আজ থেকে
প্রায় আশি বছর
আগে অগ্নিস্পর্শে স্পর্ধিত একুশ
বছরের এক অকুতোভয় তরুণী
আদালতে দাঁড়িয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে এই
সাহসী উক্তিটি করেন।
সেই তরুণীর নাম
বীণা দাস। এ
বছর এই মহান
বিপ্লবীর জন্মশতবার্ষিকী। অথচ,
আমরা ক’জনই
বা মনে রেখেছি
অগ্নিযুগের এই অগ্নিকন্যার কথা?
এদেশে, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের অগ্নিগর্ভ হতে
উঠে আসা বিপ্লবীদের আমরা
তরুণ প্রজন্মের কাছে
খুব একটা পরিচিত
করে তুলতে পারি
নি- তাঁদেরকে অনুপ্রেরণার উৎসমূল হিসেবে
প্রোথিত করতে পারি
নি আমাদের হৃদয়ে,
মস্তিষ্কে, চিন্তন-মননে।
তারপরও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কিংবা
কল্পনা দত্তের নাম
যতটুকু শোনা যায়,
বীণা দাস সে
তুলনায় একরকম অনাবিষ্কৃতই রয়ে
গেছে আমাদের তরুণ
প্রজন্মের কাছে। আমার
জানাশোনার পরিধিতে বীণা
দাসকে নিয়ে যতটুকু
তথ্য জোগাড় করতে
পেরেছি তা বীণা
দাসের রাজনৈতিক মানস,
সমাজ-দর্শন নিয়ে
বিস্তৃত আলোচনার জন্য
নিতান্তই অপ্রতুল বলা
যায়। তাই এ
রচনায় আমি শুধু
বীণা দাসের জীবনের
গল্পটি সহজ-সরল
ভাষায় তুলে ধরতে
চেষ্টা করব।
আজ থেকে
প্রায় দেড়শত বছর
আগে ১৮৬৬ সালের
২২ নভেম্বর চট্টগ্রামের শেওরাতলী গ্রামের কৃষ্ণ
চন্দ্র দাস-এর
ঘরে জন্ম নেয়
একটি পুত্র সন্তান,
যার নাম রাখা
হয় বেণী মাধব
দাস। বেণী মাধব
দাস বেড়ে ওঠেন
পরাধীন ভারতে, দর্শন
বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন
করেন এবং শিক্ষক
হিসেবে যোগ দেন
চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে।
তিনি চট্টগ্রাম,
ঢাকা, কলকাতা, কটক,
কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন স্কুল
কলেজে শিক্ষকতার মহান
ব্রত পালন করেন,
কখনো কলেজের প্রভাষক, কখনো
স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে
থেকে। একজন সৎ
নীতিনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে
তিনি ছিলেন ঋষিতুল্য। নেতাজী
সুভাস বোস স্কুলজীবনে বেণী
মাধব দাসের ছাত্র
ছিলেন। সুভাষ বোস
তার ‘ভারত পথিক’
গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন
এবং কৃতজ্ঞতার সাথে
স্মরণ করেছেন- বেণী
মাধব দাসকে, যিনি
কিশোর সুভাষের মনে
একটি স্থায়ী আসন
গড়ে নিতে পেরেছিলেন। এমনকী,
স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরো
জোরদার করার লক্ষ্যে ভারত
ত্যাগ করার পূর্বে
সুভাষ বোস, বেণী
মাধবের আশীর্বাদ নিতে
তার সঙ্গে দেখা
করেন। বেণীমাধব তাঁকে
আশীর্বাদ করেন হৃদয়-উৎসারিত
শুভকামনায়। কেশব চন্দ্র
সেনের অনুপ্রেরণায় বেণী
মাধব ব্রাহ্ম সমাজের
সদস্য হন। বেণী
মাধব ১৯২৩ সালে
অন্ধ্র প্রদেশের কাকিনাদায় ‘অল
ইন্ডিয়া থিইস্টিক কনফারেন্স’-এ
সভাপতির দায়িত্ব পালন
করেন। সেই সমাবেশে তাঁর
বক্তব্য পরবর্তীতে ‘মডার্ণ
থিইস্টিক মুভমেন্ট ইন
ইন্ডিয়া’ নামে বুকলেট
আকারে প্রকাশিত হয়।
এছাড়া তার লেখা
‘পিলগ্রিমেজ থ্রু প্রেয়ারস’ বইাটও
বেশ সমাদৃত হয়।
বেণী মাধব
বিয়ে করেন তৎকালীন কলকাতার সাধারণ
ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ
সম্পাদকের কন্যা সরলা
দেবীকে। সরলা দেবীও
সমাজসেবায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।
তিনি অসহায় ও
দুস্থ নারীদের সহায়তায় ‘সরলা
পুন্যাশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন।
বেনী মাধব এবং
সরলা দেবীর ঘরে
জন্ম নেন অগ্নিযুগের দুই
বিপ্লবী কল্যানী দাস
(১৯০৭-৮৩) ও
বীণা দাস (১৯১১-৮৬)।
পরাধীন ভারতবর্ষে, অগ্নিযুগের বিপ্লবী লড়াই-সংগ্রাম ও
আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকেই
অসংখ্য নারী প্রত্যক্ষ বা
পরোক্ষভাবে যুক্ত হন
ব্রিটিশবিরোধী
স্বাধীনতা সংগ্রামে। অগ্নিযুগের প্রথম
পর্বে অগ্রসর এবং
সমাজমনস্ক নারী হিসেবে
স্বর্ণ কুমারী দেবী,
সরলা দেবী, আশালতা
সেন, সরোজিনী নাইডু,
ননী বালা, দুকড়ি
বালা প্রমুখ বিভিন্নভাবে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার লড়াইয়ে
গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
পরবর্তীকালে তাদের দেখানো
পথে ইন্দুমতি দেবী,
(অনন্ত সিংহের দিদি)
লীলা রায়, পটিয়া
ধলঘাটের সাবিত্রী দেবী
প্রমুখ দেশপ্রেমিক নারী
সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতা রক্ষা
করেন। অনুশীলন, যুগান্তর, বেঙ্গল
ভলান্টিয়ার্স, ছাত্রী সংঘ
প্রভৃতি বিপ্লবী দলের
সঙ্গে বিভিন্ন ঘরের
মা, বোন, মাসিমা,
কাকিমা, দিদি, বৌদিরা
যুক্ত ছিলেন। সেই
উত্তাল সময়ে বেড়ে
ওঠেন বেণী মাধব-সরলা দেবীর
দুই বিপ্লবী সন্তান-
কল্যাণী ও বীণা
দাস। বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্নিচ্ছটা স্পর্শ
করে তাঁদের, অনুরণিত করে
তাঁদের স্বাধীনতাকামী সংবেদনশীল কিশোরী
মনকে।
বীণা দাসের
চার বছরের বড়
বোন কল্যাণী দাস
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন
সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
তিনি ছিলেন কলকাতা
ছাত্রী সংঘের একজন
নিষ্ঠাবান সংগঠক। বিপ্লবীদের বিভিন্ন গোপন
সভায় তিনি যোগ
দিতেন। এমনই এক
গোপন সভার লিফলেট
বহন করার দায়ে
ব্রিটিশদের আদালত তাকে
কারাদ- প্রদান করে।
উচ্চশিক্ষিত কল্যাণী দাস
অনার্স গ্রাজুয়েট হওয়া
স্বত্ত্বেও তাঁকে কারাগারে তৃতীয়
শ্রেনির বন্দীর কাতারে
রাখা হয়। এক
স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান
হয়ে সেই কারাবাসের অবর্ণনীয় কষ্ট
খুব কাছ থেকে
লক্ষ্য করেন কল্যাণী দাসের
ছোট বোন বীণা
দাস। বোনের এই
আত্মত্যাগ তাঁকে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় শাণিত
করে, অনুপ্রাণিত করে
উপনিবেশিক শাসন থেকে
দেশকে মুক্ত করার
সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
তার কয়েক বছর
পরে যখন আমরা
বীণা দাসকে দেখি
গভর্ণরকে গুলি করার
পর, আদালতে নির্ভীকচিত্তে তার
জবানবন্দী দিতে-তখনও
বীণা দাস উল্লেখ
করেন বোনের আত্মত্যাগ থেকে
তার অনুপ্রেরণা নেবার
কথা-
‘I attended
the Court proceedings during the trial of my sister Kalyani. She was punished
to serve a term of rigorous imprisonment for having allegedly attended a
meeting which could not be held and for being a member of an unlawful society
only on the basis of the evidence of her having a proscribed leaflet in her
possession. This was to my mind grossly unjust. Though she is an Honours
Graduate who had earlier lived in all the comforts of a middle-class family,
yet ignominy was hurled on her during her prison-life. The jail-dress and
jail-diet of ordinary convicts classified as third class prisoners, and the
sleepless nights amongst such criminals, militated against my whole being. I
saw all these with my own eyes and also witnessed the bitter tears welling out
of the eyes of my dearest parents.’ (STATEMENT BEFORE THE SPECIAL TRIBUNAL OF
CALCUTTA HIGH COURT-Bina Das)
বীণা দাস
আজ থেকে শতবর্ষ
আগে, ১৯১১ সালের
২৪ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি তাঁর দেশপ্রেম, আদর্শবাদ, দৃঢ়
সংকল্প, উদার চিন্তাভাবনা তাঁর
পরিবার এবং সমসাময়িক উত্তাল
ঘটনাপ্রবাহ থেকেই লাভ
করেছিলেন-তা বলার
অপেক্ষা রাখেনা। ছোটবেলা থেকে
তিনি ছিলেন শান্ত
প্রকৃতির। সংবেদনশীল কবি
ও দার্শনিক মনের অধিকারী বীণা
দাস সময়ের অগ্নিস্পর্শে পরিণত
হন অগ্নিকন্যায়, দীক্ষিত হন
বিপ্লবী মন্ত্রে।
বেথুন ও
ডায়সেশন কলেজে শিক্ষাগ্রহণ করা
বীণা স্নাতক হন
১৯৩১ সালে। ১৯২৮
সালে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে যখন
বিক্ষোভ প্রদর্শন করা
হয়েছিল বীণা তখন
বেথুন কলেজের ছাত্রী। তিনি
অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে
সায়মন কমিশন বয়কট
করেন ও বেথুন
কলেজে পিকেটিং করে
বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
ওই বছরই কলকাতা
কংগ্রেসের এক অধিবেশনে তিনি
স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ
করেন এবং ধীরে
ধীরে তিনি গান্ধীজির অহিংস
আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন।
কিন্তু ব্রিটিশ শাসন-শোষণের উপর ক্রমশ জমে
ওঠা প্রচ- ক্ষোভ
ও বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে গান্ধীজির অহিংস
মতবাদ থেকে সরে
এসে শেষ পর্যন্ত বৈপ্লবিক পন্থাকেই বেছে
নেন তিনি।
১৯৩২ সালে
বীণা দাস তাঁর
জীবনের সবচাইতে দুঃসাহসিক কাজ
করার জন্য মনস্থির করে
ফেলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন
বাংলার ব্রিটিশ গভর্ণর
স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি
করে হত্যা করার।
স্ট্যানলি জ্যাকসন ছিলেন
একসময়ের ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের
অধিনায়ক, যিনি ২০টি
টেস্ট ম্যাচ খেলেন
এবং ৫টিতে অধিনায়কত্ব করেন।
পরবর্তীতে কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে
নির্বাচন করে ১৯১৫
সাল থেকে ১৯২৬
সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য
ছিলেন। জ্যাকসনকে হত্যার
এই সিদ্ধান্ত নেয়ার
পেছনের কারণ বীণা
দাস তার জবানবন্দীতে এভাবে
ব্যাখ্যা করেন-ÔI have no sort of personal feelings against Sir Stanley
Jackson, the man and Lady Jackson, the woman. But the governor of Bengal
represents the system of repression which has kept enslaved 300 millions of my
countrymen and countrywomen.Õ
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বীণা
দাস সাহায্য নেন
তার বোন কল্যাণীর বান্ধবী কমলা
দাস গুপ্তের। কমলা
দাসগুপ্ত ‘যুগান্তর’ দলের
সাথে যুক্ত ছিলেন।
বীণা দাস যুগান্তরের সদস্য
না হলেও, তাঁর
সংকল্প এবং দৃঢ়
প্রতিজ্ঞায় সন্তুষ্ট হয়ে
কমলা দাসগুপ্ত বীণাকে
সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
২৮০ টাকা দামের
একটি চোরাই রিভলবার সহযোদ্ধা সুধীর
দত্তের কাছ থেকে
জোগাড় করেন বীণা
দাসের প্রিয় কমলা’দি। কমলা’দি শাড়ির
ভেতর রিভলবারটি লুকিয়ে
উত্তর কলকাতার ‘রামমোহন রায়’
গ্রন্থাগারে নিয়ে আসেন।
সেখানে তিনি বীণাকে
রিভলবার চালানোর কৌশল
শেখান। কিন্তু স্থানাভাবে বীণা
তখন আর টার্গেট প্রাকটিস করার
সুযোগ পান নি।
ইতিমধ্যে বীণা অবশ্য
দিনেশ মজুমদারের কাছে
শারীরিকশিক্ষার
প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
১৯৩২-এর
৬ ফেব্রুয়ারি। গভর্ণর
স্ট্যানলি যথাসময়ে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের
সিনেট ভবনে আসেন।
সমাবর্তন অনুষ্ঠান নির্বিঘেœ
চলে প্রায় ১
ঘন্টা। গভর্ণর যখন
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অভিভাষণ পাঠ
শুরু করছেন তখন
গাউন পরিহিত বীণা
উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চের
দিকে অগ্রসর হন
এবং গুলি চালান
জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে।
আত্মরক্ষার্থে
স্টানলি জ্যাকসন মাটিতে
পড়ে যান। অল্পের
জন্য বীণা দাসের
লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়।
গভর্ণর ও তার
সাঙ্গপাঙ্গরা তৎক্ষণাৎ
দৌড়ে নিরাপদ স্থানে
চলে যায়। সেসময়
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীর পিতা
কর্ণেল হাসান সোহরাওয়ার্দ্দী লাফ
দিয়ে অনুষ্ঠান থেকে
নেমে বীণা দাসের
হাত থেকে রিভলবারটি কেড়ে
নেন। ততক্ষণে বীণার
রিভলবার থেকে ৫টি
গুলি বেরিয়ে গেছে।
বীণাকে গ্রেফতার করা
হল। টানা ৪৮
ঘন্টা বিরতিহীনভাবে চলল
জিজ্ঞাসাবাদ। রিভলবারের উৎস জানতে
বীণার ওপর চালানো
হল নির্যাতন। বীণা
মুখ খুললেন না।
বীণাকে মুখ খুলতে
বলার জন্য তার
বাবা বেণীমাধবকে বলা
হল। বেণীমাধব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন
সেই প্রস্তাব। সেসময়
বীণাকে সাহস যোগাতে
বৃটিশ শাসন-শোষণের
প্রতিবাদে তিনি রাতজেগে লেখেন
২৫ পৃষ্ঠার একটি
বিবৃতি। উজ্জীবিত বীণা
দাস আদালতে দাঁড়িয়ে নির্ভীকচিত্তে গভর্ণরের উপর
হামলার সকল দায়-দায়িত্ব নিজের
কাঁধে তুলে নিয়ে
জবানবন্দি দিলেন। ইংরেজির ছাত্রী
বীণা স্পষ্ট ইংরেজিতে শুরু
করলেন এভাবে-‘ I confess that I fired at the Governor on the last Convocation
Day at the Senate House’
( আমিই সমাবর্তনের দিনে
সিনেট ভবনে গভর্ণরকে গুলি
করেছি)। এরপর
সংক্ষিপ্ত অথচ ভীষণভাবে সম্পূর্ণ এক
বক্তব্যে তিনি তুলে
ধরেন ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের কথা,
ব্যাখ্যা করলেন কেন
তিনি গভর্ণরকে হত্যা
করতে সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি বললেন, ‘আমার
উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যুবরণ করা,
এবং যদি আমাকে
মরতে হত, আমি
চেয়েছিলাম মহান মৃত্যু..
এই ভারতবর্ষে এই
পরিমাণ অন্যায়, অত্যাচার এবং
বিদেশি শোষণের মধ্যে
গুমরে কাঁদার চাইতে
সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে
প্রতিবাদ করে জীবন
বিসর্জন দেওয়া কী
অধিকতর ভালো নয়?’
১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা
বিচারে বীণা দাসের
৯ বছরের কারাদ-
দেয় আদালত। এসময়
আদালতে বীণা দাসের
শিক্ষিকা সিস্টার ডারোথি
কাঁদতে কাঁদতে বীণাকে
বলেন, Ô Bina,
I love you so much. How could you do this?’ বিপ্লবী বীণা
দাসের তৎক্ষণাৎ
প্রতিউত্তর ÔSister,
I love you no less. But, I love my country more.’ কারাভোগের সময়টুকুতে তাঁকে
একেক সময় একেক
কারাগারে, একেক স্থানে
নিয়ে যাওয়া হত।
কিছুদিন কুমিল্লার কিশোরী
বিপ্লবী শান্তি সুনীতি’র সাথে
তিনি এক কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলে
স্থানান্তরিত হয়ে থাকার
পর গান্ধীজির প্রচেষ্টায় অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীর
সঙ্গে বীণাও মুক্তি
পান। সাত বছর
জেলে কাটিয়ে ১৯৩৯-এ তিনি
মুক্তি লাভ করেন।
জেল থেকে
মুক্তির পর বীণা
থেমে থাকেন নি।
সেসময় বিপ্লবীদের অনেকে,
বিশেষত তরুণেরা, গোপন
সশস্ত্র সংগ্রামের পথ
ছেড়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ
বেছে নেন। ছাত্র
ইউনিয়নের মুখপাত্র জয়ধ্বণির সম্পাদক থাকাকালে অগ্নিযুগের আরেক
বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নেয়ার
সুযোগ আমার হয়েছিল। এ
সময়কাল সম্পর্কে বিনোদবিহারী চৌধুরী
আমাদের বলেছিলেন, “মাস্টারদা মারা
যাওয়ার পর আমাদের
বিভিন্ন জেলার কর্মীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম গোপন
বিপ্লবী দলের আর
দরকার নেই। কারণ
মহাত্মা গান্ধী যখন
সত্যাগ্রহ আন্দোলন করছিলেন, তখন
সারা দেশে তা
বিপুল সাড়া পায়। আমাদেরও তা
স্পর্শ করে। পরবর্তীতে বিশ্বযুদ্ধ যখন
শুরু হল তখন
গান্ধীজি বললেন ব্রিটিশদের এক
পয়সাও দেব না।
Not a pie, not a man।
তুমুল সংগ্রাম শুরু
হল। দেশের স্বাধীনতার জন্য
তখন তুমুল গণজাগরণ তৈরি
হল, তাই আমাদের
বিপ্লবী দলের আর
দরকার হল না।
আমরা তখন বলেছিলাম, We believe in revolution, but we don’t want violence. আমরা গান্ধীজির কথা
মানবো।’ আমরা ১৯৩৯
সালে ন্যাশনাল প্রেস-এ এই
কথা প্রচার করলাম।”
সেসময়েই আরো
অনেকের মত বীণা
দাস ও কংগ্রেসে যোগ
দেন এবং ট্রেড
ইউনিয়নের কাজ আরম্ভ
করেন। তিনি দক্ষিণ
কলকাতা জেলা কংগ্রেস কমিটির
সম্পাদিকাও ছিলেন। টালিগঞ্জের চালকল
বস্তিতে গিয়ে বস্তিবাসী দরিদ্র
শ্রমিকদের সঙ্গে দিনের
পর দিন মিশে
তাদের চরম দুর্গতিতে পাশে
দাঁড়িয়েছেন তিনি। এর
পাশাপাশি সেসময় বীণা
দাসের সাহিত্যপ্রতিভা ও
দেশাত্মবোধক চিন্তার প্রকাশ
পাওয়া যায় কমলা
দাস গুপ্ত সম্পাদিত ‘মন্দিরা’ পত্রিকায়।
এই সময়কালের আরো
কিছু আলোচনা এ
প্রসঙ্গে করা প্রয়োজন। বীণা
দাস তাঁর পিতার
প্রিয় ছাত্র সুভাস
বোস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, একথা
সত্য। এম এন
রায়ের মেধা ও
বৈজ্ঞানিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিও
বীণা দাসের এক
ধরণের মুগ্ধতা ছিল।
কংগ্রেসে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে
এম এন রায়
উৎসাহী ছিলেন।
এম এন রায়
ও সুভাস বোস
দুজনেই গান্ধীর ‘অহিংস
নীতি’র বিরোধী
ছিলেন এবং স্বাধীনতার জন্য
আরো কঠোর কর্মসূচির কথা
ভাবছিলেন। এ সময়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু
হয়। সুভাস বোস
ফ্যাসিস্ট জার্মানীর সাথে
হাত মিলিয়ে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ তাড়ানোর পরিকল্পনা করছিলেন। এম
এন রায়ের বক্তব্য ছিল
ভিন্ন। তিনি বলেছিলেন, ‘হিটলারের পৃথিবী
হবে পরাধীন পৃথিবী,
পরাধীন পৃথিবীতে ভারতের
স্বাধীনতা সম্ভব নয়।’
এদিকে ত্রিশ ও
চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষ, বিশেষত
বাংলায় এক নতুন
মতাদর্শিক ঢেউ এসে
লাগে। আন্দামানে নির্বাসিত ও
কারাবন্দী তরুণ কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা দেশে
ফিরে আসেন। কমিউনিস্টরা এই
বিশ্বযুদ্ধকে প্রথমে ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’
বললেও হিটলার কর্তৃক
সোভিয়েত আগ্রাসনের পর
তারা ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে গণযুদ্ধের ডাক
দেয়। কংগ্রেস প্রথমদিকে যুদ্ধের পক্ষে
বিপক্ষে কোন অবস্থান নেয়া থেকে
বিরত থাকে। তবে
পরবর্তীতে ‘ভারত ছাড়’
আন্দোলন কংগ্রেসকে দিশা
দেখায় এবং জনগণের
আকাক্সক্ষাকে তা ধারণ
করতে পারে। একদিকে
যখন ‘ভারত ছাড়’
আন্দোলন তীব্র হয়ে
উঠছিল, অন্যদিকে সুভাস
বোস ব্রিটিশ রাজকে
সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে উৎখাত করার
আহ্বান জানাচ্ছিলেন, আবার
প্রগতিশীল বামপন্থীরা তখন
ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে গণযুদ্ধ চালাতে
উদ্বুদ্ধ করছিলেন। এ
টালটামাল পরিস্থিতিতে সংবেদনশীল বীণা
দাস খানিকটা বিভ্রান্ত ও
দোদুল্যমান হয়ে পড়েন।
১৯৪২-এ
‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু
হলে বীণা দাস
দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের পক্ষ
থেকে সভা ডাকলেন
হাজরা পার্কে। সভাকে
বেআইনি ঘোষণা করা
হল। সেখানে একজন
সহকর্মীকে সার্জেন্ট ব্যাটন
দিয়ে প্রহার শুরু
করতেই বীণা তার
তীব্র প্রতিবাদ করেন।
পুলিশ আবারো বীণাকে
গ্রেফতার করে। এবারে
তিনি রাজনৈতিক বন্দী
হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলে
তিন বছর আটক
থাকেন। এ দফায়
১৯৪৫-এ তিনি
মুক্তি লাভ করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি
কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচন করে
রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং
তার প্রভাব বীণা
দাসকে ধীরে ধীরে
রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে
ফেলে। বীণা দাসের
স্বামী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ যতীশ
ভৌমিক। স্বামীর মৃত্যুর পর
বীণা দেবী আরো
বিচ্ছিন্ন হয়ে যান
রাজনীতি থেকে এবং
লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে
যান।
কখন যে
তিনি হরিদ্বার চলে
গিয়েছিলেন তা সঠিকভাবে কেউ
বলতে পারেন না।
ঊনবিংশ শতকের নবম
দশক। ১৯৮৬ সালের
২৬ ডিসেম্বর। হরিদ্বারে গঙ্গার
ঘাটে এক অজ্ঞাতপরিচয় বয়স্কা
মহিলার দেহ উদ্ধার
করা হয়েছিল। সংবাদপত্রেও খবরটি
উঠেছিল। পরে অজ্ঞাতনামা নারীর
পরিচয় জানা গিয়েছিল। সেই
নারী ছিলেন বীণা
দাস। ইংরেজদের ত্রাস
অগ্নিকন্যার প্রস্থাণ হল
অজ্ঞাতে-নিভৃতে।
বীণা দাসের
জীবনের গল্পের সমাপ্তি এখানেই। কিন্তু
বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিপ্লবীরা-যারা
বিনির্মাণ করবেন আগামীর
ইতিহাস, রচনা করবেন
আরো অনেক বীরত্বগাঁথা- তাঁরা
বীণা দাসকে গ্রহণ
করতে পারেন প্রেরণার এক
অফুরন্ত উৎসধারা
হিসেবে। প্রেরণার সেই
উৎসমূল হিসেবে
বীণা দাস অমর-অক্ষয় হয়ে
থাকুক মহাকালের শিলালিপিতে।
(তথ্যসূত্র: শেখ রফিক ও বিপ্লবীদের কথা)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন