সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রায়হান রশিদ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকেরা ২৩ বছর বয়সী রায়হানের সুস্থ হওয়া নিয়ে সংশয়ে আছেন। ব্যবস্থাপত্র ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র দেখিয়ে তাঁরা বলেছেন, রায়হানের চিকিৎসায় ১১ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি অকার্যকর।
আইসিইউতে ভর্তি আছে ২১ জন রোগী। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এদের অর্ধেকের ক্ষেত্রে কোনো না-কোনো অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর দেখা গেছে। সমস্যাটি চিকিৎসকদের কাছে পরিচিত ও উদ্বেগের। অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগ থেকে প্রকাশিত জার্নাল অব দ্য বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলোজিস্ট ২০১৪ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় দেখা যায়, এখানে চিকিৎসা নিতে আসা গড়ে ৩৮ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর বলে পরীক্ষায় ধরা পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার ও নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। মুড়িমুড়কি আর অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেই। বলা যায়, একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও ক্ষুদ্র পরজীবী ওষুধের ক্রিয়ার প্রতিরোধ গড়ে টিকে থাকতে চায়। মানসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক না হলে, অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা সঠিক না হলে, সেবনের মেয়াদ পূর্ণ না হলে জীবাণুগুলো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। একসময় অ্যান্টিবায়োটিকে ওই জীবাণু আর মরে না। জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে দাঁড়ায়।
সহজে কেনা যায়: সাদা কাগজে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, অ্যাজিথ, সেফ্রেড ও অ্যামিক্সিল—এই চারটি অ্যান্টিবায়োটিকের নাম লিখে রাজধানীর শাহবাগের ওষুধ বাজারে কিনতে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র না হলেও দোকানি ওষুধ বিক্রি করছেন। আটটি দোকানে গিয়ে এই প্রতিবেদকের একই অভিজ্ঞতা হয়েছে।
রাজধানীর ১০০টি ফার্মেসির ওপর করা বিএসএমএমইউর ‘ডিসপেনসিং প্যাটার্ন অব অ্যান্টিবায়োটিকস বাই মেডিসিন সেলারস ইন ঢাকা সিটি: ইফেক্ট অব ইন্টারভেনশন’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে সব দোকানই ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করে। অথচ বিএসএমএমইউর ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করার নিয়ম নেই। দোকানি এটা মানছেন কি না, তা নজরদারি করার কেউ নেই।
পরিস্থিতি: প্রভাবশালী জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট-এর ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর সংখ্যায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী শিশুস্বাস্থ্যের যে উন্নতি দেখা দিয়েছে তা হুমকির মুখে পড়েছে ক্রমান্বয়ে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ার কারণে। বছরে কমপক্ষে ২ লাখ ১৪ হাজার নবজাতকের সেপসিসে মৃত্যু হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার কারণে।
বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক বিষয়ে জাতীয়ভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিএসএমএমইউ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে যেসব জরিপ ও গবেষণা করেছে তার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন পরিস্থিতি ভয়াবহ।
অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ এই কারণে যে গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি আইসিইউতে আসা ২৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। সারা দেশের পরিস্থিতি আমরা জানি না। জানার ব্যবস্থা নেই। ভয়াবহতার অন্য কারণ হচ্ছে, দেশের প্রায় ৬০ হাজার চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন অনুমানের ওপর ভিত্তি করে, প্রয়োজন নিশ্চিত না হয়েই। প্রায় দুই লাখ ওষুধের দোকানি ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করছেন। আর অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে অসংখ্য রোগী অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করছেন।’
পরিণতি: ল্যানসেট বলছে ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমণজনিত চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ক্রমান্বয়ে অকার্যকর হওয়ার পরিণতিতে বেশি মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হচ্ছে, মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিমাণ বাড়ছে, হাসপাতালে ভর্তির প্রবণতা বাড়ছে এবং তৃতীয় বা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেবা বেশি প্রয়োজন হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে যেখানে পয়োব্যবস্থাপনা এবং জনস্বাস্থ্য সেবা দুর্বল সেখানে পরিণতি আরও খারাপ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রথম প্রভাব পড়ে চিকিৎসা খরচে। পুরোনো ও সস্তা অ্যান্টিবায়োটিকের পরিবর্তে চিকিৎসার জন্য রোগীরা বাজারে আসা নতুন ও বেশি দামি অ্যান্টিবায়োটিক কেনেন। অন্যদিকে ‘রেসপন্স রেট’ কমে যাওয়া বা ক্রমান্বয়ে অকার্যকর হওয়ার কারণে রোগীকে বেশি দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। এতে খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি উপার্জন বা কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসবের আর্থিক মূল্যও অনেক বেশি।
দেশে কে কী করছে: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা এ ব্যাপারে একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছে। রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক আবুল খায়ের মোহাম্মদ শামছুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ কী, অকার্যকারিতা কী, এর প্রভাব কী এবং করণীয় বিষয়ে দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের সচেতন করা হচ্ছে। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের স্পর্শকাতরতা নির্ণয়ে সরকারি হাসপাতালের টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, এটা নিশ্চিত করতে হবে যে চিকিৎসকেরা ব্যবস্থাপত্রে জেনে-বুঝে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের নাম লিখবেন, অনুমান করে লিখবেন না। একই সঙ্গে চিকিৎসকের দায়িত্ব হবে ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার সময় রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারবিধি বুঝিয়ে দেওয়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন