মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১১

মওলানা ভাসানী ও অবহেলিত নেতৃবৃন্দ

হুজুর মওলানা ভাসানী সত্যিই একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি। দরিদ্রের ভাঙা কুটির থেকে রাজার প্রাসাদ—সবই ছিল তার কাছে এক সমান। হুজুর মওলানা ভাসানীকে নিয়ে নানাজন নানা কথা বলে, নানাভাবে মূল্যায়ন, অবমূল্যায়ন করে। অবহেলা আর অনাদর এ যেন তার জন্মগত প্রাপ্য। জন্মেছিলেন এক দরিদ্র ঘরে। মা-বাবা হারা হয়ে ছেলেবেলায়ই হয়েছিলেন অসহায়। চেগা মিয়া নামে ছেলেবেলায় পরিচিত ছিলেন। হঠাত্ই অলি-এ-কামেল হজরত নাসির উদ্দিন বোগদাদীর সঙ্গে দেখা না হলে তিনি আর দশটি অজানা মানুষের মতোই হারিয়ে যেতেন। হজরত নাসির উদ্দিন বোগদাদী তাকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে দেওবন্দে পাঠিয়েছিলেন। নিয়মিত বাঁধনের মধ্যে থেকে কোনোকিছু করা তার কোনোদিনই ভালো লাগেনি। তাই দেওবন্দ তাকে ধরে রাখতে পারেনি, চলে এসেছিলেন। গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে পরিণাম কী হবে কোনোদিন ভাবেননি। জীবনে কত কী করেছেন তা লেখাজোখা নেই। সাধারণ ক্ষেতমজুর যেমন ক্ষেত-খামারে কাজ করে, তিনিও করেছেন। বগুড়ার পাঁচবিবির জমিদার বাড়িতে সর্দারি করেছেন। জমিদারের পুত্র-কন্যাদের গৃহশিক্ষকের কাজ করেছেন। সেই জমিদারেরই কন্যা আলেমাকে বিয়ে করেছেন। শ্বশুরের বিশাল সম্পত্তি, পাঁচবিবি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাকে দান করে নিঃস্ব-রিক্ত হয়েছেন। যে সন্তোষ জমিদারদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে জনগণের অধিকার রক্ষার চেষ্টা করেছেন, যে জমিদাররা তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে, এমনকি ব্রিটিশ সরকারকে দিয়ে ময়মনসিংহ জেলা থেকে বহিষ্কার করে আসামে পাঠিয়েছে—সেই সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করার তার বহুদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। সেখানে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। যে বিশ্ববিদ্যালয় শেরে বাংলার মৃত্যুদিনে, ইদানীং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুদিনে ও অন্যান্য জাতীয় ছুটির দিনে বন্ধ থাকে, কিন্তু তাঁর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর মৃত্যুদিনে বন্ধ হয় না বা থাকে না। এবারও ১৭ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো সরকারি অনুষ্ঠান হয়নি। কোনো মন্ত্রী যাননি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কেউ শ্রদ্ধা নিবেদন করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্মানজনক কোনো অনুষ্ঠান করেনি। এক সময় যারা হুজুর মওলানা ভাসানীর পোঁটলা-পুঁটলী, জুতা-খড়ম বয়ে নিজেদের ধন্য মনে করত তারা অনেকেই আজ বিশাল বিশাল নেতা বা ব্যক্তি। হুজুর এক দিনের জন্যও তাঁর পরিবারের প্রতি দৃষ্টি দেননি। তিনি পুরো জাতিকে জাগাতে চেয়েছিলেন। দেশকে বঞ্চনামুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই তার ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষায় তেমন উপযুক্ত হয়নি। আর্থিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে। এ যেন নিয়ম হয়ে গেছে, রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা পাবে, জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের পরিবার পাবে, ক্ষমতায় থাকলে বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর কোনো বংশধর নেই তবুও তার নামে অনেকেই পাবে। সেনাবাহিনী বা অন্য বাহিনীর লোকজনেরা আহত-নিহত হলে তারা সুযোগ-সুবিধা পাবে। হুজুর মওলানা ভাসানীর পরিবার-পরিজন না খেয়ে মরে গেলেও তারা পাবে কেন? এ যেন এক বিধিলিপি। তাই যখনই হুজুর মওলানা ভাসানীর বংশের কাউকে আশপাশে দেখি নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। হুজুর জীবনে পো ধরেননি, নিজেও পো ধরতে শিখলাম না। আখেরাতে যে কী হবে আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনই জানেন। তাই ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত্ নিয়ে সব সময়ই শঙ্কিত থাকি। কারণ হুজুর মওলানা ভাসানীর ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতকুরদের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। যারা দু’চারজন লেখাপড়া শিখেছে তারা চলে এক রকম, আর যারা শিখেনি তারা বড় লোকদের দয়া-দাক্ষিণ্যের জন্য সব সময় কাতর হয়ে থাকে। এমনকি তার নাতি-নাতকুররা মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিয়ন, চাপরাশি, চকিদারের চাকরির জন্য ভাইস চ্যান্সেলর ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের পিছে পিছে ঘুরে। হয়তো এসব দেখে তাদের অনেকেরই গর্ব হয়। আর কিছু না হোক মওলানা ভাসানীর নাতি-নাতকুররা তাদের দয়ার জন্য পিছে ঘুরছে। কবি নজরুল তার ‘গোকুল নাগ’ কবিতায় লিখেছিলেন—
‘আজ’টাই সত্য নয়, ক’টা দিন তাহা?
ইতিহাস আছে, আছে ভবিষ্যত্, যাহা
অনন্ত কালের তরে রচে সিংহাসন,
সেখানে বসাবে তোমা বিশ্বজনগণ।
আজ তাহা নয় বন্ধু, হবে সে তখন—
পূজা নয়—আজ শুধু করিনু স্মরণ।’

আমারও মাঝে মাঝে অমনটা বলতে ইচ্ছে করে। আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। সব রাজনৈতিক নেতাকে জেলে পুরে বড় বেশি অস্বস্তিতে ছিলেন। ’৫৮ থেকে ’৬২ প্রায় চার বছর এক শ্বাসরুদ্ধকর বন্ধ অবস্থা। এরপর ঘরোয়া রাজনীতির দ্বার উন্মোচন। রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে ততদিনে বুঝেছিলেন রাজনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া তার কোনো গত্যন্তর নেই। খান সাহেব ছিলেন ঝানু লোক। তিনি প্রথমই বেছে নিয়েছিলেন হুজুর মওলানা ভাসানীকে। হুজুর মওলানা ভাসানীও যে-সে কেউ ছিলেন না। আয়ুব খানকে দশ ঘাটের পানি খাওয়াতে তার তেমন ভাবতে হয়নি। রাজবন্দিদের মুক্তি ও পাকিস্তানের নানা সমস্যা সমাধানে হুজুর মওলানা ভাসানীকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মজলুম জননেতা যখন ইসলামাবাদ রাষ্ট্রপতি ভবনে যান, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রেসিডেন্ট হাউজের বারান্দায় জেনারেল আয়ুব খানকে না দেখে তিনি খুব বিরক্ত হন, বৈঠকের নির্দিষ্ট ঘরে গিয়েও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় যারা অভ্যর্থনা করে নিয়ে গিয়েছিল তাদের বলেন, ‘বাবারা, তোমাদের এখানে জায়নামাজ আছে?’ পাকিস্তানের ইসলামাবাদে রাষ্ট্রপতি ভবন, আর সেখানে জায়নামাজ থাকবে না? মুহূর্তের মধ্যেই হুজুরের সামনে জায়নামাজ পেতে দেয়া হয়। তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যান। এক, দু’রাকাত শেষ হতেই পাশের ঘর থেকে আয়ুব খান এসে দেখেন হুজুর নামাজ আদায় করছেন। হুজুরকে নামাজ পড়তে দেখে চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। নামাজ পড়ে সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত শেষে দাঁড়াতেই তাকে আয়ুব খান স্বাগত জানান। এরপর লম্বা আলোচনা। সব রাজবন্দিকে মুক্তি, ’৪৭ এর পর ভারত থেকে পাকিস্তানে আসা মোহাজেরদের পুনর্বাসন, পাটের ন্যায্য দাম এবং ক্রুক কমিশনের সুপারিশমত পূর্ব বাংলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। ঘণ্টা দুই আলোচনা করে প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে এলে সাংবাদিকরা তাকে জেকে ধরে। সাংবাদিকদের প্রশ্ন, ‘বিরোধী পক্ষের রাজনীতিক হয়েও একজন স্বৈরশাসকের সঙ্গে আপনি কেন আলোচনা করছেন? কি আলোচনা করলেন?’ হুজুর মওলানা ভাসানী খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘সব রাজবন্দির মুক্তি, মোহাজেরদের পুনর্বাসন, পাটের ন্যায্য দাম, পূর্ববঙ্গের বন্যা নিয়ন্ত্রণ—এসব দাবি মেনে নিলে আয়ুব খান কেন, আমি শয়তানের সঙ্গেও আলোচনায় বসতে রাজি আছি।’ সেদিন তার মন্তব্যে সারা পাকিস্তানে সাড়া জেগেছিল এবং পরবর্তী সময়ে মহাচীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নায়কই ছিলেন হুজুর মওলানা ভাসানী। দেখতেও মাওসেতুংয়ের মতো ছিলেন, আর মাওসেতুং তাকে খুব ভালোবাসতেন, কথাও শুনতেন। উপহার হিসেবে মাওসেতুং সরকার হুজুরকে সেচ কাজের জন্য এক বিশাল পানির পাম্প ও ট্রাক্টর দিয়েছিল। যে পাম্প চালাতে কম করে তিন-চারশ’ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনের দরকার ছিল। আর চার-পাঁচশ’ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনে ঘণ্টায় ৬০-৭০ লিটার তেলের প্রয়োজন হতো। সে তেল তার গাঁটের পয়সা খরচ করে কোনোদিনই কিনতেন না। তার প্রমাণ সেই ষাটের দশকে দেয়া ট্রাক্টর পাঁচবিবিতে ’৭০ সাল পর্যন্ত পড়েছিল। খুব একটা চালানো হয়নি। সে যাক। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেদিনের সেই ঐতিহাসিক বৈঠকে রংপুরের জনাব মশিহুর রহমান সঙ্গী ছিলেন। আসরের পর সময় নির্ধারিত ছিল। তাই বেরুবার আগেই নামাজ আদায় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হাউজে আবার নামাজ আদায় করায় জনাব মশিহুর রহমান যাদু মিয়া খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন; প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেই বিস্ময়ভরা চোখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হুজুর, আপনি তো আসরের নামাজ আদায় করেই গিয়েছিলেন, ওখানে আবার নামাজ পড়লেন কেন?’ প্রশ্ন শুনে বলেছিলেন, ‘এই সোজা ব্যাপারটা বুঝলা না? আমরা তো আর আমাদের ইচ্ছায় যাইনি। প্রেসিডেন্ট তার দরকারে দাওয়াত করেছেন। দাওয়াতের একটা তাহিজব-তামাদ্দুন আছে না? আমাদের দাওয়াত করলেন, তার বাড়িতে রিসিভ করলেন না—এটা কেমন করে হয়? আমাদেরকে প্রেসিডেন্ট রিসিভ করবেন না, আমরা প্রেসিডেন্টকে রিসিভ করব—সেও কি কখনও হয়? আক্কেল থাকলে গাড়ি বারান্দাতেই তো আমাকে তার রিসিভ করার কথা ছিল। যাক, বারান্দায় করেন নাই, যে ঘরে আলাপ হবে সেই ঘরের দরজায় রিসিভ করতে পারতেন, তাও করলেন না। ঘরে গিয়ে দেখি তিনি বাইরে। তিনি বাইরে থেকে এলে আমারই তো তাকে রিসিভ করতে হয়। রিসিভ হতে গিয়ে তাকে রিসিভ করে আসলে অমন ঠকা ঠকি কী করে? তাই আবার নামাজ পড়লাম। অতিরিক্ত নামাজ পড়ায় কোনো দোষ নেই। বরং সওয়াবই আছে। দেখলা নামাজ শেষ কইরা দাঁড়াইতেই কীভাবে রিসিভ করল?’ এই ছিলেন মওলানা ভাসানী। তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল বড় চনমনে। সারা জীবনে এ ধরনের হাজারও ঘটনা আছে; তাঁর ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের কারণে কত কিছু শুনেছি, জেনেছি। তারই বংশ বুনিয়াদ প্রতি ঘাটে ঘাটে অমর্যাদার শিকার হয়। তা হয়তো তারা বুঝতেও পারে না। তেমন মর্যাদা বোধ তাদের মাঝে জাগেনি। হুজুরের তৃতীয় পক্ষের ছেলে আবু বকর খুবই অসুস্থ। মনোয়ারা মাঝে সাঝে আমার বাসায় আসে। যখন যেভাবে পারি সম্মান করার চেষ্টা করি। আরেক বোন আনোয়ারাকে গত বছর চরের ভাঙা বাড়িতে হজরত নাসির উদ্দিন বোগদাদীর ওরসে দেখেছিলাম। অন্যদিকে আলেমা ভাসানীর গর্ভজাত আবু নাসের ভাসানী এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন, নামেই মন্ত্রী। তার ছোট ভাই কিবরিয়া টালমাটাল ঘুরে বেড়ায়। এত বড় একজন নেতার সয়-সন্তানের প্রতি আমরা কোনো দায়িত্ব পালন করলাম না। অথচ ভারতে মহাত্মা গান্ধী যেখানে নাথুরাম গডেসর গুলিতে মারা গেছেন সেই বাড়ি সংরক্ষিত আছে। ৩০ জানুয়ারি মার্গ নামে রাস্তা করা হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে পিঁড়িতে বসতেন রবীন্দ্র ভারতী সে পিঁড়ি সংরক্ষণ করছে। মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী এমনকি বোম্বেতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বাড়ি-ঘর সংরক্ষিত আছে। তাদের বংশ-বুনিয়াদ সসম্মানে সেখানে বাস করেন। আমার দেশেও পাবনায় সুচিত্রা সেনের বাড়ি সংরক্ষিত রাখতে নাগরিক আন্দোলন হচ্ছে; কিন্তু জীবন নাট্যের মহানায়ক মওলানা ভাসানীর স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তার পরিবার-পরিজনের কোনো মর্যাদা নেই। এ যে আমাদের জন্য কত বড় কলঙ্ক, কত বড় লজ্জা—এ উপলদ্ধি যে কবে হবে সেই শুভদিনের আশায় আছি।
কেন যেন সবক্ষেত্রে সব দলে জাতীয় নেতৃবৃন্দ অবহেলিত, লাঞ্ছিত হচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সবচেয়ে পুরনো দল। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে জন্ম নিয়েছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। সেই সময় দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দিয়েছিল। জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা কলাকৌশল ও ষড়যন্ত্রে দলটি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি। নানা দ্বন্দ্বে খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে। তবু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তারা আছে। অনেকের সেই চেতনাও আছে। এরপর মিলিটারি শাসক বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র জন্ম। সৌভাগ্যক্রমে দলটি এখন দাঁড়িয়ে গেছে। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের বিএনপি’র চেয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের বিএনপি অনেক বিশাল এবং বিরাট। এরপরে ওই একই পদ্ধতিতে জন্ম নেয় জাতীয় পার্টি। একটানা ৯ বছর হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দেশ শাসন করেন। এরপর ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু এটা খুবই ব্যতিক্রমী যে একজন সেনানায়ক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েও পরে বার বার ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে এসেছেন। এসব দলে ত্যাগী মানুষের মূল্যায়ন হয়নি। বিএনপি ভীষণ খারাপভাবে তার প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে দল থেকে বের করে দিয়ে নিষ্ঠুর দুর্ব্যবহার করেছে। আব্দুস সালাম তালুকদার ও আব্দুল মান্নান ভূইয়া দীর্ঘদিন দলের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করলেও মতের অমিল হওয়ায় তাদের প্রতি ভীষণ অবহেলা দেখানো হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের ব্যাপারে তো কথাই নেই। এ দলটি সব সময় বর্তমানের পূজারি। বর্তমানের জন্য অতীতকে কবর দিতে তাদের এক মুহূর্তও লাগে না। অবলীলায় কাফন-দাফন করে মুহূর্তে বর-কনে সাজতে পারে। যারা বঙ্গবন্ধুর লাশ কবর দিতে ঘৃণা প্রকাশ করেছে তারা আজ সরকারকে চতুর্দিকে মুড়ে রেখেছে। আর যারা বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন-যৌবন ঝরিয়েছে, খেয়ে না খেয়ে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছে—তারা আওয়ামী লীগের দ্বারাই নিগৃহীত। এক সময় আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সিলেটের দেওয়ান ফরিদ গাজী, ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন ভূইয়া ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, টাঙ্গাইলে জনাব আব্দুল মান্নান, হাতেম আলী তালুকদার, শামসুর রহমান খান শাহজাহান, বদিউজ্জামান খান, পাবনা সিরাজগঞ্জের ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, বগা মিয়া, মোতাহার হোসেন, দিনাজপুরের অধ্যাপক ইউসুফ আলী, জনাব আব্দুর রহিম, অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, রংপুরের মতিউর রহমান, বগুড়ার মজিবর রহমান, মাগুরার আসাদুজ্জামান যশোরের মশিউর রহমান ও রওশন আলী, খুলনায় শেখ আব্দুল আজিজ, সালাহ উদ্দিন ইউসুফ, রাজশাহীর আবু হেনা কামরুজ্জামান, ফরিদপুরের ফণী ভূষণ মজুমদার, কুমিল্লার জহিরুল কাইয়ুম, নারায়ণগঞ্জের সামসুজ্জোহা, ঢাকায় তাজউদ্দিন আহমেদ ও গাজী গোলাম মোস্তফা, চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরী ও শেখ আব্দুল আজিজ—এরাই ছিলেন তখন সারা দেশে আওয়ামী লীগের প্রাণ। আজকের নেতৃত্ব এদের কারও কথা ভাবে না। সেদিন হঠাত্ সুদূর আমেরিকা থেকে এক টেলিফোন পাই। বললেন, ‘মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছ থেকে নাম্বার নিয়েছি। আমি বগুড়ার মজিবুর রহমানের ছেলে। ’৭৫-এ বগুড়ার গভর্নর ছিলেন। তার আগে অনেকদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছে। প্রবীণ নেতা মজিবুর রহমানের নাম শুনতেই বুকের ভেতরটা নাড়া দিয়েছিল। কতবার কতভাবে তাকে দেখেছি। ’৭২-এ মকসুদের দিনাজপুর ছাত্রলীগের সম্মেলনে যাওয়ার পথে মজিবর ভাইর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সম্মেলন শেষে ফেরার পথে বগুড়ার সাত মাথায় এক বিশাল সভার পর তিনি তার বাড়িতে নিয়ে সে যে কী যত্ন করে খাইয়েছিলেন, তার তুলনা হয় না। ’৭৫-এ জেলা গভর্নর হয়েছিলেন, বঙ্গভবনে গভর্নরদের প্রশিক্ষণ ক্লাসে কত পাশাপাশি বসেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘মুজিব’ থাকতে যেমন বগুড়ায় গেলে মজিবর রহমানের বাড়িতে উঠতেন, থাকতেন, খেতেন, বঙ্গবন্ধু হয়েও তিনি বগুড়ায় মজিবর রহমানের বাড়ি গিয়েছেন, খেয়েছেন। কারণ দু’জনের একই নাম হওয়ায় খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মজিবর ভাইর ছেলে সুদূর আমেরিকা থেকে যখন এসব বলে খেদ ব্যক্ত করছিলেন তখন খুব খারাপ লাগছিল। ভদ্রলোক আমেরিকায় থাকে, তাই অনেককিছু আশা করে। কিন্তু এখন কারও কাছে কিছু আশা করা অরণ্যে রোদন মাত্র। এখন মনে রাখা নয়, ভুলে যাওয়া, ভুলিয়ে দেয়ার দিন। তা না হলে সব দলের জীবিত-মৃত জাতীয় নেতারা অবহেলিত হবেন কেন? আজ ক’টা মাস জনাব আব্দুর রাজ্জাক লন্ডনে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। একজন সংসদ সদস্য থাকার পরও সরকার তার দায়িত্ব নেয়নি। প্রয়োজনে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় যেতে পারেন, যারা বঙ্গবন্ধুর পিঠের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজিয়েছে তাদের মন্ত্রিসভায় নিতে পারেন, খন্দকার মোস্তাকের ছায়া এইচটি ইমামকে উপদেষ্টা করতে পারেন, চরম নির্যাতনের শিকার আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আব্দুল জলিল, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শ্রী সুরঞ্জিত্ সেনগুপ্ত, মোহাম্মদ নাসিম, ওবায়দুল কাদের... রাষ্ট্র চালাতে এদের মতো নেতার পরামর্শও নিতে পারেন না। জিদের ভাত কুত্তা দিয়ে খাওয়াবেন, তবু সতীনের পেট ভরতে দেবেন না। আজ লাগামহীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, একেবারে দিশেহারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সর্বৈব ব্যর্থ অর্থ মন্ত্রণালয়। একেবারে নির্জীব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের তো কথাই নেই। অথচ নির্যাতনের সময় কেউ কারও চেয়ে কম হন না। জনাব পোস্টার নুরুল ইসলাম আজকে কোথায় কেউ তার খোঁজ-খবর রাখে না। অথচ এদের অবদান কারও চেয়ে কম নয়। ইদানীং দেশটা চলছে একটি জয়েন স্টক কোম্পানির মতো। কারও কোথাও কোনো মর্যাদা নেই। প্রবীণদের তো নেই-ই, নবীনদেরও নেই। যখন যাকে প্রয়োজন তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবহার শেষে বিড়ি-সিগারেটের শেষাংশের মতো ফেলে দিচ্ছে। এ করে আর যাই হোক ভাবিকালে কোনো দেশপ্রেমিকের জন্ম হবে না। দেশপ্রেম এমনি এমনি আসে না। কাউকে না কাউকে অবলম্বন করে মানব হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগে। আমার এক বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল্লাহ বীর প্রতীক। একটুও লেখাপড়া জানে না। আজ ৪০ বছর সঙ্গে আছে। আর যে ক’বছর আমি বাঁচব বা সে বাঁচবে মনে হয় সঙ্গেই থাকবে। সে মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব একটা মাটিতে গড়াগড়ি করে যুদ্ধ করেনি। শুয়ে গুলি চালাতে গিয়ে দু’একবার ঘুমিয়ে পড়েছে বলে সে অনেক জায়গায় গুলি চালাতে দাঁড়িয়ে যেত। আমার দেখা সাধারণ যোদ্ধা হিসেবে আব্দুল্লাহ বীর প্রতীকের চেয়ে কোনো নির্ভয় সাহসী যোদ্ধা দ্বিতীয়টি দেখিনি। অমন নির্লোভ সরল মানুষ হয় না। সেই আব্দুল্লাহও যেদিন ভর্তি হয়েছিল, যদি সেদিন মুক্তি বাহিনীতে ভর্তি হতে না পারত সে রাজাকার হতো। এটা আমার কথা নয়, এটা বীর প্রতীক আব্দুল্লাহরই এক সাক্ষাত্কারের কথা। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন সে ১৫-১৬ বছরের কিশোর। মানুষের বাড়ি কাজ করে খেত। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতে পাহাড় অঞ্চলে গিয়েছিল। মুক্তি বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ালে তার স্বাস্থ্য-গতর ভালো ছিল না বলে আনফিট করা হয় মানে বাদ দেয়া হয়। সে খুব দুঃখ নিয়ে কর্মস্থলে ফিরে। কিছুদিন পর চারদিকে যখন শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ তখন তার মনে হয় তারও যুদ্ধে যাওয়া উচিত। তাই সে স্থির করে আবার মুক্তি বাহিনীতে যাওয়ার চেষ্টা করবে। যদি তাকে নেয়া না হয় তাহলে সে প্রয়োজনে রাজাকারেই ভর্তি হবে। কারণ দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। ওই বয়সে যুদ্ধ না করে তার ঘরে বসে থাকা ভালো লাগেনি। মোট কথা নাই কাজ তাই খই ভাজ। বলতে গেলে প্রায় সে রকমভাবেই আব্দুল্লাহ বীর প্রতীক মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিল। তখনও তার তেমন চেতনা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে কর্মকাণ্ড দেখে সে দেশপ্রেমিক হয়েছে। গাছ বুনলে যেমন পরিচর্যা করতে হয় তেমনি একটা সময় পর্যন্ত দেশপ্রেমের জন্যও কিছুটা পরিচর্যা করতে হয়। তাই বগুড়ার মজিবর রহমানের ছেলে জনাব মনজুর মোরশেদের বেদনা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। বিপ্লবী নেতা সিরাজুল আলম খান, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ, জননেতা আব্দুর রাজ্জাক, জননেতা আমির হোসেন আমু, নওগার আব্দুল জলিল, পঞ্চগড়ের সিরাজুল ইসলাম, দিনাজপুরের অ্যাডভোকেট আব্দুর রহিম, জামালপুরের আব্দুল হাকিম, ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন ভূইয়া... এদের মধ্যে যারা জীবিত তাদের কথাও মনে করে না, যারা মরে গেছেন তাদেরও স্মরণ করা হয় না। আর যাই হোক এভাবে একটি জাতি সভ্য সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন