বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১১

কোন বিপ্লব প্রাধান্য পাবে



সম্প্রতি বিবিসির হিন্দি সার্ভিসের রাজেশ যোশীর সঙ্গে এই সাক্ষাৎকার প্রদান করেন যাতে রয়েছে ভারতের বর্তমান দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকে আরব অভ্যুত্থান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ সম্পর্কে তার খোলাখুলি বক্তব্য। আউটলুক ইন্ডিয়া অনলাইনে প্রকাশিত চিন্তার খোরাক যোগানো এই সাক্ষাৎকারটির ইংরেজি রূপান্তর থেকে নিবন্ধাকারে ভাষান্তর করেছেন নেয়ামুল হক
নিউইয়র্কেও টুইন টাওয়ারে হামলার দশ বছর পার হয়ে গেল ১১ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে বিশ্বজুড়ে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। যুদ্ধের বিস্তার ঘটেছে অনেক। মূলত সম্পদ দখল করার জন্যে শুরু করা যুদ্ধের নাম দিয়েছে তারা এখন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই’। এর একটি গ্রহণযোগ্যতা যেমন তৈরি করা হয়েছে, তেমনি আবার এই যুদ্ধের প্রকৃত চেহারাটাও বেরিয়ে পড়ছে।
তবে যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিপজ্জনক দিকটি হলো এই, ক্রমশই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, এ যুদ্ধে তারা জয়ী হতে পারবে না, এ জাতীয় যুদ্ধ শুরু করা যায় বটে, তবে শেষ পর্যন্ত জয়ী হওয়া যায় না। যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। ইরাক যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। আফগানিস্তান যুদ্ধেও জয় অধরাই থেকে গেছে। লিবিয়া যুদ্ধেও জয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। শুরুর দিকে এসব যুদ্ধে বিজয়ের কিছুটা দাবি করা হয়। কিন্তু সময় যতই গড়ায় ততই দেখা যায় যে, দখলদার বাহিনী ধীরে ধীরে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পাকে আটকে যাচ্ছে এবং ক্রমশ হীনবল হয়ে পড়ছে। কিছুটা এ কারণেও বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমশ বিভাজনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আরেকটি বিপদের দিক হলো এই যে, যুদ্ধবিমান থেকে বোমা নিক্ষেপসহ এসব যুদ্ধে প্রথাগত অস্ত্রের পরিবর্তে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ফলে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছে তারাও ক্রমশ উপলব্ধি করতে পারছে যে, প্রথাগত কায়দায় যুদ্ধ চালিয়ে তারা জয়ী হতে পারবে না। এ জন্যই দেখা যায়, প্রথাগত অস্ত্রকে কাজে লাগিয়ে ভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং প্রতিরোধের বেপরোয়া ধরনের হিংসাত্মক কৌশল বেছে নিচ্ছে তারা। মতাদর্শগত দিক থেকেও তারা ক্রমাগত বেশি করে হিংসাত্মক হয়ে উঠছে। কারণ মতাদর্শগতভাবে উজ্জীবিত না হলে একজন মানুষ আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দিতে পারে না। সুতরাং খুবই বিপজ্জনক একটি সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তালিবান যেনবা কোনো না কোনো লেবাসে আবারো আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসীন হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাদ্দাম হোসেনের মতো মানুষেরা তো প্রথমত যুক্তরাষ্ট্রেরই সৃষ্টি। যুক্তরাষ্ট্রই এদের ক্ষমতায় বসায়, সমর্থন দেয়, অর্থ এবং অস্ত্র যোগায়। ব্যাপারটি হলো এরকম যে, কোনো একটি দেশের ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমে সেখানে কিছু স্বৈরশাসক সৃষ্টি করতে হবে। তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের আবার একে একে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। এমনিভাবে দেশটি একসময় ক্ষমতার পালাবদলের নোংরা পাকে আটকে যাবে। এর পরই লোক দেখানো কিছু একটা ঘটনার আড়ালে আস্তে আস্তে দেশটির ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
আফগানিস্তানেও ঠিক এ ব্যাপারটিই ঘটেছে। সুতরাং পৃথিবী স্বৈরশাসক, একনায়ক, কিংবা তালিবান মুক্ত হয়ে যাবে এমনটি আপনি আশা করতে পারেন না। তালিবানও তারাই সৃষ্টি করেছে। সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের সময় তারাই তালিবানের হাতে মতাদর্শিক এ অস্ত্রটি তুলে দিয়েছিল। ব্যাপারটি এখন কেউই আর উল্লেখ করছে না। পাকিস্তানে যে সন্ত্রাসীরা আস্তানা গেঁড়ে বসেছে সেসব নিয়ে তারা খুব কথা বলছে অথচ এসব সন্ত্রাসী আস্তানার পেছনে অর্থ ঢেলেছে খোদ সিআইএ এবং সৌদি আরব। এখান থেকে জন্ম নিয়েছে বড় ধরনের স্বৈরশাসক এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের মদদও দিয়ে যাচ্ছে।
আরব বিশ্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর অবশ্যই অত্যন্ত ইতিবাচক কিছু দিক রয়েছে। তবে মিশরের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বিপদ এখনো কাটেনি। হোসনি মুবারক ৪০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। আমরা জানি, তাহির স্কয়ারে সংঘটিত অভ্যুত্থান ঘটনার তিন মাস আগে থেকেই পত্রপত্রিকাগুলো প্রচার করে আসছিল যে, মুবারক মৃত্যুশয্যায়। এরপরই অভ্যুত্থানটি ঘটল এবং ঘটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো এর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তারাই ঠিক করে, কোন বিপ্লবের খবর প্রচার করতে হবে আর কোনটি করতে হবে না। আর এখানেই রয়েছে আসল রাজনীতি। কাশ্মীরেও কিন্তু এ জাতীয় অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে চলেছে প্রচুর। কিন্তু এগুলো কমবেশি সবসময় প্রচারের আড়ালেই থেকে গেছে। মিসরের অভ্যুত্থানের ঘটনা যথেষ্ট প্রচার পেলেও শেষ দিকে দেখেছেন সংবাদ শিরোনামগুলো বলছিল, ‘মিসর মুক্ত’ সেনাবাহিনী দায়িত্বও নিয়েছে।’ এখন সেখানে ১০ হাজার মানুষ সামরিক  ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন। সম্ভবত সেখানে এখন মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান ঘটতে এবং একটি বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এটা হচ্ছে। আমি এটিকে একটি সফল অভ্যুত্থান এবং প্রকৃত গণতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করতাম যদি দেখতাম যে, গাজা অবরোধের ঘটনায় মিসরের ভূমিকা এতে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তেমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে কিনা তা আমি এখনো জানি না।
বহু ধরনের ঘটনাই এখন ঘটছে এবং ঘটানো হচ্ছে। ভারতে এবং এসব স্থানে জনগণের শক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। জনগণ ক্রুব্ধ ও ক্ষুব্ধ। জনগণ সত্যি সত্যি তেঁতে আছে। ক্ষোভের যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। স্বৈরশাসনের অধীনে বসবাস করতে করতে তারা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ক্ষোভের বড় পাথরটিতে একটু নাড়া পড়তেই তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। কিন্তু সেই বিক্ষুব্ধতা কি প্রকৃত কোনো গণতন্ত্রের পরিণতি পাচ্ছে? নাকি তা অন্য কোনো পথে চালিত হচ্ছে? আমরা এখনো সেটা দেখার অপেক্ষায়ই আছি। স্বৈরশাসনের স্থলে যদি সামরিক শাসন প্রতিস্থাপিত না হয় তবেই আমি খুশি হব। আমি খুশি হতাম যদি দেখতাম, পরিকল্পনা করে কোনো কিছু ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে না কিংবা যা ঘটছে তাকে আবার ভিন্ন কোনো খাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে মিসরে লোকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তাদের সামরিক ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি করা হচ্ছে। হোসনি মুবারক আমলেও এসবই ঘটত। হোসনি মোবারকের পতনে অবশ্যই আমি খুশি। তবে আপনি এমন সব ঘটনায় কেন উচ্ছ্বসিত হবেন যেসব ঘটনায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার মতো সঠিক কোনো উপাদান এষনও সৃষ্টি হয়নি?
আমি সব ধরনের গণআন্দোলনকে সমর্থন করি না। ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ গণআন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও রামজন্মভূমি আন্দোলনকে আমি সমর্থন করিনি। সেটি ছিল বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে মন্দির নির্মাণের আন্দোলন। আমি মনে করি, সবধরনের ফ্যাসিবাদই নিজেকে গণআন্দোলন হিসেবে জাহির করতে পারে। কিন্তু ফ্যাসিবাদকে আমি সমর্থন করি না। বাছবিচারবিহীনভাবে সবধরনের গণআন্দোলনকেই আমি সমর্থন করি না। বিশেষ করে আমি বলব, আন্না হাজারের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনটির মধ্য দিয়ে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছিল সেটি অনুধাবন করাটা খুবই জরুরি। যা ঘটছিল তা কিন্তু খুব সহজ এবং সরল ব্যাপার ছিল না। বর্তমান সময়ে খনি খনন করপোরেশন এবং টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানিগুলোর ব্যাপক দুর্নীতির খবর ফাঁস হয়ে পড়ছে। এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে সরকারের কিছু মহল এবং গুমাধ্যমও। এসব দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার লুট হয়ে যাচ্ছে এবং এর জন্য কোনো রকম জবাবদিহিও করতে হচ্ছে না কাউকে। সরকারের পক্ষ থেকেও নয়, করপোরেশনগুলোর পক্ষ থেকেও নয়। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমনে প্রচন্ড রকমের ক্ষোভ জমা হয়ে আছে।
এ নিয়ে এখন যা ঘটছে তার ব্যাপারে আমি খুবই সন্ধিগ্ধ হয়ে পড়েছি। কারণ আমার ধারণা একেবারে ওপর থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত যে ক্ষোভ জমে আছে তাকে একটি গণআন্দোলনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বহুমাত্রিক ও বহুবর্ণিল এই ক্ষোভকে ব্যবহার করা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট একটি আইনকে কার্যকর করার বিষয় সামনে রেখে। আমার তো মনে হয় না কেউ এমনকি যারা এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখিত এই আইনটি তারা কেউ পড়ে দেখেছেন। আপনি যদি বিলটি পড়ে দেখেন তবে দেখবেন, আইনগত দিক থেকেই এটি কেবল হাস্যকর নয়, যারা নিজেদের টিম আন্না বলে পরিচয় দিচ্ছেন তারাও বলছেন জনগণ খেপে আছে, আর আমরা সেই ক্ষোভ প্রশমনে কিছুটা ওষুধ ঢালছি। টিম আন্নার লোকজনও বলছেন, জনগণ এই বিলটি পড়ে দেখেনি। কিন্তু তারা বলছে, ‘অসুস্থতার জন্য আমাদের কিছু ওষুধ দাও।’ তবে ওষুধের বোতলের গায়ে কী লেখা আছে সেটিও তারা পড়ে দেখছেন না। খুব, খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ এটা পড়েছে। আর যে ওষুধটি তাদের দেওয়া হয়েছে, সে ওষুধটি কিন্তু তাদের ওই রোগের চাইতেও অনেক বেশি বিপজ্জনক। আমার ভয়টা এখানেই। আর আমরা সবাই দেখলাম, নৈতিকতার এই আন্দোলন একটা পর্যায়ে এসে পুরনো ধর্মীয় ফ্যাসিবাদেও সাহায্য নিল এবং সংখ্যালঘুদের এ থেকে আলাদা করে দিল।
মেধাপাটেকর বা প্রশান্ত ভূষণের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয় এটি নয়। আমার সন্দেহ হচ্ছে, লোকপাল বিলের পুরো বিষয়টির ব্যাপারে তারা অবহিত আছেন কিনা। আমি তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। তারা কেউই তাদের কর্মজীবনে কখনো রাজনীতিতে জড়িত হননি। তারা এটিকে সবসময়ই দরজার বাইরে রেখে এসেছেন। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি যারা ৩০ আগস্টের মধ্যে কোনো রকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই পার্লামেন্টে বিলটি পাস করাতে চাচ্ছিলেন তারা কেউ অন্তত বিলটির ওপর যথাযথ একটি আলোচনা উপস্থাপন করুন। আপনি যদি বিলটির দিকে তাকান তো দেখবেন এটি একটি ভীতিকর আইন। প্রথমত, এটি খুবই দুর্বলভাবে প্রণীত। এই বিলে বলা হয়েছে সঠিক শ্রেণী থেকে আগত ১০ জন সৎ ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গঠন করা হবে এবং সেখানে ৩০ হাজার অফিসার কর্মরত থাকবেন। এসব অফিসার কোথা থেকে আসবেন বা তারা কারা সে সম্পর্কে বিলটিতে কিছুই বলা নেই। আমাদের মতো একটি সমাজে দুর্নীতি বলতে কী বা কোনটাকে বোঝানো হয় সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি এখানে। সর্বত্রই দুর্নীতি আছে। একজন গরিব মানুষকে সরকারি অফিসারের কাছ থেকে রেশনের বিলটি পেতে যেমন ঘুষ দিতে হয় তেমনি ঘুষ লেনদেন হয় করপোরেট পর্যায়ে বিনাপয়সায় নদীগুলো পেতে কিংবা পাহাড়গুলোতে খনি খননের কাজ চালাতে।
তবে দুর্নীতি হচ্ছে একটি মূল্যবোধগত বিষয়, যাকে একটি আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা দরকার। আমি সবসময়ই বলে আসছি যে, এমন বহুসংখ্যক কোটি কোটি ভারতীয় নাগরিক আছেন যারা পরিচয়হীনভাবে বেঁচে আছেন, যারা কখনো এই আইনি কাঠামোর আওতায় আসেননি। ধরুন আপনি দিল্লিতে বসবাস করছেন এখানে অসংখ্য বস্তি রয়েছে, রয়েছে বেআইনি হকার এবং অননুমোদিত বসতি। হঠাৎ একজন মধ্যবিত্ত হয় তো বলে বসতে পারেন ‘আমি জোরবাগে থাকি এবং সেখানে একটি বেআইনি বস্তি রয়েছে। রাজনীতিবিদরা এই বস্তিটি রক্ষা করে কারণ তারা সেখান থেকে ভোট পান। মিউনিসিপ্যালটিও এ ব্যাপারে কিছু বলছে না, কারণ তারা এখান থেকে ঘুষ পায়। এই বস্তিবাসীদের এখান থেকে বের করে দেওয়া হোক। কারণ তারা বেআইনিভাবে এখানে থাকছে।’ দুর্নীতি বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে কিন্তু কোনো বিতর্কই হয়নি। অথচ তারা একটি আইনের দাবি জানাচ্ছেন। এ আইনের আওতায় একেবারে ওপরের দিকে থাকবেন ১০ জন লোক এবং তাদের অধীনে স্থাপিত আমলাতান্ত্রিক কাঠামোটিতে আরো ৩০ হাজার কর্মকর্তা কর্মরত থাকবেন। সরকারের কাছ থেকে তারা বড় ধরনের আর্থিক বরাদ্দ পাবেন। তারা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিচার বিভাগের একেবারে নিম্নস্তর পর্যন্ত যে কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে, শাস্তি দিতে পারবে, তাদের টেলিফোনে অাঁড়ি পাততে পারবে, তাদের চাকরিচ্যুত করতে পারবে, সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবে এবং তাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ড তদন্ত করতে পারবে। আসলে তাদের দিয়ে নতুন একটি সমান্তরাল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলা হবে। এসব কথা না হয় বাদই দিলাম। আসল বাস্তবতাটা কী? না, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়ন নীতির কারণে যেই মধ্যবিত্ত এক সময় লাভবান হয়েছিল তারা এখন এই গণতন্ত্রের ব্যাপারে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে।
আমার তো মনে হয় জনগণের অধিকার আদায়ের এখন একটি মাত্র রাস্তাই আছে। সেটি হলো আমাদের এমন একটি বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করতে হবে যেখান থেকে আমরা সব ব্যাপারে কী করে জবাবদিহিতা দাবি করতে হয় তা শিখতে পারি। জনলোকপাল বিল তো আসলে কেবল নতুন আরেকটি উচ্চস্তরের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার কথাই বলে। আমার বক্তব্য হলো, বসবাসের উপযোগী যেই কাঙ্ক্ষিত সমাজটির দিকে আমরা এগিয়ে যেতে চাই সেটি পেতে হলে সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাতে হবে এবং এটি তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা নিজেদের অধিকার ও দাবি আদায়ের জন্য লড়াই করতে থাকা মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারব। এমন লড়াই তো কেউ কেউ করছে। সুতরাং এটা বললে চলবে না যে, দান্তেওয়াড়ায় মানুষ খুন হচ্ছে তাতে আমার কী? সেটা তো আমার নিজের সমস্যা না। আমি একজন মধ্যবিত্ত মানুষ এবং আমি বিশ্বাস করি যে, আমি সুযোগ-সুবিধা পাব। আমরা যদি একটি গণতন্ত্রের মধ্যে বসবাস করে থাকি এবং আপনার মনে যদি এ বিশ্বাস জন্ম নেয় যে, সব মানুষই ন্যূনতম পর্যায়ের হলেও কিছু না কিছু অধিকার ভোগ করবে- কেবল তখনই আপনি এ ব্যাপারে আপনার চোখটি খুলতে পারবেন। এ ব্যাপারটিই আমি সবসময় বলে আসছি এবং যেভাবে পেরেছি আমার এ বক্তব্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। আমি তাই তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি যারা নিজেদের রক্ষা করার আন্দোলন গড়ে তুলেছে, যারা বড় বাঁধ থেকে শুরু করে সবধরনের খনি খনন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা তাদের ভূমির অধিকার ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি। তারা বড় বড় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সেটি সেনাবাহিনীও হতে পারে কিংবা হতে পারে বড় বড় করপোরেশন বা অন্য কিছু।
বুকার পুরস্কার এবং এ জাতীয় অন্য সব কিছুই আমার কাছে অর্থহীন। জগতে এমন বহু মানুষ আছেন যারা জুতা কিংবা কোকাকোলা বিক্রি করার জন্য নিজেদের খ্যাতিকে ব্যবহার করছেন। কোনো মানুষই অকারণে নিজের খ্যাতিকে ব্যবহার করে না। আমার বিষয়টি হলো আমি একজন লেখক। আমি এই পৃথিবীটাকে ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যাচাই করি। আমি সবসময়ই বলে আসছি যে, ‘ভারতের উন্নয়ন’ নামে যে কথাগুলো চালু আছে এগুলো আসলে অর্থহীন কথাবার্তা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে ভারত বলতে আমরা কী বুঝি? আপনি যখন ‘ভারত’ শব্দটি উচ্চারণ করেন তখন আপনি এটি দিয়ে কাকে বুঝাচ্ছেন? আপনি কি কয়েকশ’ কোটি কোটিপতিদের কথা বলছেন নাকি প্রায় ৮৩ কোটি মানুষের কথা বলছেন যারা দৈনিক ২০ রুপিরও কম আয়ের ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করে থাকে? এটা ঠিক যে, ভারতে কিছুসংখ্যক মানুষ অতিদ্রুত নিজেদের কল্পনার চাইতেও বেশি পরিমাণে ভাগ্যের উন্নতি ঘটিয়েছে। তবে সেটি তারা করেছে অধিকাংশ ভারতীয়র কাঁধ এবং শরীরের ওপর পা রেখে।
দেখুন আমি সব সময়ই বলি, ধরুন একটি ঘরের মধ্যে ১০ জন মানুষ আছেন। তাদের মধ্যে একজন কোটি কোটিপতি হয়ে গেলেন এবং আরো দু’জন মোটামুটি সঙ্গতিসম্পন্ন হয়ে উঠলেন। কিন্তু বাকি সাতজন হয়ে রইলেন অনাহারক্লিষ্ট। তখন হয় তো কেউ একজন বলে উঠলেন, দেখুন এই ঘরটির মধ্যে সাতজন মানুষ না খেয়ে আছে। উত্তরে আপনি কি বলবেন? আপনি হয় তো বলবেন দেখুন, এতটা নেতিবাচক হচ্ছেন কেন? মানুষ তো উন্নতি করছে! আমি কে, আমি কী জয় করেছি কিংবা কী জয় করতে পারিনি সেটা বড় কথা নয়। আমি যদি এমন কিছু বলি যা যুক্তিসঙ্গত এবং যার প্রাসঙ্গিকতা আছে তবে সে কথাটার একটা মূল্য এই পৃথিবীতে থাকবে। কিন্তু আমি যদি নির্বোধ হই, যদি নেতিবাচক হই কিংবা হই অর্থহীন একজন মানুষ তবে এ পৃথিবী থেকে আমার নাম-নিশানা মুছে যাবে। সুতরাং কোনো ব্যাপারই ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার কিছু নেই এবং প্রকৃত কোনো কাজের কথাও নয় সেটি।
মাওবাদ অবশ্যই কোনো সমাধান নয়। আমি বারবারই বলে এসেছি যে, সমাধানের পথ হচ্ছে অস্তিত্ব রক্ষার বহুমাত্রিক লড়াই। এই লড়াইয়ের একটি পথ হয় তো মাওবাদীরা বেছে নিয়েছে এবং সেটি হচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ। তারা যুদ্ধ করছে গহীন অরণ্যে, যে অরণ্য ছেয়ে আছে আধাসামরিক বাহিনীর সৈন্য আর পুলিশ বাহিনীর সদস্যতে। আমি নিশ্চিত আদিবাসী অধ্যুষিত যেসব গ্রামে কোনো দিন কোনো টেলিভিশন ক্যামেরা পৌঁছায় না, সেখানে গান্ধীবাদী কোনো অনশন আন্দোলনের সূচনা ঘটে না। সেখানে কেবল একটি লড়াইয়ের সুযোগই আছে। আর সেটি হলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন। গভীর সেই অরণ্যের বাইরে অন্য যে কোনো স্থানে এ জাতীয় সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন মুহূর্তেই স্তব্ধ করে দেওয়া হতো। অরণ্যের বাইরে মাওবাদীদের তেমন কোনো সাফল্যই নেই। অন্য যেসব প্রতিরোধ আন্দোলন রয়েছে সেগুলোর দিকেও একবার তাকানো দরকার। এসব প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয় কৌশলগত দিক ও মতাদর্শগত দিকের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে আমরা প্রায়শই বিভ্রান্তিতে ভুগি। তা সত্ত্বেও আমার মতে, ভারতে চমৎকার একটি ব্যাপার বিদ্যমান রয়েছে। সেটি হলো- এখানে নিজ নিজ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বহু ধরনের আন্দোলন-সংগ্রাম চলমান রয়েছে।
অধিকার রক্ষার এসব আন্দোলনে কেউ কেউ বা কোনো কোনো গোষ্ঠী আবার বিজয়ীও হচ্ছে। আপনি যদি আবারও দুর্নীতির প্রসঙ্গটি তোলেন তবে আমি বিভিন্ন সরকার এবং বেসরকারি করপোরেশনগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত শত শত গোপন সমঝোতা স্মারকের কথা উল্লেখ করতে চাই। এসব সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে ভারতের মধ্যাঞ্চলের বহু অরণ্য, পাহাড় এবং নদী বেসরকারি করপোরেশনগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ তাদের অধিকার রক্ষায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়িয়ে দাবি জানাচ্ছে না যে, গোপন সমঝোতা স্মারকগুলোতে কী লেখা আছে তা প্রকাশ করা হোক।
রাষ্ট্রের কী করার আছে, রাষ্ট্র তো নিজেকে রক্ষা করবেই। এ জাতীয় একটি প্রশ্নের মধ্যেই রাষ্ট্র যে জনগণের শত্রুপক্ষ সে কথাটির ইঙ্গিত রয়েছে। আপনি যদি সারাবিশ্বের দিকে তাকান তা হলে দেখবেন সেই সত্যটিই ক্রমশ ধরা পড়ছে। আপনি দেখবেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্র ও তার সেনাবাহিনী নিজস্ব জনগণের ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যুদ্ধ যে সবসময়ই দুটি দেশের মধ্যে সংঘটিত হবে তা কিন্তু নয়। একটি রাষ্ট্র নিজে তার নিজস্ব জনগণের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে। এটা হচ্ছে সমান্তরাল উপনিবেশবাদ ঠেকানোর নামে আনুভূমিক উপনিবেশবাদ কায়েম করা।
আমি বিশ্বাস করি ক্ষমতাকে জবাবদিহিতার আওতায় রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রতিনিয়ত তাকে প্রশ্ন করা, প্রশ্নের সম্মুখীন করা। যে কোনোভাবেই হোক তার সঙ্গে সবসময়ই একটি বিরোধাত্মক সম্পর্ক জিইয়ে রাখা। আমি ভবিষ্যতে রাজনীতিতে যোগ দেব কিনা এটি আমার কাছে তেমন গুরুতর কোনো প্রশ্ন নয়। আমি যা করি তা রাজনীতিই। আমি যা লিখি তাও রাজনীতি। ঐতিহ্যগতভাবেই লেখকরা এ কাজটি করে এসেছেন। সুতরাং মন্তব্যকে যদি লেখা থেকে, রাজনীতি থেকে আলাদা করতে হয় তবে সেখানে রাজনীতি কমাতে হবে এবং লেখাও কমাতে হবে। এমনকি একইভাবে কমাতে হবে মন্তব্যও। ঐতিহাসিকভাবে এই ছিল লেখকদের ভূমিকা। আমি খুব সহজেই একটি খাদি শাড়ি পরে জঙ্গলে গিয়ে আস্তানা গাড়তে পারি এবং শহীদও হতে পারি। কিন্তু তেমন কিছু করা আমার পরিকল্পনার মধ্যে নেই। আমি এখন যা বা যেমন আছি, কিংবা যা লিখছি তা নিয়ে আমার কোনো সমস্যাই নেই। কারণ আমি সন্ত সাজার চেষ্টা করছি না। জনপ্রিয়ও হতে চাই না আমি। নন্দিত কোনো জননেতা হিসেবে আমাকে বিবেচনা করতেও বলছি না। আমি একজন লেখক। আমার নিজস্ব কিছু ধ্যানধারণা বা চিন্তাভাবনা রয়েছে। যেটুকু দক্ষতাই আমার আছে আমি সেটুকুকেই কাজে লাগাই, সেটুকুকেই নিয়োজিত করি। যতটুকু সম্ভব আমি আমার চিন্তা-ভাবনাগুলোকে লেখার মাধ্যমেই প্রকাশ করি। সবসময়ই যে আমি এগুলো একেবারে নিজে থেকে করি তা নয়। প্রতিরোধের অন্তর্গত তাগিদ থেকেও আমি এসব করে থাকি।
রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে লেখাটা খুব উত্তেজনাকর কিছু বলেই যে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লিখি ব্যাপারটি তেমন নয়। এটা আসলে লেখারই একটি নতুন মাত্রা। আমি যদি একজন লেখক হয়ে থাকি এবং আমি যদি সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে লিখে থাকি তাহলে আপনার কাছে মনে হবে আমার ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ একটি রাজনৈতিক রচনা। তবে এর পর পরই আরো বেশি রাজনৈতিক গুরুত্ববাহী রচনায় আমাকে হাত দিতে হয় এবং সেটি হচ্ছে উপন্যাস নয় এমন সব রাজনৈতিক রচনা। কিন্তু আমি তো মনে করি উপন্যাসের মধ্যেই রাজনীতি অনেক বেশি গভীরভাবে উঠে আসে। আর উপন্যাসে বিধৃত রাজনীতি অনেক বেশি শক্তিশালী। আপনি যদি ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ পড়ে থাকেন তবে দেখবেন সেখানে বর্ণ প্রথা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এটা সরকার কিংবা রাষ্ট্র বনাম জনগণ জাতীয় কোনো বিষয় নয়। এটি আমাদের সমাজের ভেতরকার অসুস্থতাকে তুলে ধরেছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্য উপন্যাসই হচ্ছে অনেক বেশি জোরালো মাধ্যম। আপনি সবসময় একই ধরনের কাজ করা, একই কায়দায় চিন্তা করা কিংবা লেখার ক্ষেত্রে একই কৌশল অবলম্বনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারবেন না। ব্যাপারটি সবসময়ই চ্যালেঞ্জের। সুতরাং একথাও আমি বলতে পারি না যে, নিজেকে আমি রাজনৈতিক ব্যক্তি হয়ে ওঠা থেকে বিরত রাখব। আমি অবশ্যই মনে করি যে, প্রতিটি ব্যক্তিই এমনকি একজন ফ্যাশন মডেলও রাজনৈতিক ব্যক্তি। আপনি কোন ধরনের রাজনীতি করতে চান তার ওপর নির্ভর করবে আপনি রাজনীতির কোন পথটি বেছে নেবেন। এখানে ফাঁকিঝুঁকির কোনো জায়গা নেই। রাজনীতি হচ্ছে শুধুমাত্র নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এবং জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া – এ জাতীয় ধারণা একেবারেই ফাঁপা এবং ভাসা ভাসা একটি ব্যাপার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন