চলতি মে মাসের ২০-২১ তারিখে আমরা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেখতে পেলাম এক রাজকীয় সফরে সৌদি আরবে। সেই একই ট্রাম্প, যিনি গত ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের শপথ নিয়েই তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ‘মুসলিম ব্যান’ বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, মুসলমানদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করবেন। সেটা মুরোদে না কুলালেও অন্তত সাত মুসলমান দেশ থেকে রওনা দিয়ে এসে আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন তিনি। তবে তিনি তার এই আদেশ টিকাতে পারেননি। আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়ে এটা রদ হয়ে যায়, পরপর দু’বার। সেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সৌদি আরব সফরে গেছেন। সবই ভাগ্যের পরিহাস! কারণ প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার প্রথম বিদেশ সফর এই সৌদি আরবেই। কেন এই সফর?
মাত্র ২৫ বছর ব্যবধানের দুই বিশ্বযুদ্ধ দুনিয়ার ইতিহাস ভুগোলের আগা-পাশ-তলা বহু কিছুই উল্টেপাল্টে দিয়েছিল। বিশেষ করে ইসলামি জনগোষ্ঠীর সর্বশেষ খলিফার শাসনাধীন অটোম্যান সাম্রাজ্যকে প্রথমে ভেঙে দুই বড় টুকরোয় ভাগ করে নিয়েছিল ব্রিটিশ আর ফরাসি সরকার। এরপর দুই অংশেরই তস্য টুকরো টুকরা করা শুরু করেছিল। ব্রিটিশ অংশ থেকে এক বড় টুকরা ভাগ নিয়ে আজকের রাজতান্ত্রিক সৌদি আরব রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা (আবদুল-আজিজ আল-সৌদ) ইবনে সৌদের হাতে এর শুরু হয়েছিল ১৯৩২ সালে। অবশ্য আমেরিকার সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষে, ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মিসর সফরে এসে কিছু আরব নেতার সাথে দেখা করেছিলেন। সে সময় বাদশাহ ইবনে সৌদ আর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মধ্যে প্রথম শীর্ষ বৈঠক হয়েছিল সুয়েজ খালে নোঙর করা আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস কুইনসে বসে। সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক অনেক পুরনা, সৌদি আরবের জন্মের মাত্র ১৩ বছর পর থেকে যা এখনও বর্তমান। সিঙ্গাপুরের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘এশিয়ান টাইমস’ গত ১৮ মে সংখ্যায় এসব পুরনো ইতিহাস স্মরণ করেছে।
এক রাজকীয় রেওয়াজের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সৌদি বাদশাহ এক কাপ কড়া সৌদি কফি পান করতে দিয়েছিলেন তার বিশেষ অতিথি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে। প্রেসিডেন্ট শান্তভাবে সে কফি পান করার পরে রাজা ওই কাপ মেঝেতে আছড়ে ভেঙে ফেলে বলেছিলেন, ‘আপনি আমার কাছে খুবই বিশেষ একজন। তাই এই কাপ আপনার পর আর কেউ যেন ব্যবহার করতে না পারে তাই ভেঙে ফেললাম।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই নায়ক রুজভেল্ট দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে ওই সফরের দু’মাসের মাথায় সিটিং প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়ই মারা যান; তবু বলা যায়, এই রিচুয়াল দিয়ে সৌদি-আমেরিকান সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ভালোভাবেই কার্যকর হতে পেরেছিল। এশিয়ান টাইমস লিখছে, ‘ইবনে সৌদের সাথে রুজভেল্টের চুক্তি হয়েছিল যে, সৌদি তেলের বিনিময়ে আমেরিকা ইবনে সৌদ ও তার উত্তরাধিকারীদের সৌদি সরকারগুলোর সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবে।’ পরে এই সম্পর্ক আরেক উঁচুপর্যায়ে পৌঁছেছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমলে ১৯৭৪ সালে। বলা ভালো, ১৯৭৩ সালের অক্টোবর শেষ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরবদের হার হয়েছিল আর এর প্রতিক্রিয়ায় পরের ছয় মাস ধরে তেল অবরোধ চলেছিল।
ইসরায়েল সমর্থক আমেরিকা ও তাদের বন্ধু অন্য রাষ্ট্রগুলোকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এই তেল অবরোধে। এই অবরোধের সমাপ্তিতে নতুন চুক্তি করার ক্ষেত্রে সৌদি-আমেরিকা পরস্পরের প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হিসেবে অনুভব করেছিল। নিক্সন ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে সৌদি সফরে গিয়ে তাদের সেই সম্পর্ক আরো পাকা করেছিলেন। ফলে সৌদি আরবের মনে হয়েছিল আমেরিকান প্রটেকশনের প্রতিশ্রুতিতে রাজশাসন ব্যবস্থার আয়ু আরো দীর্ঘ হয়েছে এবং তা যেকোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে থিতু অবস্থায়। কিন্তু সৌদি আরবের সেই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব আবার এক অনিশ্চয়তা হিসেবে ছায়া ফেলেছিল। ইরানের বিপ্লব রাজতান্ত্রিক শাসনের ধর্মীয় ও নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্ন তুলে নড়বড়ে করে দেয়ার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল। আরেক দিক থেকে দেখলে ইরানের এই বিপ্লবে ক্ষতিগ্রস্ত আমেরিকাও। কারণ সে শাহের ইরান হারিয়েছিল এবং নতুন বিপ্লবের ইরানের সাথে আমেরিকার আবার সহসাই কোনো ধরনের সম্পর্ক তৈরি হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। ইরান-সৌদি কূটনৈতিক সম্পর্ক সেই থেকে খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়ে যায়। উল্টা দিকে আমেরিকার সঙ্গে ইরানের প্রায় স্থায়ী হয়ে যাওয়া খারাপ সম্পর্ক সৌদি আরবকে স্বস্তি দিয়েছিল। সৌদিরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, ইরান-আমেরিকার সম্পর্ক সঙ্ঘাতময়ই এবং এই সঙ্ঘাতের দীর্ঘস্থায়িত্বের মধ্যেই সৌদি আরব রাজতন্ত্রের ভাগ্য নিহিত। পরের ৩৫ বছর ধরে ইরান-আমেরিকার সম্পর্ক সঙ্ঘাতময় থেকেছে। তদুপরি, ইরানের ওপর আরোপিত পশ্চিমের অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানকে যথেষ্ট ভুগিয়েছে।
সবশেষে ২০১৫ সালে আমেরিকার ওবামা প্রশাসনের আমলে এক ‘নিউক্লিয়ার ডিল’-এর বিনিময়ে, ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ ধাপে ধাপে তুলে নেয়া শুরু হয়েছিল। আর সেই থেকে সৌদি আরবের অস্বস্তি আর অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। রাজপরিবার সৌদি আরবে রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম চিন্তিত হয়ে পড়ে।
ওবামা প্রশাসন ইরানের সাথে ‘নিউক্লিয়ার ডিল’ কেন করতে গিয়েছিল এর প্রধান কারণ ছিল আইএস মোকাবেলায় ইরানকে পাশে পাওয়া এবং অনেক দায় ও খরচ ইরানের ওপর দেয়ার সুযোগ নেয়া। কারণ ইরাকের ওপর আইএসের আক্রমণ ও তৎপরতার চাপ বাড়ছিল। ওবামা প্রথম টার্মে তো বটেই, দ্বিতীয় টার্মেও সামগ্রিকভাবে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে ‘আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহার’ আর বিশেষ করে ‘মাঠের সৈন্য প্রত্যাহার’ এই নীতিতে পরিচালিত হচ্ছিলেন। এর মূল কারণ ছিল, আমেরিকান অর্থনীতির যুদ্ধের খরচ হলে অপারগতা। দ্বিতীয় কারণ এটাও ছিল যে, জড়িয়ে যাওয়া অন্তহীন যুদ্ধে থেকে দেশকে বের করে আনা। অথচ আইএসের তৎপরতা সেখানে মাঠের সৈন্য বাড়াবার তাগিদ হাজির করছিল। এই অপারগ পরিস্থিতিতে ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী’ জোট তৎপরতায় ওবামা ইরানকেও অন্তর্ভুক্ত করে পেতে চাইলেন। বিশেষ করে আমেরিকার ইরাক দখলের পরের ইরাক ইরান প্রভাবিত মালেকী সরকারের হাতেই চলছিল। ফলে ওবামার হিসাব হলো, ইরাক সরকারের সাথে ইরান এসে যোগ দিয়ে তারাই ইরাকে আইএস তৎপরতা রোধের বাড়তি দায়িত্বে নিক। তাতে খরচের ও সামরিক দায়ের এক বড় অংশ ইরান সরকারই বহন করবে।
আর ওবামার এই নতুন নীতিকে সৌদি সরকার ঘোরতরভাবে নিজ স্বার্থবিরোধী এবং বিশেষ করে নিজ রাজতন্ত্রের জন্য বড় বিপদ হিসেবে দেখেছিল। তা থেকে আমেরিকার ওপর সৌদি ক্ষোভ আর হতাশা কত তীব্র হয়েছিল তা বুঝার একটা উপায় হলো সৌদি আরব রাশিয়ার পুতিনের সাথে নিজের সুরক্ষা নিয়ে কথা বলেছিল। আমেরিকার বদলে নিজের সুরক্ষার কাজ রাশিয়ার সাথে করা যায় কিনা, রাশিয়াকে দেয়া যায় কিনা সে আলোচনায় বসেছিল। তখন রাশিয়া থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থের অস্ত্র সৌদি আরব ক্রয়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। কিন্তু শর্ত ছিল, সিরিয়াসহ পুরা ইরানি ব্লক থেকে রাশিয়াকে দূরে সরে আসতে হবে। কিন্তু রাশিয়ার কাছে স্থায়ী ও কৌশলগত সম্পর্কের দিক থেকে ইরান-সিরিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। ফলে সেই প্রস্তাবিত রাশিয়া ডিল কোনো ইতি পরিণতি পায়নি। ইতোমধ্যে আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রার্থিতার মধ্যে আশার আলো দেখেছিল সৌদি আরব। কারণ, যেটা বুঝা গিয়েছিল, ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ফিরে এলে ইরান নিউক্লিয়ার ডিল উল্টে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। রিপাবলিকান হলে কিছু হলেও সম্ভাবনা আছে, যদি সবটা নেই। কারণ এটা শুধু ইরান-আমেরিকান সমঝোতা নয় বরং এটা জার্মানিসহ জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের (৫+১) সাথে একযোগে ইরানের ডিল।
এক কথায় বললে, ট্রাম্পের এই সৌদি সফর ছিল এক পুরোপুরি আই ওয়াশ। দেখানো হয়েছে, সৌদি উদ্যোগে পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান রাহিলের নেতৃত্বে এক ‘আরব ন্যাটো’ গঠন করা হয়েছে। তা অপ্রকাশ্যে ইরানবিরোধী সুন্নি রাষ্ট্র জোট। ওই সুন্নিপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর জনগণ না হোক অন্তত সরকারগুলোকে রাজতন্ত্রের পক্ষে বুক করে রাখা হলো। কিন্তু তামাশার দিকটা হলো এই ‘আরব ন্যাটো’ এটা করা হলো ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী ইসলামি রাষ্ট্রজোট’ বলে। আর এই জোটের উদ্বোধন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে দিয়ে করিয়ে তার মুখ দিয়ে ইরানবিরোধী বুলি হাজির করা হলো।
তাই এমন কোনো মিডিয়া দেখা যায়নি, আমেরিকান বা বাইরের, যে এই সফরকে ইতিবাচকভাবে দেখেছে অথবা ফেসভ্যালুতেই সম্মেলন যা বলেছে তা বিশ্বাস করে। এর মূল কারণ, ট্রাম্প যতই হম্বিতম্বি করুন, আসলে তো ওবামার ‘ইরান নিউক্লিয়ার ডিল’ থেকে ট্রাম্প একচুলও সরেননি।
মিডলইস্টের মনিটর পত্রিকা জানাচ্ছে, স্টেট ডিপার্টমেন্টের টিলারসন বলেছেন ‘১৮ এপ্রিল কংগ্রেসকে চিঠি দিয়ে তিনি সার্টিফাই করে জানিয়েছেন, ইরানি ডিলে ইরান সঠিকভাবে তার করণীয় শর্তাবলি মেনে চলছে’। আরেক কর্মকর্তা বলছেন, তারা যদিও এখনো পর্যন্ত ইরানি ডিল পুরোটাই পর্যালোচনা করে দেখছে। কিন্তু ওইদিন পর্যন্ত সবকিছুই ইরান ঠিকঠাক পালন করেছে ফলে তারা চুক্তি বজায় রাখার পক্ষে থাকবে।
তাহলে পাগলা ট্রাম্প উল্টা হাওয়া গেছে সৌদি আরবে গেল কেন? কারণ ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি হলে ক্রেতার সন্তুষ্টিতে কিছু তো করা দরকার!
লেখক : গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন