বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১১

এশিয়ান হাইওয়ে : ভারত প্রস্তাবিত রুটই চূড়ান্ত

এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য শেষপর্যন্ত ভারতের প্রস্তাবিত রুটই চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনে (ইউএন-এসকাপ) রুট পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গত দুই বছরেও কোনো প্রস্তাব দেয়া হয়নি; বরং একতরফাভাবে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী ইউএন-এসকাপের চাপিয়ে দেয়া রুট ধরেই সড়ক উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী এক থেকে ১০ বছরের মধ্যে সড়ক উন্নয়নের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিকল্পনায়। সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ভারত প্রস্তাবিত রুট কবুল করে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হলে বাংলাদেশ শুধু আর্থ-সামাজিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, দেশের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, চূড়ান্ত হওয়া রুটে ভারত বাংলাদেশকে ব্যবহার করে তাদের পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ পাবে। অপরদিকে এশিয়ান হাইওয়েকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ পূর্বদিকে এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের দরজা উন্মোচন করতে পারতো; এ রুটে সে সুযোগ থাকছে না। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের পরিষ্কার অভিমত—এটা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
উল্লেখ্য, এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে আন্তঃদেশীয় ও আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ২০০৯ সালের ১০ আগস্ট চুক্তির মাধ্যমে ‘দি ইন্টারগভর্নমেন্টাল এগ্রিমেন্ট অন দি এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক’ পক্ষভুক্ত হয়। ওই সময় বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক কক্সবাজার-টেকনাফ রুট বাদ দিয়ে ভারতের প্রস্তাবিত সিলেটের তামাবিল রুটকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা এশিয়ান হাইওয়ের নকশা প্রাথমিকভাবে কবুল করা হয়। এতে সড়ক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরাসহ বিভিন্ন পেশার নাগরিক বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে ভারতের প্রস্তাবিত রুট মেনে নিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ওই চুক্তির প্রবল বিরোধিতা করেন। ব্যাপক আপত্তির মুখে সরকার চুক্তির খসড়া অনুমোদনের জন্য তৈরি করা মন্ত্রিসভার কার্যপত্রে উল্লেখ করেছে যে, আপাতত চুক্তি হলেও তা কার্যকর করার আগে বাংলাদেশ ইউএন-এসকাপে নিজস্ব রুটের বিষয়ে দেনদরবার অব্যাহত রাখবে। চুক্তি সম্পাদনের পর দুই বছরের অধিক সময় পার হলেও বাংলাদেশ ইউএন-এসকাপে দেনদরবার তো দূরের কথা, একটি চিঠিও দেয়নি; বরং ভারতের রুট মেনে নিয়েই যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এশিয়ান হাইওয়ের জন্য সড়ক নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ বিষয়টি তদারকি করার জন্য সড়ক বিভাগের একজন প্রকৌশলীকে দায়িত্বও দেয়া হয়েছে।
এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্প : যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এশিয়ান হাইওয়ে ও বিমসটেক সংক্রান্ত সমীক্ষার আওতায় বাংলাদেশে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সড়ক প্রকল্পের আওতায় নেয়া প্রকল্পগুলো হচ্ছে—এডিবির সহায়তায় ৬৩.৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ট্রান্সপোর্ট করিডোর প্রজেক্টের অধীনে বেনাপোল-যশোর- নড়াইল-ভাটিয়াপাড়া (কালনা ব্রিজসহ) ১০২ কিলোমিটার সড়ক উন্নত করা। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ঋণে আশুগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া- সুলতানপুর- চিনাইর- আখাউড়া- সেনারবাদি সড়ক। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ঋণের আওতায় ৮৮.৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ধরখর-আখাউড়া সড়ক জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ। এডিবির সহায়তায় সাব-রিজিওনাল রোড ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের অধীনে ১৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে হাটিকুমরুল সড়ক উন্নত করা। ১৩.৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা সড়ক উন্নত করা। এডিবির সহায়তায় ১৭৬.৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে প্রায়োরিটি রোড প্রজেক্টের অধীনে জয়দেবপুর-চন্দ্রা-বঙ্গবন্ধু সেতু- হাটিকুমরুল সড়ক উন্নত করা। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এসব সড়ক উন্নত করার কাজ শেষ করার কথা বলা হয়েছে। সড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব সড়কের দু’পাশে এশিয়ান হাইওয়ের চিহ্ন হিসেবে এএইচ-১ ও এএইচ-২ লিখে সাইনবোর্ড টানানোর জন্য সড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখাকে ইতোমধ্যে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
এশিয়ান হাইওয়ের চূড়ান্ত রুট : বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের জন্য রুট হিসেবে ভারত ইউএন-এসকাপে যে প্রস্তাব দিয়েছে, বাংলাদেশ শেষপর্যন্ত সেটাই মেনে নিয়েছে। চূড়ান্ত হওয়া রুটগুলোর মধ্যে ১ নং রুট হিসেবে দেখানো হয়েছে পশ্চিমদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের যশোরের বেনাপোল হয়ে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে সিলেট-তামাবিল হয়ে ভারতের আসামে গন্তব্য। ২ নং রুট হিসেবে ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা হয়ে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে আবার সিলেট-তামাবিল হয়ে ভারতের আসাম। ৩ নং উপ-আঞ্চলিক রুট হিসেবে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশের মংলা সমুদ্রবন্দর হয়ে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে ঢাকা হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার। প্রস্তাবে ১ নং রুটকে এএইচ-১, ২ নং রুটকে এএইচ-২ এবং ৩ নং রুটকে এএইচ-৪১ রুট হিসেবে দেখানো হয়েছে। এএইচ-১ এবং এএইচ-২ (ভারত থেকে ভারত) আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর এএইচ-৪১ (বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার) রুটকে উপ- আঞ্চলিক রুট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এশিয়ান হাইওয়ের ইতিবৃত্ত : ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ইউএন-এসকাপ) এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্প গ্রহণ করে। ১৯৯২ সালে বেইজিংয়ে এসকাপের বৈঠকে এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে ও ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ফেসিলিটেশন সমন্বয়ে এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট গঠনের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়। ২০০১ সালে সিউলের অবকাঠামো কমিটির মন্ত্রীপর্যায়ের সম্মেলনে প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৩ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এসকাপের ৫৮তম সম্মেলনে ৩২ দেশের মধ্যে এ বিষয়ে একটি আন্তঃরাষ্ট্র সমঝোতা হয়। পরে সাংহাইতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৩২ দেশের মধ্যে ২৬টি দেশ স্বাক্ষর করে। ভারতের দেয়া প্রস্তাব অনুযায়ী ইউএন-এসকাপ বাংলাদেশের জন্য ওই দুটি আন্তর্জাতিক রুট ও একটি সাব-রিজিওনাল রুট নির্ধারণ করে দেয়। এ রুটের ব্যাপারে বাংলাদেশ ওই সময় প্রবল আপত্তি পেশ করে বলে, এএইচ-১ ও এএইচ-২ রুট দুটির মাধ্যমে বাংলাদেশ লাভবান হওয়া তো দূরের কথা, অর্থনৈতিকভাবে ও জাতীয় নিরাপত্তার দিক দিয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ভারত থেকে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বুলগেরিয়াসহ অন্যান্য দেশে সড়কপথে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হলে এএইচ-৪১কে উপ-আঞ্চলিক রুট থেকে আন্তর্জাতিক রুটে রূপান্তর করতে হবে। এএইচ-১ ও এএইচ-২ রুট দুটি ভারত থেকে ভারতে যাওয়ার জন্যই নির্ধারিত। তামাবিল ও আসাম হয়ে পূর্বদিকে ওইসব দেশে যেতে হলে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত প্রায় ৬শ’ কিলোমিটার পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ ঘুরতে হবে। যৌক্তিক কারণসংবলিত রুট পরিবর্তনে বাংলাদেশের এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভারত প্রবল আপত্তি দেয়। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সর্বশেষ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২১ মে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ইউএন-এসকাপের আগের প্রস্তাব অনুযায়ী এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই বছর জুন মাসে মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বাংলাদেশ এগ্রিমেন্টে স্বাক্ষর করে। তবে রুট পরিবর্তনের বিষয়টি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলা হলেও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং ওই রুট ধরেই এখন সড়ক উন্নত করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের লাভক্ষতি : বর্তমান রুট ধরে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হলে বাংলাদেশের ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেছেন, এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে—এটাই জাতি আশা করেছিল। কিন্তু ভারত প্রভাবিত ইউএন-এসকাপ যে রুট বাংলাদেশকে চাপিয়ে দিয়েছে, তার মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে গেলে বাংলাদেশের কোনো লাভের সুযোগ নেই। এতে ভারত মূলত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়ার সহজ করিডোর পাবে। এটা বোঝার জন্য কোনো বিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন নেই। যে কোনো সাধারণ নাগরিকও বুঝবে যে, ঢাকা থেকে মিয়ানমারসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যেতে হলে কক্সবাজার রুটটিই হবে বাংলাদেশের জন্য সহজ। ঢাকা থেকে সিলেটের তামাবিল ও আসাম হয়ে অতিরিক্ত ৭-৮শ’ কিলোমিটার পাহাড়ি উঁচু-নিচু সড়ক ঘুরে আবার মিয়ানমার যাওয়ার কথা বলাটাই এক ধরনের মূর্খতা ও বোকামি। মূলত এর মধ্যেই প্রকৃত রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। কাজেই এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে হলে কক্সবাজার-মিয়ানমার রুটটিকেই আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ভারতের স্বার্থে তামাবিল রুটটি একটি উপ-আঞ্চলিক রুট হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহ্বুবউল্লাহ্ ইউএন-এসকাপের চাপিয়ে দেয়া রুটের বিরোধিতা করে বলেন, এ রুট হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী। এর আগে ভারত এ রুটটি বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নেয়ার জন্য বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে এসে তারা সেটা ঠিকই আদায় করে নিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের দেশের মানুষ এ বিষয়টি অনেক দেরিতে উপলব্ধি করতে পেরেছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত যে ক’টি উদ্যোগ নিয়েছে, তার সবক’টিই ভারতের স্বার্থে। তিনি বলেন, ভারতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইউএন-এসকাপ যে রুট নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটা ধরে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হলে বাংলাদেশের জন্য সেটা হবে চরম আত্মঘাতী। এতে করে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, একইসঙ্গে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়বে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন