মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০১৭

বিজেপির বিজয় : আগামী তুফানের পূর্বাভাস

উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বিপুলভাবে জিতেছে। বিজয়ের এই বৈপুল্য ছোটখাটো ব্যাপার নয়, বেশ বড়সড় ঘটনা। বিজেপির এই বিজয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব আরও মজবুত হল, এটা সহজেই বোঝা যায়। ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি একটা পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তার হিসাবে ২০১৪-তে লোকসভায় বিজেপির পক্ষে ভোটারদের সমর্থন ছিল ৪০ ভাগ, এবার সে হার প্রায় ৮০ ভাগ। এই বিজয় যদি ভারতীয় রাজনীতির মেরুকরণ এবং ভারতীয় গণমানসের পুনর্গঠনের ইঙ্গিত হয় তাহলে এটা স্পষ্ট যে, সর্বভারতীয় প্রকল্প হিসেবে হিন্দুত্ববাদ স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। বাংলাদেশের জনগণ কীভাবে তা মোকাবেলা করবে এ নিয়ে অবিলম্বে ভাবনা-চিন্তা দরকার।

উত্তর প্রদেশে বিজেপির সাম্প্র্রতিক বিজয় ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নতুন মেরুকরণ নয়, সেটা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। এখন মেরুকরণের ভারসাম্য সুস্পষ্টভাবেই হিন্দুত্ববাদের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে; অপরাপর তাৎপর্য ছাড়াও এই বিজয় প্রমাণ করছে যে, কংগ্রেসের পক্ষে আবার সর্বভারতীয় দল হিসেবে হাজির হওয়া এখন রীতিমতো অসম্ভব। সেটা খারাপ কিছু নয়। সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে জাতিবাদী হিন্দুর চেহারা আড়াল করে রাখার চেয়ে সরাসরি নিজের হিন্দু পরিচয় সামনে আনা অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন, সৎ ও সত্য। ভারতীয় গণমানস তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে এটা বুঝেছে। কেন তাদের এই উপলব্ধি ঘটল তা নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক কিংবা রাজনৈতিক গবেষণা হতেই পারে। কিন্তু এটাই ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতা।

এই বিজয়ে এটাই স্পষ্ট যে, নির্বাচনপন্থী বামপন্থাও ভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে পরাজিত শক্তি। রাজনীতির এই উত্থান-পতনের মর্ম বোঝা আমাদের জন্য এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। সেই লক্ষ্যেই এখানে কিছু পর্যবেক্ষণ পেশ করব।

তবে তার আগে যারা ভারতের নির্বাচন ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেননি তারা নিচের পরিসংখ্যানগুলোর দিকে তাকালে অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পারবেন।

রাজনৈতিক দল নির্বাচন ২০১৭ নির্বাচন ২০১২

সমাজবাদী পার্টি ৪৭ ২২৪

ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ৭ ২৮

বহুজন সমাজ পার্টি ১৯ ৮০

ভারতীয় জনতা পার্টি ৩১২ ৪৭

রাষ্ট্রীয় লোক দল ১ ৯

অন্যান্য ২৯ ১৫

মোট ৪০৩ ৪০৩

সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস ২০১২ সালে আসন পেয়েছিল ২৮টি, এবার পেল মাত্র ৭টি। বহুজন সমাজ পার্টির আসন সংখ্যা ৮০ থেকে ১৯-এ নেমে এসেছে। সমাজবাদী পার্টি এতকাল ক্ষমতায় ছিল। ২০১২-তে তাদের আসন সংখ্যা ছিল ২২৪। এবার অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বে তাদের ২২৪ আসন কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭-এ। প্রশ্ন উঠেছে, ভবিষ্যতে ভারতের রাজনীতিতে জাতীয় দলের চেয়েও নির্ধারক ভূমিকা রাখবে আঞ্চলিক দল, তারা সমাজবাদী পার্টির ভরাডুবি থেকে ভিন্ন ইঙ্গিতই পাবেন। ভারতীয় গণমানস রাজ্যকেন্দ্রিক চিন্তার চেয়ে জাতিবাদী হিন্দুত্ববাদ বা ভারতীয়তাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। রাজ্য ও কেন্দ্রের দ্বন্দ্ব এতে কমবে না। তাতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দুর্বল হবে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। নির্বাচন রাজ্য আর কেন্দ্রের সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক বনাম জাতীয় রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব নতুন করে মূল্যায়ন করবে। এসব বিষয়েই নতুন করে ভাবতে হবে।

নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো জোট বাঁধে। তো জোটের হিসাব ধরলে উত্তর প্রদেশের ৪০৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি জোট পেয়েছে ৩২৫টি। ক্ষমতাসীন সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৫৬টি আসন। বহুজন সমাজবাদী পার্টি পেয়েছে ১৯টি আর বাকিরা পেয়েছে ৩টি আসন।

অন্য যেসব রাজ্যে নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে উত্তরাখণ্ড রাজ্যেও বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। পাঞ্জাবে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। গোয়া ও মনিপুর রাজ্যের নির্বাচনে বেশি আসন পেয়েছে কংগ্রেস, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি তারা। সরকার গঠন করতে চাইলে তাদের জোট বাঁধতে হবে।

এটা আমরা জানি, নরেন্দ্র মোদি গত বছর নভেম্বর মাসে চালু নোটের ৮৬ শতাংশ বাতিল করেছিলেন, ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে গিয়েছিল। তার নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত খুব জনপ্রিয় হয়নি। সাধারণ মানুষকে বিস্তর ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। বিরোধী দলগুলো এই নোট বাতিল করাকে কেন্দ্র করে বিস্তর প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেছে। মোদি নোট বাতিল করে কালো টাকা নস্যাৎ করার যে দাবি করছিলেন তার পক্ষেও বিশেষ যুক্তি তিনি দিতে পারেননি। প্রচুর কালো টাকা বিকল করা গেছে সেটাও বাস্তবে প্রমাণিত হয়নি। অনেকে ধারণা করেছিলেন, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নির্বাচনে বড়সড় প্রভাব ফেলবে। কিন্তু দেখা গেল সেটা ঘটেনি। বোঝা যাচ্ছে, গণমানসে তিনি এমন একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছেন যা নোট বাতিলের সৃষ্ট দুর্দশা ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেনি। ভারতের রাজনীতি বোঝার জন্য এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিম্পটম।

সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিজেপি এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নয়। তাই মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার সব বিল পাস করতে পারে না। সেই পরিস্থিতি রাজ্য বিধানসভাগুলোতে নবনির্বাচিত বিজেপি সদস্যদের ভোটের ফলে আগামীতে বদলাবে, এটা অনুমান করা যায়। যতজন সংসদ সদস্য রাজ্যসভায় বিজেপি পাঠাতে পারবে, সেই অনুপাতে উচ্চকক্ষের সংখ্যার ভারসাম্যেও বদল ঘটবে। বিজেপির পক্ষে একটি অনুকূল হাওয়া বইছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের ফল শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। ফল অনুযায়ী উত্তর প্রদেশের ৪০৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি জোট পেয়েছে ৩২৫টি আসন। ক্ষমতাসীন সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৫৬টি আসন। বহুজন সমাজবাদী পার্টি পেয়েছে ১৯টি, আর বাকিরা পেয়েছে ৩টি আসন। সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে কংগ্রেস জোট বেঁধে ভোটে নেমেছিল। উভয়েই পরাজিত। জোটের প্রচারে প্রধান ছিলেন দুই দলের দুই যুবনেতা বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব আর কংগ্রেসের সহসভাপতি রাহুল গান্ধী। নিজেদের সীমিত চিন্তা ও ব্যর্থতার কোনো পর্যালোচনা না করে এবং ভারতের নতুন বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে তারুণ্য দিয়ে তারা নরেন্দ্র মোদিকে ঠেকাতে পারবেন ভেবেছিলেন। বিজেপির পক্ষে প্রচারে ছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। ব্যাপক প্রচারাভিযান। তার প্রচারে উন্নয়ন আর মেড ইন ইন্ডিয়ার আবেগ ছিল। আর, বলা বাহুল্য, সরবে ছিল রাজ্য সরকারের ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তৃতা। ওতে কাজ হয়েছে।

উত্তরাখণ্ডেও কংগ্রেস দাবড় খেয়েছে। নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে বিজেপি। এখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলা হয়েছিল। কিন্তু হয়নি। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী হরিশ রাওয়াত নিজে দুটি কেন্দ্রেই পরাজিত হয়েছেন। ৭০ আসনের উত্তরাখণ্ড বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ৩৬টি আসন। এর মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৫৭টি আসন। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পেয়েছে ১১টি। আর অন্যরা পেয়েছে ২টি আসন। ২০১২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি অল্প ব্যবধানে কংগ্রেসের কাছে হেরেছিল, রাজ্যের দখল নিয়েছিল কংগ্রেস। এবার ইতিহাস ভিন্ন।

তবে পাঞ্জাবে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। পরপর দু’বার পাঞ্জাবের সরকারে এসেছে আকালি-বিজেপি জোট। পাঞ্জাবে সাধারণত পাঁচ বছর অন্তর অন্তর ক্ষমতা বদল হয়। কিন্তু গত ২০১২ সালে আকালি দল ও বিজেপি জোট ক্ষমতায় আসে। পাঞ্জাবের ড্রাগ সমস্যা নিয়ে জোরদার প্রচার চালিয়ে বড় মুখ হিসেবে উঠে আসেন আম আদমি পার্টির নেতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। অবশেষে জিতল কংগ্রেস। ১১৭ আসনের পাঞ্জাব বিধানসভায় কংগ্রেস পেয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ৭৭টি আসন। আম আদমি পার্টির জোট পেয়েছে ২২টি, ক্ষমতাসীন আকালি দল ও বিজেপি জোট পেয়েছে ১৮টি আসন। গোয়া ও মনিপুরেও এগিয়ে রয়েছে কংগ্রেস।

এই ভোটাভুটি থেকে ভারতীয় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট আন্দাজ করতে পারি বলেই আমার ধারণা। বুঝতে পারি, ১. কংগ্রেস জাতীয় দল হিসেবে তার গণভিত্তি আসলেই হারিয়েছে, ক্রমশ তার ভূমিকা আঞ্চলিক দলগুলোর অধিক কিছু হবে না। আগামীতে এ দলটির পক্ষে কেন্দ্রে শক্তিশালী জাতীয় দল হিসেবে ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা খুবই কম; ২. হিন্দুত্ববাদী বিজেপির বিরুদ্ধে আদর্শিক অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করার সাংগঠনিক শক্তি কোনো দলেরই নেই, বামপন্থীদেরও নেই; ৩. ভারতে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আবেদন সাধারণ মানুষের কাছে বাড়ছে; ৪. সংখ্যালঘুকে ভোটব্যাংক ভেবে যারা রাজনীতি করছে, তারা এক হিসাবে খাদে পড়ছে, বিজেপি তার হিন্দুত্বের শক্তি মুসলমানদের ভোট ছাড়াই কায়েম করতে পারছে। ভারতীয় রাজনীতির এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ দিক।

দুই

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আদতে হিন্দুত্ববাদেরই নামান্তর, এ কথা অনেকে এর আগে নানাভাবে অনেকবারই বলেছেন। এই দিকটা বুঝতে পারলে ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থান এবং ভারতীয় রাজনীতিতে তার গেড়ে বসার মধ্যে বিস্ময়কর কিছু নেই। এটা খুবই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ঘটনাই বটে। হিন্দুত্ববাদ যখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সেকুলার পোশাক পরিধান করে থাকে, তখন সেটা নিতান্তই তার লজ্জাস্থান আচ্ছাদিত করে রাখার দরকারে। এটা এতকাল কংগ্রেস ও বিভিন্ন ফেরকার সমাজতন্ত্রী ও বামপন্থী ধারা সেকুলারিজমের নামে করে এসেছে। নরেন্দ্র মোদির রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাড়তি আচ্ছাদন অপ্রয়োজনীয় করে তোলা। সেদিক থেকে তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞই থাকা উচিত। যা সব সময় তত্ত্ব দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়, তিনি তা করে দেখিয়েছেন।

তবে বিখ্যাত দৈনিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় শিব বিশ্বনাথন একটি নিবন্ধে বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন, যা আমাদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে। তিনি শুরুই করেছেন ভবিষ্যতে ভারতে একটা বিশাল সুনামি বা লণ্ডভণ্ড করে দেয়া তুফানের ইঙ্গিত দিয়ে। উত্তর প্রদেশে বিজেপির বিজয় তার কাছে সেই প্রলয়ংকরী তুফানেরই ইঙ্গিত : ‘এমন এক তুফান যার পূর্বাভাস কেউই দেয়নি’ (দেখুন, Reflection on the election of our time, 15 March 2017)। নির্বাচনে বিজেপি উত্তর প্রদেশে জিতবে এটা অবশ্য অনেকে বলেছেন; কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক ভোটে জিতবে সেটা কেউই আন্দাজ করেননি। তবে বিশ্বনাথন সেই পূর্বাভাসের কথা বলছেন না। মাইক্রো বা খণ্ড খণ্ডভাবে বিচ্ছিন্ন নজরে দেখলে ভারতের গণমানসে কী রূপান্তর ঘটেছে, আমরা ধরতে পারব না। একে নিছকই একটা নির্বাচনী ফলাফল আকারে বুঝব। কিন্তু বিশ্বনাথনের দাবি, সামগ্রিকভাবে বিচার করলে, ‘it is like watching the arrival of a juggernaut, whose presence nwo looks inevitable.’ পুরিতে জগন্নাথের রথযাত্রা থেকে ইংরেজিতে juggernaut কথাটার উৎপত্তি। এখন ইংরেজিতে এর মানে ‘a literal or metaphorical force regarded as mercilessly destructive and unstoppable.’ অর্থাৎ আক্ষরিক কিংবা প্রতীকী মহাক্ষমতাধর শক্তি, যা নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে সবকিছু ছারখার করে ফেলে এবং যাকে কিছুতেই রুখে দেয়া যায় না।’

বিশ্বনাথন দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিধর ও ধ্বংসাত্মক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আবির্ভাব সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করতে চাইছেন। এ মুহূর্তে তা বিশাল বিপদ বা চ্যালেঞ্জ হয়ে হানা দিয়েছে তা নয়, কিন্তু এটা বিপদের ‘আবির্ভাব’। সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু আমাদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। শিবনাথন বলেছেন, বোঝা দরকার কীভাবে আমরা এই অবস্থায় এসে হাজির হলাম। তবে তিনি পাশাপাশি আরেকটি কথা বলেছেন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হচ্ছে তুফানের এই আগাম আবির্ভাব একই সঙ্গে ভারতীয় মনের, কিংবা যা কিছু এতকাল ভারতীয় বলে ধরে নেয়া হয়েছিল তারও পরিসমাপ্তি। বিশ্বনাথনের ভাষায় ‘Closure of Indian Mind’। ভারত যে বদ্ধ চিন্তার চোরাবালিতে আটকা পড়ে গিয়েছে বিশ্বনাথন সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ভারতের গণমানসের যেসব বিচিত্র ও বহুমুখী অনুসন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধান, সেখানেও ছেদ ঘটল।

নিজের কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশ্বনাথন দেখিয়েছেন কীভাবে নরেন্দ্র মোদি নিজেই একটি ফেনোমেনা হয়ে উঠেছেন, যার মধ্যে ভারতের জনগণ, বিশেষত নিন্মবর্গের জনগণও পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে নরেন্দ্র মোদির মধ্যেই তাদের বাসনা চরিতার্থের উপায় দেখে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ এই দুইয়ের স্বপ্ন ফেরি করে এতকাল ভারতের রাজনীতি চলছিল; কিন্তু নরেন্দ্র মোদি সেই রাজনীতির গায়ে কাফন পরিয়ে দিলেন। যেসব আদর্শ বা পরিভাষাকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনৈতিক পরিসর নেহেরু-গান্ধীর হাতে তৈরি হয়েছিল সেটা কাচের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। তার কথা মানলে এটাও বিশ্বাস করতে হয় যে, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের দিন শেষ। অর্থাৎ যে অর্থে এই পরিভাষাগুলোর ব্যবহার হয়েছে তার উপযোগিতা ফুরিয়ে গিয়েছে। যদি এসব পরিভাষার আদৌ কোনো উপযোগিতা থাকে তাহলে দরকার ভারতে এই ধারণাগুলোর উৎপত্তি ও ব্যবহারের ইতিহাস পর্যালোচনা করা এবং নতুন করে ভাবতে শেখা। গণতন্ত্রও ডুবুডুবু। কারণ একজন ব্যক্তি যখন গণমানসের বাসনা ও আশা-ভরসার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, সেখানে বিরোধী মতের কিংবা চিন্তার কোনো ভূমিকা থাকে না। সবকিছুই ক্রমে এক ব্যক্তির অধীনে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতায় কুক্ষিগত হয়। নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্রের এই পরিণতিই হওয়ার কথা। ভারতেরও সেই দশা ঘটছে। তাহলে গণতন্ত্র, অর্থাৎ বহু মত ও কাজের কৌশলের মধ্য থেকে জনগণের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মত ও পথ নির্ণয়ের সামষ্টিকতারও দিন শেষ। নরেন্দ্র মোদির সিদ্ধান্তই সবার সিদ্ধান্ত হবে। তাহলে ‘গণতন্ত্র’ বলতে আমরা কী বুঝেছি, কীভাবে তার চর্চা হয়েছে, সেসব নিয়েও পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

যদি প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্র শুকিয়ে যায়, এসবের কোনো উপযোগী মর্মার্থ যখন গণমানসের চিন্তা ও ইচ্ছার জগতে দানা বাঁধে না, দানা বাঁধে হিন্দুত্ববাদ, তখন জনগণকে দোষারোপ করে লাভ হবে না। যেসব পরিভাষা আদর্শের নামে আমরা ব্যবহার করি, আর তা কাজ করছে না বলে বিশ্বনাথনের মতো আক্ষেপ করি- উচিত হচ্ছে তাদের পর্যালোচনা করে। পরিভাষা ও আদর্শ যদি বাস্তবের সঙ্গে না মেলে কিংবা জনগণের কাছে আবেদন রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে উচিত বাস্তবকে দোষারোপ নয়, নিজেদের চিন্তার পর্যালোচনা করা। এখন বাকি রইল জাতিবাদ বা জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের গর্ব। ভারত তাকেই মুকুট হিসেবে পরছে, সেখানেই তার আনন্দ ও গৌরব। জনগণের ওপর দোষারোপ না করে বাস্তবকে বোঝা দরকার। বোঝা দরকার একে মোকাবেলার পথ কী হতে পারে। তুফান আসছে বলে ঘরে বসে থাকা যাবে না।

শিব বিশ্বনাথনের আক্ষেপ হচ্ছে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সংকীর্ণ চিন্তার মানুষদের জগতে পরিণত হয়েছে, পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে যাদের কাছে যে কোনো মূল্যে ভারতের ‘উন্নয়ন’ই প্রধান অগ্রাধিকার। তার সারকথা হচ্ছে, ‘Mr. Modi's victory signals the victory of the parochial and affordably mediocre over aû vision of the cosmopolitan or plural. Deep down it is the future whic
h we have lost today. This is Indian democracy's most ironic gift.’

একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়ে বিচিত্র ও বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা, জাতিকে উচ্চ বর্ণের হিন্দু এতদিন আচ্ছাদিত রেখে শাসন করছিল। তা খসে যাওয়ার পর বিশ্বনাথনের এই আক্ষেপ আমরা বুঝতে পারি। একে ‘মিডিওকার’দের উত্থান হিসেবে তিনি নিন্দা করছেন। সেটা ঠিক নয়, কারণ ওই নিন্দার মধ্য দিয়ে নিজের অভিজাত চিন্তার গর্বে তিনি খামাখা গর্বিত হতে চাইছেন, আমরা এই আভিজাত্যের সঙ্গে একমত নই। বর্ণ ও শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই ভারতে কেন এ উপমহাদেশেও শেষ হয়নি, এমনকি বিশ্বেও নয়। যেসব পরিভাষা বর্ণহিন্দু নিজের জাত ও শ্রেণীর স্বার্থে এতকাল ব্যবহার করেছে, তার উপযোগিতা বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এটা খুবই ভালো কাজ হয়েছে বা হচ্ছে। একটা তুফান আসছে অবশ্যই, কিন্তু প্রাচীন, বাজে, অকার্যকর চিন্তা ও চিন্তার আবর্জনা জমিয়ে রেখে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ এগিয়ে যাবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। অনেক আবর্জনাই সাফ করতে হবে। কোনো কিছুই আপসেআপ হবে না। নতুন রূপান্তরের রাজনীতি গণমানস নিন্দা করে নয়, নিজেদের প্রাচীন পরিভাষা, বদ্ধ মতাদর্শ ও আভিজাত্যের পর্যালোচনা দরকার। সেটাই প্রথম কাজ।

পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে আমাদের নতুন করে ভাবতে-শিখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ার জনগণকেও শেখাতে হবে। শর্টকাট আছে বলে আমি মনে করি না।

১৭ মার্চ ২০১৭, ৩ চৈত্র ১৪২৩, শ্যামলী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন