বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১১

ভারতের বিস্মৃত অনশন



ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে বিরাট বৈপরীত্য রয়েছে। এরই প্রকাশ ঘটেছে আন্না হাজারের সাম্প্রতিক ১৩ দিনের এবং মণিপুরের ইরোম শর্মিলার ১১ বছরব্যাপী চলমান অনশন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়। ভারতের ব্যাঙ্গালোর ভিত্তিক স্বাধীন সাংবাদিক ও গবেষক সুধা রামচন্দ্রনের এই বৈপরীত্যমূলক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন আজফার আজিজ •
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক কর্মীরা তাদের প্রতি ভারত সরকার, তথাকথিত মূলধারার গণমাধ্যম ও ‘মূল ভূখন্ডের’ জনগণের ‘বৈষম্যপূর্ণ’ আচরণের প্রতিবাদে হাতে আবার অস্ত্র তুলে নিয়েছে।
একদিকে যখন দুর্নীতিবিরোধী ধর্মযোদ্ধা ও সমাজকর্মী আন্না হাজারের ১৩ দিনের অনশনের প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার তার দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পর্কে স্বাধীন তদন্ত চালানোর অধিকারী এক লোকপাল সংস্থা গঠনের দাবির ওপর কাজ শুরু করেছে, অন্যদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের রাজনৈতিক কর্মী ইরোম শর্মিলার ১১ বছরব্যাপী অনশনেও নয়াদিল্লির বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া নেই।
এশিয়া টাইমস অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শর্মিলার বড় ভাই, জাস্ট পিস ফাউন্ডেশনের প্রধান, ইরোম সিংহজিত বলেন, ‘হাজারের ১৩ দিনের অনশনের প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার লোকসভায় তার দাবি নিয়ে আলোচনা করলেও, শর্মিলা তার অনশন শুরু করার পর ১১ বছরে ভারতের লোকসভা একবারও তার আফসপা [আর্মড্ ফোর্সেস (স্পেশাল পাওয়ার্স) অ্যাক্ট, ১৯৫৮ বা সশস্ত্র বাহিনীর (বিশেষ ক্ষমতা) আইন, ১৯৫৮] বাতিলের দাবি নিয়ে আলোচনা করেনি।’ তিনি বলেন, ‘এটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণের প্রতি ভারতের জাতিগত বৈষম্যের প্রমাণ।’
আফসপা বাতিলের জন্য চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ৩৯ বছর বয়সী শর্মিলা ২০০০ সালের ৪ নভেম্বর থেকে এক অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন। তার দু’দিন আগে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত আধাসামরিক বাহিনী আসাম রাইফেলসের সদস্যদের তিনি মণিপুরের ইমফলের কাছে এক বাসস্টপে অপেক্ষমান ১০ জন বেসামরিক লোককে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছিলেন।
আফসপাই যে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করার সুযোগ ও ক্ষমতা যোগায় সে ব্যাপারে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আরো অযুত জনতার মতো নিশ্চিত হয়ে, তিনি এর পৈশাচিক চারিত্র্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ ও তা বাতিল করার জন্য চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে এক অনশন শুরু করেন।
অনশন শুরু করার কয়েক দিনের মধ্যেই পুলিশ শর্মিলাকে আত্মহননের চেষ্টা চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার করে। ভারতীয় দন্ডবিধির ৩০৯ ধারা অনুযায়ী আত্মহননের চেষ্টা একটি অপরাধ। প্রতিবাদে অনশন শুরু করার পর থেকে ১২০ মাসে শর্মিলা কিছুই খাননি। এক কারাগারের হাসপাতালে নাক দিয়ে ঢোকানো নলের মাধ্যমে তার খাদ্যনালীতে ফোটায় ফোটায় তরল খাদ্য ঝরে পড়ার যে ব্যবস্থা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী তার ক্ষেত্রে জোর করে চালু রেখেছে সে জন্যই আজও বেঁচে আছেন তিনি।
ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দিল্লির রামলীলা ময়দানে হাজারের অনশন যেভাবে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা টানা সম্প্রচার করে গেছে, ইরোমের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা একদম উল্টো। ভারতের তথাকথিত মূলধারার গণমাধ্যম তার প্রতিবাদের ওপর এক দশকে প্রায় কিছুই প্রকাশ বা প্রচার করেনি।
একদিকে যেখানে সারাদেশ থেকে হাজার হাজার লোকজন এসে হাজারের দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে, তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে, অন্যদিকে এদেশের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোর বাইরে বসবাসকারী অতি অল্প কয়েকজন ভারতীয়ই কেবল জানে যে, ২০০০ সালের নভেম্বর থেকে শর্মিলা এক অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন। বিদ্রোহ-বিধ্বস্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং জম্মু ও কাশ্মীর, যেখানে আফসপা বলবৎ রয়েছে, তার বাইরের খুব কম লোকেরই এই আইন বা যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য শর্মিলা এভাবে প্রাণপাত করে লড়ে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা রয়েছে।
১৯৫৮ সালে নাগাল্যান্ডে যার প্রথম প্রয়োগ- কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার কোনো অঞ্চলকে ‘অশান্ত’ ঘোষণা করলে যা জারি করা হয়ে থাকে- সেই আফসপার কিন্তু কেবল এক বছরকাল বলবৎ থাকার কথা। কিন্তু, আইনটি জারি হওয়ার ৫৩ বছর পর, আজ যে ভৌগলিক এলাকার ওপর আফসপা বলবৎ তার আয়তন অতিদ্রুত অনেক বিকৃত হয়েছে। মণিপুরে ১৯৬১ সালে প্রথমে এটি কিছু এলাকায় জারি করা হয়, কিন্তু ১৯৮০ সালে তা সম্প্রসারিত হয় সারা রাজ্যব্যাপী। এটি এখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের প্রতিটির ‘অশান্ত এলাকাসমূহে’ বলবৎ। কাশ্মীরে এটি চলে আসছে ১৯৯০ সালের জুলাই থেকে।
আফসপা সশস্ত্র বাহিনীকে নিছক সন্দেহবশত দেখামাত্র গুলি বা ঠুনকো অজুহাতে লোকজনকে গ্রেফতার করা, কোনো পরোয়ানা ছাড়াই খানা-তল্লাশি করা এবং কোনো বাড়িঘরে সন্দেহভাজন লোকজন লুকিয়ে আছে এমন ধারণা হলে তা গুঁড়িয়ে দেওয়ার অবাধ ক্ষমতা দেয়। এটি সশস্ত্র বাহিনীকে সব ধরনের এমনকি হত্যাকান্ডের অভিযোগ থেকেও অব্যাহতি দেয়। এর ৬নং ধারা বলে ‘এই আইন কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাসমূহ প্রয়োগ করার জন্য কৃত কোনো কাজ বা কোনো কাজ করার অভিযোগের দায়ে… কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন, মামলা দায়ের বা অন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।’
মানবাধিকার কর্মীরা এটা দেখিয়ে দিয়েছেন যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং জম্মু ও কাশ্মীরে হাজার হাজার নিরপরাধ বেসামরিক জনগণের মৃত্যু ও ‘নিখোঁজ’ হওয়ার জন্য আফসপা দায়ী। আফসপার লক্ষ্য যদি বিদ্রোহ দমন করা হয়ে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে এটি স্পষ্টতই ব্যর্থ। এই আইন প্রণয়নের প্রস্তাব পেশ করার পর সশস্ত্র বিদ্রোহী দলের সংখ্যা যে শুধু বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে তা-ই নয়, সেই সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষ অনেক বড় ভৌগলিক এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও সশস্ত্র বাহিনীগুলো দাবি করে যে, বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করতে আফসপার অধীনে যেমন অধিকার দেওয়া হয়েছে তেমন কিছু বিশেষ ক্ষমতা তাদের প্রয়োজন, কিন্তু একথা বলা মোটেই অতিশয়োক্তি হবে না যে, আফসপাই বরং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ ও বিক্ষোভকে উচ্চকিত করেছে।
আফসপা বাতিল করার দাবিতে পরিচালিত আন্দোলন কয়েক দশকের পুরনো। মনিপুরে তার পুরোভাগে ছিল কমবেশি ৩২টি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ অপুনবা লুপ, মণিপুরি পল্লীনারীদের তৃণমূল আন্দোলন মেইরা পাইবি এবং অধিকার কর্মীরা। যদি কেউ নিখোঁজ হয়, মেইরা পাইবির সদস্যরা জ্বলন্ত মশাল হাতে নিরাপত্তা বাহিনীর ছাউনির চারপাশে জড়ো হয়ে আফসপার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। এ অঞ্চলের অন্য হাজারো মানুষের মতো তারাও শর্মিলার অনশনের প্রতি জনসমর্থন গড়ে তুলেছে।
কিন্তু, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর বাইরে, আফসপা বাতিলের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন খুবই নগণ্য। আফসপার ধ্বংসাত্মক পরিণতি বা এমনকি শর্মিলার অসমসাহসী প্রতিবাদের কথা দূরে থাকুক, উত্তর-পূর্বের বাইরে খুব কম লোকই এই আইন সম্পর্কে কিছু জানে। বহু দূরবর্তী অশান্ত অঞ্চলটির প্রসঙ্গগুলোর ব্যাপারে ভারতীয় গণমাধ্যমের আগ্রহের অভাব বিবেচনা করলে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। তার ওপর, আফসপা যেহেতু ভারতীয় ‘মূল ভূখন্ডের’ জন্য প্রযোজ্য নয়, এখানকার খুব কম লোকই উত্তর-পূর্বের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করে।
এমন নয় যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চল আফসপার প্রতি ভারতের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেনি। একটা প্রবল ঝাঁকিতে ভারতের তন্দ্রা ছুটিয়ে দেওয়ার জন্য এটি নানা নাটকীয় কৌশল অবলম্বন করে। উদাহরণ স্বরূপ, ২০০৪ সালের জুলাইয়ে যখন আসাম রাইফেলসের সদস্যরা ৩২ বছর বয়সী থাংযাম মনোরমা দেবীকে ধর্ষণ ও পরে গুলী করে হত্যা করে, মেইরা পাইবি আন্দোলনের ১২ ইমা (মা) আফসপা বাতিলের দাবিতে আসাম রাইফেলসের তৎকালীন সদর দফতর কাংলা দুর্গের সামনে পুরো নগ্ন হয়ে অবস্থান নেন। ‘ওহে, ভারতের সৈনিকের দল! এসো, আমাদের সবাইকেই ধর্ষণ করো’ কাংলা দুর্গের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ওই ১২ জন মহিলা উলঙ্গ দেহে চিৎকার করতে থাকেন। তাদের ওই নাটকীয় প্রতিবাদের উদ্দেশ্য ছিল উত্তর-পূর্বে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলো আফসপার যে নির্লজ্জ অপব্যবহার করছে সেদিকে বাকি ভারত তথা সারাবিশ্বের, দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
মণিপুরে ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠা প্রতিবাদের মুখে, ভারত সরকার ২০০৪ সালে আফসপার পুনর্বীক্ষণের দায়িত্ব দেয় বিচারপতি বিপি জীবন রেড্ডি কমিটিকে। এই কমিটি আফসপা বাতিলের সুপারিশ করে। তারপরও আফসপা বলবৎ রয়েছে মণিপুর ও ভারতের আরো নানা ‘অশান্ত এলাকায়’।
হাজারের প্রতিবাদ ও তা সর্বভারতীয় গণসমর্থন লাভ করার পর, তাদের যন্ত্রণা ও দাবি-দাওয়ার প্রতি ভারতের নির্বিকার নির্লিপ্ততা দেখে তারা যে তীব্র মনোকষ্ট পায় এবার সেকথা বলেছে মণিপুরিরা। সিংহজিত বলেন, ‘ভারতের বাকি অংশ চিরকালই উত্তর-পূর্ব ভারতের জনগণকে শুধু অবহেলা আর অবজ্ঞাই করে আসছে।’ আসলেই, ভারতের ইতিহাসগ্রন্থ, গণমাধ্যমের আলোচনা বা জাতিগত কল্পনা, সর্বত্রই এই উত্তর-পূর্বের দেখা মেলে কদাচিৎ।
হাজারের অনশনের প্রতি ভারতীয় জনগণ ও গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া এবং সরকার কর্তৃক তার বেশ কয়েকটি দাবি মেনে নেওয়ার ঘটনার সঙ্গে নিজেদের বাস্তবতার চরম বৈপরীত্য উত্তর-পূর্বের অধিবাসীদের খুব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারতীয় চেতনার পরিধিতে তাদের অবস্থান আর ভারতের রাজনৈতিক শ্রেণীর কাছেও তাদের গুরুত্ব খুবই কম।
হাজারের অনশনের এক সপ্তাহ পর, মণিপুরের ইংরেজি দৈনিক দ্য সাঙ্গাই এক্সপ্রেসের এক সম্পাদকীতে হাজারে ও শর্মিলার সঙ্গে ভারতের আচরণের চরম বৈপরীত্যের এক দুঃখ জাগানিয়া রূপ মূর্ত হয়েছে। এটি লিখেছে, হাজারে ‘দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন, তিনি তার আহার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করামাত্র রাজনৈতিক মহল শলা-পরামর্শ করা শুরু করে এবং তিনি গত সপ্তাহখানেক ধরে এক অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন।’ এর বিপরীতে, শর্মিলা ‘২০০০ সালের নভেম্বর থেকে এক অনশন চালিয়ে আসলেও, তাতে ক্ষমতার অঙ্গনে মৃদুতম কম্পনও তৈরি হয়নি।’
আন্নার অনশন ছিল গণমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। তার অনশনক্ষেত্রে ছিল স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ ও বিখ্যাত সমাজকর্মীদের দলবেঁধে নিয়ত আনাগোনা। শর্মিলার অনশনের চিত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাকে তার পরিবারের সঙ্গেও থাকতে দেওয়া হয় না। সিংহজিত বলেন, ‘এমনকি তার পরিবারের সদস্যদেরও তার কাছ থেকে দূরে রাখা হয়।’ তিনি জানান, জেলখানার হাসপাতালে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য তার পরিবারের সদস্যদের সরকারের অনুমতি নিতে হয়।
অনশন ও অনশন ধর্মঘটের সঙ্গে ভারতীয়রা সুপরিচিত। মহাত্মা গান্ধী ১৭ বার অনশন করেন, যার তিনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ আমরণ অনশন। স্বাধীন ভারতে সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদরা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ডজন ডজন অনশন ধর্মঘট করেছেন। এসব অনশনের কিছু ছিল আন্তরিক, কিন্তু বেশ কয়েকটি ছিল নিতান্তই প্রহসন, যেমন শ্রীলঙ্কায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে ২০০৯ সালে তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুথুবেল করুণানিধির সকালের নাস্তার পর থেকে দুপুরের আহার পর্যন্ত অনশনটি।
অনশনকে গান্ধী দেখতেন সহিংসতার বিপরীত একটি বিকল্পপন্থা হিসেবে। গান্ধী অনশন করতেন জনগণকে সহিংসতার বিরুদ্ধে যুথবদ্ধ করতে, ব্রিটিশ উপনিবেশের শাসকদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করার জন্য নয়। ‘মোহনদাস’ গ্রন্থের লেখক, তার পৌত্র রাজমোহন গান্ধীর ভাষায়, গান্ধীর অনশনের ‘লক্ষ্য ছিল বিবেককে নাড়া দেওয়া, বিধ্বংসী আলোড়ন তৈরি করা নয়’।
বর্তমান ভারতের অধিকাংশ অনশন ধর্মঘটকারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আর সেরকম নেই। তাদের অনশনে থাকে স্পষ্ট এক দমনমূলক উপাদান। তাদের প্রতিবাদের আড়ালে দাবি পূরণ করা না হলে সহিংসতার হুমকি প্রচ্ছন্ন থাকে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের সহিংস অনশনই ভারত সরকারকে সক্রিয় করতে পেরেছে। গণমাধ্যম হাজারের আন্দোলনের একটি গান্ধীবাদী অহিংস ছবি তুলে ধরলেও, আসলে তাতে ছিল একটি দমনমূলক উপাদান। তার দাবিগুলো এমন ভাষায় জানানো হয় যার প্রতি ছত্রে অসহিষ্ণুতা, হুমকি ও ব্ল্যাকমেইল ছিল সুস্পষ্ট।
হাজারের আন্দোলন বেশ কিছু উৎস থেকে সমর্থন পায়। ভারতীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তার দেশব্যাপী আন্দোলনে অর্থায়ন করেছে বলে জানা যায়। হাজারের পাশে এসে দাঁড়ায় দেশের ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও প্রভাবশালী মূলধারার গণমাধ্যম। তাছাড়া, তার প্রতিবাদের প্রতি হিন্দু দক্ষিণপন্থী সংঘ পরিবারের তাত্ত্বিক উৎস রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সমর্থন ছিল বলেও জানা যায়।
হাজারের সমর্থনকারী দলবলের আকার, তাকে মদদদানকারী শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী নানা মহল এবং তার মৃত্যু প্রতিক্রিয়ায় গণসহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাই সরকারকে তার প্রতিবাদের প্রতি মনোযোগ দিতে ও তার দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে।
শর্মিলার দশক-দীর্ঘ অনশন ধর্মঘট ভারতকে নাড়া দিতে বা তার সহানুভূতি লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছে, কেননা তিনি যে উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন সেটি এত দূরবর্তী যে, তা ভারতের বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে কোনো সমবেদনা সৃষ্টি করতে পারেনি। তার ভারতের বিবেককে নাড়া দেওয়ার প্রচেষ্টা সবার অগোচরে রয়ে গেছে, কেননা গণমাধ্যম তার বক্তব্য প্রচার করতে রাজি নয়।
তাই, দিল্লীর জন্য তার নাক দিয়ে খাদ্যতন্ত্রে জোরপূর্বক খাবার প্রবেশ করিয়ে তাকে সহিংসভাবে বাঁচিয়ে রাখাটাই বরং সহজ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন