শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১১

ওয়ালস্ট্রিট দখলের আন্দোলনে কিছুক্ষণ

তরুণটির বয়স ২১-২২ বছর হবে। তাঁর হাতে একটা প্ল্যাকার্ড। তাতে ইংরেজিতে যা লেখা আছে, তার অর্থ এ রকম: ‘প্রথমে ওরা তোমাকে অবজ্ঞা করবে/ তারপর তোমাকে নিয়ে হাসবে/ তারপর তোমার সঙ্গে লড়বে/ আর তারপর তুমি জয়ী হবে।’ বাক্যগুলোর শেষে উল্লেখ আছে মহাত্মা গান্ধীর নাম। অর্থাৎ এটা মহাত্মা গান্ধীর একটি উদ্ধৃতি।
ভারতে অহিংস আন্দোলনের জনক হিসেবে খ্যাত গান্ধীজির নাম আজও বিশ্বে শান্তিবাদী অথচ অন্যায়বিরোধী আন্দোলনের জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গেই উচ্চারিত হয়। আর তাই বিশ্ব লগ্নি পুঁজির (ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল) সুবিশাল প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ওয়ালস্ট্রিটের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও প্রেরণা হিসেবে অন্য অনেকের সঙ্গে গান্ধীজি উপস্থিত।
সেটা ছিল ‘ওয়ালস্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলনের চতুর্দশ দিবস। দুপুর ১২টার দিকে আমি নিউইয়র্কের গ্রাউন্ড জিরো ঘুরে দেখে ওয়ালস্ট্রিটের দিকে হাঁটতে গিয়ে জুকটি পার্কের সামনে চলে আসি। পার্কটি খুব যে বিশাল, তা-ও নয়। তবে তরুণ-তরুণী থেকে প্রৌঢ় পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের মানুষের সরব উপস্থিতি ও নানামুখী তৎপরতায় মনে হলো, এরা বড় কিছু একটা করার জন্য সচেষ্ট।
প্ল্যাকার্ডধারী তরুণটি কথা বলছিলেন একটি টেলিভিশনের সাংবাদিকের সঙ্গে। ‘কেন তুমি এখানে এসেছ’—এ রকম প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘কোটি কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে ওয়ালস্ট্রিটের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। এসব অর্থ এসেছে জনগণের কর থেকে। অথচ এসব ব্যাংকই আর্থিক সংকট তৈরি করেছে, মন্দা ডেকে এনেছে, আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে। কাজেই এদের আর কোনোভাবেই কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যাবে না।’
রবার্ট নামের এই তরুণের কথা থেকে ‘ওয়ালস্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল। বস্তুত, ২০০৮ সালে আমেরিকায় যে আর্থিক সংকট দেখা দেয়, তার জের ধরে আমেরিকার অর্থনীতি মন্দায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তিন বছর পর এসে মন্দা থেকে তো উত্তরণ হয়নি, বরং আরেকটি মন্দার মুখে পড়তে যাচ্ছে। অথচ যারা এ সংকট তৈরির জন্য প্রধানত দায়ী, সেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার নামে কোটি কোটি ডলার দিতে হয়েছে আমেরিকার সরকারকে। তার পরও এরা আরও অর্থ চাচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা মোটা অঙ্কের বেতন-বোনাস নিচ্ছেন। অন্যদিকে বাড়ছে বেকারত্ব। কমছে সামাজিক নিরাপত্তার পরিধি। উচ্চবিত্ত ও ধনীরা আয়করে বিশাল ছাড় পাচ্ছেন। মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপছে করের বোঝা।
এ রকম অবস্থায় শেষ পর্যন্ত রাস্তায় নেমেছে আমেরিকার বিভিন্ন বয়সের সাধারণ মানুষ। নিজেদের তারা পরিচয় দিচ্ছে ৯৯ শতাংশ হিসেবে। জুকটি পার্কের পুব দিকে একজন মাঝবয়সী নারীকে আরেকটি প্ল্যাকার্ড হাতে অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তাতে লেখা: ‘ওয়ালস্ট্রিট আমেরিকার ৯৯ শতাংশ মানুষকে খুন করেছে’। তাঁর চোখের ভাষায় মনে হলো, তিনি বলছেন, ‘আমাদের সঙ্গে এসে দাঁড়াও বা আমাদের সমর্থন করো।’
প্রতিবাদমুখর আন্দোলনকারীরা পার্কটির নাম দিয়েছে লিবার্টি প্লাজা (স্বাধীনতা চত্বর)। পার্কের ভেতর প্রবেশ করে দেখলাম, একপাশে পুরোনো বিভিন্ন বই ও ম্যাগাজিন দিয়ে বানানো হয়েছে লাইব্রেরি। এসব বই নামমাত্র দরে বিক্রিও করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা পালাক্রমে খাবার বানিয়ে তা বিক্রিও করছে। এগুলো করা হচ্ছে আন্দোলনের খরচ জোগানোর জন্য। আছে অনুদান বাক্স। যার যা ইচ্ছা হচ্ছে, দিয়ে যাচ্ছে। একদল ড্রাম ও গিটারে বাজিয়ে যাচ্ছে সংহতি ও প্রতিবাদের সুর। ল্যাপটপ, ক্যামেরাসহ কিছু ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করছেন কয়েকজন। তাঁরা প্রতিবাদের কার্যক্রম ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করাসহ গণমাধ্যমের জন্য খবর পাঠানোর কাজ করছেন। রাতযাপনে তাঁদের সম্বল স্লিপিং ব্যাগ।
রেডিও-টিভির সাংবাদিকদের দেখা গেল এখানে-ওখানে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলতে। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শ্রমিক, গৃহিণী, কেরানিসহ বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষের সমাবেশ ঘটেছে বলে জানালেন এক প্রতিবাদকারী। নাম উইলি। ৩০ বছর বয়সী এই তরুণী এসেছে নিউজার্সি থেকে। একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি আরও জানালেন, প্রতিদিনই নতুন নতুন লোক যোগ দিচ্ছে তাঁদের সঙ্গে। আর আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংহতি জানাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। ‘নিউইয়র্কের মতো বিভিন্ন স্থানেও আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গেছে,’ বলল উইলি।
‘তাহলে তোমাদের দাবিগুলো কী?’
‘আমরা দু-চারটা দাবিতে আন্দোলন সীমিত রাখছি না,’ ও জবাব দিল। ‘তুমি খেয়াল করে দেখবে, এখানে অন্যায্য করব্যবস্থা থেকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন দাবি করা হচ্ছে। কেননা, আমরা মনে করি, একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।’
এরই মধ্যে একটা স্লোগানমুখর একটা মিছিল পুব দিক দিয়ে পার্কে এসে ঢুকল। মিছিলটি প্রতিদিনের মতো ওয়ালস্ট্রিটের আশপাশের এলাকা প্রদক্ষিণ করে এসেছে। তবে কড়া পুলিশি বাধার কারণে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে ঘেঁষতে পারেনি। মূলত ২০১১ সালের জুন মাসে কানাডাভিত্তিক অ্যাডবাস্টার্স মিডিয়া ফাউন্ডেশন এই আন্দোলনের ডাক দেয়। তারা অতিরিক্ত মুনাফাখোর ও লোভী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শাস্তির দাবিতে একটা শান্তিপূর্ণভাবে ওয়ালস্ট্রিট দখলের আহ্বান জানায়। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। বিক্ষোভকারীরা ওই দিন এসে এই পার্কে অবস্থান নেয়। এখান থেকে ঘোষণা করা হয় বিভিন্ন কর্মসূচি। দিনের কর্মসূচি শুরু হয় জনগণের এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রতীকী ঘণ্টা বাজিয়ে। সকাল নয়টায় নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের ঘণ্টা বাজানো হয় দিনের লেনদেন শুরুর জন্য। তারই প্রতিবাদ হিসেবে ‘ওয়ালস্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলনের এই কর্মসূচি।
অবশ্য আন্দোলনের চতুর্থ দিনেই কিছুক্ষণের জন্য প্রথমবার ওয়ালস্ট্রিট পরিদর্শনের সুযোগ মিলেছিল আমার। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে আমরা ১৫ দেশের ১৫ জন অর্থনৈতিক সাংবাদিক তখন নিউইয়র্কে। সকালে ক্রেডিট সুইসে ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস কার্যালয় পরিদর্শন শেষে দুই ঘণ্টার বিরতি। নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের বিজনেস এডিটর লিয়াম ড্যানের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরের বিজনেস টাইমসের ইউ-ওয়েন লি এবং বাংলাদেশের প্রথম আলোর আমি—এই তিনজন মেট্রোতে চেপে চলে আসি ওয়ালস্ট্রিটে। কিন্তু এ কি! নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের আশপাশের রাস্তায় নামা যাচ্ছে না। ফুটপাতের শেষ প্রান্তে লোহার ব্যারিকেড টেনে দিয়েছে নিউইয়র্ক পুলিশ। পরে জানলাম, আন্দোলনকারীদের ভয়েই এই ব্যবস্থা। অথচ আন্দোলন তখনো তেমন গতি পায়নি। মূলধারার গণমাধ্যমও এটাকে কোনোর খবর বলে মনে করেনি।
সে কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলনকারীরা ‘ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল অকুপাইড’ নামে নিজেদের পত্রিকাও বের করে ফেলে। আমি লক্ষ করেছি যে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে এই বিক্ষোভের খবর চেপে যাওয়া হয়েছে। এমনকি ১ অক্টোবর যেদিন ব্রুকলিন ব্রিজে ৭০০ বিক্ষোভকারীকে পুলিশ নির্বিচারে গ্রেপ্তার করে, পরের দিন সে খবরটিও আসেনি। এটাকেই বোধ হয় বলে করপোরেট জার্নালিজমের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। দেশে ফেরার জন্য ফিলাডেলফিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসে যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন টিভিতে দেখলাম, সিএনএন আন্দোলনকারীদের নিয়ে বিদ্রূপ করছে। এরা কতটা ‘সিরিয়াস’, সে প্রশ্নই বারবার করা হচ্ছিল। আজ যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই আন্দোলন বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে, তখন হয়তো এসব করপোরেট মিডিয়া এই ধরনের প্রশ্নের জবাবটি পেয়ে গেছে।
ছবি: লেখক

ওয়ালস্ট্রিট বৃত্তান্ত
ওয়ালস্ট্রিট নামের তাৎপর্য অনেক বিস্তৃত। নিউইয়র্কের আর্থিক জেলা বা অঞ্চল (ফিন্যানশিয়াল ডিস্ট্রিক্ট) হিসেবে অভিহিত করা হয় এই এলাকাকে। ওয়ালস্ট্রিট নামের সড়কটি পশ্চিমে ব্রডওয়ে থেকে পুবে সাউথস্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত। ওয়ালস্ট্রিটেই একধারে আছে বিশ্বের বৃহত্তম (বাজার মূলধনের দিক দিয়ে) স্টক এক্সচেঞ্জ নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ। ওয়ালস্ট্রিট ও আশপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে আছে আমেরিকার বড় বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। কালক্রমে তাই ওয়ালস্ট্রিট নামটি হয়ে উঠেছে আমেরিকার আর্থিক বাজারের প্রতীক। আর নিউইয়র্ক হয়ে উঠেছে বিশ্বের আর্থিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম সুবৃহৎ কেন্দ্র। শেয়ারবাজার, বন্ড বাজার বা ঋণ বাজার, মুদ্রা বাজার মিলে আর্থিক বাজারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ওয়ালস্ট্রিট।
তো আর্থিক সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল ওয়ালস্ট্রিট থেকে, মানে আমেরিকার আর্থিক বাজার থেকে। নিয়ন্ত্রণহীন এই বাজারে চড়া মুনাফার লোভ শেষ পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষকে সর্বস্বান্তই করেছে, লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে ছোট-বড় শ খানেকের বেশি ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানের। বাড়ি কিনতে নির্বিচারে সস্তায় ঋণ দিয়ে বন্ধকি সম্পত্তিগুলোকে সিকিউরিটিজে বা আর্থিক পণ্য বানিয়ে বাজারে ছাড়া হয়। সেগুলোতে বিনিয়োগও করে ব্যক্তি ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান। এভাবে পরস্পরসম্পর্কিত কয়েকটি ধাপে তৈরি করা এসব আর্থিক পণ্যের দর কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়। কিন্তু ঋণগ্রহীতারা যখন ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতে থাকে, তখনই শুরু হয় সমস্যা। প্রচুর গ্রাহক খেলাপি হলেও বন্ধকি বাড়িগুলোও বাজারমূল্য হারায়। ওগুলো বিক্রি করে টাকা তোলার অবস্থায় আর থাকে না। ব্যস। বন্ধকি ভিত্তিতে গড়ে তোলা কৃত্রিম আর্থিক পণ্যগুলোও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে বিপদে পড়ে যায় ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো। এভাবে আর্থিক বাজারের যাবতীয় ঝুঁকি উপেক্ষা করে নানা ধরনের জটিল আর্থিক পণ্য বানিয়ে তা থেকে টাকা বানানোর নেশায় মেতে উঠেছিল এসব প্রতিষ্ঠান, যার মূল্য গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন