শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১১

মরুভূমির সেই বেদুঈন, যিনি গল্পও লিখতেন
প্রমিত হোসেন

মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি যেদিন নিহত হলেন, সেদিন পৃথিবী হারাল এক নিভৃতচারী গল্পকারকেও। এই লেখককে নিয়ে কখনও হয়নি কোনও মাতামাতি, উল্লেখযোগ্য আলোচনা, কিংবা প্রশংসাকীর্তন। তার নিজেরও এসবে আগ্রহ ছিল কম। শুধু নিজের মতো লিখে গেছেন মরুভূমির তাঁবুর নিচে। যেন এক নিঃসঙ্গ কবি। যেন মরুভূমির বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি ছিল তার লেখার খাতা। তার সঙ্গে কথা বলত রুক্ষ পাহাড়, ইস্পাতনীল দিগন্ত, রক্তিম চাঁদ আর দূরবর্তী নক্ষত্র। তার বক্ষপিঞ্জরে স্পন্দিত হত প্রকৃতিবাদী বেদুঈনের হƒদয়।

গাদ্দাফির মৃত্যু এক লেখকের মর্মান্তিক মৃত্যু। তার লেখায় পাইÑ‘পৃথিবীকে হত্যা কোরো না, তোমাদের জীবনকে হত্যা কোরো না। পৃথিবী হচ্ছে পানি ও সঞ্জীবনী। দালানকোঠায় ঢাকা মৃত ভূমি দিতে পারে না এই পানি ও সঞ্জীবনী। মৃত পৃথিবীতে নেই প্রাণের কোনও স্পন্দন।’
ুয়াম্মার আল গাদ্দাফি সম্পর্কে যাদের প্রশ্ন আছে, তারা সেসব প্রশ্নের কিছু উত্তর খুঁজে পাবেন তার লেখকসত্তায়, বিশেষ করে তার লেখা ছোটগল্পের মধ্যে। গাদ্দাফির ‘দি গ্রিন বুক’ সম্পর্কে কম-বেশি অনেকেই জানেন। মূল আরবি ভাষায় দি গ্রিন বুক প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। বইটিতে প্রতিফলিত হয়েছে গাদ্দাফির রাজনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তাধারা। একদিকে তিনি কমিউনিস্টবিরোধী, অন্যদিকে পশ্চিমা পুঁজিবাদেও আস্থাহীন। তার জন্য শ্রেয়তর আদর্শ ধার্মিকতা ও সমতা। এ কারণেই আল কুরআন ও হাদিস তার রাজনৈতিক ভাবনার মূল ভিত্তি। কিন্তু তা মৌলবাদ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সরাসরি জনগণ পরিচালনা করবে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দলাদলি থাকবে না, অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হবে না কেউÑ এমন রাষ্ট্রের পক্ষে তুলে ধরেছেন তার মতবাদ : ইসলামী সমাজতন্ত্র।

গাদ্দাফি ছিলেন আরব জাতীয়তাবাদী নেতা গামাল আবদ এন-নাসেরের একনিষ্ঠ অনুরাগী। এই জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই করেছেন। মাথা নোয়াননি কখনওÑ সব হারিয়ে যখন তিনি একা, তখনও না। তার রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তার প্রয়োগে লিবিয়ায় বাস্তব রূপ নিয়েছিল জামাহিরিয়া। জনতার রাষ্ট্র। এটা ছিল পৃথিবীর অন্যসব রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই রাষ্ট্রের নেতা ছিলেন তিনিÑ প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী নন। তার ৪২ বছরের নেতৃত্বে গোত্রপ্রধান লিবিয়ার উন্নতি হয়েছে না অবনতি, জনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে না একনায়কতন্ত্র, তিনি জনতার নায়ক ছিলেন না স্বৈরশাসক Ñ এ লেখায় এসব আলোচ্য নয়। বরং ছোটগল্পের সূত্র ধরে লেখক গাদ্দাফির অন্তর্জগতে খানিকটা প্রবেশ করা যাক।

মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির জš§ এক মরু শহরে। রুক্ষ-কর্কশ বালুরাশি আর পাথরপ্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠেন তিনি নিজ গোত্রে। এমন পরিবেশেই ইমরুল কায়েস, জালালুদ্দীন রুমির মতো অনেক বড় কবির জš§ হয়েছে। বালু, পাথর আর রুক্ষ পাহাড় নি®প্রাণ দেখায় বটে। তার মধ্যেও আছে প্রাণের স্পন্দন। বেদুঈনের কাছে কিছুই প্রাণহীন নয়। এমন কি মৃত্যুও। ‘মৃত্যু’ শিরোনামে একটি গল্পই আছে তার। সেখানে আছেÑ ‘আমার অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রণা থেকে এ আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। মৃত্যু হল পুরুষ, আর সব সময় আক্রমণাত্মক, সে কখনই আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকে না, এমন কী পরাজয়েও। সে নিষ্ঠুর ও সাহসী, ধূর্ত ও ভীরু কখনও কখনও। মৃত্যু আক্রমণ করে এবং পরাস্ত হয়; পিঠ ফেরাতে বাধ্য হয় সময়ে সময়ে, লোকেরা যেমন ভাবে ঠিক সেই রকম বিজয়ী নয় সর্বদা।’ গাদ্দাফি বেদুঈন এবং মরুভূমির কবি। প্রাসাদ নয়, খোলা আকাশের নিচে তাঁবুতে বাস করতে ভালবাসতেন তিনি। তার গল্পে সহজ মানুষের সেই অনাড়ম্বর জীবনের হাতছানি। গাদ্দাফি লেখার জন্য ঠিক কী কারণে ছোটগল্পই বেছে নিয়েছিলেন, সেটা বোঝা যায় তার দর্শনের ছায়াপাত থেকে। সেখানে প্রকৃতির আরাধনা। কবিতা না লিখলেও তার গল্পে কবিতার উপস্থিতি স্বতঃস্ফুর্ত।

গাদ্দাফির গল্পসংকলন ১৯৯৬ সালে আরবি থেকে ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে লন্ডন থেকে। ইংরেজি সংস্করণের নাম ‘এস্কেপ টু হেল অ্যান্ড আদার স্টোরিজ।’ এই সংস্করণের দীর্ঘ অবতরণিকা লিখেছেন জে এফ কেনেডির সাবেক সহযোগী ও বিখ্যাত সাংবাদিক পিয়ের স্যালিঙ্গার। বইটিতে রয়েছে ১২টি গল্প ও চারটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধ চারটি মূল আরবী সংস্করণে নেই। অনুবাদে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এ বইটির গল্পগুলোয় সন্ধান মেলে অন্য এক গাদ্দাফিরÑ সাধারণ, প্রকৃতিগত এক মানুষ। তাকে নিয়ে কারও প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর পেতে এ বইটি হতে পারে বীজতলা।
এস্কেপ টু হেল অ্যান্ড আদার স্টোরিজের শুরুর গল্পগুলোয় রয়েছে বিরোধাভাস। শহর বনাম গ্রাম, মৃত্তিকা বনাম অলীকতা, যুক্তি বনাম সংস্কার, কাজ বনাম অলৌকিকতা, প্রগতি বনাম প্রাচীনধারা। বিকল্প বিবেচনায় আমরা দেখতে পাব লেখক তার পছন্দটি বেছে নিয়েছেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এবং বহুকাল আগে। ‘দি সিটি’ গল্পে যে ভাবনা ফুটে উঠেছে, তার বর্ণনাকারী প্রৌঢ়ত্বেও বহন করেছেন সেই ভাবনাই। গাদ্দাফির কাছে পল্লীজীবন ও শহুরে জীবনের মধ্যে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। ‘দি সিটি’ গল্পে তিনি লিখেছেনÑ ‘নগর আমাদের সঙ্গে রয়েছে বহু যুগ অতীত থেকে, কিন্তু আজ এর শোচনীয় দুর্দশার কথা বিবেচনা করুন! নগর এক দুঃস্বপ্ন, আনন্দের বাহক নয় মোটেও, কেউ হয়তো ভাবতে পারে, অথবা এমনভাবেই তৈরি হয়ে থাকবে। নগর তৈরি করা হয়নি বিলাসিতা, সুখ অথবা আনন্দের জন্য। বাস্তবে নগর হচ্ছে রাস্তা ঝাড়-র জনতা, যার মধ্যে লোকেরা নিজেদের কোনও প্রয়োজনীয়তা দেখতে পায় না। লোকেরা আমোদ-ফুর্তির জন্য নগরে আসেনি, এসেছে জীবিকা ধারণ করতে। কেউ মত্ত লোভে, ফাঁদে, আর অবরুদ্ধ চাহিদায়ঃ কর্মসংস্থান একটা লোককে নগরে থাকতে বাধ্য করে।

নগর হচ্ছে সামাজিক সংযোগ ও সম্পর্কের কবরখানা। যেই এখানে পা রাখুক সে এর ঢেউয়ের ওপর দিয়ে সাঁতার কেটে যেতে বাধ্য হবে এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায়, এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায়, এক কাজ থেকে আরেক কাজে এবং এক বন্ধু থেকে আরেক বন্ধুতে। নগরের প্রকৃতির কারণেই সেখানে আত্মপরতা আর সুযোগসন্ধান হয়ে দাঁড়ায় লোকের জীবনের উদ্দেশ্য, আর তার আচরণ ভণ্ডামিতে পর্যবসিত হয়।’

আরও লিখেছেনÑ ‘নগর-জীবন হলো কেঁচোর মতো একরকম জৈবিক অস্তিত্ব যেখানে অর্থহীনভাবে মানুষ বেঁচে থাকে ও মারা যায়ঃ কোনও স্বচ্ছ ধারণা বা অন্তর্দৃষ্টি ছাড়াই। উভয় ক্ষেত্রেই সে ভিতরে ভিতরে একটা কবর, তা সে জীবিতই হোক বা মৃত।’

এই বর্ণনার মধ্যেই গাদ্দাফির লেখকজীবনের দর্শন স্পষ্টরূপে প্রকাশিত। প্রকৃত সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইলে যেতে হবে প্রকৃতির কাছে। লেখকের দাবি পরিষ্কার। ‘দি ভিলেজ’ গল্পে এ প্রসঙ্গও এসেছেÑ ‘নগর পরিত্যাগ করে গ্রামে এসো। সেখানে তুমি জীবনে প্রথম দেখতে পাবে চাঁদ। কেঁচো আর ধেড়ে ইঁদুর থেকে বদলে যাবে তুমি, পরিণত হবে প্রকৃত মানুষে। নাগরিক কবরখানা ছেড়ে চলে এসো খোদার বিস্তীর্ণ ও বিস্ময়কর পৃথিবীতে।’

লিবিয়ায় বেদুঈনদের জীবন ঠিক আগের মতো যাযাবর নয়। তারা স্থির হয়েছে মরুদ্যানে অথবা শহরে অথবা পল্লীতে। কিন্তু গ্রাম বা শহর বসবাসের ভৌগোলিক স্থানই নয় শুধু। বেদুঈনের ভাবনায় সর্বদা তা রূপক। ‘দি সুইসাইড অফ দি অ্যাস্ট্রোনট’ গল্পের নায়ক মহাশূন্য থেকে মাটিতে নেমে আসে সেই মৃত্তিকালগ্ন সরল জীবনের খোঁজে। গাদ্দাফির ভাষায়Ñ ‘বস্তুত, সাদামাটা ব্যাপারটা হল এই যে পৃথিবীই একমাত্র পরিচিত ভূমি, অনন্য, জীবনের উৎস। জীবন মানে পানি ও খাদ্য; পৃথিবীই একমাত্র স্থান যে আমাদের এগুলোর জোগান দেয়। একমাত্র প্রকৃত প্রয়োজন হল রুটি, খেজুর, দুধ, মাংস ও পানি। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় একমাত্র বাতাস ঘিরে রেখেছে পৃথিবীকে। আর তাই নিঃসীম মহাশূন্যে তার রোমাঞ্চাভিযান থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসে মানুষটা।’
মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি আজ আর নেই। ঘাতকের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। যে শহরে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সেখানেই। তার মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছে মরুভূমির কোনও অজ্ঞাত স্থানে। কিন্তু তার ভাবনাগুলো রয়ে গেছে। গাদ্দাফি স্বৈরশাসক না জননায়ক না সন্ত্রাসবাদী না দেশপ্রেমিক না মুক্তিদূত না তাঁবেদার না সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিলেনÑ প্রশ্নশীল মন সেখান থেকেই খুঁজে নেবে সব উত্তর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন