি শেখ হাসিনা দিল্লির সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষা করার পরও তিস্তার পানি পাননি। তার ভাগ্যে সেটা জোটেনি। সেটা প্রতিশ্রুতি হয়েই ঝুলে রয়েছে। এখন দিল্লি টিপাইমুখ প্রকল্পও বাংলাদেশের আপত্তি ও জনগণের প্রতিবাদ সত্ত্বেও বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বিকাশের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি দিল্লির স্বার্থের অনুকূল। কিন্তু দিল্লি সেটা চায় না বা সেই পথে যেতে চায় না—এখানেই বিপদের জায়গা।
এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, দিল্লি কালই বাংলাদেশ হজম করে ফেলবে। বাস্তবতাকে বোঝা ও সেই বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার জন্যই উপ-আঞ্চলিক যুদ্ধ প্রস্তুতির বিষয়টি আমরা আলোচনা করেছি। এই বাস্তবতা যত তাড়াতাড়ি আমরা উপলব্ধি করব তত তাড়াতাড়ি আমাদের কি করতে হবে সেটাও আমরা বুঝব। তবে বাংলাদেশের জন্য বিপদের কারণ বাংলাদেশ নিজেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বাংলাদেশকে ভেতরে ভেতরে ক্ষয় করে ফেলেছে। দুই বৃহত্ দলের বিরোধ, প্রতিহিংসা ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার রাজনীতি চরমে গিয়ে পৌঁছেছে। দিল্লির হুকুম তামিল করেই দুটো দল ক্ষমতায় যেতে ও ক্ষমতায় থাকতে চায়। বাংলাদশ এই অভিশাপ থেকে মুক্ত না হলে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু রাজনীতিবিদরা শুধু নয়, প্রকাশ্যে নির্লজ্জভাবে দিল্লির স্বার্থ রক্ষা করে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই বাংলাদেশে। দিল্লিকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রাস্তা দেয়ার জন্য যে বিপুল উত্সাহ ও প্রচারণা তাতে এটা পরিষ্কার বাংলাদেশের জনগণকে সবার আগে নিজের ঘর সাফ করেই দিল্লির মোকাবিলা করতে নামতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ লড়াই একই সঙ্গে দিল্লির মোকাবিলা, বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। রাজনৈতিক লড়াইটা নিজের ঘরের মধ্যে।
এতটুকু বুঝতে পারলে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে যেতে পারবে।
৪ ডিসেম্বর ২০১১। ২০ অগ্রহায়ণ ১৪১৮। শ্যামলী।

ট্রানজিট-করিডোর ও সাম্প্রতিক রাজনীতি

তা লু ক দা র ম নি রু জ্জা মা ন
দেশে এখন শ্বাসরুদ্ধকর ও সংঘাতময় অবস্থা বিরাজ করছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনা সরকারের একদলীয় আচরণ তীব্র রূপ নিয়েছে। রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার, ‘আমার দেশ’ পত্রিকা বন্ধ করে সম্পাদককে গ্রেফতার ও কারা নির্যাতন, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া, সংবাদপত্রের সম্পাদকদের হুমকি প্রদান, টকশো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টার মতো একের পর এক বাকস্বাধীনতা হরণের ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রধান বিরোধী দল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুত্ ও গ্যাসের অভাব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ এমন বহুবিধ এজেন্ডা নিয়ে সরকারের পদত্যাগ ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি করে আসছে।
বিএনপির আন্দোলন ব্যাপক ও তীব্র করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার আন্দোলনের সঙ্গে আরেকটি এজেন্ডা যোগ করা জরুরি মনে করি তা হলো, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার। ট্রানজিট কার্যকর হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আওয়ামী লীগ সরকার ও কিছু বুদ্ধিজীবী তা আমলে আনতে নারাজ। আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদরা একসময় বলেছিলেন, ট্রানজিট দিলে শত শত মিলিয়ন ডলার আয় হবে। এখন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বলছেন, ট্রানজিটের জন্য ফি চাওয়া হবে অসভ্যতা। অর্থাত্ ফি ছাড়াই এখন সরকার ট্রানজিট দেয়ার জন্য প্রস্তুত। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এক সদস্যকে কিছুদিন আগে টেলিভিশনে বলতে শুনেছি সার্বভৌমত্বের ব্যাপারটি মানসিক। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি যুদ্ধ করে আমরা মানসিকভাবে স্বাধীন। আমাদের স্বাধীনতা কেউ খর্ব করবে না। শুধু মানসিকভাবে স্বাধীন হলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। ইউরোপের সবচেয়ে স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি পোল্যান্ড। পোলিশরা স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রায় একশ’ বছর ইউরোপের দুটি বড় শক্তি জার্মানি-অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। সবশেষে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানি পদানত হয়েছে। কথিত আছে পোলিশরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ঘোড়ায় চড়ে জার্মানির ট্যাংকের মোকাবিলা করে। বেলজিয়াম, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া স্বাধীনচেতা কিন্তু তারা স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারেনি। আফগানরা ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি হিসেবে পরিচিত। তারা দীর্ঘ যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার দখলদারি প্রতিহত করলেও এখন আবার আমেরিকান ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। শুধু স্বাধীন মনোভাব দিয়ে দেশ রক্ষা করা যায় না।
প্রকৃতপক্ষে ট্রানজিটের নামে ভারত সরকারকে করিডোর দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামীদের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি ছাড়াও এর প্রভাব অনিবার্য বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ওপর পড়বে। কারণ এ ধরনের করিডোর সামরিকভাবে ব্যবহারের ঝুঁকি থাকবে। চীন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত সমস্যা রয়েছে। চীন পূর্ব ভারতের বিশাল স্থলভাগ এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের একাংশের দাবিদার। ভারত-চীন সুপারপাওয়ার প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষের দিকটি উড়িয়ে দেয়া যায় না। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের কথা আমাদের স্মরণে আছে। এ রকম যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বাংলাদেশকে কোনো তোয়াক্কা না করেই ভারত ট্রানজিটকে সামরিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করবে। এর ফলে বাংলাদেশ ও চীনের কৌশলগত সম্পর্ক চরমভাবে ব্যাহত হবে।
এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ট্রানজিটের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি আর বেড়ে যাবে। ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের উত্পাদনমুখী পণ্যগুলো ভারতের পণ্যের সঙ্গে টিকে থাকা কঠিন হবে। এর ফলে বাংলাদেশের শিল্পখাত বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। একসময় পূর্বপাকিস্তান যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের বাজারে পরিণত হয়েছিল ভারত ট্রানজিটের সুবিধা পেলে একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ হবে ভারতের কলোনিয়াল ইকনোমি। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি ট্রানজিট দেয়ার পক্ষে ইউরোপের তুলনা করেন। কিন্তু তারা এ কথা ভুলে যান ইউরোপের দেশগুলোর শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় সমান। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র সম্পূর্ণ অন্যরকম। ভারতের অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ছোট। যেকোনো অর্থনীতির ছাত্র বোঝে উন্নত দেশের অর্থনীতির সঙ্গে অনুন্নত দেশের অর্থনীতির সংযোগ অর্থনীতির সূত্রের কারণে অনুন্নত দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বড় অর্থনীতি ছোট অর্থনীতিকে গ্রাস করে। ট্রানজিট শেষপর্যন্ত বাংলাদেশীদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। আমার মনে হয় বিরোধীদলগুলোর এ ইস্যুতে অনেক আগেই আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত ছিল।
ট্রানজিট বা করিডোর দেয়ার ব্যাপারে ভারতবান্ধব দুই উপদেষ্টা এসব বিষয় ঠিক করছেন। ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে উদ্বেগের আরও অনেক কারণ আছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এতই ভারতবান্ধব যে আগেরবার ক্ষমতায় এসে কলকাতা সফরে গেলে তাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছিল, তিনি তার প্রতিবাদ করেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে এবার ভারতীয় সাংবাদিক বাংলাদেশকে পাকিস্তানের বাফার স্টেট বললেও তিনি প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। এখন বাংলাদেশ আর্মির পাসিং আউট প্যারেডে স্যালুট নেন ভারতীয় সেনাপ্রধান। বাংলাদেশ করদরাজ্য হতে আর কত দেরি? সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এখনই রুখে দাঁড়ানোর সময়।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় অধ্যাপক

আটাশ বছর পর ট্রানজিট দিতে যাব কেন?

এ না য়ে তু ল্লা হ খা ন
ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট নিয়ে এ ধরনের আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এখানে শুধু রাজনীতি ও ব্যবসা জড়িত নয়, আরও একটি বড় বিষয় জড়িত। তাহলো নিরাপত্তার প্রশ্ন। এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে আলোচনার প্রয়োজন আছে, ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে। এসব নিয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্বের সম্পর্ক নেই।
ট্রানজিটের সঙ্গে বহুপক্ষীয় বা আঞ্চলিক বাণিজ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। ট্রানজিটের যে সংজ্ঞা রয়েছে মন্ত্রিকে তা স্বাভাবিক কারণে পাল্টাতে হয়েছে। কারণ এটি হচ্ছে একটি দেশের একটি অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে পণ্য পরিবহন করা। এ পরিবহন তাদের যানবাহনের মাধ্যমে হবে কিংবা আমাদের।
এই ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট থেকে আমরা প্রকৃত কী পাব তা জানতে হবে। ভারত আমাদের পঁচিশটি পণ্যের বিনাশুল্কে প্রবেশাধিকার দিতে বাধ্য। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়মের মধ্যেই তা আমরা পেতে পারি। প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমের কাছে আমাদের প্রাপ্তির যে হিসাব দিয়েছেন তাতে আমরা বিভ্রান্ত। এখন দেখতে হবে আমরা কেন ভারতকে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা দেব? এটা আমাদের স্বার্থ নয়, ভারতের স্বার্থ। ভারত কী সত্যিই এ ব্যাপারে আমাদের চাপ দিচ্ছে? যদি গত ২৬ বছর ধরে এ সুবিধা ছাড়াই ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পাঠাতে পারে হঠাত্ কেন আজ আমরা নিজের স্বার্থের কথা পুরোপুরি বিবেচনা না করে বা আমাদের স্বার্থ যদি তেমন না থাকে তাহলে আমরা এ সুবিধা দেব কেন? বরং এ ব্যাপারে সাপটার মধ্যে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করব।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিষয়টি প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ভারত বা উন্নত দেশগুলোর কাছে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাইতে পারি। সবকিছু করতে হবে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আওতায়। সাপটার আওতায় যদি বহুমুখী যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয় তাহলেই একমাত্র বাংলাদেশ তার ভূকৌশলগত অবস্থান থেকে শিল্পায়িত হতে পারবে। নাহলে ট্রানজিট হোক আর নাই হোক কখনো পারবে না। বাংলাদেশ মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রপ্রদেশের বাজারে পরিণত হবে। কারণ, আমাদের বারোকোটি লোকের বাজারে বোম্বে থেকে সহজেই মাল সরবরাহ করা সম্ভব। এখন হরলিক্স এ কাজ করছে, লিভার ব্রাদার্স করছে। তারা এখানে উত্পাদন কমিয়ে দিয়েছে। তারা ওখান থেকে মাল নিয়ে আসছে। কিন্তু যে মুহূর্তে আন্তঃমহাদেশীয় ট্রানজিট হবে, পুঁজি ও মালের অবাধ প্রবাহ হবে তখনই বাংলাদেশে প্রচুর শিল্প চলে আসবে। কারণ, এ অঞ্চলে শুধু আমাদের বারোকোটি লোকের বাজার ছাড়াও পূর্ব-ভারতের একাংশ, উত্তর-পূর্ব ভারতের পুরো অংশ, নেপাল ও ভুটানের বাজার পাওয়া যাবে। বোম্বে বা অন্য জায়গার চেয়ে এখানে শিল্প স্থাপন করলে লাভের পরিমাণ বাড়বে। তাছাড়া, আমাদের অবকাঠামো মোটামুটি ভালো।
এখন, ভারতকে বিশ্বাস করা যায় কি না—এ প্রশ্ন আমাদের অবচেতন মন থেকেই গেছে। দহগ্রাম, আঙ্গরপোতা এসবের কথা না হয় বাদ দিচ্ছি। তারপরও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টেটের মধ্যেই থেকে গেছে। ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে এক পোলট্রি ফার্মার আবদুল্লাহ লুিফ ক্যুনা কী করল অমনি ভারত সেখানে সৈন্য নিয়ে হাজির। শ্রীলঙ্কায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। ভারতের এই যে দৃষ্টিভঙ্গি এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। আজকে বাংলাদেশে কিছু হলে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। আর উত্তর-পূর্ব ভারতে কিছু হলে আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না? এ কথা সত্য যে, ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক এক রকম। আমাদের সম্পর্ক আরেক রকম। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের আজন্ম শত্রুতার সম্পর্ক। ভারতের সঙ্গে নেপালের সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও জনৈক কূটনীতিককে নেপালি রাজার সম্পর্কে বলতে শুনেছি ‘আমরা ওকে টেনে নামাবো’। আসলে প্রতিবেশীদের সম্পর্কে ভারতের মনোভাব এই রকম।
জওহরলাল নেহরু তার ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ব্যাপারে তার মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেছেন। সেই মনোভাব এখনও ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে চালনা করছে। তাই, দিল্লিতে বিজেপি সরকার হোক, কংগ্রেস সরকার হোক বা জ্যোতি বসুর সরকারই হোক, তাতে কিছু যাবে আসবে না। সুতরাং, একটা কথা বলা যায়, ভারতের এই কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। জেএন দিক্ষিতের বই পড়ুন। সেখানেও একই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
তাছাড়া আমাদের যে পূর্ব-অভিজ্ঞতা রয়েছে তা ভারত কীভাবে দূর করবে? হ্যাঁ, আইকে গুজরালের আমলে কিছুটা পরিবর্তন এসেছিল। তারপরও কোনো বাস্তব বিষয় নিয়ে আলোচনার সময়ে কী ভারত তার ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টেটের চিন্তাভাবনা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে! ভারত নিজেকে এখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি বলে মনে করে। এখান থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যত বাস্তব, রাষ্ট্রনৈতিকভাবে যত নৈতিক এবং ব্যবসায়িকভাবে যত লাভজনক হোক না কেন, যে কোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সন্দেহের উদ্রেক করবে।
আমাদের সুবিধা হলো, আমরা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় প্রবেশ করেছি। সেখানে তো আমাদের কোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রয়োজন নেই। আর ২৮ বছর বাদে ট্রানজিটই বা দিতে যাব কেন? মাত্র এক কোটি লোকের বাজারে ব্যবসার জন্য? এ ব্যবসা ভারতের কাছে কিছুই না। ভারতের অন্যকোনো বাধ্যবাধকতা আছে! সেটার মধ্যে কী আমরা জড়িয়ে পড়ছি? আর যদি ভারত না চায় কেন বর্তমান সরকার আগবাড়িয়ে এসব দিচ্ছে? এ প্রশ্নগুলো কিন্তু উঠবে।
রচনাকাল : ৮ অক্টোবর ১৯৯৯

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন