রবিবার, ৪ জুন, ২০১৭

পার্বত্য চট্টগ্রামকে আমরা কোথায় নিয়ে চলেছি?


এক. 
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে এখন বাঙ্গালিরা সেই ভুল করছে কি না-- যা পাঞ্জাবিরা করেছিল পূর্ব-পাকিস্তানে; কাশ্মীরে করছে ভারত, বালুচিস্তানে করছে পাকিস্তান, চীন করছে কাশগরে, বর্মা করছে আরাকানে, সিংহলিরা করেছে তামিলদের সঙ্গে?
দক্ষিণ এশিয়ায় এইরূপ ভুলের প্রথম ফল ছিল পূর্ব-পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশ নিজের সংগ্রামের ঐতিহাসিক শিক্ষাটুকুই ভুলতে বসেছে। 
এটা আত্মঘাতি। 

দুই.
আমার যেসব বন্ধু ফিলিস্তিনী, রোহিংগা, কাশ্মীরী বা উইঘুরদের ন্যায়বিচারের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সেখানে ন্যায্যতা দেখেন-- লংঘদু’র ঘটনায় তাদের ‘বাঙ্গালি হয়ে যাওয়া’য় দুঃখ পেলেও বিস্মিত হইনি। মাঠের খবরও এরকম যে, সারা দেশে তিক্ততা থাকলেও লংঘদুসহ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাহাড়িদের মোকাবেলায় শামিল। কিন্তু গভীর আত্মজিজ্ঞাসা প্রয়োজন, পার্বত্য লীগ-বিএনপি-জামায়াত ঐক্যের কাফেলা সেই ভুলের জন্ম দিতে যাচ্ছে কি না-- যা উর্দুভাষীদের একাংশ পূর্ববাংলায় করেছিল একাত্তর সালে?
কথিত যুবলীগ নেতাকে কে হত্যা করেছে সে বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই অসংখ্য গ্রামের শত শত পাহাড়ি নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বিচার বহির্ভূত পন্থায় শাস্তি দেয়ার দায় কার? আন্তর্জাতিক পরিসরে এই প্রশ্ন উঠলে আশা করি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত মিলে সদুত্তর দেবেন।

তিন.
বর্তমান বিশ্ব একটা গ্রামের মতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালি-মুসলমানদের এটা ভুলে যাওয়ার অবকাশ নাই যে, লংঘদুর ঘটনার সরাসরি প্রতিক্রিয়া ঘটবে শ্রী লঙ্কার বাত্তিকালোয়া-ত্রিংকোমালেতে, বর্মার আরাকানে, চীনের উইঘুরদের জনপদে এবং ভারতের লাদাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালি মুসলমানরা লংঘদুর মতো ঘটনা যত ঘটাবেন--দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য স্থানে ‘প্রবল সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে মুসলমানদের স্বাধীকারের ন্যায্য সংগ্রামগুলো তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 
বস্তুত জাতিগত ফ্যাসিবাদই আজ দক্ষিণ এশিয়ার মূল ব্যাধি। সামাজিক ন্যায় বিচারের সংগ্রামে জাতিতে-জাতিতে মৈত্রীর সম্ভাবনাটুকু এখানে এসেই থমকে যাচ্ছে। উল্টো ব্যাপক বিস্তৃত এক হানাহানির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে পুরো অঞ্চল। বাংলাদেশকে প্রায় জোর করেই যেন সেই পরিসরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। 

চার.
মূলত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির আকাল এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহের দুর্বলতা-দ্বিধাবিভক্তি-আদর্শিক দেউলিয়াত্ব পাহাড় ও সমতল সব জায়গার জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের জন্য পরিস্থিতি বিপর্যকর করে তুলেছে। বলা যায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক সংকটের সবচেয়ে খারাপ অভিঘাতটি পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। 
ত্রিধারায় বিভক্ত পাহাড়িদের মাঝে ভাতৃঘাতি বৈরিতাও তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে। অনুমান করা যায়, এসবের মিলিত ফল হিসেবে সেখানে অবাঙ্গালিদের আসন্ন দিনগুলোতে আরো বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়তে হতে পারে। তৃতীয় বিশ্বে এটা প্রায় পরীক্ষিত এক অভিজ্ঞতা, কর্তৃত্ববাদী কেন্দ্রীভূত শাসন চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতিগত উম্মাদনা উস্কে দেয়।
চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা নেতৃবৃন্দের জন্য সামনের দিনগুলো চালেঞ্জিং। তরুণদের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের ধারায় আটকে রাখা এবং এনজিও মানবাধিকার ব্যবসায়ীদের দুষ্টছায়া এড়িয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির (যা প্রায় অবলুপ্ত হতে চলেছে) সঙ্গে মৈত্রীর পরিসর বাড়ানো দুরূহ এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
বিশেষত যখন লংঘদুর মতো উস্কানিমূলক ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে।

পাঁচ.
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশে সামরিকায়নের জন্য শাসক শ্রেণীর এক দারুণ উপলক্ষ্য। এবারের বাজেটেও রাষ্ট্রীয় ২,৯৩,৪৯৪ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে সম্মিলিত ব্যয় ছিল প্রায় ৪৫,০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশে জাতীয় আয়ের প্রায় পাঁচভাগের এক ভাগই এখন নিরাপত্তা আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনে যাচ্ছে। এইরূপ বরাদ্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহুধরনের কেনাকাটা--যা শাসকএলিটদের অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন সংস্কৃতিতে এইরূপ ব্যয়ভারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকলেও যেকোন জবাবদিহিমূলক শাসনামলে তা উঠবে বৈ কি। পার্বত্য চট্টগ্রাম এইরূপ ব্যয়ভারের অন্যতম যৌক্তিক পাটাতন হিসেবে কাজ করে। বস্তুত এভাবেই বর্মায়, শ্রী লঙ্কায়, ভারতে এবং পাকিস্তানে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে সামরিকায়ন ঘটেছে এবং ঘটছে। এরূপ সামরিকায়নের লাগাম টেনে না ধরতে পারলে এক সময় তা আত্মবিনাশী রূপ নেয়। ফলস্বরূপ বর্মা, শ্রী লঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে এখন মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অভিযোগের মুখোমুখি প্রতিনিয়ত। ভূ-রাজনীতির যেকোন ওলোটপালটে এসব অভিযোগ কীভাবে ভিন্নরূপ নেয় তার নজির পূর্ব-তিমুর, তার নজির দক্ষিণ সুদানসহ আরও বহু অঞ্চল।
জাতীয়তাবাদী উগ্রতা বাংলাদেশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়া বিচিত্র নয়। 
ছয়.
১৯৪৭-৪৮ এ ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি যখন দক্ষিণ এশিয়া ছেড়ে যায় তখন এ অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ ছিল শ্রী লঙ্কা। সম্প্রতি বাংলাদেশের লংঘদুতে যা ঘটেছে ১৯৮৩ সালে জাফনায় এইরূপ এক ঘটনা থেকেই শ্রী লঙ্কা প্রায় ২৬ বছরের জন্য সিংহলি-তামিল রক্তক্ষয়ি বিবাদে জড়িয়ে ধ্বংসের কিনারে উপনীত হয়। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বর্মার বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের একগুঁয়েমি পুরো দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে চড়ায় আটকে রেখেছে। কাশ্মীরে মাত্র ৬০ লাখ মানুষকে ১০ লাখ সৈন্য দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না দিল্লি। বালুচিস্তান পাকিস্তানকে আরেকবার খন্ডিত হওয়ার সম্ভবনা জিইয়ে রেখেছে।

চারপাশের এসব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শেখা দরকার।

ALTAF PARVEZ·SUNDAY, JUNE 4, 2017

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন