শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১১

দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন তৎপরতা



আফগান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানার প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে নতি স্বীকারে যে প্রচারণার আশ্রয় নিয়েছে তা আঞ্চলিক রাজনীতির মাপে দুটি কারণে শংকাজনক প্রশ্নের মুখে এসে পড়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে নয়াদিল্লি কর্তৃক নিজেকে মার্কিনি এই প্রচারণা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়াস এবং ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি স্বকীয় নীতি গ্রহণ। দ্বিতীয় উপাদানটি হচ্ছে ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার যে মার্কিন নীতি তা বাধাগ্রস্ত হওয়া। পাকিস্তানের প্রতি বর্তমান মার্কিন নীতি তাকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় জাতিগুলো থেকে ইরানকে আলাদা করার যে মার্কিন নীতি তা বাধাগ্রস্ত করছে। পাকিস্তানের প্রতি বর্তমান মার্কিন নীতি তাকে ইরানের প্রতি আকৃষ্ট হতে আরো বেশি উৎসাহই যোগাচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা পাক-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে বিবৃতি দেন তাতে মার্কিন নীতির প্রতি তার দ্ব্যর্থহীন সমর্থন প্রকাশ পায়নি। এতে বরং সতর্কতার সঙ্গে এই অভিব্যক্তিই প্রকাশ পেয়েছে যে, পাকিস্তানের ভূখন্ডে মার্কিন সামরিক তৎপরতার ব্যাপারে ভারত আগ্রহী নয়।

ভারতের এই মনোভাবে পাকিস্তানের নেতারা খুশিই। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাওয়ালপিন্ডিস্থ পাকিস্তানি সেনা সদরের সাম্প্রতিক এক পদক্ষেপে। সংবেদনশীল সিয়াচেন সেক্টরে তিনজন শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তাসহ একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার খারাপ আবহাওয়ার কারণে পাকিস্তান ভূখন্ডে জরুরি অবতরণে বাধ্য হলে বিনাবাক্য ব্যয়ে পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের এক ঘণ্টার মধ্যে দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে। দিল্লির সরকারি মুখপাত্র পাকিস্তানের এই সৌজন্যের জন্য সঙ্গে সঙ্গে ভারতের তরফ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। দুই পক্ষের এ ধরনের সৌজন্যমূলক আচরণ সত্যি এক বিরল ঘটনা। এছাড়াও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অস্থায়ী সদস্য পদে ভারত সম্প্রতি ভোট দিয়েছে পাকিস্তানের প্রার্থীতার পক্ষে। প্রত্যুত্তরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত দ্রুততার সঙ্গে নিউইয়র্কস্থ ভারতের রাষ্ট্রদূতকে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি তার সঙ্গে একযোগে কাজ করবেন। এখানে উল্লেখ্য, কাশ্মির সমস্যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রধান বাহাসের স্থান এই জাতিসংঘ।

আগামী ১০-১১ নভেম্বর মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। এ সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে স্থির করা হয়েছে। পরিস্থিতি দৃষ্টে ধারণা করা যায়, ওয়াশিংটন ভারত-পাকিস্তানের এ সম্পর্কোন্নয়নের ধারায় বাহ্যিকভাবে এমন একটি ধারণা দিতে চায় যে, সে এতে ‘সঞ্চালকের’ ভূমিকা পালন করতে উৎসাহী। কিন্তু বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের অস্বস্তিত্বেই ভুগছে দক্ষিণ এশীয় জাতিসমূহের সম্পর্কের এই ঐক্যতানে। কারণ ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের পারদের ওঠানামার ভিত্তিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এ অঞ্চলের কূটনীতি পরিচালিত করে থাকে। কৃষ্ণার বিবৃতির পর পরই ওয়াশিংটন ‘প্রতিরক্ষামূলক’ একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। সে মার্কিন নাগরিকদের ভারত ভ্রমণের ব্যাপারে সন্ত্রাসী আক্রমণ নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। প্রত্যুত্তরে নয়াদিল্লি মার্কিনি এই পদক্ষেপকে ‘ভারসাম্যহীন’ বলে জানিয়ে দিয়েছে।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের এই ক্রমধারায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান-ইরান সম্পর্ক নিয়েও যে উদ্বিগ্ন তাও প্রকাশ পেয়েছে। ইসলামাবাদ ও তেহরানের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের বেশ ক’টি সরকারি সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রতি। এসব সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের নিরাপত্তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার একটা পর্যায়ে তারা পৌঁছেছে। তেহরান ইতোমধ্যেই তাদের সন্তোষ প্রকাশ করেছে এই বলে যে, বিগত ১০ মাসে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে জিন্দাল্লাহ নেটওয়ার্কের একটি হামলাও ইরান ভূখন্ডে ঘটেনি। তেহরান জানিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত জিন্দাল্লাহ নেটওয়ার্কের কার্যক্রম বন্ধের ব্যাপারে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী যে উদ্যোগী হয়েছে তাতে তারা খুশি। তারা আফগান নীতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতেও আগ্রহী বলে জানিয়েছে। একই সঙ্গে তেহরানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আফগান শান্তি পরিষদের প্রধান বুহরানউদ্দিন রববানির হত্যাকান্ডের ব্যাপারেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনোরকম উচ্চাবাচ্য করেনি ইরান। তেহরানের অভিযোগ রয়েছে যে, ইরানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে গোপন তৎপরতার মাধ্যমে জিন্দাল্লাহ সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে। পাকিস্তান সিআইএ সদস্য রেমন্ড ডেভিসকে গত জানুয়ারিতে লাহোরে দুই ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে আটক করে এবং পরে তাকে বের করে দেওয়া হয়। সেই থেকে পাকিস্তানে জিন্দাল্লাহ নেটওয়ার্কসহ অন্যান্য মার্কিনি গোয়েন্দা কার্যক্রম সীমিত করে দেওয়া হয়। ইরান এতে খুশি। এছাড়াও ইরান চায় আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীসহ সব বিদেশী সৈন্য চলে যাক। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পক্ষে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বর্তমান কেŠশলগত অবস্থান তাই ইরানের নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ইরাকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা উপস্থিতির অবসান ইরানের কাম্য। তবে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ভিন্ন এবং এখানে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি ‘সাধারণ কৌশল’ই বাস্তব কারণে ইরানের জন্য প্রয়োজন।

সব কিছু মিলিয়ে এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মোটেও অনুকূল নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত ও ইরানের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের সূত্র ধরেই পাকিস্তানে মার্কিন উপস্থিতি যুক্তিগ্রাহ্য করা হয়। আর এজন্যই এ দুই দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কাম্য নয়। মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাদের জনণকে ভারত সফরকালে সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে যে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয় তা আসলে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীদের দিকে আঙ্গুল তুলেই করা হয়। একইভাবে তারা ফলাও করে প্রচার করছে যে, কাশ্মিরের অংশ যা এখন পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত সেখানে চীনা সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হচ্ছে। এ প্রচারণার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ঢিলে দুটি পাখি মারতে চায়। প্রথমত ভারত-পাকিস্তান এবং দ্বিতীয়ত চীন-ভারত সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি।

ইতোমধ্যে ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের একটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। সম্পতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেছেন, ভারত ও চীনের মধ্যেকার সব সীমান্ত সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান যে চীনা নেতারা চায় সে ব্যাপারে তিনি আশ্বস্ত। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে এর ধারাবাহিকতায় নয়াদিল্লিতে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে উচ্চপর্যায়ে আলোচনাও হয়। চীনও এর প্রত্যুত্তরে বলেছে, সে কৌশলগত অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে চায় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেই সীমান্তসহ সব সমস্যার সমাধানে আগ্রহী।

পাকিস্তান, ইরান, ভারত ও চীনের মধ্যেকার সম্পর্কের এ নতুন মাত্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ অস্বস্তিতেই ভুগছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মিরের নর্দার্ন এরিয়ায় চীনের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের প্রমাণহীন অনুমিত সংবাদটি এজন্য সে বেশি করে প্রচার করছে। তার এই পরিশ্রমলব্ধ তত্ত্বটির উদ্দেশ্য হচ্ছে তার ভাষায় চীন ও পাকিস্তানের ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ সম্পর্কে ভারতকে সতর্ক করা। তার লক্ষ্য হচ্ছে ভারত তার ‘বিশ্বাসঘাতক’ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বিলম্বিত পদক্ষেপ নিক।

একই সময়ে আফগানিস্তান নিয়েও ওয়াশিংটন নতুন খেলায় মেতেছে। ভারতকে লক্ষ্য করে সে পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে ‘গ্র্যান্ড বারগেইন’ বা ‘মহা দর কষাকষি’ ফর্মুলা উপস্থাপন করেছে। এতে আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ স্বার্থ রক্ষার ধারণা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে কারজাইকে দিয়ে ‘ভারত-আফগান কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ চুক্তি করা হয়েছে। গ্র্যান্ড বারগেইন বা মহা দর কষাকষি সূত্র অনুযায়ী, কাশ্মির সমস্যা সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যস্থতাকারী এবং আফগানিস্তানে মার্কিন স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটনের পাকিস্তান সফরও ছিল এই লক্ষ্যে।

পুরো এই প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কাবুলে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই সরকারের সঙ্গে একটি কৌশলগত চুক্তিতে আসা। এ চুক্তির বলে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য অপসারণ করলেও সেখানে একটি স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন। হামিদ কারজাই এতে রাজি থাকলেও আফগান জনগণ ও পার্লামেন্ট এর বিরোধী। এ জন্যই কারজাইকে দিয়ে ১৬ নভেম্বর একটি লয়া জিরগা আহবান করা হয়েছে। যাতে সব পার্লামেন্ট সদস্য, কিছু সাবেক সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, ধর্মীয় শিক্ষাবিদ ও প্রভাবশালী উপজাতীয় নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এছাড়াও মোট ২০৩০ জন আমন্ত্রিত অতিথির মধ্যে রয়েছেন পাকিস্তান, ইরান ও পশ্চিমা দেশগুলোতে অবস্থানরত ২৩০ জন প্রবাসী আফগান। এ লয়া জিরগা আহবানের উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্লামেন্টেকে পাশ কাটিয়ে ‘গ্র্যান্ড বারগেইন’ অনুমোদন নেওয়া অর্থাৎ আফগানিস্তানে স্থায়ী মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের পথ বৈধ করা।

এই অঞ্চলে খবরদারির জন্য আফগানিস্তানে একটি মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনও ওয়াশিংটনের কাছে অতীব জরুরি। আর এজন্যই আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষের খেলা এখন একটি অতি সংকটময় চূড়ান্ত পর্যায় পার করছে। সবকিছু নির্ভর করছে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনীতির ওপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাই পাকিস্তান, ইরান, ভারত ও চীনের মধ্যেকার দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের আন্তঃআঞ্চলিক রাজনীতি এখন সবচেয়ে শঙ্কার ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের বিরোধিতায় এসব দেশ ঐকমত্যে উপনীত হোক তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কাম্য নয়। আর এজন্যই সে এখন এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের বীজ উপ্ত করতে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ কৌশল অবলম্বনে মরিয়া হয়ে উঠেপড়ে লেগেছে।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন