মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১১

সরকারের ভুল নীতি বা দুর্নীতির খেসারত জনগণ কেন দেবে?

র্থমন্ত্রী যেদিন বললেন এই বছর আর তেলের দাম বাড়ানো হবে না তার একদিন পরই কেরোসিন, ডিজেল ও অকটেন প্রতিটির দাম ৫ টাকা করে বাড়ানো হলো। সরকারের সিদ্ধান্ত তাহলে কোথায় হয়, কে নেয়? মন্ত্রীদের কাজ কি তবে মনোরঞ্জন করা? নাকি জনগণকে একের পর এক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করা?

তেলের দাম বৃদ্ধির পেছনে সরকার যে যুক্তি দিয়েছে তা হলো তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এর পেছনে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে তা বহন করা সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গত কয়েক মাসে ভর্তুকি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ভর্তুকি এই পরিমাণে বাড়ল কেন? আন্তজাতিক বাজারে তেলের দাম প্রায়ই বাড়ে, আবার কমেও। ২০০৮ সালের তুলনায় তেলের দাম এখনো কম। তাহলে দাম বৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি বেড়েছে এটা ঠিক নয়। ভর্তুকি বেড়েছে তেলের আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে। গত কয়েক মাসে এই আমদানি গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৬০ ভাগ। কেন? সরকার কি জনগণের প্রয়োজনে তেল আমদানি করতে গিয়ে এই নাকানি চুবানি খাচ্ছে? না।

এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র যেগুলো তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেরকম অনেকগুলো কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় চুক্তি করবার কারণে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র এমনিতেই অনির্ভরযোগ্য, ব্যয়বহুল এবং জরুরি অবস্থায় ১/২ বছর চলার মতো। বাংলাদেশের বিদ্যুৎসহ জ্বালানি খাত বিপর্যস্ত করবার জন্য এগুলোই যথেষ্ট। বিদ্যুৎ সংকট মেটানোর জন্য সরকারের কাছে কি বিকল্প ছিল না? ছিল। আমরা বহুবার সরকারের কাছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও কয়লা খাতে কম ব্যয়বহুল, টেকসই, জনস্বার্থমুখী পদক্ষেপগুলো নির্দেশ করে সুপারিশ করেছি।

সরকার এগুলোতে কান দেয়নি। কারণ তার মনোযোগ জনগণের প্রয়োজন মেটানো বা তার স্বার্থরক্ষা নয়। তার প্রধান আগ্রহ দেশী- বিদেশী কিছু গোষ্ঠীকে ব্যবসা দেওয়া, বহুজাতিক কোম্পানিকে আশ্বস্ত করা, বিশ্বব্যাংক আইএমএফকে সন্তুষ্ট করা, কমিশনভোগীদের দাপট মেনে নেওয়া। কিছু গোষ্ঠীকে বিদ্যুতের ব্যবসা দিতে গিয়ে তেলের আমদানি ও ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। গ্যাস খাতের বড় অংশ বিদেশীদের হাতে থাকায় উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনতে গিয়ে সেখানেও ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। রাষ্ট্রের ঋণগ্রস্ততা বেড়েছে, ঋণের চাপ অর্থনীতিকে কাবু করছে। আবার ভর্তুকির চাপ কমাতে গিয়ে বারবার তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। আর এই উপর্যুপরি বৃদ্ধি ঘটছে বাজেট প্রক্রিয়া, আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে এমনকি রাতের অাঁধারে। আইএমএফ বিশ্বব্যাংক, দেশী-বিদেশী সুবিধাভোগী আর তাদের কমিশনভোগীরা খুশি। কিন্তু এসব দাম বৃদ্ধি ব্যক্তি, পরিবার ও জাতীয় অর্থনীতিকে ভয়াবহ সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, সরকারের ভুল নীতি বা দুর্নীতির খেসারত কেন জনগণ দেবে?

সরকার বললে হবে না যে, এ বিষয়ে তাদের কেউ সতর্ক করেনি কিংবা কোনো বিকল্প ছিল না। সরকার যখন প্রথম এসব তৎপরতা শুরু করেছে তখনই আমরা এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানাতে এবং বিকল্প নির্দেশ করে বক্তব্য দিয়েছিলাম। ১১ মে ২০১০ তারিখে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যের অংশবিশেষ এখানে তাই খুবই প্রাসঙ্গিক :

‘বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের দিকে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে সরকার জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন করে অতীতের সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় সর্বনাশা নানা পদক্ষেপে হাত দিচ্ছে। জ্বালানিবিষয়ক সংসদীয় কমিটি বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় একের পর এক বিনা দরপত্রে অত্যধিক ব্যয়বহুল রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের সরকারি কর্যক্রম সর্মথন করেছেন। যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, ‘বর্তমান বিদ্যুৎ সংকটে মানুষ বিদ্যুৎ চায়, নিয়ম বা দামের বিষয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।’ কিন্তু আসলে কি বর্তমান এই দরপত্রবিহীন উচ্চদামের বিদ্যুৎ প্রকল্প জনগণকে নিশ্চিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে? জনগণের বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য কী আর কোনো বিকল্প নেই? জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে এর আগেও বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার সেদিকে নজর না দিয়ে ব্যয়বহুল জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে পুরো জ্বালানি খাত বিদেশী কোম্পানির কর্তৃত্বে দিয়ে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তাকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। নিচের ছকে সরকারি অপতৎপরতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে জনস্বার্থে জরুরি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো।

বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কয়লা নিয়ে সরকারি তৎপরতা এবং জনস্বার্থে জরুরি প্রস্তাবনা



১.লক্ষ্য : বিদ্যুৎ সংকটের আশু সমাধান/স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ
সরকারি উদ্যোগ মালিকানাসম্ভাব্য ফলাফল
রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট।
পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট।
প্রধানত বিদেশীউৎপাদন : ৭০০ মেগাওয়াট।সময়কাল : ৩-৯ মাস।
বিদ্যুৎ একক প্রতি খরচ : ৮-১৪ টাকা।
উৎপাদন ও সময়কাল : অনিশ্চিত ও অনির্ভরযোগ্য।
বাড়তি খরচ : প্রতি বছর ৫০০০-৭০০০ কোটি টাকা।
জাতীয় কমিটির প্রস্তাব
ওাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর নবায়ন/মেরামত।
ক্যাপাসিটর স্থাপন।

এনার্জি সেভিং বাল্ব।
আইএমসি

জাতীয়
উৎপাদন বৃদ্ধি : ১৭০০ মেগাওয়াট।
সময়কাল : ৩-৯ মাস।

বিদ্যুৎ একক প্রতি খরচ : গড়পড়তা ১.৬০।
প্রয়োজনীয় খরচ : ১২০০-১৫০০ কোটি টাকা।
২.লক্ষ্য : গ্যাস সংকট সমাধানে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ
সরকারি উদ্যোগমালিকানাসম্ভাব্য ফলাফল
স্থলভাগে বিদেশি কোম্পানির হাতে, উৎপাদন বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে, আরও ব্লক প্রদান।

বিদেশি





গ্যাস একক প্রতি খরচ : ২৫০-৩০০ টাকা।প্রয়োজন মতো গ্যাসপ্রাপ্তি : অনিশ্চিত। সারাদেশ জিম্মি।
প্রতি বছর ভর্তুকি : বর্তমানে ২০০০ কোটি টাকা। চুক্তি হলে তা আরো বৃদ্ধি পাবে।
জাতীয় কমিটির প্রস্তাব
দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ব্লকগুলোতে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি।
অচল গ্যাকূপগুলো সচল করা।
বিদেশী কোম্পানিগুলোর ফেলে রাখা ব্লকগুলো অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাধ্য করা।
জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সেগুলো ফেরত এনে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করা।
জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ।
জাতীয়জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন খরচ একক প্রতি : ২৫-৩০ টাকা।
প্রয়োজন মতো গ্যাসপ্রাপ্তি।
জনগণের সম্পদের ওপর জনগণের  কর্তৃত্ব নিশ্চিত।
দেড় মাসের মধ্যে বর্তমান গ্যাস ঘাটতি দূর করা সম্ভব।
৩.লক্ষ্য : মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার
সরকারি উদ্যোগমালিকানাসম্ভাব্য ফলাফল
উন্মুক্ত খনির মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন।বিদেশিকয়লা সম্পদের ওপর মালিকানা হারানো।শতকরা ৮০ ভাগ কয়লা পাচার।
আবাদি জমি, ভূ-গর্ভস্থ/ভূ-উপরিস্থ অমূল্য পানি সম্পদ ধ্বংস, অগণিত মানুষ উচ্ছেদ।
খাদ্য নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা ও জ্বালানি নিরাপত্তা বিনষ্ট।
জাতীয় কমিটির প্রস্তাব
জাতীয় সংস্থা গঠন ও জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে শতভাগ জাতীয় মালিকানায় নিরাপদ প্রযুক্তিতে কয়লা সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার।জাতীয়মাটি, পানি ও মানুষ অক্ষত।শতকরা ১০০ ভাগ কয়লা সম্পদ দেশের স্বার্থে ব্যবহার।
প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পায়নে সম্পদের ব্যবহার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন