শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১১

বিজয় সরণি দিয়েই মেট্রোরেল করা যৌক্তিক

মো. শামসুল হক
অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। মেট্রোরেল বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির সদস্য

প্রথম আলো  ঢাকার মতো একটি শহরে মেট্রোরেলের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
মো. শামসুল হক: যত ধরনের গণপরিবহন রয়েছে, তার মধ্যে মেট্রোরেল হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর একটি ব্যবস্থা। কারণ, এর ধারণক্ষমতা সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি যাত্রী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করতে পারে। ঢাকার বিষয়টি যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তবে দেখব যে বাস বা এ ধরনের গণপরিবহন চলতে পারে—এমন পর্যাপ্ত সড়ক শহরটিতে নেই। একদিকে শহরটি জনবহুল, রাস্তার সংখ্যা কম ও অন্যদিকে সব রাস্তা বাস চলাচলের উপযোগী নয়। বিশ্বের সব আধুনিক শহরে বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন-ব্যবস্থা থাকে। এর চূড়ান্ত ধাপটি হচ্ছে মেট্রোরেল। ঢাকার মতো জনবহুল একটি শহরে, যেখানে বাস চলাচলের উপযোগী প্রয়োজনীয় রাস্তা নেই, সেখানে মেট্রোরেল একটি জরুরি বিষয় ও বহু আগেই এই মেট্রোরেল চালু হওয়া উচিত ছিল।
 বর্তমানে যে রুট প্রস্তাব করা হয়েছে, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী কী বিবেচনা কাজ করেছে?
শামসুল হক: ঢাকার জন্য ২০ বছরমেয়াদি যে কৌশলপত্র করা হয়েছিল, সেখানে তিনটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি ও তিনটি মেট্রো র‌্যাপিড ট্রানজিট বা এমআরটি রয়েছে। এটি একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। একে বাস্তবায়ন করা গেলে একটি সমন্বিত ও বহুমাত্রিক গণপরিবহন-ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। জাপানি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা জাইকা এই তিন এমআরটি লাইনের প্রাক-সমীক্ষা করে দেখেছে যে এমআরটি-৬-এ সবচেয়ে বেশি যাত্রী যাতায়াত করে। ফলে, এই রুটে বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে। এরপর চূড়ান্ত সমীক্ষা করে তারা অ্যালাইনমেন্টসহ রুট, ডিপো, স্টেশন, টার্নিং—সবকিছুই চূড়ান্ত করা হয়। সব ধরনের বিকল্প বিবেচনায় নিয়েই তারা এই রুট চূড়ান্ত করেছে।
 আপনি কি মনে করেন, যে রুটটি প্রস্তাব করা হয়েছে সেটিই সবচেয়ে কার্যকর রুট?
শামসুল হক: মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এর গতির বিষয়টি। বাঁক বেশি থাকা মানে গতি কমে যাওয়া, আর মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য ঝুঁকিও বেড়ে যাওয়া। ফলে যত কম ও সহনীয় বাঁক রাখা যায়, সেটাই বড় বিবেচনা হিসেবে কাজ করেছে। এসব বিবেচনা থেকেই বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেলের রুটের বিষয়টি ঠিক করা হয়েছে। এখন এই অংশ পরিবর্তন করার অর্থই হচ্ছে এই মেট্রো রুটের সক্ষমতার ক্ষেত্রে আপস করা, মানের ক্ষেত্রে আপস করা।
 বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে বিজয় সরণি অংশের ব্যাপারে যে আপত্তি তোলা হয়েছে, তা কতটুকু যৌক্তিক?
শামসুল হক: তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামার ঝুঁকির প্রসঙ্গ তুলে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে মেট্রোরেল রুটের এই অংশের ব্যাপারে আপত্তি তোলা হয়েছে। তারা বলছে যে ১৯ মিটার উচ্চতার এই মেট্রোরেলের স্থাপনার ফলে দক্ষিণ দিক থেকে বিমান ওঠানামা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। জাইকার সমীক্ষা ও আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, তেজগাঁও বিমানবন্দরের এয়ার ফানেল বরাবর ইতিমধ্যেই যেসব স্থাপনা রয়েছে, এই গণপরিবহন-ব্যবস্থা তৈরি হলে অতিরিক্ত কোনো ঝুঁকির সৃষ্টি হবে না। নভোথিয়েটারসহ এই অঞ্চলের ২৬১টি ভবন বিমান চলাচলের জন্য উচ্চতার সীমা লঙ্ঘন করা সত্ত্বেও বিমানবন্দরটি সচল রয়েছে। এই স্থাপনা যদি বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টি করত, তবে আপত্তিকে যৌক্তিক বলা যেত। বর্তমান স্থাপনাগুলো যদি কোনো সমস্যা না করে থাকে, তবে গণমুখী এই স্থাপনার বিরোধিতা করার কোনো কারণ দেখি না।
 এই স্থাপনা যে বাড়তি ঝুঁকির সৃষ্টি করছে না, সেটার স্বপক্ষে আপনার সুনির্দিষ্ট যুক্তিটি কি ব্যাখ্যা করবেন?
শামসুল হক: দক্ষিণ দিকের যে এয়ার ফানেলের প্রসঙ্গ তুলে মেট্রোরেলের বিরোধিতা করা হচ্ছে, সেখানে ২২ মিটার বা ৭৭ ফুট উচ্চতার নভোথিয়েটার রয়েছে। এর আড়াই শ ফুট দূরে ৬৬ ফুট উচ্চতার প্রস্তাবিত মেট্রোলাইনটি কোনোভাবেই বাড়তি ঝুঁকি বাড়াবে না। এটা নভোথিয়েটারের একটি ছায়া স্থাপনা হিসেবেই গড়ে উঠতে পারে। শুধু তা-ই নয়, নভোথিয়েটার-লাগোয়া মণিপুরীপাড়ায় রানওয়ে ফানেল বরাবর চার-পাঁচতলার এমন আরও অনেক ভবন রয়েছে, যেগুলোর উচ্চতা কোনোভাবেই দোতলার বেশি হওয়া উচিত নয়। এগুলোর কিছু মানা হচ্ছে না। আমি যা বলার চেষ্টা করছি তা হচ্ছে, বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেলের লাইনটি যেহেতু বর্তমান ঝুঁকির বাইরে বাড়তি কোনো ঝুঁকির সৃষ্টি করবে না, তাই এর বিরোধিতা করার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। ত্রাণ বা এ ধরনের কাজে ব্যবহারের উপযোগী বিমানবাহিনীর সবচেয়ে বড় বিমানটি হচ্ছে সি ১৩০। এই আকাশযানের নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের হিসাব অনুযায়ী, এর টেকঅফ ও ল্যান্ডিংয়ের জন্য সর্বোচ্চ প্রয়োজন হচ্ছে চার হাজার ৭০০ ফুট, সেখানে তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে আছে নয় হাজার ৮০০ ফুট। ফলে, কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। একটি বার্তা সংস্থার ওয়েবসাইটে বিমানবাহিনীর ব্যাখ্যা দেখেছি। সেখানে নভোথিয়েটারকে ‘পয়েন্ট অবস্ট্রাকশন’ আর মেট্রোলাইনকে ‘ওয়াল অবস্ট্রাকশন’ হিসেবে উল্লেখ করে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা আইকাও এর নিয়ম অনুযায়ী রানওয়ের অ্যাপ্রোচ ফানেলের কোনো বাধাকে এ ধরনের ‘পয়েন্ট’ বাধা ও ‘ওয়াল’ বাধা হিসেবে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। এখানে যেকোনো ধরনের বাধাই বাধা হিসেবে বিবেচিত। আর নভোথিয়েটারের বাধাকে ‘ম্যানুভার’ করে উড়োজাহাজ ওঠানামার যে কথা বলা হয়েছে, এর সঙ্গে বাস্তব জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
 আন্তর্জাতিক আইন মেনে তেজগাঁও বিমানবন্দর চালাতে হলে তবে তো অনেক ভবন ভেঙে ফেলতে হবে।
শামসুল হক: বলা হচ্ছে, মেট্রোরেলের লাইনটি রানওয়ের অ্যাপ্রোচ ফানেলের মধ্যে পড়বে। আগেই বলেছি, এটাকে বাধা মানলে অ্যাপ্রোচ ফানেলের মধ্যে থাকা নভোথিয়েটারসহ অনেক ভবন ইতিমধ্যেই বাধা হিসেবে কার্যকর রয়েছে। আর একটি বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে শুধু বিমান ওঠানামার জন্য অ্যাপ্রোচ ফানেলই নয়, ইনার হরিজেন্টাল সারফেস বলেও একটি সীমা আন্তর্জাতিকভাবে মেনে চলতে হয়। আইকার আইন অনুযায়ী, বিমানবন্দরের চারদিকে বৃত্তাকারে চার কিলোমিটারের মধ্যে ৪৫ মিটারের বেশি কোনো স্থাপনা থাকার কথা নয়। অ্যাপ্রোচ ফানেলে মধ্যে না থাকা সত্ত্বেও এই কারণ দেখিয়ে র‌্যাংগস ভবন ভাঙা হয়েছে। বিমানবাহিনীর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের আশপাশে ফ্যালকন টাওয়ার, নতুন তৈরি হওয়া ট্রাস্ট ব্যাংক ভবন বা আইডিবি ভবন অ্যাপ্রোচ ফানেলের মধ্যে না পড়ায় বিমান ওঠানামায় কোনো সমস্যা হবে না। এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, অ্যাপ্রোচ ফানেলের মধ্যে না পড়লেও এই ভবনগুলো ইনার হরিজেন্টাল সারফেসের মধ্যে পড়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মানলে এই ভবনগুলোও থাকার কথা নয়। আমার কথা হচ্ছে, এই ভবনগুলো থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে তেজগাঁও বিমানবন্দর চলছে। সুতরাং মেট্রোরেলের লাইনটি যেহেতু বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টি করছে না, তাই এর বিরোধিতা করার সুযোগ নেই।
 আন্তর্জাতিক আইন যেহেতু মানা যাচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে ঢাকার মতো জনবহুল একটি শহরে এ ধরনের একটি বিমানবন্দরের যৌক্তিকতা কতটুকু?
শামসুল হক: তেজগাঁও বিমানবন্দরের অবস্থানগত দিক দেখলে আমরা দেখব, এই বিমানবন্দর, সেনানিবাস ও হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর—সাড়ে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই তিন স্থাপনা পুরো শহরটিকে দ্বিখণ্ডিত করে রেখেছে। শহরটির সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য এটা এক বড় বাধা। ফলে পূর্ব-পশ্চিমের সংযোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা যাচ্ছে না। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে, শহরের কেন্দ্রে এ ধরনের একটি বিমানবন্দর ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। পাশাপাশি বেসামরিক বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হলে এই শহরের ওপর এর প্রভাব পড়বে। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে প্রগতি সরণি, আর পল্লবী ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১২-১৩ তলার ওপরে কোনো ভবন করা যাবে না। একটি মেগা সিটির ধারণার সঙ্গে বিষয়টি সংগতিপূর্ণ হতে পারে না।
 শাহজালাল বিমানবন্দরের জরুরি বিকল্প হিসেবে তেজগাঁও বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে।
শামসুল হক: দেখুন, তেজগাঁও বিমানবন্দর কখনো শাহজালাল বিমানবন্দরের বিকল্প বা জরুরি অবতরণ ক্ষেত্র হতে পারে না। রানওয়ে সক্ষমতার বিষয়টি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত ৩০ বছরে শাহজালাল বিমানবন্দরের কোনো উড়োজাহাজ জরুরি প্রয়োজনে তেজগাঁওয়ে অবতরণ করেনি। শাহজালাল বিমানবন্দরের উড়োজাহাজগুলো এখন জরুরি প্রয়োজনে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বা সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর ব্যবহার করে।
 সামরিক কৌশলগত যে দিকের কথা বলা হচ্ছে—
শামসুল হক: ঢাকার মতো জনবহুল একটি শহরের মাঝখানে এ ধরনের বিমানবন্দর সামরিক ও অন্য কোনো কৌশলগত কারণের ব্যবহারের বিষয়টি কৌশলগত কারণেই অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সামরিক কারণে শহরের মাঝখানে অবস্থিত বিমানবন্দর ব্যবহার করতে গেলে ঝুঁকি আরও বাড়ে। কৌশলগত দিক বিবেচনায় নিলে শহর থেকে দূরে ও যেখানে লোকালয় কম, সেখানেই এ ধরনের বিমানবন্দর থাকা উচিত।
 সংসদ ভবন একদিকে যেমন জাতীয়ভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, তেমনি স্থাপত্যের বিচারে অনন্য। এমন একটি স্থাপত্যের পাশ দিয়ে এটি নিয়ে যাওয়া কতটা যৌক্তিক?
শামসুল হক: এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, মেট্রোরেল বাস্তবায়নের বিষয়টি খুবই জরুরি। কোনোভাবে তা বিলম্বিত হোক, তা প্রত্যাশিত নয়। আমি আশা করব, যৌক্তিক বিবেচনায় সরকার বিজয় সরণি দিয়েই মেট্রোরেল বাস্তবায়নের দিকে এগোবে। সেটা না হলে বিকল্প যদি সংসদ ভবনের সামনে দিয়েই হয়, তবে আমি বলব যে সৌন্দর্য কিছুটা নষ্ট হলেও মেট্রোরেল করার কোনো বিকল্প নেই। শহরের মানুষ ও গণপরিবহনের কথা চিন্তা করলে এটা করতেই হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন