রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১১

যশোরে গোলটেবিল : পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে

‘ফারাক্কা থেকে টিপাইমুখ : বাংলাদেশের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিলে আলোচকরা বলেছেন, টিপাইমুখ, ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা ব্যারেজ, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প—সবই বাংলাদেশের স্বার্থপরিপন্থী। ফলে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একমাত্র ঐক্যবদ্ধ জাতিই এই বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।
মুক্তি আন্দোলন নামে একটি পাঠচক্র গতকাল প্রেস ক্লাব যশোর মিলনায়তনে এই গোলটেবিলের আয়োজন করে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মুক্তি আন্দোলনের মুখপাত্র লেখক, গবেষক বেনজীন খান। আলোচনায় অংশ নেন যশোর সরকারি সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক নার্গিস বেগম, নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট শেখ আবদুস সবুর, যশোর জেলা বিএনপির সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, যশোর পৌরসভার মেয়র মারুফুল ইসলাম, ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনামুল হক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল হোসেন, দৈনিক প্রভাতফেরী সম্পাদক ফকির শওকত, জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সহিদুল আলম সদু, যশোর ইনস্টিটিউটের সহকারী সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ তোতা, লেখক মুস্তাফিজুর রহমান কাবুল, প্রেস ক্লাব সম্পাদক আহসান কবীর, পাকশিয়া আইডিয়াল কলেজের সহকারী অধ্যাপক শেখ মফিদুল ইসলাম, মহিলা কলেজের শিক্ষক এরফানুল হক শোয়েব, ডা. আবদুর রাজ্জাক কলেজের শিক্ষক জুলফিকার আলী প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মুক্তি আন্দোলনের সদস্য ফজলে রাব্বী মোপাসা। সঞ্চালক ছিলেন একই সংগঠনের সদস্য মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু।
গোলটেবিলে অধ্যাপক নার্গিস বেগম বলেন, ছোট রাষ্ট্র হলেও আমরা মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। বন্ধুত্বের ছদ্মাবরণে ভারত আমাদের মর্যাদা, স্বার্থ লুণ্ঠন করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের বিচক্ষণতার অভাব অথবা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা অন্য কোনো দেশের প্রতি আনুগত্যের কারণে ফারাক্কাসৃষ্ট দুর্দশা ভোগ করছি। তিনি বলেন, ব্রহ্মপুত্রের উত্সমুখে চীন বাঁধ নির্মাণ করতে চাইছে। চীনের কাছ থেকে ভারত যে আচরণ আশা করে আমরাও ভারতের কাছ থেকে একই আচরণ আশা করি।
অ্যাডভোকেট শেখ আবদুস সবুর বলেন, ফারাক্কা-টিপাইমুখ সমস্যা সমাধানে জাতীয় ঐকমত্য দরকার। তিনি বলেন, অভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত যে স্বস্তিতে থাকবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। এদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এখানকার মানুষ কাজের জন্য ভারতের শহরগুলোতেই ভিড় জমাবে। কোনো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, গুলি করে জনস্রোত ঠেকানো যাবে না। তিনি ভারতের সমপ্রসারণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে বলেন, জুজুর ভয়ে ঘরে বসে না থেকে ভারতের বাংলাদেশবিরোধী তত্পরতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, ফারাক্কায় পরীক্ষামূলক বাঁধ চালুর সময়ও ভারত একই রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ফারাক্কার কারণে দেশের একাংশ মরুভূমি হতে চলেছে। সে কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বক্তব্যে বিশ্বাস করার সুযোগ নেই। টিপাইমুখ ইস্যুতে বিরোধীদলীয় নেত্রীর উদ্যোগের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, সরকার টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলেই বিরোধী নেত্রী উদ্যোগী হয়েছেন। সরকারের উচিত বরং তাকে সহযোগিতা করা।
মারুফুল ইসলাম বলেন, আমাদের রাজনৈতিক বিরোধের সুযোগে ভারত একের পর এক অভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে চলেছে। সামাজিক আন্দোলন বেগবান করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। না হলে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ করেই ছাড়বে।
প্রফেসর আবুল হোসেন বলেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুর রাজ্য সরকারের সঙ্গে টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে কথা বলে। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কোনো কথা বলে না। এটি কীভাবে সম্ভব? আমাদের পররাষ্ট্র নীতির দুর্বলতার কারণে ভারত এমন একতরফা কাজ করতে পারছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ফকির শওকত বলেন, টিপাইমুখে বাঁধ হলে যশোরবাসীর প্রত্যক্ষ কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু ফারাক্কার ক্ষতির ধরন কী, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসী তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। সে কারণে ভারত আরেকটি ফারাক্কা যাতে গড়তে না পারে সে ব্যাপারে দক্ষিণ-পশ্চিমের মানুষ ঐক্যবদ্ধ থেকে লড়াই-সংগ্রাম করবে।
সহিদুল আলম সদু বলেন, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নদী নিয়ে আলোচনা হয়। তাহলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পানি নিয়ে আলোচনা হবে না কেন? তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের দিল্লিপ্রীতি বেড়েছে—যা জাতির জন্য সুখকর নয়। জাতীয় ইস্যুতে বিভেদের সুযোগ নেই। জাতীয় স্বার্থে সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে হবে।
আবু সালেহ তোতা বলেন, পরিবেশের ওপর মানুষ হস্তক্ষেপ করলে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবেই। ভারত যা করছে, তা নিজের স্বার্থেই। কিন্তু আমরা কী করছি? আমরা দেশটাকে বিকিয়ে দিয়েছি। ব্যক্তি স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছি না।
মুস্তাফিজুর রহমান কাবুল বলেন, উজানে বাঁধ দেয়া হলে ভাটিতে কী হয়, তা আমরা জানি। তিনি টিপাইমুখসহ ভারতের সব প্রকৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারত-বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন সমস্যা সমাধানে দ্বিপক্ষীয় নয়, বহুপক্ষীয় আলোচনা দরকার। বাংলাদেশ-ভারত পানি সমস্যা সমাধানে প্রতিবেশী চীন, নেপাল প্রভৃতি রাষ্ট্রকে যুক্ত করতে হবে।
আহসান কবীর বলেন, ফারাক্কা বাঁধের কারণে যে বাংলাদেশের একাংশ মরুভূমিতে পরিণত হবে মওলানা ভাসানী তা ৩৫-৪০ বছর আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। আমাদের রাষ্ট্রনায়করা তা এখনও বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না। তিনি বলেন, ভারত যে টিপাইমুখে বাঁধ করবেই—এ কথা বাংলাদেশ সরকার অনেক আগেই জানত। কিন্তু জাতিকে তা জানতে দেয়নি। তাদের ভারত-তোষণ নীতির ফল ভোগ করছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। তিনি তিস্তা সেচ প্রকল্প, জিকে প্রজেক্ট, সুন্দরবন, দক্ষিণ-পশ্চিমে মরুকরণসহ নানা ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ চালু হলে দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিণতিও হবে এমনই।
এরফানুল হক শোয়েব বলেন, আমাদের সভ্যতা নদীকেন্দ্রিক। এই নদীগুলোকে একের পর এক মেরে ফেলছে ভারত। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুখের কথার কোনো মূল্য নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মুখে মুখে যে আশ্বাস দিয়েছেন তার কোনো দাম নেই।
মূল প্রবন্ধে বেনজীন খান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত হিমালয় অঞ্চলে ৭৪টি বাঁধ নির্মাণ করেছে। নির্মাণ করছে আরও ৩৭টি। এ পর্যন্ত দেশটি ৪ হাজার ৩০০টি বৃহত্ ড্যাম নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। নির্মাণাধীন রয়েছে অনেকগুলো। ভারত এরই মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ বাঁধ নির্মাণকারী দেশে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা শুধু নিজ দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপরই আঘাত করছে না, সর্বনাশ করছে ভাটির দেশ বাংলাদেশের। তিনি দল-মত নির্বিশেষে আগ্রাসী ভারতের এই তত্পরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন