সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্পর্কে আমেরিকার ভয়ানক দুশ্চিন্তা নিয়ে নোয়াম চমস্কি এখনো তার স্বভাবসিদ্ধ ভাষাশৈলীর লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন। এ ব্যাপারে চমস্কির উদ্বেগও কিছু কমেনি। তার নতুন বই ‘কে শাসন করছে পৃথিবী?’ -এ স্বভাবতই সেটা অনুপস্থিত থাকতে পারে না। তিনি এ বইতে অন্য সব বিষয়ের সাথে ভিয়েতনাম যুগের কথা বলাটা আবশ্যকীয় মনে করেছেন। এর একটাই সংজ্ঞা হয়- ‘ক্ষমতার আগ্রাসন’। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় অতি সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া তার এই লেখাটি কয়েক সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে নয়া দিগন্তে। এর অনুবাদ করেছেন সুমাইয়া হাবিবা
চ্যালেঞ্জের মুখে আমেরিকার ক্ষমতা?
যখন আমরা কাউকে প্রশ্ন করি, এ বিশ্ব কে শাসন করবে? তখন সাধারণত আমরা যে পথে আমাদের চিন্তা বা দৃষ্টিকে প্রসারিত করি তা হলো, আমরা এমন কারো কথা ভাবি যে, বৈশ্বিক আন্তঃসম্পর্কে প্রধান ভূমিকায় থাকে বা কোনো মহাশক্তিধর কেউ। তাদের সিদ্ধান্তগুলো আমরা মেনে নেই। তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ি। এটা দূষনীয় কিছু নয়। তবে সাথে এটাও খুব ভালোভাবে মাথায় রাখা উচিত যে, এ ধরনের অতি বাস্তব চিন্তাভাবনাগুলোই মারাত্মকভাবে আমাদের বিপথগামী করতে পারে।
আবশ্যিকভাবেই রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত জটিলতা থাকবেই এবং যখন সাধারণ মানুষ বারবার প্রান্তিকতায় পৌঁছে যায়, তখন সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পছন্দ ও সিদ্ধান্তগুলো, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। এটা সব রাষ্ট্রের জন্য তো বটেই, এমনকি অধিক গণতন্ত্র চর্চাকারী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সত্য। আমরা কখনোই মানবজাতির নেতৃত্বকে বাদ রেখে বাস্তবিক উপলব্ধি অর্জন করতে পারব না। বিখ্যাত স্কটিশ দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ বলেছিলেন, ‘আজকের দিনে আমাদের ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা ও উৎপাদকেরাই হচ্ছে সত্যিকারের বহুজাতিক ব্যবসায়ীর গ্রুপ। তাদের নানা ধরনের প্রচুর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং একইভাবে রয়েছে খুচরা প্রতিষ্ঠানের বিশাল সাম্রাজ্য।’ এ সময় স্মিথকে অনুসরণ করাও বুদ্ধিমানের কাজ। অর্থাৎ ‘নিজের বেলা ষোলআনা, পরের বেলায় এক আনাও নয়’- এ জাতীয় জঘন্য নীতি পরিহার করে মানবতার স্রষ্টার পথে উৎসর্গিত পন্থায় অংশগ্রহণ করা। অন্যথায়, এ মতবাদ তীব্রতর, তিক্ত ও অবিরাম শ্রেণিযুদ্ধের কারণ হবে যা প্রায়ই একপক্ষীয় এবং নিজের দেশেই শুধু নয়, বিশ্বের বেশির ভাগ জনগণেরই ক্ষতির কারণ হবে।
সমকালীন বিশ্ব রীতিতে, হর্তাকর্তা প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে। এটা শুধু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং দেশগুলোর জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও একই অবস্থা। এর ওপর নির্ভর করে তারা তাদের ক্ষমতা রক্ষা এবং নানাভাবে বিশাল আকারের অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রস্তুত করতে চায়। যখন আমরা মানবজাতির নেতৃত্বের ভূমিকা স্বীকার করে নেবো, তখন আমাদের এমন রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে সময়ের দাবিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেমন- ‘পরিবর্তনশীল শান্তিপ্রয়াসী অংশীদারিত্ব’ (ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ)। এটা এক ধরনের উদ্যোক্তা অধিকার চুক্তি, যা ‘মুক্তবাণিজ্য চুক্তি’ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) নামে অপপ্রচারণা ও অপব্যাখ্যার শিকার। তারা এ বিষয়ে গোপনে আলোচনারত, শ’খানেক করপোরেট আইনজীবী ও লবিস্টের একটি অংশের বিবরণ দিচ্ছেন। উদ্দেশ্য, স্টালিন স্টাইলে খুব দ্রুততায় প্রক্রিয়া পরিচালন রীতি অঙ্কন করা, যাতে এ সংক্রান্ত আলোচনার পথ আটকে দেয়া যায় এবং শুধু হ্যাঁ অথবা না অপশনই থাকে। অঙ্কনকারীরা যে এটা হুট করে করছে তা কিন্তু নয়। তারা খুব ভালোভাবে এবং নিয়মিতই তাদের কাজ করে যাচ্ছে। জনগণ একটি সুনির্দিষ্ট সম্ভাব্য পরিণতির প্রতীক্ষা করছে।
দ্বিতীয় পরাশক্তি
দমনমূলক ও কারিগরি গণতন্ত্রের কয়েকবার হাতবদলের পর নব্য উদারনীতিবাদী চিন্তাধারা অতীত প্রজন্মকে সম্পদ ও ক্ষমতায় মনোনিবেশ করাতে পেরেছিল। কিন্তু তারা বিরোধী পক্ষকেও ভালোভাবে সক্রিয় করেছে। যেমন, ল্যাটিন আমেরিকায় সবচেয়ে ‘সুন্দরভাবে’ করেছে শুধু বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র করা ছাড়া। যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রত্যাশার চেয়ে অধিক উন্নতি করেছে, তারাও এখন দোদুল্যমান। কারণ, মন্দার সময় রাজনৈতিক নীতিনিষ্ঠায় অত্যন্ত কঠোর প্রভাব পড়ছে। এমনকি, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের অর্থনীতিবিদদের দ্বারাও নিন্দিত হচ্ছে (আইএমএফও রাজনৈতিক চরিত্র না নিলে তা অব্যাহত থাকবে।) আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্রাসেলস আমলাতন্ত্রে বদলে যাওয়ায় গণতন্ত্র আজ দলিতমথিত। তাছাড়া, উত্তরের ব্যাংকগুলো তাদের সভার কার্যবিবরণীর ওপর ভালোভাবেই ছায়া বিস্তার করেছে।
মূলধারার দলগুলো ক্রমাগত তাদের সদস্য হারাচ্ছে; ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। প্যারিস ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোপানোভার নির্বাহী পরিচালক ফ্রাঙ্কুই ল্যাফঁ সাধারণের মোহমুক্তির বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে বলেছেন, রাগান্বিত অক্ষমতা হলো জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের (যারা অন্তত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যাপারে নীতিবান) থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনগুলোকে স্থানান্তর করে মার্কেটে ছড়িয়ে বৃহদাকারে রূপদানের প্রকৃত শক্তি। এটা হুবহু নব্য উদারনীতিবাদী মতবাদের সারকথা। এর সাথে অনেক সামঞ্জস্যশীল প্রক্রিয়াই চাপা পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে; কিছুটা একই রকম কারণে। এ বিষয়গুলো নিরূপণ এবং এ নিয়ে উদ্বেগ শুধু আমেরিকার জন্যই নয়, বিশ্বের জন্যও জরুরি। এর কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা।
নব্য উদারনীতিবাদী মতবাদের আকস্মিক হামলায় বিরোধী পক্ষের উত্থান আরেকটি মানসম্মত রেওয়াজ প্রচলনের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গির দিকে আলোকপাত করছে। এটি জনবিচ্ছিন্নভাবে ছিল। যখন হামেশাই অংশগ্রহণকারীদের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য দর্শকের ভূমিকাও মেনে নিতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন এটা উদার গণতান্ত্রিক মতবাদে আরোপিত হলো। এ রকম অবাধ্যতা সব সময়ই প্রভাবশালী শ্রেণীর জন্য উদ্বেগের বিষয়। আমেরিকার ইতিহাসেই দেখা যায়, জর্জ ওয়াশিংটন সাধারণ মানুষদের যারা জঙ্গিগোষ্ঠী গঠন করে তাদের স্পষ্টতই অতীব নোংরা ও কদর্য মানুষ হিসেবে গণ্য করতেন এবং তাদের এভাবে গণ্য করতে আদেশও দিতেন। এসব নিম্ন শ্রেণীর মানুষের অর্ধতব্য নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
হিংসাত্মক রাজনীতিতে ‘আমেরিকান বিদ্রোহ’ আমেরিকা থেকে সমকালের আফগানিস্তান, ইরাকে স্থানান্তরিত হয়েছে। উইলিয়াম পল্ক জেনারেল ওয়াশিংটন সম্পর্কে বলেন, তিনি যেসব সৈন্যকে ঘৃণা করতেন তাদের ব্যাপারে অভ্যুত্থান নিয়ে অত্যন্ত শঙ্কিত ছিলেন। যে বিপ্লবকে হারানোর খুব কাছে তিনি চলে এসেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি যথার্থভাবেই সেটা করেছেন। তিনি ফ্রান্সে ব্যাপক হস্তক্ষেপ করেননি এবং বিপ্লব রক্ষা করতে পেরেছিলেন; যতক্ষণ পর্যন্ত না গেরিলারাই জয় লাভ করে, আমরা আজকে যাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলছি। তখন ওয়াশিংটনের ব্রিটিশ ধাঁচের আর্মি একের পর এক পরাজিত হচ্ছিল এবং আদতে যুদ্ধটিই হারতে বসেছিল।
রেকর্ড বলে, সফল বিদ্রোহের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো জয়ের পর একবার যখন জনসমর্থন মিলিয়ে যায় তখন নেতৃত্ব এই ‘নোংরা ও কদর্য’ মানুষদেরই দমন করে। এ নেতৃত্ব প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধে জয় লাভ করেছে গেরিলা কৌশল এবং গেরিলা সন্ত্রাস দিয়েই। এই ভয়ে এটা করা হয় যে, তারা সম্ভবত বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। অভিজাত শ্রেণী সব সময় এই নিম্ন শ্রেণীর জনতাকে নানাভাবে নানারূপে অবজ্ঞা করে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই অবজ্ঞার আরেকটি রূপ হলো, আনুগত্য ও নিষ্ক্রিয়তার (মধ্যমপন্থী গণতন্ত্র) ডাক দেয়া।
মাঝে মাঝে রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনতার মতামতকে অনুসরণ করে থাকে, কেন্দ্রের ক্ষমতার প্রচণ্ডতা আরো অধিক পরিমাণে বাড়িয়ে তুলতে। এমনই একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটেছিল ২০০৩ সালে। যখন বুশ প্রশাসন তুরস্ককে আহ্বান করেছিল ইরাকে আগ্রাসনে অংশ নিতে। ৯৫ শতাংশ তুর্কি সেদিন এর বিরোধিতা করেছিল; যার ফলে এর বাস্তবায়ন হয়নি। ওয়াশিংটনকে বিস্মিত এবং ভয়কে উপেক্ষা করে, তুর্কি সরকার জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিকেই গ্রহণ করেছে। তুরস্ক এহেন দায়িত্বশীল আচরণ থেকে সরে আসায় অব্যাহত নিন্দায় জর্জরিত হতে থাকে। প্রতিরক্ষা উপসচিব পল উলফইজ যিনি গণমাধ্যম কর্তৃক প্রশাসনের আদর্শবাদী প্রধান আখ্যায়িত, তিনি তুর্কি সেনাবাহিনীকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন সরকারের এমন অন্যায় অনায্য সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার জন্য। এবং ক্ষমাও চাইতে বলেন। এ রকম ও অটলতার অন্যান্য সহস্র উদাহরণ আমাদের গণতন্ত্রের জন্য অলীক কল্পনা। গণতন্ত্র উন্নয়নে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের একাগ্রতা নিয়ে গুণকীর্তন জোরালোভাবেই হয়েছে। মাঝে মাঝে সমালোচনাও করা হয়েছে দেশের বাইরে ক্ষমতা প্রয়োগ করে অন্যদের ওপর তার গণতান্ত্রিক আকুলতা চাপিয়ে দেয়ার একপেশে চিন্তার জন্য।
তুর্কি জনগণ একা ছিল না, পুরো বিশ্বই মনেপ্রাণে ইন্দো-আমেরিকান আগ্রাসনের বিপক্ষে ছিল। আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী, ওয়াশিংটনের যুদ্ধের পরিকল্পনার সমর্থন সব জায়গায়ই বড়জোর ১০ শতাংশ ছিল মাত্র। যুদ্ধবিরোধী পক্ষ যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্বেই প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবার প্রথম পাতায় সাংবাদিক প্যাট্রিক টেইলর রিপোর্ট করেন, বর্তমানে সম্ভবত দু’টি পরাশক্তিই পৃথিবীতে বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের সাধারণ জনতার মতামত।
অভূতপূর্ব বিক্ষোভ হয় যুক্তরাষ্ট্রে। আগ্রাসনবিরোধী মিটিং-মিছিল হলো। এর শুরুটা হয়েছিল দশকের শুরুতে ইন্দোচীনে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের নিন্দা জানিয়ে। যদিও অনেক দেরিতে, তবুও বিরোধিতার মাত্রাটা শেষমেশ বলিষ্ঠ ও প্রভাবশালী হতে পেরেছে। ১৯৬৭ সাল, যখন থেকে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হতে পেরেছে, সামরিক ঐতিহাসিক ও ভিয়েতনাম বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড ফল সাবধান করেন, ভিয়েতনাম একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সত্তা... এটি বিলুপ্তির হুমকির মুখে... যদি গ্রামাঞ্চলগুলো আক্ষরিকভাবেই মৃতুবরণ করে দৈত্যাকার সমরাস্ত্রের আঘাতে, এই আকারের একটি অঞ্চল চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে।”
কিন্তু যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন পরিণত হয়েছিল একটি শক্তিতে, যাকে অবহেলা করা যায় না। নচেৎ এটাকে এড়িয়ে যাওয়াই হতো যখন রোনাল্ড রিগ্যান এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েই প্রেসিডেন্ট অফিসে এসেছিলেন যে, সেন্ট্রাল আমেরিকার ওপর আক্রমণ শুরু করবেন। তার প্রশাসন সেরকম পদক্ষেপের খুব কাছাকাছিই ছিল, বিশ বছর আগে জন এফ কেনেডি দক্ষিণ ভিয়েতনামে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাদের পিছু হটতে হয় জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে। ষাটের দশকের শুরুতে এর অভাব ছিল। সে আক্রমণ খুবই ভয়ানক ছিল। ভুক্তভোগীরা এখন অবধি সারিয়ে উঠতে চেষ্টা করে যাচ্ছে সে ক্ষতি। তবে দক্ষিণ ভিয়েতনামে ও ইন্দোচীনে যা ঘটেছিল, সেসব সঙ্ঘাতের অনেক পরে সেখানে দ্বিতীয় পরাশক্তি যে প্রতিবন্ধকতা আরোপ করেছিল, তা ছিল আরো মন্দ।
এটা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, ইরাক আক্রমণের ব্যাপক বিরোধিতার কোনো প্রভাব ছিল না। সে ক্ষেত্রে আমাকে ভুল মনে হয়। আবার, এই আক্রমণ বেশ ভয়ঙ্কর ছিল এবং এর পরবর্তী ফলাফল ছিল চূড়ান্তভাবে কিম্ভূতকিমাকার। তা সত্ত্বেও এটা এখন পর্যন্ত অত্যধিক মন্দই বিবেচিত হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামসফেল্ড এবং বুশ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা কখনোই এমনটি ভাবতে পারেননি যে, এ ধরনের প্রতিরোধ আসবে। প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং প্রেসিডেন্ট জনসন ৪০ বছর আগে তা গ্রহণ করেছিলেন কোনো রকম বাধা ছাড়াই।
চাপের মধ্যে পশ্চিমা ক্ষমতা
এখানে একটু বেশি বলতে হয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভূমিকা রাখার সময় যখন আমরা একটি মানসম্মত নীতি অবলম্বন করব, তখন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের প্রভাবকগুলোকে পাশে সরিয়ে রাখতে হবে। তবে সামান্য নয় এমন আদেশগুলোকে সাথে নিয়ে। নাহলে চলুন, এমন একটি নীতি অবলম্বন করি, যা অন্তত বাস্তবতার একদম কাছাকাছি। তারপর আসা যাক এ প্রশ্নে; বিশ্ব কে শাসন করবে এবং এ সংক্রান্ত উদ্বেগগুলো কী? যেমন চীনের পরাশক্তি হিসেবে উত্থান এবং এটা আবার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে যাওয়া এবং বৈশ্বিক মেরুকরণ। পূর্ব ইউরোপের ফুটন্ত নতুন স্নায়ুযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধ, আমেরিকার কর্তৃত্ব ও পতন, এবং একই পরিসীমায় ব্যপ্ত বিষয়গুলো।
পশ্চিমা শক্তিগুলো ২০১৬ আসার আগে থেকেই যে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রধান আন্তর্জাতিক কলামিস্ট গিডিয়ান র্যাচম্যান সে ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী অবকাঠামোর সংক্ষিপ্তসার তৈরি করেছেন। বৈশ্বিক মেরুকরণে যে পশ্চিমা ছবি অঙ্কিত, তার পুনর্বিবেচনা শুরু করেছেন। বলেছেন, ‘ স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমেরিকার সেনাবাহিনীর দুর্বার ক্ষমতা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে।’ এটি তিনটি স্বতন্ত্র কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ১. পূর্ব এশিয়া; যেখানে মার্কিন নেভি প্রশান্ত মহাসাগরকে একটি মার্কিন লেক হিসেবে পরিচালনা করে। ২. ইউরোপ; যেখানে ন্যাটো মানেই যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে ন্যাটোর সামরিক ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশই একটি সদস্য রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষার্থে ব্যয় হয়। ৩. মধ্যপ্রাচ্য। যেখানে দৈত্যাকার মার্কিন নৌ ও বিমানঘাঁটি রয়েছে সেখানে বিদ্যমান বন্ধুদের আশ্বস্ত করতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয় দেখাতে।
আজকের মেরুকরণের সমস্যা হচ্ছে, র্যাচম্যানের মতে, এই নিরাপত্তা নির্দেশ তিনটি কারণে হুমকির সম্মুখীন। প্রথমত, ইউক্রেন ও সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ। দ্বিতীয়ত, চীন তার নিকটবর্তী সাগরে অগ্রসর হচ্ছে। যা স্পষ্টতঃই আমেরিকার হ্রদের পানি নিয়ে প্রতিযোগিতা। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে মূলগত প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের কি উচিত অন্যান্য প্রধান শক্তিকে মেনে নেয়া, যা তার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের আশপাশে এক রকম প্রভাব বলয় তৈরি করবে? র্যাচম্যানের মতে, সাধারণ জ্ঞান বলে- বিশ্বে অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিকিরণের কারণে এটাই উচিত। এখানে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকে দেখার অনেক রকম দৃষ্টিভঙ্গি আছে। কিন্তু আমাদের এ তিনটি বিষয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটিকে অবশ্যই নিতে হবে।
আজকের চ্যালেঞ্জ র্পূব এশিয়া
আমেরিকান হ্রদের শুরুর সাথে সাথে কিছু লোকের ভ্রু কুঁচকে গেছে, যখন গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদন বের হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমেরিকান বোমারু বিমান দক্ষিণ চীন সাগরে রুটিন মিশনে ওড়ার সময় বেখেয়ালে চীনের কৃত্রিম দ্বীপের দুই নটিক্যাল মাইলের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে একে ঘিরে বিবাদ সৃষ্টিকর ইস্যু সৃষ্টি হয়েছে, যা তাদের ক্রুদ্ধ করেছে।’ যারা সত্তর বছর ধরে পরমাণু অস্ত্রের যুগে তাদের ক্রুর রেকর্ডের জন্য সুপরিচিত তাদের সম্পর্কে সবাই অবগত যে, এটি প্রায়ই হতে থাকা একটি ছোট্ট ঘটনা মাত্র, যা আরেকটি আখেরি পরমাণু যুদ্ধের জ্বলে ওঠার জন্য ভয়ানক রকম নিকটবর্তী হচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চায়নার উত্তেজনামূলক ও দখলদারিমূলক আচরণের যে একজন সমর্থক নয় সে-ও লক্ষ করল, এই আকস্মিক ঘটনায় চায়নিজ পরমাণু সক্ষম বোমারু বিমানকে জড়ানো হয়নি ক্যারিবিয়ানে। অথবা ক্যালিফোর্নিয়ান উপকূল বন্ধ করেনি। অথচ চায়নার একটি চায়নিজ হ্রদ প্রতিষ্ঠা করতে কোনো ভণ্ডামির প্রয়োজন নেই।
বিশ্বের জন্য সৌভাগ্যবশত, চায়নিজ নেতারা এটা বুঝতে পেরেছেন তাদের দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্য রুট অপ্রতিরোধ্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী দ্বারা শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে আছে জাপান থেকে মালাক্কা প্রণালী ছাড়িয়েও পুরো এলাকা। একইভাবে চীন পশ্চিমা বিশ্বে বিশাল বিনিয়োগ বিস্তৃত করতে অগ্রসর হয়েছে এবং সতর্কভাবে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার অংশ হিসেবে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) বাণিজ্য উন্নয়নমূলক অবকাঠামো যাতে মধ্য এশিয়া ও রাশিয়া অন্তর্ভুক্ত এবং খুব তাড়াতাড়িই ইন্ডিয়া-পাকিস্তানও অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। সাথে ইরানও পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দেবে। আবার বলা হয়েছে ওইসব অঞ্চলের সব সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করতে। এখানে এক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে অবজ্ঞা করা হয়েছে।
চীন পুরাতন সিল্করোডের আধুনিক রূপদান করে নতুন করে নির্মাণ করতে চাইছে। এখানে উদ্দেশ্য শুধু সেসব অঞ্চলকে চায়নিজ বলয়ে নিয়ে আসা নয়; বরং ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোতে পৌঁছা। এতে বিশাল অঙ্ক ঢালা হয়েছে একটি সমৃদ্ধ এশিয়ান জ্বালানি ও বাণিজ্যিক সিস্টেম তৈরির জন্য। সাথে দ্রুতগতির রেললাইন ও বিস্তৃত পাইপলাইনও স্থাপন হবে।
এই উদ্যোগের একটি উপাদান সিল্করোড নামে মহাসড়ক বিশ্বের বৃহত্তম পর্বতের কিছু অংশ ধরে এগিয়ে পাকিস্তানে চীনের সংস্কার করা ঘাদার বন্দর পর্যন্ত গেছে, যা তেলের বহরকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করবে। এ উদ্যোগের আরো একটি বিষয়, চীন-পাকিস্তান আশা করছে, এর মাধ্যমে পাকিস্তানে ব্যাপক শিল্পন্নোয়ন ঘটানো। যে উদ্যোগ পাকিস্তানে অব্যাহত সামরিক সহায়তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র নেয়নি এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদকে শক্ত হাতে দমন করার জন্য একটি উপায় তৈরি করা, যা চীনের পশ্চিমে জিনজিয়ান প্রদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। ঘাদার বন্দর চীনের একটি মুক্তা অনুসন্ধান অভিযানের অংশ হতে চলেছে। ভারত মহাসাগরে ঘাঁটি নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে বাণিজ্যিকভাবেই, তবে সাথে সম্ভাব্য সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্যও। এ প্রত্যাশা নিয়ে যে, চীন ভবিষ্যতে একদিন আধুনিক যুগে প্রথমবারের মতো পারস্য উপসাগরে পাওয়ার প্রজেক্ট করতে সক্ষম হবে। এসবই হচ্ছে ওয়াশিংটনের দুর্বার সামরিক ক্ষমতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। পরমাণু যুদ্ধের ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য, যা যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালোভাবেই ধ্বংস করতে পারে।
২০১৫ সালে চীন এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এইইবি) প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজে এর সব থেকে বড় শেয়ারহোল্ডার হয়। গত জুন মাসে ৫৬টি দেশ বেইজিংয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। ওয়াশিংটনের বিরাগ উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেনসহ অন্যরাও অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান অনুপস্থিত ছিল। কিছু বিশ্লেষকের বিশ্বাস এই ব্যাংক ভবিষ্যতে আন্তজাতিক হর্তাকর্তা প্রতিষ্ঠানগুলোকে (আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক) টেক্কা দেবে, যেগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। কেউ কেউ আশা করছেন- এসসিও ভবিষ্যতে ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে।
আজকের চ্যালেঞ্জ : পূর্ব ইউরোপ
পূর্ব ইউরোপের দ্বিতীয় অঞ্চল ন্যাটো রাশিয়ান বর্ডারে সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। এটা কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নয়। রিচার্ড সাকওয়া তার দূরদর্শী ও ভূবিষয়ক পাণ্ডিত্যর্পূণ বিচারিক গবেষণাপত্র ‘ইউক্রেন ফ্রন্টলাইন : ক্রইসিস ইন দ্য বর্ডারল্যান্ড’-এ উল্লেখ করেছেনÑ খুব সম্ভবত ন্যাটোর পরিবর্ধন রোধে, ২০০৮ সালের আগস্টের রুশ-জর্জিয়া যুদ্ধের প্রভাব ছিল প্রথম প্রভাব। দ্বিতীয় প্রভাব ছিল ২০১৪ সালে ইউক্রেন সঙ্কট। এটা পরিষ্কার নয় যে, মানবতা কখন তার তৃতীয় প্রভাবটি ফেলবে।
পশ্চিম দেখেছে ন্যাটোর পরিবর্ধনের ক্ষতিকর দিক। এতে আশ্চর্যজনক কিছু ছিল না। রাশিয়া তার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্বের দক্ষিণে একটি বিশাল অংশজুড়ে আছে। বিশিষ্ট কিছু পশ্চিমা কণ্ঠ যেমন- রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আমেরিকান কূটনীতিক জর্জ কেনান শুরুতেই সর্তক করেছিলেন ন্যাটোর পরিবর্ধন একটি বেদনাদায়ক ভুল এবং তিনি এটা হোয়াইট হাউজের সিনিয়র মুখপাত্রকে লেখা খোলা চিঠিতে যোগ করে দিয়েছিলেন। হোয়াইট হাউজ এটাকে আখ্যায়িত করেছিল ঐতিহাসিক সমানুতার নীতিগত ত্রুটি।
বর্তমান সঙ্কটের উৎপত্তি মূলত ১৯৯১ সালে। স্নায়ুযুদ্ধ শেষে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়। তখন ইউরেশিয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এবং নিরাপত্তাব্যবস্থায় দু’টি বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সাকওয়ার ভাষায়, একটি ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে ‘বৃহত্তর ইউরোপ’ গঠন। শোনা যেত ঠিকই ‘ইউ’র সাথে তবে তার সখ্য ক্রমবর্ধমানভাবে ইউরো আটলান্টিক নিরাপত্তা ও তার রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের দিকে সমব্যাপ্ত ছিল। আরেক দিকে বৃহত্তর ইউরোপের যে আইডিয়া ছিল তখন তা ছিল মূলত মহাদেশীয় ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি। লিসবন থেকে ভøাদিভস্তক পর্যন্ত যে দাগ, তাতে ব্রাসেলস, মস্কো, আঙ্কারাসহ অনেক কেন্দ্র আছে। উদ্দেশ্য খুবই সাধারণ। বিদ্যমান বিভাজনগুলোকে জয় করা, যা দিয়ে ঐতিহ্যগতভাবেই মহাদেশ জর্জরিত।
সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ছিলেন ‘বৃহত্তর ইউরোপ’ ধারণার একজন অন্যতম প্রবক্তা, যাতে গ্যালিবাদ (ফ্রেঞ্চ নেতা গ্যালির মতবাদ) ও অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে ইউরোপের শিকড় মনে করা হতো। ১৯৯০ সালে যখন রাশিয়া আত্মবিধ্বংসী বাজারনীতির অধীনে ধসে পড়ে, এ দৃষ্টিভঙ্গি ম্লান হয়ে যায়। শুধু রাশিয়া হিসেবেই পূর্ণজীবন লাভ করে এবং ভøাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে বিশ্বমঞ্চে নতুন করে হারানো জায়গা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা শুরু করে। পুতিন তার সহযোগী দিমিত্রি মেদভেদেভকে সাথে নিয়ে বৃহত্তর ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে বারবার ভূরাজনৈতিক একীভূতকরণের জন্য আহ্বান করছেন। লিসবন থেকে ভøাদিভস্তক পর্যন্ত একটি প্রকৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব সৃষ্টির জন্য।
সাকওয়া উল্লেখ করেন, মার্জিতভাবে উপেক্ষা করলেও এ উদ্যোগ গণ্য হয়েছে আড়ালে আড়ালে কিছুটা চৌর্যবৃত্তির সাহায্যে বৃহত্তর রাশিয়া গঠনের উদ্যোগ হিসেবে এবং র্পূব আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে গজাল ঠুকে তার সুবিধাভোগ করার জন্য। যেমন স্নায়ুযুদ্ধের শুরুতে ভয় কাজ করত ইউরোপ বুঝি একটি তৃতীয় শক্তি হতে যাচ্ছে স্বাধীন ছোটখাটো সব পরাশক্তির সমন্বয়ে এবং শেষেরটির নিকটবর্তী হতে পারে। ( এ সংক্রান্ত আরো জানতে জার্মান রাজনীতিক উইলি ব্রান্টের সরলীকরণ ও অন্যান্য উদ্যোগ সম্পর্কে দেখতে পারেন)।
রাশিয়ার পতনে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া ছিল কীর্তন গাওয়ার অনুষ্ঠানের মতো। একটি ইতিহাসের সমাপ্তি এ সঙ্কেত দিচ্ছিল এটি পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয়। অন্তত রাশিয়া যদি প্রাক বিশ্বযুদ্ধ সময়ের অবস্থার দিকে ফিরত, আমি লিখে দিতে পারি রাশিয়া তাহলে পশ্চিমাদের অসৎ অর্থনৈতিক উপনিবেশ হয়ে যেত। আর তার সাথে সাথে ন্যাটোর পরির্বধন শুরু করা গর্বাচেভের মৌখিক প্রতিশ্রুতির খেলাপ। ‘ন্যাটো পূর্ব দিকে (পূর্ব জার্মানি) এক ইঞ্চিও আগাবে না।’ পরে একীভূত জামার্নিও ন্যাটোর সদস্য হয়। ইতিহাসের আলোকে এটি ছিল একটি অবিস্মরণীয় ছাড়। এ আলোচনা ধারণ হয়েছিল পূর্ব জার্মানিতে। হতে পারে ন্যাটো জার্মানি ছাড়িয়ে আরো প্রসারিত হওয়ার আগে গর্বাচেভের সাথে আলোচনা করে নেয়নি। এমনকি ব্যক্তিগতভাবে অভিমতও নেয়নি। হতে পারে।
শিগগিরই ন্যাটোর অধিকার রাশিয়া সীমান্তে প্রসারিত হওয়া শুরু করেছিল। ন্যাটো তার সাধারণ ব্রত বৈশ্বিক শক্তি পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, সামুদ্রিক পথ, পাইপলাইনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকভাবেই পরিবর্তন করে ফেলেছিল। বিশ্বজুড়েই অভিযান করেছিল। উপরন্তু, বর্তমানে ব্যাপকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা পুুনর্বিবেচনার অধীন ‘নিরাপত্তার জন্য দায়িত্ববোধ’সংবলিত হেরাল্ড মতবাদ পরিষ্কারভাবেই জাতিসঙ্ঘের আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। ন্যাটো বোধ হয় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি হস্তক্ষেপকারী বাহিনী হিসেবেই কাজ করছে।
রাশিয়ার বিশেষ উদ্বেগের কারণ ন্যাটো ইউক্রেনে বিস্তৃত হওয়ার পরিকল্পনা। ২০০৪ সালে এপ্রিলে বুখারেস্টে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে এ পরিকল্পনা স্পষ্টভাবেই উচ্চারিত হয়। যখন ইউক্রেন ও জর্জিয়া উভয়ে ন্যাটোর পরিণামগত সদস্য হওয়ার ওয়াদা করে, সে ওয়াদা দ্ব্যর্থহীন ছিল। ন্যাটো ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে স্বাগত জানায় ইউরো আটলান্টিক আকাক্সক্ষায় ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য। আমরা আজকে একমত এ দু’টি রাষ্ট্র ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য হতে যাচ্ছে। ২০০৪ সালে অরেঞ্জ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সমর্থনভুক্ত প্রার্থী জয়ী হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ড্যানিয়েল ফ্রায়েড বেশ ব্যস্ত সময় কাটান সেখানে। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছড়িয়ে দেন ইউক্রেনের ন্যাটোতে ও ইউরো আটলান্টিক আকাক্সক্ষায় যোগ দেয়ার ব্যাপারে। ফাঁস হওয়া উইকিলিকস রিপোর্ট তা-ই বলছে।
রাশিয়ার উদ্বেগ সহজেই বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠিত একটি সাময়িকীকে নেতৃত্ব দেয়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ জন মেয়ারশিমার তাদের একটি রূপরেখা তৈরি করেছেন। তিনি লিখেছেন, ইউক্রেন বিষয়ে বর্তমান সঙ্কটের মূল শিকড় ন্যাটোর সম্প্রসারণ ও ওয়াশিংটনের ইউক্রেনকে মস্কোর কক্ষপথ থেকে সরিয়ে পশ্চিমা বলয়ে জুড়ে দেয়ার অঙ্গীকার। যে বিষয়ে পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো এটা সরাসরি রাশিয়ার কোটিপতি স্বার্থের জন্য হুমকি।
মেয়ারশিমার প্রশ্ন করেন, কে তাকে (পুতিনকে) দোষারোপ করতে পারে? তিনি দেখলেন, ওয়াশিংটন রাশিয়ার এ অবস্থানকে পছন্দ করছেনা; কিন্তু এটা তো বুঝতে হবে এর পেছনের কারণটি কী। এটা বোঝা খুব কঠিন নয়। এটা তো সবাই জানে, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই পশ্চিম গোলার্ধের কোনো জায়গাতেই কোনো দূরবর্তী পরাশক্তির সামরিক বাহিনী মোতায়েন সহ্য করবে না। এখন এটা তার সীমানায় হোক বা দূরে কোথাও হোক।
মূলত বেশ দূর পর্যন্তই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শক্তিশালী। যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৮২৩ সালের মনরো মতবাদ অনুযায়ী ‘সফল অবাধ্যতা’ বলা হয় তা কখনোই যুক্তরাষ্ট্র সহ্য করবেনা, যা পুরো গোলার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করে। (অবশ্য এটি এখনো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি)। একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বিপর্যয়কর নিষেধাজ্ঞা নিয়েই এ সফল অবাধ্যতা করেই যাচ্ছে এবং যাকে পৃথিবীর ত্রাস বলা যায়। কিউবার কথা বলছি। আমাদের বলার দরকার নেই যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। যখন কানাডা আর মেক্সিকো ল্যাটিন আমেরিকার দেশ হওয়ার জন্য ওয়ারশ চুক্তিতে যোগদানের পরিকল্পনা করেছিল। এটা ছিল প্রথম পরীক্ষামূলক পদক্ষেপের গুরুত্বর্পূণ ইঙ্গিত, যা নির্দেশ করে সিআইএর চরম একচোখা নীতি বুলি বাতিল করতে।
চীনের ক্ষেত্রে যেমন, কারোই পুতিনের নড়াচড়া এবং উদ্দেশ্যগুলো ও তাদের পেছনের যুক্তিগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে বোঝার দরকার দরকার নেই। এই ইস্যুটিকে অভিশাপ দেয়ার পরিবর্তে এ যুক্তি বোঝাবুঝির ব্যাপারটাকে গুরুত্বের সাথে নেয়ারও কিছু নেই। চীনের ক্ষেত্রে, জীবনধারণ প্রশ্নে আক্ষরিক অর্থেই একটি বিশাল চুক্তির ঝুঁকি রয়েছে।
আজকের চ্যালেঞ্জ : ইসলামি বিশ্ব
এখন তৃতীয় বড় উদ্বেগের বিষয়ে দৃষ্টি ফেরানো যাক। (বিশাল) ইসলামি বিশ্ব বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের (জিডব্লিউওটি) দৃশ্যে অবশ্যম্ভাবীভাবেই আছে, ২০০১ সালের নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার পর প্রেসিডেন্ট র্জজ ডব্লিউ বুশ যা ঘোষণা করেছিলেন। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে পুনঃঘোষণা করেছিলেন। এই সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ মূলত প্রেসিডেন্ট রিগ্যান প্রসাশন কার্যভার গ্রহণের পর ঘোষণা করেছিলেন। জরাগ্রস্ত অলঙ্করণ দিয়ে। যেমন, ‘নচ্ছার প্রতিপক্ষের দ্বারা সভ্যতার বুকে মহামারী ছড়াচ্ছে’ এবং ‘আধুনিক যুগ বর্বরতায় ফিরে যাচ্ছে’ (এটা তার স্বরাষ্ট্র সচিব জর্জ শালজের কথা)। প্রকৃত সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। এটা খুব দ্রুতই হত্যাযজ্ঞ এবং বিধ্বংসী সন্ত্রাসী যুদ্ধে রূপ নিয়েছে; যা বর্তমানে হিংস্র প্রতিক্রিয়ার সাথে প্রতিফলিত হচ্ছে সেন্ট্রাল আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে। আন্তর্জাতিক আদালত দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্বের জন্য নিন্দা করা হয়েছে (অবশ্য একেও ওয়াশিংটন বরখাস্ত করে দিয়েছে)। যেকোনো অভিযানেই, ইতিহাসের জন্য এটি সঠিক গল্প নয়। তাই একে বিদায় দেয়া হয়েছে।
গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আলকায়েদা এবং আইসিস কিছুটা স্পষ্টতার সাথেই যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের গেমপ্লানই অনুসরণ করে। তাদের লক্ষ্য ‘যত গভীরভাবে এবং কার্যকরভাবে সম্ভব পশ্চিমাদের কর্দমাক্তভাবে চিত্রিত করো’। যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল এবং পশ্চিমাদের একের পর এক দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক পাশা খেলায় চিরস্থায়ীভাবে আবদ্ধ করে ফেলতে, যাতে তাদের সমাজ দুর্বল হয়ে পড়বে, ব্যয় হবে তাদের সম্পদ, বৃদ্ধি পাবে সহিংসতার মাত্রা এবং রুদ্ধ হবে গতিশীলতা। এটাই পকের বিশ্লেষণ।
স্কট অ্যাট্রন, জিহাদি আন্দোলনগুলোর ওপর অন্তর্ভেদি গবেষকেরা হিসাব করে দেখেছেন, নাইন-ইলেভেন হামলার খরচ অন্তত চার থেকে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার হবে, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের সামরিক ও নিরাপত্তা দায়িত্ব খরচ এই পরিমাণের বিন্যাসে দশ লাখবার হবে। খরচের পুঙ্খানুপুঙ্খ মুনাফার ভিত্তিতে এ সহিংস আন্দোলন ব্যাপকভাবে সফল এবং একইভাবে পরলোকগত বিন লাদেনের কল্পনাগুলোও ক্রমবর্ধমানভাবে সফল। এখানে জুজিৎসু স্টাইলের অপ্রতিসম যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রকৃত পরিমাপ নেই। এতসবের পরও, কে-ইবা দাবি করতে পারবে যে, আমরা আগের চেয়ে ভালো আছি! বা সব বিপদ আপদ কেটে গেছে!আর যদি আমরা হাতুড়ি-বাটালি থেরাপি অব্যাহত রাখি, অঘোষিতভাবে জিহাদি নীতিই অনুসরণ করতে থাকি, তাহলে এর প্রভাব হবে জিহাদি নীতির চেয়েও ভয়াবহ এবং আরো অনেকটা বৃহৎ পরিসরের। অ্যাট্রনের পরামর্শ, ‘আমাদের প্রতিকৌশল নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনয়নের জন্য অনুপ্রাণিত করা উচিত’।
আলকায়েদা বা আইসিস আমেরিকানদের দ্বারাই সহায়তাপ্রাপ্ত। উদাহরণস্বরূপ, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী টেড ক্রুজ (কার্পেট বোম, ইএম)। অথবা মূলধারার বর্ণনা শেষে অন্যান্যের বিষয়ে আসি। নেতৃস্থানীয় পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কলামিস্ট থমাস ফ্রায়েড ম্যান। যিনি ২০০৩ সালে চার্লি রোজ শোতে (জনপ্রিয় টিভি শো) ওয়াশিংটনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কিভাবে ইরাকে যুদ্ধ করতে হবে। সেখানে যা হচ্ছে আমি তাকে সন্ত্রাসবাদের বুঁদবুঁদ বলব... এবং যা করা প্রয়োজন ছিল তা হলো বিশ্বের ওই অংশে গিয়ে বুঁদবুঁদটাকে ফাটিয়ে ফেলা। মূলত আমাদের ওখানে যাওয়াটা প্রয়োজন ছিল। আর আহ! দরকার ছিল একটা বড় ছড়ি নিয়ে ঠিক ওই বিশ্বের হৃদয় বরাবর তাক করে বুঁদবুঁদটাকে বিস্ফোরিত করা। আর সেটা করার একটাই মাত্র উপায় ছিল... তাদের দেখা প্রয়োজন ছিল আমেরিকান ছেলেমেয়েরা বসরা থেকে বাগদাদ পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে এবং আসলেই বলছি, এ কথাগুলোর কোন অংশ আপনি বুঝতে পারেননি? আপনি কী চিন্তা করছেন না আমাদের মুক্ত সমাজ সম্পর্কে আমরা যত্নশীল হই? আপনি ভাবছেন এ বুঁদবুঁদ কল্পনাবিলাস? আমরা শুধু যাওয়ার জন্যই গিয়েছি? ভালো, আপনি এটাই গিলতে থাকুন। ঠিক আছে চার্লি, আপনিই বলুন, এ যুদ্ধ কী বিষয়ে ছিল! ওপরের সবগুলোই স্পষ্টভাবে আরবদের র্যাগিংয়ের শামিল।
সবাই উন্মুখ
অ্যাট্রন এবং অন্যান্য কাছাকাছি পর্যবেক্ষকেরা আমার এই ব্যবস্থাপত্রের ব্যাপারে সাধারণভাবে একমত। আমাদের উচিত এই যত্নশীল ও সতর্ক গবেষণাকে স্বীকৃতি দেয়া, যা গ্রহণযোগ্যভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। তারা জিহাদকে চিত্রিত করে থাকেন, তাদের শৌর্যবীর্য ও নৈতিকতার সাথে তাদের ইতিহাস ঐতিহ্যে কিছু করার জন্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামিক স্টেট আমাদের কাছে নিষ্ঠুর ও বেমানান। এমনকি আরব মুসলিম বিশ্বের বেশির ভাগ অংশই সরাসরি একই কথা বলেছে। কোন বিষাক্ত আততায়ী, কোন রোমাঞ্চ, গৌরব, প্রতিপত্তি, অপরের চোখে সম্মান পাওয়ার প্রতিশ্রুতি ছাড়াই তাদের এ কাজে উদ্বুদ্ধ করছে আজ? কুরআন তো মোটেই নয়। এমনকি খুব কম জিহাদিরই ইসলামি বা অন্য ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে।পক পরামর্শ দেন, সবচেয়ে ভালো কৌশল হলো একটি বহুজাতিক, কল্যাণভিত্তিক, মানসিক প্রশান্তিদায়ক বৈঠকের আয়োজন করা, যা ঘৃণ্য আইসিসকে ক্ষতিকর রূপ থেকে কমিয়ে বিশ্বাসীরূপে তৈরি করবে। উপাদানগুলো আমাদের কাছে শনাক্ত হয়ে গেছে : গোষ্ঠীগত চাহিদা, অতীতের কৃত অধর্মের ক্ষতিপূরণ এবং একটি নতুন শুভারম্ভের আহ্বান। পক আরো যোগ করেন, অতীত পাপের জন্য একটুখানি সতর্কতামূলক ক্ষমার্প্রাথনা- খুব সামান্যই খরচ হবে; কিন্তু দেবে অনেক। এ ধরনের প্রকল্প সম্পন্ন করা যেতে পারে শরণার্থী শিবিরগুলোয় অথবা প্যারিসের উপকণ্ঠে খুপরিগুলোয় এবং জঘন্য আবাসন প্রকল্পে। অ্যাট্রন লিখেছেন, তার গবেষক দল সুন্দর সুষ্ঠুভাবে বৃহৎ পরিসরের সমর্থন ও সহনশীলতা পেয়েছেন আইসিসের ব্যাপারে এবং প্রকৃত কূটনৈতিক নিষ্ঠা দিয়ে আরো বেশি কিছুও করা যেতে পারে। আত্মবিধ্বংসী সহিংসতার পথ অবলম্বনের পরিবর্তে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।তার মানে শুধু এই নয় যে, শরণার্থী সঙ্কটে সম্মানজনক পদক্ষেপ নেয়া। এটা অনেক দীর্ঘ সময় ধরেই এসেছে; কিন্তু ইউরোপে ঢেউ তুলেছে ২০১৫ সালে। এটার অর্থ দাঁড়ায়, যতটা সম্ভব খুব প্রবলভাবেই লেবানন, জর্ডান তুর্কির শরণার্থী শিবিরগুলোয় মানবিক ত্রাণতৎপরতা বৃদ্ধি করা। যেখানে সিরিয়ার দুস্থ শরণার্থীরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ সমস্যাগুলোকে ঝেড়ে ফেলে এগোতে হবে বহুদূর এবং আপন আলোয় উদ্ভাসিত চিত্র উৎপন্ন করতে হবে, যা এ মন্দ আকর্ষণ থেকে দূরে অবস্থান করবে এবং যা হবে একটি ‘আলোকিত ধরার’। সে লক্ষ্যেই কাজ করা উচিত।শরণার্থী উৎপন্নকারী দেশ, যেগুলো ব্যাপকভাবে মারাত্মক সহিংসতা ছড়াচ্ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয়ত ব্রিটেন ও ফ্রান্স। তারপর সেসব দেশ যারা অসংখ্য পরিমাণে শরণার্থী, পশ্চিমা সহিংসতার কারণে পালিয়ে আসা শরণার্থীসহ সবরকমের শরণার্থী গ্রহণ করেছে। যেমন লেবানন (মাথাপিছু হিসাবে অবধারিতভাবেই চ্যাম্পিয়ন), জর্ডান, সিরিয়া (অন্যান্য অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হওয়ার আগে) এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়া দেশগুলো। এরা প্রত্যেকেই শরণার্থী তৈরি করেছে এবং তাদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয় যুক্তরাষ্ট্রও দক্ষিণের সীমান্তে পিঠ দেখিয়েছে তাদের। গভীরভাবে ভাবার জন্য একটি বিস্ময়কর বেদনাদায়ক চিত্র!প্রকৃত চিত্র খুঁজে বের করতে হবে। শরণার্থী প্রজন্মের ইতিহাস অনেক পেছনের। বর্ষীয়ান মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি রবার্ট ফিস্ক রিপোর্ট করেন, আইসিসের তৈরি করা একদম প্রথম ভিডিও, যাতে দেখা যাচ্ছে ইরাক সিরিয়া সীমান্তে একটি মার্কেটকে বুলডোজার বালিতে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। যেভাবে মেশিনটি নোংরা পলেস্তারা ধ্বংস করল, ক্যামেরা নিচে এসে দেখাল বালুতে পরে থাকা একটি হাতে লেখা পোস্টার, যা বলছে ‘সাইকস-পিকট সমাপ্ত’।সে অঞ্চলের মানুষের জন্য সাইকস-পিকট চুক্তি, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের নৃশংসতার প্রতি খুব বড় প্রতীক এবং ঘৃণাপূর্ণ উক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গোপনে ষড়যন্ত্র করা ব্রিটেনের মার্ক সাইকস এবং ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া জর্জ পিকট তাদের সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য অর্জনে কৃত্রিম রাজ্যগুলোয় নিজস্ব অঞ্চল গঠন করে। সেখানে বসবাসরত মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে এবং যুদ্ধকালীন প্রতিশ্রুতিগুলোকে সহিংসভাবে লঙ্ঘন করে, আরবদের প্রণোদিত করে মিত্রবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য। এ চুক্তি ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যের অনুশীলনেরই প্রতিফলন। আফ্রিকাকে বিধ্বস্ত করা হয়েছে একইরকম পদ্ধতিতে, যা ছিল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত পুরোপুরি শান্ত, বরাবরই স্থিতিশীল একটি রাজ্য। তাকে রূপান্তরিত করা হয় বিশ্বের সব থেকে অস্থিতিশীল ও আন্তর্জাতিকভাবে বিস্ফোরণোন্মুখ একটি রাজ্যে।
তার পর যখন থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় পশ্চিমা হস্তক্ষেপ শুরু হয়েছে তখন থেকে সেখানে উত্তেজনা, সঙ্ঘাত, ভাঙন ঘটছে, যা সমাজগুলোকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। শেষে ফলাফল ‘শরণার্থী সঙ্কট’, যা নিষ্পাপ পশ্চিমারা মোটেই সহ্য করতে পারছে না। জার্মানি ইউরোপের বিবেক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সর্বপ্রথম (তবে এখন আন নয়) অন্তত এক লাখ শরণার্থী আশ্রয় দিয়ে। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অন্যতম একটি দেশ। আশি লাখ জনসংখ্যা। বিপরীত পক্ষে, গরিব দেশ লেবানন সিরিয়ার কমপক্ষে দেড় লাখ শরণার্থী নিয়েছে। বর্তমানে তার মোট জনসংখ্যার সিকি ভাগ হচ্ছে, জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ কর্তৃক নিবন্ধিত অর্ধ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থী। বেশির ভাগই ইসরায়েলি রাজনীতির শিকার।ইউরোপও বিধ্বস্ত আফ্রিকান দেশগুলোর শরণার্থীর চাপে রোদন করছে, যা তারাই করেছে এবং অবশ্যই মার্কিন সহায়তা ছাড়া নয়। আটলান্টিক মহাসাগরের কঙ্গো ও অ্যাঙ্গোলাসহ অন্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জনগণই তার সাক্ষী। ইউরোপ এখন চাইছে তুরস্ককে ঘুষ (দুই লাখের ওপর সিরিয়ান শরণার্থীর বিনিময়ে) দিতে। যারা সিরিয়ার বিভীষিকা থেকে পালিয়ে ইউরোপ সীমান্তে এসেছে, তাদের দূরে ঠেলে দিতে। শুধু ওবামা মেক্সিকোকে চাপ দিচ্ছে দুস্থ মানুষগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত খোলা রাখতে। চাইছেন প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের ‘জিডব্লিউওটি’-এর পরিণাম থেকে বের হতে। একই সাথে সাম্প্রতিক বিপর্যয়গুলো থেকেও বের হতে চাইছেন। এর মধ্যে হন্ডুরাসের সামরিক অভ্যুত্থানও শামিল। যাকে ওবামা শুধু এককভাবে বৈধতা দিয়েছেন, যা রাষ্ট্রটিকে অন্যতম একটি বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরী বানিয়েছে।সিরিয়ান শরণার্থী সঙ্কটে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের ওপরের কথাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারে। অন্তত আমি তাই মনে করি।
শুরুর প্রশ্নটিতে ফিরে যাই। ‘কে শাসন করবে বিশ্ব’? আমাদের অবশ্যই একই সাথে আরো একটি প্রশ্নও তোলা উচিত। ‘বিশ্ব শাসনের নীতি ও মূল্যায়ন কি হবে’? ধনী ও ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলোর প্রতিটি নাগরিকের অন্তরে এ প্রশ্নটিই সর্বাগ্রে আসা উচিত। যারা উত্তরাধিকার সূত্রে অবাধ স্বাধীনতা এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এবং এটাই সুযোগ পূর্ব পুরুষের সংগ্রামের জন্য তাদের ধন্যবাদ দেয়ার। এটাও ভেবে দেখা দরকার, তারা পছন্দের অপশনগুলোকে কিভাবে সামলাচ্ছে। যেমন বর্তমানে তারা মানুষ আমদানির বিশাল চ্যালেঞ্জে কিভাবে সাড়া দিচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন