শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১১

বিমানবন্দর নয়, স্টলপোর্ট

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (ক্যাব) ওয়েবসাইটে তেজগাঁও কোনো পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর নয়, সীমিত বিমান চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট করা একটি স্টলপোর্ট হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এ বিষয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মন্তব্য চাওয়ার পর ১৫ অক্টোবর আকস্মিকভাবে এর স্টলপোর্ট পরিচয় মুছে ফেলা হয়। হয়ে যায় ‘অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর’।
স্টল (এসটিওএল) মানে শর্ট টেকঅফ অ্যান্ড ল্যান্ডিং। বিমানবন্দরের সঙ্গে স্টলপোর্টের পার্থক্য হলো, এর জন্য নামমাত্র রানওয়ে হলেই চলে।
২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে এই স্টলপোর্টের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক হলফনামা দিয়ে ক্যাবের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া স্টলপোর্ট-সংক্রান্ত কপি পেশ করেন। প্রায় চার বছর স্টলপোর্ট পরিচয় টিকে থাকে। এমনকি এ মাসের ১১ তারিখে হালনাগাদ করা ওয়েবসাইটেও স্টলপোর্ট পরিচয় ছিল।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, তেজগাঁও এলাকায় যাতে উঁচু স্থাপনা নির্মাণে কোনো বাধা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য ১৯৮৮ সালের আগস্টে এইচ এম এরশাদ তেজগাঁও বিমানবন্দরটি পরিত্যক্ত ঘোষণার সিদ্ধান্ত দেন। তা ছাড়া, বিগত আওয়ামী লীগের আমলে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনমতে, ওই এলাকায় যেকোনো ধরনের বিমানবন্দর রাখা অবৈধ।
এরপর আর কখনো পরিত্যক্ত ঘোষণার সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনা হয়েছিল বলে নগর পরিকল্পনাবিদদের জানা নেই। বিমানবাহিনী সদর দপ্তর এখন দাবি করছে, এটি পরিত্যক্ত নয়।
বাংলাদেশ স্থপতি পরিষদের একজন মুখপাত্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৮৮ সালের প্রজ্ঞাপন বাতিলের কোনো দলিল আমরা শত অনুসন্ধান করেও খুঁজে পাইনি।’
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এর আগে সুপ্রিম কোর্টে স্বীকার করে যে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তেজগাঁও বিমানবন্দর ‘নিষ্ক্রিয়’ ছিল।
বিমানবাহিনী পুরাতন বিমানবন্দরকে শাহজালালের সঙ্গে তুলনা করে ‘পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর’ ধরে নিয়েই মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তন করিয়েছে। কোনো স্টলপোর্ট দিয়ে সাধারণত রোটেটিং হেলিকপ্টার ওঠানামা করে। তার জন্য বড় রানওয়ের দরকার পড়ে না।
৬ অক্টোবর আন্তবাহিনী জনসংযোগ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিমানবাহিনী পুরাতন বিমানবন্দরে জঙ্গিবিমান ব্যবহারের দাবি করেছে। কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এর সত্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কারণ, গুগল আর্থের মাধ্যমে ২০০১ থেকে ২০১০ সালের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ ও ওয়াকিবহাল সূত্রের মতে, তেজগাঁও থেকে জঙ্গিবিমান ওড়ানো হয় না। ২০০১ সালেও এর রানওয়ে ভাঙাচোরা দেখা যায়।
এয়ারপোর্ট বনাম স্টল: ক্যাব ওয়েবসাইটে পুরাতন বিমানবন্দরকে দেশের সাতটি অচল স্টলপোর্টের অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করা ছিল। ১১ অক্টোবর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর ছিল পাঁচটি। এখন এর সঙ্গে তেজগাঁও ছাড়াও প্রায় ১০ বছর ধরে অচল থাকা ঈশ্বরদীও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের নতুন খেতাব পেয়েছে। আর অচল স্টলপোর্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে শমশেরনগর ও কুমিল্লা।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র ১১ অক্টোবর প্রথম আলোকে জানায়, ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য হালনাগাদ করা নেই। যদিও ক্যাবের আবুল হাসনাত সর্বশেষ ১১ অক্টোবর ওয়েবসাইটটি হালনাগাদ করেছেন বলে উল্লেখ ছিল।
এদিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়ে সাড়ে ১০ হাজার ফুট। দাবি করা হচ্ছে, তেজগাঁওয়েরটি ৯,৮০০ ফুট। অথচ স্টল সার্ভিস চালু রাখতে এর অর্ধেক দৈর্ঘ্যের রানওয়ে দরকার হয় না। এমনকি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরও তিন-চার হাজার ফুটেরও হতে পারে।
বিমানবাহিনীর দাবি, তেজগাঁও বিমানবন্দর একটি সম্পূর্ণভাবে সচল বিমানঘাঁটি, যেখান থেকে বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে সব ধরনের হেলিকপ্টার, প্রশিক্ষণ বিমান, জেটবিমান এবং বৃহদাকার পরিবহন বিমান (চার ইঞ্জিনবিশিষ্ট সি-১৩০) পরিচালনা করে থাকে।
সূত্রমতে, ঢাকায় বিমানবাহিনীর দুটি বিমানঘাঁটি। তেজগাঁও ছাড়া অন্যটির নাম বাশার ঘাঁটি। শাহজালাল বিমানবন্দরের যে অংশে মিগ-২৯ ও এফ-৭ রাখা আছে, সেটি বাশার ঘাঁটির অংশ হিসেবে গণ্য হয়। বিমানবাহিনী শাহজালালের শুধু রানওয়ে ব্যবহার করে। ১৯৮১ সালে কুর্মিটোলা (‘জিয়া’ নামকরণ হয়েছিল ১৯৮৩ সালে) বিমানবন্দর চালুর আগে যৌথভাবেই তেজগাঁও ব্যবহূত হতো। বিমানবাহিনীর চট্টগ্রাম বিমানঘাঁটির জন্যও কোনো রানওয়ে নেই। শাহ আমানতের রানওয়ে দিয়েই যথারীতি চলছে।
অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর ইশফাক এলাহি চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, টাঙ্গাইল অঞ্চলের দিকে বিমানবাহিনীর জন্য একটি নিজস্ব এয়ারপোর্ট করে দেওয়া যেতে পারে।
তেজগাঁও আসলে কী: একটি বিমানবন্দরের রানওয়ে কত বড় থাকবে, তা নির্ভর করে কী ধরনের বিমান ওঠানামা করবে। আর এর ওপরই আশপাশের উচ্চতাজনিত বাধার বিষয়টি নির্ভর করে। উচ্চতাজনিত আপসের সুযোগ আছে। ক্যাব ম্যানুয়াল অব অ্যারোড্রাম স্ট্যান্ডার্ড বলছে, ক্যাবের চেয়ারম্যানই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। ২০০৭ সালের আগস্টে র‌্যাংগস ভবন ভাঙার রায় ঘোষণার পর গণপূর্ত ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিবদ্বয়ের যৌথ সভাপতিত্বে এক সভা হয়। এর কার্যবিবরণীতে বেসরকারি ভবনের মালিকপক্ষের বরাতে বলা আছে, ক্যাবের ওয়েবসাইটে তেজগাঁও বিমানবন্দরের উপস্থিতি/অবস্থানের উল্লেখ নেই। এটি পরিত্যক্ত। তাই উচ্চতাসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা এখানে খাটে না।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আদালতে উল্লেখ করেছিল, ‘যদিও একে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর বলা যায় না। কিন্তু এখানে সব সুযোগ-সুবিধা আছে। আইনে বিমানবন্দর ও বিমানঘাঁটির মধ্যে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়নি।’ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আদালতে এ যুক্তি খণ্ডন করেন। তিনি বলেছিলেন, ১৯৬০ সালের সিভিল অ্যাভিয়েশন অধ্যাদেশের আওতায় ১৯৮৪ সালের সিভিল অ্যাভিয়েশন বিধি প্রণীত হলেও পুরাতন বিমানবন্দরকে একটি ‘অপারেটিং এয়ারপোর্ট’ হিসেবে কোনো জনবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি। তা ছাড়া মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নাধীন রেখে তেজগাঁও বিমানবন্দর ধরার কোনো আইনি পথ খোলা নেই। (৫২ ডিএলআর ২০০০, পৃ. ৪৬৫)
রাজউকের মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ভলিউমের (যার বৈধতা ২০১৫ পর্যন্ত বহাল থাকবে) ৮৪ পৃষ্ঠায় পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় স্টলপোর্ট বা কোনো ধরনের রানওয়ে বজায় না রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
১৯৯৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর সিভিল এভিয়েশনের এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে স্টল সার্ভিস চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু উচ্চতাসংক্রান্ত বিষয়ে এতে ঢালাও তথ্য দেওয়া হয় যে, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য যে ধরনের, তেমনি তেজগাঁও, লালমনিরহাট ও শমসেরনগরের জন্যও একই নিয়ম প্রযোজ্য।’ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দরের জন্য যত বড় রানওয়ে এবং সেই অনুপাতে উচ্চভবনজনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়, সেটা স্টলের ক্ষেত্রে ঘটে না। একটি স্টল চলাচলের জন্য ছোট রানওয়ে দরকার পড়ে।
জাতীয় প্যারেড স্কোয়ার: এইচ এম এরশাদ সাবেক তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে জাতীয় প্যারেড স্কোয়ার ঘোষণা করেছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবাহিনী তখনো জায়গাটি ছাড়তে চায়নি। কিন্তু এরশাদের কঠোর মনোভাবের কারণে অনেকটা নাটকীয়ভাবে বিমানবাহিনী তাদের বিমানগুলো কুর্মিটোলায় সরিয়ে নেয়।
রাজউকের নথি: ১৯৮৮ সালের ৯ আগস্ট রাজউকের চেয়ারম্যান পুরাতন বিমানবন্দরের এয়ারফানেলের মধ্যে বহুতল ভবন নির্মাণ প্রসঙ্গে একটি নোট লেখেন। এতে দেখা যায়, বিমান সদর ৩.৭.৮৮-তে একটি নকশা এঁকে সেই এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণে সীমাবদ্ধতা জারি করে। এর ১১ দিন পর ক্যাব এয়ারফানেলের ১৫ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে বহুতল ভবন নির্মাণে শর্তারোপ করে। এ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা এড়াতে রাজউক পূর্তমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত চায়। তখন তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম লেখেন, ‘এ বিষয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির (এরশাদ) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে এবং তিনি পুরাতন বিমানবন্দরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত বিমান সদর ও ক্যাবকে জানানো যায়।’ ১০ আগস্ট ১৯৮৮ তা যথারীতি জানিয়ে দেওয়া হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন