শনিবার, ১৮ জুন, ২০১৬

চৌদ্দদলীয় জোটে গৃহদাহ

ব্রিটিশ শাসনামলে গঠিত হয় অনুশীলন দল। ঢাকা ছিল অনুশীলন দলের শক্তিশালী কেন্দ্র। এই দলের লক্ষ্য ছিল বড় বড় ইংরেজ অফিসারদের হত্যা করে ত্রাস সৃষ্টি। এবং ত্রাসের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান। পরে এই দলের একজন শক্তিশালী নেতা প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকায় গড়েন রেভুলিউশনারি স্যোসালিস্ট পার্টি। যাকে সংক্ষেপে বলা হতো আরএসপি। ঢাকা থেকে এই দলের সংগঠন তদানীন্তন বাংলার নানা অংশে ছড়িয়ে পড়ে। আরএসপি বলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা। অর্থাৎ জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের কথা। এদের মত ঢাকার ছাত্রসমাজে যথেষ্ট সাড়া জাগায়। মনে করার কারণ আছে, জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান আরএসপির চিন্তাচেতনায় ছাত্রজীবনে প্রভাবিত হয়েছিলেন। 

১৯১৭ সালে ঘটেছিল রুশ বিপ্লব। রাশিয়ায় ভøাদিমির লেনিনের মৃত্যুর পর ঘটে স্টালিন ও ত্রতস্কির বিরোধ। ত্রতস্কি বলেন, অবিরাম বিপ্লবের কথা। অন্য দিকে স্টালিন বলেন, প্রথমে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কেননা, সারা দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাবার মতো ক্ষমতা রাশিয়ার নেই। সেটা করতে গেলে রাশিয়া হবে বিভিন্ন দেশ থেকে আক্রান্ত। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নেয় স্টালিনের পক্ষ। অন্য দিকে আরএসপি নেয় ত্রতস্কির পক্ষ। ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ ঘটে ত্রতস্কিপন্থীদের। যাদের নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। জাসদ নামটা বেশ কিছুটা গোলমেলে। হের হিটলারের দলের নাম ছিল নাৎসি। নাৎসি নামের বাংলা করলে দাঁড়ায় জাতীয় সমাজতন্ত্রী। জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল হিটলারের নাৎসি দলের মতোই উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করতে চায়। প্রথমে তারাই তুলেছিল উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের আওয়াজ, জয়বাংলা। 

পরে তারা আওয়াজ তুলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের। হের হিটলারের মতোই তারা গণতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন না। ত্রতস্কিবাদ আর হিটলারের একটা সংমিশ্রণ থাকতে দেখা যায় জাসদের মূল মতাদর্শের মধ্যে। ১৯৭৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাসদ তার একটি ইস্তিহারে বলে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকাল সুদীর্ঘ ২৫টি মাস অতিক্রম করে গেছে। এক দিকে ধনবাদী মুজিব সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ, গণনির্যাতন, খামখেয়ালিপনা শাসন, অপদার্থতা এবং অন্য দিকে বিদেশী দাসত্বের দরুণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সাধারণ মানুষের জীবন আজ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

... এই অবস্থাকে কোনোমতেই আর অধিক কাল চলতে দেয়া যেতে পারে না। সুতরাং সময় থাকতেই শোষক শোষিতের মধ্যে কারা টিকে থাকবে, তার একটা ফয়সালা হওয়া দরকার। (দ্রষ্টব্য: জাসদের উত্থান পতন : অস্তির সময়ের রাজনীতি; মহিউদ্দিন আহমদ। পৃষ্ঠা : ১০৯। প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা-২০১৪) জাসদের এই বক্তব্য সে সময় তরুণদের ওপর রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর পড়েছিল জাসদের বিশেষ প্রভাব।

জাসদ সম্পর্কে আমি কিছু জানতাম না। ফ্রান্সের এক সংবাদপত্রের সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করেন, ছাত্রদের মধ্যে ত্রতস্কির মতবাদ কতটা আছে। আমি তাকে বলি এ বিষয়ে আমি কিছু অবগত নই। তবে পরে খোঁজ নিয়ে জানি, জাসদের মধ্যে কাজ করছে ত্রতস্কির মতবাদ। ত্রতস্কি ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন চতুর্থ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক। যার সদরদফতর অবস্থিত হলো ফ্রান্সের রাজধানী পারি শহরে। ওই সাংবাদিক পারি শহরে প্রথম জেনেছিলেন ত্রতস্কিপন্থীরা বাংলাদেশে রয়েছেন সক্রিয়।

পিটার্স কাসটার্স বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৩ সালে। তিনি ছিলেন নেদারল্যান্ডসের (হল্যান্ড)। তবে নিতি নেদারল্যান্ডস থেকে বাংলাদেশে সরাসরি আসেননি। এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে। তিনি ছিলেন ত্রতস্কিপন্থী। তিনি কর্নেল (অব:) আবু তাহেরকে ৬০ হাজার টাকা দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি চক্র তৈরি করার জন্য। সে সময় এই টাকা ছিল অনেক টাকা। তিনি পরে জাসদকে আরো টাকা দেন। কর্নেল (অব:) তাহের সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে একটি চক্র তৈরি করতে পারেন। যারা ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে তিন, চার, পাঁচ তারিখে ঘটায় অভ্যুত্থান। সাধারণ সিপাহিরা আওয়াজ তোলেন ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’। এই অভ্যুত্থানের ফলে বেশ কিছুসংখ্যক অফিসার ও সেই সাথে তাদের স্ত্রীরাও নিহত হন। কিন্তু অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত সাফল হয় না। কর্নেল তাহের ধরা পড়েন ও প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। পিটার কাসটার্স ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে ধরা পড়েন। বাংলাদেশের সামরিক আদালতে তার বিচার হয়। বিচারে তার ১৪ বছর কারাদণ্ড হয়। কিন্তু নেদারল্যান্ডস সরকারের বিশেষ অনুরোধে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তিনি চলে যান তার দেশে। পিটার্স কাসটার্স সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা জায় না। তবে তিনি বাংলাদেশে আসেন জাসদ দলকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য। বিদেশ থেকে আরো কয়েকজন ত্রতস্কপন্থী বাংলাদেশে এসেছিলেন; এমন কথাও শোনা যায়। তবে তারা ধরা পড়েননি। এবং তাদের বিচার হয়নি।

জাসদের হাসানুল হক ইনু ১৯৭১ সালে ভারতে তানদুয়া এলাকায় গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেয়। এ সময় ভারতের উচ্চপদস্থ একদল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার সাথে তার গড়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বর্তমান সরকারে তিনি মন্ত্রী হওয়ার মূলে থাকা সম্ভব ভারতীয় চাপ। অন্য কোনো জাসদ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেননি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। কিন্তু অভিযোগ তুলেছেন বিশেষ করেই হাসানুল হক ইনুর সম্পর্কে। মনে হয় তিনি ইনুর কার্যকলাপ সম্পর্কে এমন কিছু জেনেছেন, যা তার মনে সৃষ্টি করেছে শঙ্কা। এটা ঠিক কী, তা আমরা জানি না। তবে বিষয়টি ভাবারই মতো। এটা কেবল অতীতের ব্যাপার নয়। হাসানুল হক ইনু বেঁচে আছেন এবং রাজনীতি করছেন। জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান যত দূর জানি এখনো জীবিত আছেন। তিনি বহু দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। পরে ফিরে আসেন ঢাকায়। তিনি যে ত্রতস্কিপন্থী এ কথা আবদুর রাজ্জাক বলেছেন তার এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারটি পাওয়া যাবে মাসুদুল হক লিখিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ‘র’ এবং ‘সিআইএ’ নামক বইয়ে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রচিন্তা প্রকাশনী, ঢাকা থেকে। এর চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০১০ সালে। সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে আর যা বলেছি তা একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে শ্রুত। প্রতুল গাঙ্গুলি সম্পর্কে যা বলেছি তার ভিত্তি হলো Labour Movement in East Pakistan  নামক গ্রন্থ। যা লিখেছেন কামরুদ্দীন আহমদ ১৯৬৯ সালে। তবে বইয়ে আরএসপি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা নেই। আমি যা বলেছি তার ভিত্তি হলো নিজের অভিজ্ঞতা। রাজশাহীতে আরএসটি দল একসময় যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। এখন অতীত ইতিহাসের অনেক কথা উঠে আসছে, যা উঠে আসা স্বাভাবিক। কেননা একটি জাতি গড়ে উঠে ইতিহাসের ধারায়, নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে। বলা হচ্ছে, সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য সমালোচিত হয়নি। এর ফলে ১৪ দলের জোট ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু ১৪ দলের জোট ভেঙে গেলে আওয়ামী লীগ যে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নয়। বরং আওয়ামী লীগ অনেক সহজে অনেক ব্যাপারে গ্রহণ করতে পারবে তার আপন সিদ্ধান্ত। মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগে বিরাট নীতিগত পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ক’দিন আগে সৌদি আরবে গিয়ে চুক্তি করেছেন বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে সৈন্য পাঠানোর। এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কেননা এর ফলে রুশ সৈন্যের সাথে যুদ্ধ হতে পারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। আওয়ামী লীগে শুরু থেকেই ভারত এবং মার্কিন লবি ছিল। ভারত লবির প্রভাবে সৃষ্টি হয় ১৪ দলের জোট। মন্ত্রিত্ব পেতে পারেন হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন। এরা দু’জনেই হজ করতে যান। প্রমাণ করতে চান, এরা আর আগের মতো মার্কসবাদী নন। হয়ে উঠেছেন খাঁটি মুসলমান। ধর্মে তাদের আস্থা আছে অগাধ। কিন্তু মনে হয় এখন আওয়মী লীগে বাড়ছে মার্কিন লবির প্রভাব। বর্তমানে মার্কিন লবি চাচ্ছে এদের প্রভাব থেকে আওয়ামী লীগকে মুক্ত করতে। সৈয়দ আশরাফ যথেষ্ট ভেবেচিন্তে হাসানুল হক ইনুর বিপক্ষে তার বক্তব্য রেখেছেন। হয়তো আগামীতে তিনি মেনন সম্পর্কেও কিছু মন্তব্য করতে পারেন। কেননা এক কালের ছাত্রনেতা মেনন বলেছিলেন, শেখ মুজিব হচ্ছেন সিআইএয়ের লোক। আর ছয় দফা হচ্ছে সিআইএয়ের তৈরি। অনেক কিছুই ঘটছে বাংলাদেশে। যার কথা আগে ভাবা যায়নি। জামায়াতকে রুখার জন্য আওয়ামী লীগ গঠন করেছিল আওয়ামী ওলামা লীগ। আওয়ামী ওলামা লীগ এখন বলছে, দেশে প্রতিষ্ঠা করতে হবে ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা। ছাত্রদের পড়ানো চলবে না কোনো হিন্দু লেখকের লেখা। আওয়ামী লীগ অবশ্য এখন বলছে, আওয়ামী ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গসংগঠন নয়। তারা যা বলছে, সেটা তাদের নিজস্ব বক্তব্য। অনেক কিছুই ঘটছে, যার কথা আগে ভাবা যায়নি। যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতলেন বিধানসভার নির্বাচনে বিস্ময়কর ভোট লাভ করে। তিনি শপথ নিলেন ভগবান এবং আল্লাহর নামে। শুধু তা-ই নয়, শোনা যাচ্ছে তিনি তার জয়ের জন্য কয়েক রাকাত নফল নামাজ পড়েছেন তার মুসলিম অনুগামীদের সাথে। বাংলাদেশে যখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কথা চলেছে, তখন পশ্চিমবঙ্গে জামায়াত হয়ে উঠেছে মুসলমানদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। মমতার জয়ের মূলে তাদের অবদান সামান্য নয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন সিপিআই(এম) মার খাচ্ছে মমতা সমর্থকদের হাতে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি যোগাযোগ রেখে চলত পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম)-এর সাথে। সিপিআই(এম)-এর বিপর্যয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি হয়ে উঠল অনিকেত। আর সেই সঙ্গে চৌদ্দদলের জোট হলো দুর্বল।

লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন