বহুল আলোচিত রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির হোতাদের এখনও চিহ্নিত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)। বরং ঘটনাটিকে দিন দিন ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা চলছে। এদিকে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভে (ফেড) বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্ট থেকে খোয়া গেছে মোট ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার। এই অর্থ খোয়া যাওয়ার কথা শুরু থেকে অস্বীকার করে আসছে ফেড। তারা বলছেন,বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েই তারা অর্থ ছাড় করেছে। তাদের এই বক্তব্যে প্রমাণ করে ঘটনার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোক জড়িত। বিশেষজ্ঞরাও বলে আসছে বিতরের কেউ জড়িত। তা না হলে হ্যাকড করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ঘটনার সাথে দায়ীদের আড়াল করতে ফেড এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পিংপং খেলা খেলছে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এসব কথার গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো অর্থমন্ত্রী ফেডারেল রিজার্ভের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের রিজার্ভ (টাকা) যদি ফেডারেল রিজার্ভ থেকে চুরি বা হ্যাকড হয় তাহলে এর জন্য দায়ী হবে ফেড। আর যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনে তা উত্তেলন হয়ে থাকে তাহলে এর দায়ভার কোনভাবেই ফেড নিতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ফেডকে দায়ী না করে নিজেই খোয়া যাওয়া রিজার্ভ (টাকা) ফেরৎ পেলে ফায়ার আইকে নিযোগ দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ফিলিপাইন এবং শ্রীলংকার সাথে যোগাযোগ করছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন,ফেড থেকে টাকা চুরি বা হ্যাকড হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এত চিন্তা কেন। এতে বুঝা যায় এই ঘটনায় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনেই ফেড টাকা ছাড় করেছে এমন দলিল থাকার কারণেই তারা বলছেন,রিজার্ভ থেকে কোন টাকা হ্যাকড হয়নি। এধরনের কোন তথ্য তাদের জানা নেই।
তবে অর্থ লেনদেনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে টাকা আদান প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে। এরপর তারা ভিন্ন একাউন্টে অর্থ স্থানান্তরের জন্য নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংককে প্রায় ৩০টি অনুরোধ পাঠায়। এর মধ্যে চারটি অনুরোধে ৮১ কোটি ডলার ফিলিপাইনে এবং ২০ কোটি ডলার শ্রীলংকার একাউন্টে স্থানান্তরের অনুরোধ পাঠানো হয়।
পঞ্চম অনুরোধটি শ্রীলংকার একটি অলাভজনক এনজিও শালিকা ফাউন্ডেশনের একাউন্টে স্থানান্তর করতে বলা হয়। কিন্তু তারা ভুল করে শালিকা ফাউন্ডেশনের স্থলে লেখে শালিকা ফ্যান্ডেশন। ফলে অর্থ স্থানান্তরে যাচাইকারী অফিসার এর ক্ল্যারিফিকেশনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়। তখনেই ব্যাপারটা ধরা পড়ে, সাথে সাথে স্থানান্তরটি বন্ধ করা হয়। রয়টার্স খোঁজ নিয়ে জেনেছে, শ্রীলংকায় শালিকা ফাউন্ডেশন নামে কোনো নিবন্ধিত এনজিও নেই। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ঠিকানা বা ফোন/ইমেইলও পাওয়া যাচ্ছে না।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি এঘটনা ঘটলেও দীর্ঘ এক মাস পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়টি অর্থমন্ত্রীকে জানায় নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছেন তদন্তের স্বার্থে তারা অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টি জানায়নি। তাহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে অর্থমন্ত্রীকে তদন্তেকাজে প্রধান বাধা কিনা। তা না হলে কেন তাকে জানানো হল না। প্রকৃত বিষয় হলো ফিলিপাইনের সংবাদ মাধ্যম ‘ইনকোয়্যারার’র গত ৬ মার্চ সংখ্যায় এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তার পরে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় চলে আসে। গত ৭ মার্চ সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, পত্রিকার মাধ্যমে আমি বিষয়টি জেনেছি। আমার জানা মতে, সরকারের কোন মহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানানো হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্বনর ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, আমার ব্যাংক হিসাব থেকে যদি বড় অঙ্কের একটি চেক যায়, আমার স্বাক্ষর থাকলেও ব্যাংক কিন্তু আমার কাছে জানতে চাইবে যে আমি চেকটি দিয়েছি কি না। স্বাক্ষর মিললেও কিন্তু করে। একইভাবে আমাদের রিজার্ভের অর্থ যেসব ব্যাংকে রাখা আছে, সেখানে অস্বাভাবিক কোনো লেনদেন যদি হয় তাহলে তারা প্রথমে কোড পরীক্ষা করবে। কোড ঠিক থাকলে যদি টাকার পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে তারা জানতে চাইতে পারত। তিনি আরও বলেন,ভেতরের যুক্ততা ছাড়া হ্যাকিং সহজ নয়।
আমি স্বীকার করি এটা একটা বড় সমস্যা, তবে সংকট নয়। জাতীয় বিপর্যয়ও নয়। এখানে দেখতে হবে যে অর্থ স্থানান্তরটি কীভাবে হয়। রিজার্ভ জনসাধারণের সম্পদ। এর মালিক জনগণের পক্ষে সরকার। আর বাংলাদেশ ব্যাংক এর ব্যবস্থাপক মাত্র। অর্থাৎ ম্যানেজার। এমনভাবে ম্যানেজ করে যাতে আয় বাড়ে বলে মতামত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গর্বনর।
অর্থ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভাবশালী মহল ও একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত রয়েছে বলে মনে করে অর্থ মন্ত্রনালয়। এটা হ্যাকিংয়ের ঘটনা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন সুইফট কোড, কার্ড ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই পুরো লেনদেন হয়ে থাকার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে অর্থমন্ত্রণালয়।
বাইরের কারো কাছে এই তথ্য দিয়ে ঘটানো হয়েছে এই লেনদেন বলে মনে করছে অর্থমন্ত্রণলায়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এ বিষয়গুলোকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কাজ পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলে সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের এক জরুরি বৈঠক হয়েছে বুধবার।
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব ড. এম আসলাম আলমসহ অন্যান্য পরিচালকরা যোগ দেন। অর্থ কিভাবে গেল, কারা কারা জড়িত, বাংলাদেশ ব্যাংকের গাফিলতি বা দায়িত্বহীনতা আছে কি না, সরকারের বিভিন্ন মহলে জানানো হয়নি কেন, সর্বশেষ অবস্থা কি ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্বনরকে জিজ্ঞাসা করেছে পরিচালকরা।
সূত্র জানায়, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে পৃথিবীর সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লেনদেন করে সুইফট কোডের মাধ্যমে। কর্তৃপক্ষ এই সুইফট কোড লেনদেনের জন্য ঝুঁকিমুক্ত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন নির্দিষ্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করে। এই সফটওয়্যারটি হ্যাক হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। সফটওয়্যারটি ব্যবহার করতে হয় নির্দিষ্ট কোড, কার্ড ও সংকেতের মাধ্যমে। এই কোড দিয়ে তথ্য প্রেরণ করার পরেই পুরো তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পরিবর্তন হয়ে নতুন সাংকেতিক চিহ্নে রুপান্তরিত হয়। এভাবেই বদলাতে বদলাতে সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে রিসিভার কম্পিউটারে পৌঁছে যায়। রিসিভার কম্পিউটার পুনরায় সিঙ্কক্রোনাইজ হওয়া তথ্য প্রেরণকারী সার্ভারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তথ্য উদ্ধার করে। পুরো প্রক্রিয়াটা নিরাপদ হওয়ায় আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং চ্যানেলে সুইফট প্রক্রিয়াটি অর্থ লেনেদেনে সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এর বাইরেও নতুন লেনদেনের জন্য সর্বশেষ লেনদেনের একটি সাংকেতিক চিহ্ন দিতে হয়। যা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তিন সেকশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই জানেন।
জানা গেছে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্ষিত অর্থ হ্যাক করার কয়েক সপ্তাহ আগে হ্যাকাররা ব্যাংকের কম্পিউটার ব্যবস্থায় ম্যালওয়্যার ইনস্টল করে রেখেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে নিউইয়র্কে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ উত্তোলন করে, এই ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে তা নজরদারি করেছিল হ্যাকাররা। দুই ব্যাংক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, পুরো প্রক্রিয়াটি কিভাবে সম্পন্ন হয়েছে তা এখন খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা যাচাই-বাছাই করে দেখছে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে জানতে একাধিক বৈঠক করছেন দেশের সাইবার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সুইফট কোডের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করার সময় কিছু টার্ম এন্ড কন্ডিশন থাকে। কিছু লিগ্যাল বিষয় আছে। আমরা পুরো প্রক্রিয়াটা খতিয়ে দেখব। তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছে কিনা তাও দেখা হচ্ছে। তা দেখেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
এ ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত থাকতে পারে এমনটা ধরে নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকের ১০ কর্মকর্তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। তাদের উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি পেলে তাদের জিজ্ঞেস করবেন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা।
উল্লেখ্য নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভে বিশ্বের ২৫০টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকার ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বৈদেশিক একাউন্ট আছে। ফেডের এ রিজার্ভে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগার ও বিভিন্ন এজেন্সি ঋণের অর্থ সঞ্চিত থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন