শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১১

যশোরে গণআলোচনায় মাহমুদুর রহমান : রাষ্ট্রযন্ত্র নির্যাতকের ভূমিকায় গণপরিষদ গঠন অপরিহার্য

আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আবারও সংসদ ভেঙে দিয়ে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বর্তমান শাসকগোষ্ঠী গণবিরোধী। এই সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রযন্ত্র নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এদেশে কারও নিরাপত্তা নেই। সে কারণে নতুন সংবিধান প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আর নতুন সংবিধান রচনা করতে পারে শুধু যারা ১৬ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারে তারাই।
মাহমুদুর রহমান গতকাল বিকালে যশোর টাউন হল মাঠে আয়োজিত ‘সংবিধান নিয়ে বিভ্রান্তি এবং জনগণের ভূমিকা’ শীর্ষক এক গণআলোচনায় বক্তৃতা করছিলেন। মুক্তিআন্দোলন নামে একটি পাঠচক্র এ গণআলোচনার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কবি দার্শনিক কলামিস্ট ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস থেকে বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন।
গণআলোচনায় বক্তব্যের শুরুতেই মাহমুদুর রহমান যশোরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অন্যায়ভাবে আমাকে জেলে পুরে নির্যাতন করেছে। আমার মুক্তির দাবিতে যশোরের রাজপথেই প্রথম মিছিল বেরিয়েছিল। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার আমাকে নৈতিকভাবে ভেঙে ফেলতে নির্যাতনের এমন কোনো পন্থা নেই, যা প্রয়োগ করেনি। কিন্তু আমি নই, সরকারই পরাজিত হয়েছে। জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রশ্নে কোনো আপস করিনি বলেই এ জয় এসেছে।
সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব কখনই আদালত নিতে পারেন না মন্তব্য করে মাহমুদুর রহমান বলেন, বিচারকরা যখন ইতিহাস রচয়িতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখন ইতিহাস বিকৃতি অবধারিত। এই সংবিধানে আমাদের লড়াই-সংগ্রামের কোনো ইতিহাস লিপিবদ্ধ নেই। মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দীর মতো লোকদের স্থানও হয়নি সংবিধানে। পূজা করা হয়েছে একব্যক্তির। এটি ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। মরহুম শেখ মুজিবর রহমান এদেশে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার কন্যা তা জোরালো করেছেন। বাংলাদেশে এখন দলের নয়, ব্যক্তির শাসন চলছে। এ ধরনের ব্যক্তিপূজা জনগণ কখনও মেনে নেয়নি, নেবে না।
সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছেন। কী ছিল পঞ্চম সংশোধনীতে জনগণকে তা জানতে হবে। আর পঞ্চম সংশোধনীর আগে শেখ মুজিবের আমলে করা আরও তিনটি সংশোধনী রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষে ছিল কিনা তাও বিবেচনা করা দরকার। তিনি বলেন, শেখ মুজিবের আমলে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে এদেশে কালো আইন প্রণয়ন করা হয়। যার মাধ্যমে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা যায়। তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে স্বাধীন দেশের অংশ বেরুবাড়ী সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র ভারতকে দিয়ে দেয়া হয়। বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। আর চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয় একদলীয় বাকশালী শাসন।
তিনি বলেন, এ তিনটি সংশোধনীর একটিও রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে করা হয়নি। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশালী শাসন বাতিল করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। সংবিধানে সংযুক্ত করা হয় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। পঞ্চম সংশোধনীতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্র বিদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি করলে সে চুক্তি অবশ্যই রাষ্ট্রপতিকে জানাতে হবে এবং রাষ্ট্রপতি তা সংসদে পেশ করবেন। এরচেয়ে গণতান্ত্রিক চেতনা আর কী হতে পারে! প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, আদি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তনের জন্য গণভোটের আয়োজন বাধ্যতামূলক ছিল। এখন আইন মন্ত্রণালয়ের ছাপানো সংবিধানে এই বাধ্যবাধকতাও অপসারণ করা হয়েছে। সরকার ইচ্ছা করলে ২০১২ সালের পর জাতির ঘাড়ে একদলীয় শাসন চাপিয়ে দিতে পারে। আসলে সংবিধান নিয়ে ছেলেখেলা চলছে। সরকার মানুষকে মূর্খ বিবেচনা করছে। তারা জনমতের কোনো ধার ধারে না।
মাহমুদুর রহমান বলেন, শাসকরা দেশকে এমন একটি ভূখণ্ডে রূপান্তরিত করতে চায়, যেখানে ভূখণ্ড থাকবে, রাষ্ট্র থাকবে না। জনগোষ্ঠী থাকবে, নাগরিক থাকবে না। তিনি বলেন, সংবিধান হলো জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের চুক্তিপত্র। এই চুক্তির মাধ্যমে জনগণ কিছু দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দেয়। বিনিময়ে রাষ্ট্র জনগণের নিরাপত্তাসহ আরও কিছু বিষয়ের নিশ্চয়তা দেয়। এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সংশোধনে অবশ্যই জনগণের মতামত নিতে হবে। জনগণের মতামত ছাড়াই আদালত এই দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন। এটি তারা পারেন না।
মাহমুদুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে সৃষ্ট বিতর্ক নিয়েও কথা বলেন। তিনি আওয়ামী ঘরানার লেখকদের লেখা বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, মরহুম জিয়াউর রহমানই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক এ ব্যাপারে দেশবাসীর মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী একমাত্র শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কাউকে কোনো কৃতিত্ব দিতে চায় না।
গণআলোচনায় ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সংবিধান প্রণেতারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতেন না। আওয়ামী লীগের লোকরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধান কেটেকুটে বাংলাদেশের সংবিধান তৈরি করেন। সংবিধান প্রণয়নের ওই কমিটিতে বিরোধী দলের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। এমন ন্যক্কারজনক ইতিহাস পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। জনগণের কাছে এই সংবিধান গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ফলে এই সংবিধান ছুড়ে ফেলে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু রাষ্ট্র গঠন করতে পারিনি। বর্তমান সংবিধানকে অগণতান্ত্রিক আখ্যায়িত করে ফরহাদ মজহার বলেন, এই সংবিধান জনগণের অধিকার দেয় না। এতে অধিকার আদায়ের কোনো ইতিহাসও সন্নিবেশিত হয়নি। এটা একটা ছেঁড়া ত্যানা। সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র কায়েমের সংবিধান এটি। সে কারণে নতুন গণপরিষদ চাই। যে গণপরিষদ এমন একটি সংবিধান রচনা করবে, যেখানে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। জীবন ধারণ, প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার অবাধ অধিকার থাকবে।
মুক্তিআন্দোলনের মুখপাত্র বেনজীন খানের সভাপতিত্বে গণআলোচনায় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন মুক্তিআন্দোলনের সদস্য মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন