বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১১

পুঁজিবাদ সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান হতাশাই আন্দোলনের প্রধান কারণ


গত ১৫ মে স্পেনের ‘‘ক্ষুদ্র জনতার আন্দোলনের’’ রেশ ধরে ১৭ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ‘‘ওয়ালস্ট্রিট দখল করো’’ আন্দোলনের উত্তাপ এখন ছড়িয়ে পড়েছে আমেরিকা-ইউরোপ হয়ে আফ্রিকা, এশিয়া অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। শনিবার বিশ্বের ৮২টি দেশের ৯শরও বেশি শহরে লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভে শামিল হয়। পুঁজিবাদের সাম্প্রতি প্রতিভূ কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের লোভ-লালসা সীমাহীন লুটপাট, ধনী দরিদ্রে্যর ব্যাপক বৈষম্য এবং এই লুটপাটের সহযোগী সরকারগুলোর ব্যয় সংকোচননীতি ধনীদের বেইল আউটের নামে কোটি কোটি ডলারের অর্থ সাহায্যের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ পরিচালিত হচ্ছে। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণেই যে বর্তমান এই পরিস্থিতি এবং এই পরিস্থিতি যে মোকাবেলার শক্তিও সে ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে তারই আভাস মিলছে এই বিক্ষোভের মধ্যদিয়ে। বিশ্বায়নের ধারায় মাত্র শতাংশের লুটপাটের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশের প্রতিবাদেরও বিশ্বায়ন ঘটছে, এরই নমুনা পাওয়া গেছে গত শনিবার। এরই বিশ্লেষণধর্মী দুটি লেখা প্রকাশ করা হলো এই বিক্ষোভের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ অনুধাবনের জন্য।
ডেভিড সুজুকি লাগাতার প্রবৃদ্ধি এবং সীমিত সম্পদের ওপর ভর করে সীমাহীন ভোগেচ্ছা পূরণের বর্তমান এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে কেবল আমি একাই অসন্তুষ্ট নই। এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অধিকাংশ সম্পদই গুটি কয়েক মানুষের কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ নিরন্তর জীবিকার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কেওয়াল স্ট্রিট দখল করোনামে যে আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল তা এখন ক্রমশ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য সবসময় স্পষ্ট নয়। কখনো কখনো মনে হয় তাদের দাবি-দাওয়া একেবারেই সঙ্গতিহীন কিংবা বায়বীয় ধরনের। যেমন একদিকে তারা উন্মুক্ত সীমান্তনীতির কথা বলছে, অন্যদিকে আবার দাবি জানাচ্ছে অধিক হারে বাণিজ্য শুল্ক আদায়েরও
লক্ষ্যণীয় যে, এই আন্দোলনের যারা উদ্যোক্তা তারাও একক একটি দাবির প্রশ্নে বলেছে, ‘আমাদের একক এবং একমাত্র দাবিটি কী?’ এই দাবিটি প্রথম উত্থাপিত হয়েছে আমারই নিজ শহরের ভ্যাংকুভারের পত্রিকা এডবাসটার্সে। পত্রিকাটির সম্পাদক কালে লাজন মন্তব্য করেছেন, আন্দোলনকারী প্রথমদিকে সবাইকে শুধু আন্দোলনে অংশগ্রহণেরই আহবান জানিয়েছে, আন্দোলন থেকে কী ফল লাভ করা যাবে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেনি। একক কোনো দাবিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত আন্দোলন কতটা সফল কার্যকর হবে তা হয় তো বলা মুশকিল। তবে আন্দোলনকারীদের মধ্যে মতবিনিময় বা আলাপ-আলোচনা হওয়াটা জরুরি। আরো জরুরি বর্তমান এই পরিস্থিতির শেকড় কোথায় তা খুঁজে বের করার। আর আন্দোলন হওয়া উচিত সেই শেকড় উপড়ে ফেলার। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আন্দোলনে অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হচ্ছে। ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ, ছাত্র, শ্রমিক এবং অন্য আরো অনেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সংঘবদ্ধভাবে আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে
কেন সরকারগুলো করদাতাদের কোটি কোটি ডলার খরচ করে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা করে আসছে? এরা সরকারের কাছ থেকে বহু ধরনের আইনি এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নিয়েছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানগুলো জোর করে বন্ধ করে দেওয়ার সময় যেসব আমানতকারী সর্বস্বান্ত হয়েছিল, নিজেদের সঞ্চয় ঘরবাড়ি হারিয়েছিল তাদের জন্য কিন্তু এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কিছুই আর করেনি। সরকারের কি উচিত নয়, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে পরিবেশগত এবং সামাজিক কিছু দায়দায়িত্ব পালন করিয়ে নেওয়া?
উন্নত দেশগুলোতে এখনো কেন সম্পদশালীরাই বেশিমাত্রায় কর অবকাশ সুযোগ পাবে, যেখানে বহু শিশু না খেয়ে থাকছে, শ্রমজীবী মানুষ এবং বেকাররা দেখছে, দিন দিন তাদের মজুরি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমে যাচ্ছে? একই সঙ্গে তারা দেখতে পাচ্ছে, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবা শিক্ষার সুযোগও হ্রাস পাচ্ছে। আমরা কেন স্বল্পমেয়াদি মুনাফা এবং ভঙ্গুর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের সীমিত সম্পদ এবং অমূল্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছি? জ্বালানি তেলের মজুদ যখন নিঃশেষ হয়ে যাবে, কিংবা এই তেল আহরণ যখন আরো বেশি দুঃসাধ্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে তখন আমরা কী করব? আমরা কেন আগে থেকেই আমাদের জ্বালানি চাহিদাকে কমিয়ে আনছি না এবং জ্বালানির অন্য কোনো সহজলভ্য খুঁজে বের করছি না?
আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ বায়ু, স্বচ্ছ জল এবং পাদনশীল ভূমির চাইতে সাময়িক ব্যবহারোপযোগী এবং প্রায়শই অপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং সেবা কেন বেশি গুরুত্ব পাবে? এটা ঠিক যে, মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ভোগ্যপণ্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে একটি বিপরীতধর্মিতা দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু যে আন্দোলনটি চলছে তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিবর্তন আনা কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ত্যাগ স্বীকারের আহবান সম্বলিত নয়। এর সঙ্গে আসলে জড়িয়ে রয়েছে পৃথিবী নামক গ্রহটিতে আমরা কীভাবে টিকে থাকব সেই প্রশ্নটি
এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ১৫০ কোটি থেকে বেড়ে ৭০০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এই জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে গিয়ে প্রযুক্তির উন্নয়ন পণ্য পাদন দ্রুততর হয়েছে। একইভাবে সম্পদের ব্যবহার এবং জ্ঞানের বিকাশও ঘটেছে দ্রুতগতিতেই। উন্নয়নের গতি এবং কৌশল আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল করে ফেলেছে। নির্ভরশীলতার মাত্রা এতটাই যে আমাদের অবকাঠামোর সঙ্গে মোটরযানের মতো বিত্ত সংগ্রহের উপকরণকেও পুরোপুরিভাবেই এই জ্বালানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আমাদের চলমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি তুলনামূলকভাবে অর্বাচীন। দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটাতে এবং প্রাপ্ত সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে আমরা আমাদের পাদন বিতরণ প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজিয়েছি। আপাততভাবে মনে হতে পারে পরিবর্তন ঘটানোর তেমন আর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, যেসব উন্নয়ন ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে সেগুলো খুবই সাম্প্রতিক এবং মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি, সৃজনশীলতা দূরদর্শিতা সীমাহীন। যথেষ্ট পরিমাণ বিরোধিতা সত্ত্বেও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই কোনো এক সময় মেনে নিয়েছিল যে, দাস প্রথার বিলোপ সব ধরনের অর্থনৈতিক বিবেচনাকে পেছনে ফেলে মানুষের অধিকার এবং সম্মানবোধকে সমুন্নত করবে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, দাস প্রথার বিলোপ অর্থনীতিকে ধ্বংস করেনি। যেমনটা দাস প্রথার সমর্থকরা আশঙ্কা করেছিলেন
ওয়ালস্ট্রিট দখল করো আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোনো ফলাফল বয়ে আনবে কিনা আমি জানি না। তবে অবশ্যই এর একটা প্রভাব থেকে যাবে। আমি এই প্রতিবাদী আন্দোলনকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বয়ে যাওয়া আন্দোলনের সঙ্গে মিলাতে যাব না। তবে শুধু এটুকু বলব, এসব আন্দোলন আমাদের এই শিক্ষাটিই দিয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে থাকা মানুষের সিদ্ধান্তসমূহ যখন একটি দেশের জনগণের সামনে সীমাহীন বৈষম্য, নেতিবাচক মানসিকতা ধ্বংসাত্মক প্রবণতার চিত্রকে স্পষ্ট করে তোলে তখন আমাদের কারোরই আর ঘরে বসে থাকা চলে না। আমাদের তখন দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সংঘবদ্ধ হওয়া এবং প্রতিবাদ করা। মানব সভ্যতার ইতিহাস বিরতিহীন এক পরিবর্তনের ইতিহাস। আমাদের সবারই এখন দায়িত্ব হচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করা, আলোচনায় যোগ দেওয়া। উদ্দেশ্য বর্তমানের চাইতে উন্নততর এক ভবিষ্যতের পানে নিজেদের ধাবিত করা। সম্ভবত আমাদের একমাত্র দাবিটি হবে : কিছু একটা করার লক্ষ্যে গুরুত্ব সহকারে ভাবনা-চিন্তা করুন
 আমরা শতকরা ৯৯ 
ফেদরা এলিস লামকিনস ৯৯ শতাংশের অংশ হওয়া মানে অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী হওয়া নয় বরং ধরনের অংশীদারিত্ব হচ্ছে সর্বজনীন এক বিষয়
বিপর্যস্ত অর্থনীতি প্রত্যেককেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ঠিক আছে, অন্তত প্রায় প্রত্যেককেই করছে। সবদিক বিবেচনায় নিয়েই বলতে হয়, মার্কিনিরা আর এগুতে পারছে না; বছর বছর তারা পিছিয়েই পড়ছে। প্রায় প্রতিটি মার্কিনিই তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ নিয়ে চিন্তিত। তারা চিন্তিত তাদের চাকরিটি থাকবে কিনা তাই ভেবে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ভয়াবহতা ২০১১ সালে এসে আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে
আমরা কাজ করে গেছি, একটা পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষাও করেছি। আমরা আশা করেছিলাম পুরো ব্যবস্থাটিরই একটি উন্নতি ঘটবে; যে সব কারণে আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল সে সব কারণ দূর হবে
একটি পরিবর্তন চেয়েই মার্কিনিরা অপেক্ষা করেছিল। অবশেষে হতাশ, ক্ষুব্ধ জনগণ রাস্তায় নেমে এলো
ওয়াল স্ট্রিট দখল করো, ডিসি দখল করো, ওকল্যান্ড দখল করো, বইজ দখল করো- ইত্যাদি বলে তারা এতদিন একটি পরিবর্তনের অপেক্ষাই ছিল। কিন্তু আর অপেক্ষা নয়, পরিবর্তন এখন তাদের দাবি
ওয়াশিংটন আমাদের অর্থনীতির বিপর্যয়কর অবস্থার অবসান ঘটাচ্ছে না, রাজনীতিকরাও না, তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো কিংবা ওয়াল স্ট্রিট কেউ না। তারা অর্থনীতিকে ভালো করার চেষ্টা করছে না, কারণ অর্থনীতির দুরবস্থা তাদের স্পর্শ করে না। যে সব সিনেটর কর্মসংস্থান বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন তারা কেউই কিন্তু বেকার নন কিংবা জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ নিয়েও তাদের ভাবতে হচ্ছে না। এক্সন মবিন এবং গোল্ডম্যান সেচের প্রধানদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারণেই তাদের নিজেদের মধ্যে কারো বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগ নেই। তবে দেশজুড়েই আন্দোলন প্রতিবাদ চলছে। উচ্চস্বরের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আমাদের অর্থনীতির অনিয়ম আর দুর্বল দিকগুলোর দিকে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি নিবন্ধ করিয়েছে। পাঁচ বছর ধরে সুনির্দিষ্টভাবে এবং সুশৃঙ্খল পন্থায় আমরাও কথাগুলোই বলে আসছিলাম। কিন্তু এখন বোঝা গেল, বিষয়গুলো নিয়ে আরো জোরালোভাবেই সোচ্চার হতে হবে। আমাদের সমর্থকদের উদ্দেশ্য বলছি : আজকের আলোচনায় যোগ দিন। স্থানীয় পর্যায়ে দখল করো আন্দোলনে যোগদানকারীদের সামনে আপনারা আপনাদের মতামত ইস্যুগুলো তুলে ধরুন। এগিয়ে যান- দৃঢ় পদক্ষেপে। নিজেদের প্রকাশ করুন। আন্দোলনে নামুন। নিজের বিশ্বাসের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়ান
বিশুদ্ধ বায়ু, স্বচ্ছ জল, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং ভালো চাকরি-বাকরি আমাদের কপালে জুটছে না। অর্থনীতি বিপর্যয় কাটিয়ে উঠছে না। সুতরাং দাবি-দাওয়ার কথাগুলো নিম্নস্বরে বলা এখন আর কোনো কাজের কথা নয়। সব কিছুই এখন যথেষ্ট উচ্চস্বরে বলতে হবে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বসবাসকারী তরুণ এবং প্রবীণ প্রজন্ম, কালো, বাদামি এবং সাদা- আপনাদের সবার উদ্দেশ্যই বলছি, আপনারা যে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন তাতে আমরাও শামিল হচ্ছি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন