মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১১

ভারতে মৃতরা কথা বলতে শুরু করেছে

দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ৩টায়, যুক্তরাষ্ট্রের বেতার সাংবাদিক ডেভিড বার্সামিয়ানকে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বেসরকারি বেতারে বিনামূল্যে সম্প্রচারের জন্য স্বাধীনভাবে অনুষ্ঠান নির্মাণকারী এই বিপজ্জনক লোকটি ৪০ বছর ধরে ভারতে আসা-যাওয়া করছেন এবং এখানে তিনি উর্দুভাষা ও সেতার বাজানো শেখার মতো বিপজ্জনক সব কাজ করে আসছেন।

এডওয়ার্ড সাঈদ, নোয়াম চমস্কি, হাওয়ার্ড জিন, এজাজ আহমেদ ও তারিক আলী প্রমুখ সর্বলোকবিদিত বুদ্ধিজীবীদের বইয়ের মতো দীর্ঘ সব সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছেন বার্সামিয়ান (তিনি এমনকি চমস্কি ও এডওয়ার্ড হারম্যানের বই ‘ম্যানুফ্যাকচারি কনসেন্ট’-এর ওপর পিটার উইনটনিক নির্মিত ডকুমেন্টারি ফিল্মে এক বেলবটম পরা তরুণ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন)।

ভারতে তার সাম্প্রতিক সফরগুলোতে সে রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক ও লেখকদের (আমাকেসহ) বেতার সাক্ষাৎকারের একটি সিরিজ তৈরি করেছেন। কাজের জন্য বার্সামিয়ানকে তুরস্ক, ইরান, সিরিয়া, লেবানন ও পাকিস্তানে যেতে হয়েছে। এসব দেশের কোনোটি কখনোই তাকে বিতাড়ন করেনি। তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রটি কেন এই একজন একাকি, সেতারবাদক, উর্দুভাষী, বামঘেঁষা বেতার প্রযোজকটিকে ভয় পায়? বার্সামিয়ান নিজে বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন :

‘এর পুরোটাই কাশ্মীর নিয়ে। আমি ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ, নর্মদা বাঁধ, কৃষকদের আত্মহত্যা, গুজরাটের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বিনায়ক সেন মামলা নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের উদ্বেগের মর্মস্থান হচ্ছে কাশ্মীর। [এ সম্পর্কে] সরকারি ভাষ্যের কোনো বিরোধিতাই করা যাবে না।’

তার বিতাড়নের ওপর প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনগুলো সরকারি ‘সূত্রদের’ এই ভাষ্য উদ্ধৃত করে যে, বার্সামিয়ান ‘তার ২০০৯-১০ সালের সফরকালে পর্যটন ভিসাধারী হয়েও পেশাদারি কাজে লিপ্ত হয়ে তার  ভিসার নিয়মাকানুন ভঙ্গ করেছিলেন।’ ভারতে ভিসার নিয়মকানুনগুলো এমন এক মজাদার গোপন ছিদ্র যার ভেতর দিয়ে সরকারের উদ্বেগ ও অনুরাগের বিষয়গুলো দেখে নেওয়া যায়। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’- এই টুটাফাঁটা পুরনো ব্যানারটি ব্যবহার করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই আদেশ জারি করেছে যে, বিভিন্ন কনফারেন্স ও সেমিনারে আমন্ত্রিত বিদ্বান ও শিক্ষাবিদদের ভিসা দেওয়ার আগে তাদের নিরাপত্তা ছাড়পত্র পেতে হবে। করপোরেট সংস্থাগুলোর কার্যনির্বাহী ও ব্যবসায়ীদের তা প্রয়োজন হবে না।

কাজেই, এমন কেউ যে কোনো বাঁধে বিনিয়োগ করতে চায়, বা একটি ইস্পাত কারখানা তৈরি করতে চায় কিংবা একটা বক্সাইট খনি কিনতে চায় সে নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হয় না, কিন্তু একজন পন্ডিত যে ধরা যাক বাস্ত্তচ্যুত বা সাম্প্রদায়িকতা বা বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান পুষ্টিহীনতার ওপর, কোনো সেমিনারে অংশ নিতে চায় সে নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হয়। মন্দ উদ্দেশ্য আছে এমন সন্ত্রাসবাদীরা সম্ভবত অনুমান করতে পেরেছে যে, তারা কোনো সেমিনারে যোগ দিতে চায় একথা বলার চেয়ে প্রাদা স্যুট পরে এসে যদি বলে যে তারা একটি খনি কিনতে ইচ্ছুক তবে তা হবে তাদের জন্য সব দিক দিয়েই মঙ্গলজনক।

ডেভিড বার্সামিয়ান কোনো খনি কিনতে বা কোনো কনফারেন্সে যোগ দিতে ভারত সফরে আসেননি। তিনি এসেছিলেন কেবল লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে। ‘সরকারি সূত্রসমূহের’ বক্তব্য অনুযায়ী, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তার আগের সফরকালে সে জম্মু ও কাশ্মীরের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রতিবেদন করেছিল এবং এসব প্রতিবেদন ‘বাস্তব তথ্যভিত্তিক’ ছিল না। মনে রাখবেন, বার্সামিয়ানকে একজন প্রতিবেদক নয়; সে এমন এক লোক যে জনগণের সঙ্গে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিন্নতামতাবলম্বীদের সঙ্গে, তারা যে সমাজে বাস করে সে সম্পর্কে আলাপ করে।

পর্যটকরা যেসব দেশে যায় সেখানকার লোকজনের সঙ্গে আলাপ করা কি তাদের জন্য অবৈধ? আমি যদি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ ভ্রমণে যাই এবং সেখানে যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাদের নিয়ে লিখি, এমনকি আমার লেখা যদি ‘বাস্তব তথ্যভিত্তিক’ নাও হয়, তবে কি তা আমার জন্য অবৈধ হবে। কোন ‘তথ্যগুলো’ ঠিক ও কোনগুলো ঠিক নয় তা কে নির্ধারণ করে।

বার্সামিয়ান যেসব আলাপচারিতা রেকর্ড করেছিলেন তার বিষয়বস্ত্ত বিশ্বের সবচেয়ে ঘন দখলদার সেনাঅধ্যুষিত রাজ্যটির (এক কোটি জনগণের জন্য আনুমানিক ছয় লাখ সক্রিয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য যেখানে নিয়োজিত) দৈনন্দিন জীবনের বদলে যদি কাশ্মীরের নির্বাচনে ভোটদানকারীদের যে বিপুল সংখ্যা তার প্রশংসাসূচক হতো তবে কি তাকে বিতাড়িত হতে হতো?

ডেভিড বার্সামিয়ানই কাশ্মীর বিষয়ে ভারত সরকারের সংবেদনশীলতার কারণে বিতাড়িত প্রথম ব্যক্তি নন। অধ্যাপক রিচার্ড শ্যাপিরো, স্যান ফ্র্যান্সিস্কো থেকে আসা এক নৃতত্ত্ববিদকে ২০১০ সালের নভেম্বরে কোনো কারণ না দর্শিয়ে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে বিতাড়ন করা হয়। এটা করা হয় সম্ভবত তার কাজের অংশীদার অঙ্গনা চ্যাটার্জিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। অঙ্গনা চ্যাটার্জি হচ্ছেন ইন্টারন্যাশনাল পিপলস ট্রাইব্যুনাল অন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড জাস্টিসের (মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্তর্জাতিক গণআদালত) যুগ্ম আহবায়ক। এ সংগঠনটি কাশ্মীরে চিহ্নহীন গণকবরগুলোর অস্তিত্ব প্রথম লিপিবদ্ধ করে।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ম্যানিলাভিত্তিক সংগঠন দ্য এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস (এফাদ) বা অনিচ্ছায় হারিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে এশীয় ফেডারেশন থেকে আসা মে অ্যাকুইনোকে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে বিতাড়ন করা হয়। চলতি বছরের প্রথম দিকে, ২৮ মে ভারতীয় স্পষ্টবাদী গণতান্ত্রিক অধিকার কর্মী গৌতম নবলাখকে শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে জোর করে দিল্লিতে ফেরত পাঠানো হয়। কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ এ বিতাড়নের সমর্থনে বলেন, নবলাখ ও আমার মতো লেখকদের কাশ্মীরে প্রবেশের কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা ‘কাশ্মীর পোড়াবার জন্য নয়’।

দিল্লি ও সেই সঙ্গে শ্রীনগরে সীমান্ত প্রহরার দুটো সমকেন্দ্রিক বৃত্ত কাশ্মীরকে ক্রমশ বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে, যেন এটি ইতোমধ্যেই নিজস্ব ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হয়েছে। অবশ্য এর সীমান্তের অভ্যন্তরে সরকার ও সেনাবাহিনী যখন যা খুশি তাই করতে পারে। ঘুষ, ভীতি প্রদর্শন, ব্ল্যাকমেইল ও অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতার এক বিস্তৃত ধারার ভয়ঙ্কর এক মিশ্রন ব্যবহার করে কাশ্মিরী সাংবাদিক ও সাধারণ জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশলটি ক্রমশ বিকশিত হয়ে এক বিকৃত শিল্প মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

সরকার যখন জীবিতদের চুপ রাখার চেষ্টায় রত, মৃতরা তখন কথা বলতে শুরু করেছে। ঠিক যখন রাজ্যটির মানবাধিকার কমিশন লজ্জায় শেষ পর্যন্ত এটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, কাশ্মীরের তিনটি জেলাতে ২ হাজার ৭০০টি চিহ্নহীন কবর রয়েছে, তখন বার্সামিয়ানের কাশ্মীর ভ্রমণের পরিকল্পনা করাটা ছিল সম্ভবত এক অসংবেদনশীল কাজ। অন্য জেলাগুলো থেকেও এমন হাজার হাজার কবরের খবর এসে উপচে পড়ছে। ঠিক যখন জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সামনে ভারতের রেকর্ড পর্যালোচনা হওয়ার কথা তখন চিহ্নহীন কবরগুলোর মাধ্যমে ভারত সরকারকে বিব্রত করাটা ছিল সম্ভবত এক অসংবেদনশীল কাজ।

বিপজ্জনক ডেভিড ছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রটি আর কাকে ভয় পায়? হ্যাঁ, লিঙ্গরাম কোডোপি নামে ছত্তিশগড় রাজ্যের দান্তেওয়াড়ার এক তরুণ আদিবাসী আছে, যাকে ৯ সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ বলছে, এসার নামের এক লৌহ আকর খনি কোম্পানির তরফ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী) কাছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তার জন্য চাঁদার টাকা দেওয়ার সময় তারা এক বাজার এলাকায় লিঙ্গরামকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে। তার চাচী সোরি বলছে, সাদা পোশাক পরা পুলিশ পালনার গ্রামে তার দাদার বাড়ি থেকে তাকে একটি বোলোরো গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এমনকি তাদের নিজেদের ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশ লিঙ্গরামকে গ্রেফতার করলেও মাওবাদীদের কিন্তু পালিয়ে যেতে দেয়। এটা হচ্ছে লিঙ্গরামের বিরুদ্ধে আনা ও পরে প্রত্যাহার করা একের পর এক নানা উদ্ভট, প্রায় দৃষ্টিভ্রমসম অভিযোগসমূহের সবশেষেরটি। তার আসল অপরাধ হচ্ছে, সে হচ্ছে একমাত্র সাংবাদিক যে স্থানীয় ভাষা গন্ডিতে কথা বলতে পারে এবং যে দান্তেওয়াড়ার গহীন পথগুলো চেনে, কেননা দান্তেওয়াড়া হচ্ছে ভারতের আরেক যুদ্ধক্ষেত্র যার কোনো খবর বাইরে যাওয়া চলবে না।

মধ্য ভারতের আদিবাসী উপজাতিদের আবাসভূমির বিশাল সব এলাকা কতগুলো গোপন চুক্তির অধীনে বহুজাতিক খনি ও অবকাঠামো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিয়ে, সরকার শত সহস্র নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিয়োগ করেছে ওই বনাঞ্চলগুলো আদিবাসীমুক্ত করতে। এর বিরুদ্ধে যত প্রতিরোধ সংগঠিত হয়েছে, সশস্ত্র ও নিরস্ত্র, সবই মাওবাদী আখ্যা দেওয়া হয়েছে (কাশ্মীরে এগুলো সব হচ্ছে ‘জিহাদি উপাদান’)।

গৃহযুদ্ধ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, শত শত গ্রাম আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। হাজার হাজার আদিবাসী পালিয়ে গিয়ে প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। বনগুলোতে লুকিয়ে সন্ত্রস্ত জীবন কাটাচ্ছে শত সহস্র লোক। অরণ্য অবরোধ করে ঘাঁটি গেড়েছে আধাসামরিক বাহিনীগুলো। যার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদী ও ওষুধপত্র কিনতে বাজারে যাওয়া গ্রামবাসীর জন্য হয়ে উঠেছে এক দুঃস্বপ্ন। কত লোক যে জেলে পচছে তার সংখ্যা জানা নেই। যাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিযোগ আনা হয়েছে কিন্তু তাদের পক্ষ সমর্থন করার জন্য কোনো উকিল নেই। ওই বনগুলো থেকে খুব কম খবরই বাইরে আসতে পারে এবং মৃতদেহের কোনো হিসাব রাখা হয় না।

অতএব, তরুণ লিঙ্গরাম কোডোপি কেন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা বোঝা আর শক্ত নয়। সাংবাদিক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগে সে দান্তেওয়াড়াতে গাড়ি চালাত। পুলিশ ২০০৯ সালে তাকে গ্রেফতার করে ও তারি জিপটি জব্দ করে নেয়। তাকে ৪০ দিন একটা ছোট টয়লেটে আটকে রেখে সালওয়া যুদুমের একজন বিশেষ পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার জন্য তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। সালওয়া জুদুম হচ্ছে একটি সরকার গঠিত প্রহরী সেনাদল যাদের ওই সময়ে জোর করে লোকজনকে তাদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করার কাজে নিয়োগ করা হয়- পরবর্তীতে সুপ্রিমকোর্ট সালওয়া জুদুমকে সংবিধানবিরোধী বলে ঘোষণা করে।

গান্ধীবাদী কর্মী হিমাংশু কুমার আদালতে একটি হেবিয়াস কোর্পাস (কোনো ব্যক্তিকে অন্তরীণ রাখার বৈধতা যাচাই করার জন্য তাকে বিচারকের সামনে বা আদালতে হাজির করার নির্দেশ জারি করার) আবেদন দাখিল করার পর, পুলিশ লিঙ্গরামকে মুক্তি দেয়। কিন্তু, তারপর পুলিশ লিঙ্গরামের বৃদ্ধ পিতা ও তার পরিবারের আরো পাঁচজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। পুলিশ তার গ্রামের ওপর আক্রমণ চালায় এবং গ্রামবাসী তাকে আশ্রয় দিলে, তাদের হুমকি দেয়। শেষ পর্যন্ত লিঙ্গরাম দিল্লিতে পালিয়ে যায়, যেখানে বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীরা তাকে একটি সাংবাদিকতা বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। ২০১০ সালের এপ্রিলে সে দান্তেওয়ারাতে গিয়ে গ্রামবাসীদের দিল্লি নিয়ে আসে সালওয়া যুদুম, পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীগুলোর বর্বরতার ব্যাপারে স্বাধীন গণআদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। সে নিজে যে সাক্ষ্য দেয় তাতে লিঙ্গরাম মাওবাদীদেরও কড়া সমালোচনা করে।

কিন্তু ছত্তিশগড় পুলিশকে তা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। ২০১০ সালের ২ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশ মাওবাদী পার্টির মুখপাত্র প্রবীণ মাওবাদী নেতা কমরেড আজাদকে গ্রেফতার ও হত্যা করে। ছত্তিশগড় পুলিশের উপ-মহাপরিচালক কাল্লুরি এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, মাওবাদী পার্টি কমরেড আজাদের ভূমিকা পালনের জন্য লিঙ্গরাম কোডোপিকে নির্বাচিত করেছে (এটা যেন ১৯৩৬ সালের ইয়ানানে কোনো তরুণ স্কুলছাত্রের বিরুদ্ধে ঝৌএনলাই হওয়ার অভিযোগ আনার মতো)। এই অভিযোগ এমন বিদ্রূপের মুখোমুখি হয় যে, পুলিশকে তা প্রত্যাহার করতে হয়। কিছুদিন পরেই ওরা দান্তেওয়াড়ায় কংগ্রেসের এক আইন প্রণেতার ওপর এক মাওবাদী আক্রমণের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে লিঙ্গরামকে অভিযুক্ত করে। কিন্তু, অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ওরা তাকে গ্রেফতার করার জন্য কোনো উদ্যোগই নেয়নি।

লিঙ্গরাম দিলিলতে থেকে যায়, তার কোর্স শেষ করে ও সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা পায়। ২০১১ সালের মার্চে আধাসামরিক বাহিনীগুলো দান্তেওয়াড়ার তিনটি গ্রাম- তাদমেতলা, তিম্মাপুরম ও মোরাপল্লি জ্বালিয়ে দেয়। ছত্তিশগড় সরকার এর জন্য মাওবাদীদের দায়ী করে। সুপ্রিমকোর্ট সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা কেন্দ্রীয় অনুসন্ধান ব্যুরোকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়। লিঙ্গরাম একটি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে দান্তেওয়াড়ায় ফিরে আসে এবং গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসীর সাক্ষ্য সরাসরি রেকর্ড করে যারা এ ঘটনার জন্য পুলিশকে অভিযুক্ত করে। এ কাজটি করে সে হয়ে ওঠে দান্তেওয়াড়ার যে ক’জনকে পুলিশ সবচেয়ে হন্যে হয়ে খুঁজছিল তাদের একজন। অবশেষে ৯ সেপ্টেম্বরে পুলিশ তাকে ধরতে সক্ষম হয়।

লিঙ্গরাম ছত্তিশগড়ের জ্বালাতন সৃষ্টিকারী সংবাদ সংগ্রাহক ও সরবরাহকারীদের এক বেশ বড়সড় দলে যোগ দেয়। তাদের মধ্যে সবার আগে যার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয় তিনি হচ্ছেন লোকমান্য চিকিৎসক বিনায়ক সেন, যিনি ২০০৫ সালেই সালওয়া জুদুমের নানা অপরাধ সম্পর্কে প্রথম সতর্ক করে দেন। তাকে মাওবাদী হওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালে গ্রেফতার করা হয় ও আজীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। বছরের পর বছর জেল খেটে, তিনি এখন জামিনে মুক্ত আছেন।

দান্তেওয়াড়ার অরণ্যের গ্রামগুলোয় যখন প্রথম যাই তখন আমার পথপ্রদর্শক ছিলেন কোপা কুনজম। সে সময় সে হিমাংশু কুমারের বানভাসী চেতনা আশ্রমের কাজে যুক্ত ছিল এবং লিঙ্গরাম বেশ পরে যা করার চেষ্টা চালায় সেও তা-ই করছিল- প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে যাওয়া, সংবাদ সংগ্রহ করে আনা এবং যে বিভীষিকা মূর্ত হয়ে উঠছিল সতর্কতার সঙ্গে তার তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করে রাখা। দান্তেওয়াড়ায় আসা সাংবাদিক, লেখক ও শিক্ষাবিদদের শেষ নিরপেক্ষ আশ্রয় ওই আশ্রমটিকে ছত্তিশগড় সরকার ২০০৯ সালের মে’তে ধ্বংস করে দেয়।

২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে মানবাধিকার দিবসে কোপাকে গ্রেফতার করা হয়। এক ব্যক্তিকে হত্যা ও অন্য একজনকে অপহরণ করার কাজে মাওবাদীদের সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। কিন্তু, কোপার বিরুদ্ধে মামলাটি ঝুলে যাচ্ছে, কেননা যাকে অপহরণ করা হয় সেই লোকসহ পুলিশের সাক্ষীরা পুলিশের কাছে আগে যে জবানবন্দি দিয়েছিল বলে দাবি করা হয় তা অস্বীকার করেছে। এতে আসলে কিছু আসে যায় না, কেননা ভারতে বিচার প্রক্রিয়াটাই শাস্তি।

নিজেকে নিরপরাধী প্রমাণ করতে কোপার হয় তো বহু বছর লাগবে। কোপার দেখাদেখি সাহস করে যারা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে তাদেরও অনেককে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে যেসব নারীও আছে যারা ধর্ষিত হওয়ার অপরাধ করেছিল। কোপার গ্রেফতারের কিছুদিনের মধ্যেই হিমাংশু কুমারকে দান্তেওয়াড়া থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

কালক্রমে এখানেও মৃতরা কথা বলতে শুরু করবে। আর শুধু মৃত মানুষই নয়, মৃত ভূমি, মৃত নদীগুলো, মৃত পর্বতগুলো এবং মৃত অরণ্যসমূহে মৃত প্রাণীকূলও তাদের কথা শোনার দাবি জানাবে।

নজরদারি, ইন্টারনেট প্রহরা ও ফোনে আড়িপাতার এই যুগে যারা স্পষ্ট কথা বলে তাদের ওপর চালানো দমন যখন দিনে দিনে আরো বেশি কঠোর হয়ে উঠেছে তখন ভারত যেভাবে সাহিত্য উৎসবের স্বপ্নভূমি হয়ে উঠছে তা সত্যি অদ্ভুত। এসব উৎসবের অনেককেই অর্থ যোগায় সেই সব করপোরেশন যাদের হয়ে পুলিশ তাদের সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

শ্রীনগরের হারুদ সাহিত্য উৎসবটি এ মুহূর্তে যা স্থগিত রয়েছে ভারতের নবতম, সবচেয়ে উদ্দীপনাময় সাহিত্য উৎসব হওয়ার কথা ছিল- ‘হেমন্তে পাতারা যেভাবে বদলায়, কাশ্মীর উপত্যকাও তেমনি কবিতা, সাহিত্য সংলাপ, বিতর্ক ও আলোচনার শব্দে অনুরণিত হবে…’।

এর আগে আয়োজকরা এটাকে একটি ‘অরাজনৈতিক’ অনুষ্ঠান হিসেবে প্রচার করে। কিন্তু তারা জানায়নি, যে পাশবিক সামরিক দখলদারিত্ব শত সহস্র জীবন কেড়ে নিয়েছে তার শাসকবৃন্দ অথবা প্রজাবর্গের পক্ষে কীভাবে ‘অরাজনৈতিক’ হওয়া সম্ভব। আমি মনে মনে প্রশ্ন করি- অতিথিরা কি ভ্রমণ ভিসা নিয়ে আসবে? শ্রীনগর ও দিল্লির জন্য কি তা হবে আলাদা আলাদা? তাদের কি নিরাপত্তা ছাড়পত্রের প্রয়োজন হবে?

এসব ভেজাল স্বাধীনতার আনন্দ কোলাহল বিতাড়িতদের যখন হাত পা ধরে ঝুলিয়ে প্রস্থানোদ্যত উড়োজাহাজে তুলে দেওয়া হয় তখন বিমানবন্দরের করিডোরে ওঠা পায়ের শব্দ স্তিমিত করতে সাহায্য করে, শক্ত, গরম কব্জির চারপাশে হাতকড়া আটকানোর যে ক্লিক শব্দ আর জেলখানার দরজাগুলো বন্ধ হওয়ার যে ঠান্ডা ধাতব ক্ল্যাং শব্দ তা ঢেকে দিতেও সাহায্যে আসে। আমাদের ফুসফুসের অক্সিজেন ক্রমশই কমে আসছে। এখনো আমাদের দেহে যে শ্বাস তা ব্যবহার করে হয়তো এখন আমাদের বলা উচিত : ‘হারামি দরোজাগুলো খুলে দাও’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন