সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

হজরত সোলায়মান ও ফয়েরবাখ ধর্মের পর্যালোচনা ও বাংলাদেশে ইসলাম-৭


হেগেলের দর্শনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে লুদভিগ ফয়েরবাখ তাঁর একটি লেখা জার্মান ভাবাদর্শের সঙ্গে প্রাচ্য চিন্তার ফারাক বা বৈপরীত্যের উল্লেখ করে শুরু করেছেন (দেখুন Towards A Critique of Hegel’s Philosoph)। ফয়েরবাখ শুরু করছেন এভাবে যে, জার্মান ভাবাদর্শীরা হজরত সোলায়মানের প্রজ্ঞার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছেন। কোন অর্থে?

হজরত সোলায়মান আ:-এর প্রজ্ঞার গল্প কমবেশি আমাদের সকলেরই জানা। দুই মহিলা একই সন্তানের মা হিসাবে নিজেদের দাবি করছে। কেউই তার মীমাংসা করতে পারছেন না। এই বিরোধের মীমাংসার জন্য তারা হজরত সোলায়মানের দরবারে হাজির। তারা তাদের নিজ নিজ দাবির পক্ষে জোরালো দাবি হাজির করল। খুব গোলমেলে মামলা। সাক্ষীসাবুদ কিম্বা আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার দ্বারা এই মামলার নিষ্পত্তি অসম্ভব। তথ্য, প্রমাণ ও যুক্তি সবকিছুই যেখানে ব্যর্থ, সেখানেই প্রজ্ঞার সার্বভৌম প্রতিভা প্রদর্শন করবার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই প্রতিভাকে আমরা সাধারণত ‘উপস্থিত বুদ্ধি’ বলে থাকি। অর্থাৎ উপস্থিত পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য বুদ্ধির প্রচলিত নিয়ম বা অভ্যাসের বাইরে এসে সিদ্ধান্ত দেওয়া। এই অর্থেই সার্বভৌম। বুদ্ধি যখন প্রজ্ঞার চরিত্র ধারণ করে তখন তার কারবার তথ্য, প্রমাণ, সাক্ষীসাবুদ, যুক্তিতর্ক ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল নয়। তার উৎপত্তি পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের তাৎক্ষণিক কিন্তু সামগ্রিক উপলব্ধির মধ্যে। দুইজন মহিলা নিজেদের একই সন্তানের মা বলে দাবি করছে; তাদের উভয়ের পক্ষের প্রমাণ, যুক্তি, সাক্ষী সবই আছে। এটা বিশেষ এক পরিস্থিতি। দুইজন মহিলা তো একসঙ্গে মা হতে পারে না। সেটা যুক্তির কথা। কিন্তু যুক্তিটি বিশেষ পরিস্থিতিতে খাটছে না। কিভাবে তাহলে পয়গম্বর সোলায়মান তার মীমাংসা করলেন?
হজরত সোলায়মান নির্বিকার এক রায় দিলেন। যেহেতু সাক্ষীসাবুদে যুক্তিতর্কে বোঝা যাচ্ছে, দুজনেই ‘সঠিক’, তাহলে কী আর করা, শিশুটিকে ভাগ করে দুইজনকে দিয়ে দেওয়া হোক। যিনি সন্তানটির আসল মা নন, এই রায়ে তাঁকে বিশেষ বিচলিত দেখা গেল না। কিন্তু আসল মা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, আমার সন্তানের দরকার নাই। ঐ মহিলাকেই শিশুটি দিয়ে দেওয়া হোক। বলাবাহুল্য, মা কোনো ভাবেই তাঁর সন্তানকে দুই টুকরা করা হোক, তা চাইতে পারেন না। হজরত সোলায়মান নিজেও শিশুটিকে দুই টুকরা করা হোক, তা চাননি। কিন্তু ইনসাফ নিশ্চিত করার জন্য মাতৃত্বের প্রমাণ তাঁর দরকার। শিশুর জন্ম দেবার প্রমাণ কিম্বা সাক্ষীসাবুদের ওপর নির্ভর করবার উপায় এখানে অনুপস্থিত। আগাম অনুমান করলেন, যিনি আসলেই মা, তিনি কোনোভাবেই নিজের সন্তানকে দুই টুকরা হতে দেবেন না। দুই মহিলার মধ্যে কে আসল মা, তা নির্ধারণের জন্য তিনি তৎক্ষণাৎ যে কৌশল খাটালেন, সেই প্রয়োগের সাফল্যই প্রজ্ঞার রূপ বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। হজরত সোলায়মান উপস্থিত বুদ্ধি দিয়েই নির্ধারণ করলেন, শিশুটির মা আসলে কে। এটাই ‘সোলায়মানি প্রজ্ঞা’ নামে পরিচিত। প্রাচ্যে যেমন, পাশ্চাত্যেও। এই সোলায়মানি প্রজ্ঞা সত্য নির্ণয়ের প্রচলিত পদ্ধতি যুক্তি, সাক্ষী কিম্বা তথাকথিত প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল নয়। সোলায়মানি প্রজ্ঞা আসলে প্রত্যক্ষবাদ ও যুক্তিবাদ, উভয়েরই পর্যালোচনা বটে। উভয়ের সীমা নির্ধারক। ফয়েরবাখ বলছেন, ‘জার্মান ভাবাদর্শ সোলায়মানি প্রজ্ঞার সরাসরি বিপরীত।’ অর্থাৎ বিশেষ পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বুঝতে ও তা বিচার করতে অক্ষম। বিভিন্ন বস্তু, বিষয় বা ঘটনার সাধারণ চরিত্র বুঝতে গিয়ে আমরা যদি তাদের বিশেষত্ব বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলি বা ভুলে যাই, তাহলে এ কারণে যে বিমূর্ত চিন্তার অভ্যাস গড়ে ওঠে, তা থেকে নিস্তার পাওয়া সহজ নয়। এই বিমূর্ত চিন্তার অভ্যাস সোলায়মানি প্রজ্ঞার সঙ্গে মেলে না। হজরত সোলায়মান জমির মালিকানার দাবি মীমাংসা করছেন না, করছেন সন্তানের মালিকানার দাবি। দুটিই মালিকানার দাবি, এটা তাদের সাধারণ দিক। কিন্তু জমি আর সন্তান এক নয়। জার্মান ভাবাদর্শীরা দর্শনকে বিমূর্ত চিন্তাচর্চার এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছেন, যেখানে তাদের পক্ষে বিশেষ আর সামান্যের ফারাক বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। 

সোলায়মানি প্রজ্ঞা বলতে ফয়েরবাখ আরো কিছু বুঝিয়েছেন। হজরত সোলায়মান ফয়েরবাখের কাছে প্রাচ্য চিন্তার প্রতিনিধি। এর বিপরীতে রয়েছে পাশ্চাত্যের ভাবাদর্শ, বিশেষভাবে হেগেল। এই ক্ষেত্রে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের চিন্তাপদ্ধতির পার্থক্য কী? প্রাচ্য চিন্তার দৃষ্টিতে সূর্যের নিচে বা এই দুনিয়ায় এমন কিছুই দেখা যায় না যা নতুন; বিপরীতে, পাশ্চাত্য মনে করে সূর্যের নিচে এমন কিছুই দেখবার নাই যা নতুন নয়। প্রাচ্যের মানুষ (Oriental Man) সবকিছুর মধ্যে ঐক্য আবিষ্কার করতে গিয়ে তাদের পার্থক্য বা বিভিন্নতার কথা ভুলে যায়, সবকিছুর মধ্যেই নির্বিশেষ পরম বিরাজ করেন- এই ব্রহ্মচিন্তায় নিমগ্ন থাকতে গিয়ে বিশেষকে প্রাচ্য ভুলে যায়; পরমের চিন্তায় প্রাচ্য সদাই চিন্তিত। বিপরীত দিকে, পাশ্চাত্যের মানুষ (Occidental Man) পার্থক্যের প্রতি মনোযোগী হতে গিয়ে নির্বিশেষ বা ঐক্যের ক্ষেত্রটির কথা ভুলে যায়। তাদের মধ্যে মিলের জায়গাগুলো আর ঠাহর করতে পারে না। 

ফয়েরবাখ মনে করেন, জার্মান দর্শনে শেলিং (Friedrich Wilhelm Joseph Schelling ১৭৭৬-১৮৫৪) প্রাচ্যের চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তার ঝোঁক ছিল প্রাচ্যের দিকে। এটা জার্মান দর্শনের দিক থেকে বেশ ভিনদেশীয় প্রবণতা। জার্মান জমিতে অন্য জিনিস। কিন্তু হেগেল তার বিপরীত। তিনি পাশ্চাত্যের, কিন্তু শেলিংয়ের বিপরীতে বিচার করলে তাঁর দর্শনের মধ্যে প্রাচ্যকে হেয় করবার উপাদানও আছে। হেগেলের বিরুদ্ধে ফয়েরবাখের এই অভিযোগ গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে ধর্মবিরোধিতা কিম্বা নাস্তিকতা সত্ত্বেও সবকিছু ছাপিয়ে ফয়েরবাখ আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হয়ে ওঠেন। জার্মান ভাবাদর্শের দিক থেকে ফয়েরবাখের হেগেল পর্যালোচনার তাৎপর্য আর প্রাচ্যের পরিমণ্ডলে, বাংলাদেশ যার বাইরে নয়, ফয়েরবাখ, ঠিক একইভাবে বিচার্য নয়। 

প্রাচ্যের পারমার্থিক ঐক্যের চিন্তার তুলনায় হেগেলের দর্শনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পার্থক্য। অর্থাৎ হেগেলের পার্থক্যের বিচার গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন- প্রকৃতির বৈচিত্র্য, বিভিন্নতা ও বিভিন্ন প্রত্যক্ষ সত্তার পারস্পরিক ফারাক। কিন্তু তারপরও হেগেল তাঁর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাঁর প্রকৃতিসংক্রান্ত দর্শন মেরুদণ্ডহীন প্রাণী আর শামুকজাতীয় জীবের পার্থক্য নির্ণয়ের অধিক অগ্রসর হতে পারেনি। এই স্তর থেকে হেগেল কীটপতঙ্গের স্তরে আমাদের নিতে পেরেছেন বটে, কিন্তু অত দূরই। হেগেল যে স্পিরিটের কথা বলেন তা অবশ্যই লজিক্যাল আর নির্ণায়ক, কিন্তু ফয়েরবাখ ঠাট্টা করে বলছেন ‘পতঙ্গসুলভও বটে’। পতঙ্গের যেমন শরীর বাঁধাছাদা না, শরীরের নানান দিক নানানভাবে ফোলা, যেন মূল শরীর থেকে কিছু কিছু অংশ বেরিয়ে আসতে চাইছে। হেগেলের দর্শনও এইরকম।

হেগেলের দর্শনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে ফয়েরবাখ এভাবেই আরম্ভ করেছেন। ফয়েরবাখের আপত্তিটা হেগেলের ইতিহাস সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে। ফয়েরবাখ বলছেন, ‘হেগেল হচ্ছেন এমন এক স্পিরিট, যে তার বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছে এমন এক শরীর, যার মধ্যে এ দিক সে দিক বের হয়ে থাকা বিস্তর অঙ্গপ্রতঙ্গ রয়েছে, আর রয়েছে গভীর সব গর্ত আর কাটাদাগ। হেগেল যখন ইতিহাস বিবেচনা করেন, তখনই তার স্পিরিটের এই চেহারাটা ধরা পড়ে। বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন, সময় ও মানুষের মধ্যে প্রকট পার্থক্য পর্যায়ে পর্যায়ে হেগেল বিচার করেন, কিন্তু তাদের মধ্যে যা কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যা কিছু এক- তাকে তিনি উপেক্ষা করেন।’ 

ইতিহাস সম্পর্কে হেগেলের ধারণার সমালোচনা করতে গিয়ে ফয়েরবাখ বলছেন, ‘হেগেলের ধারণা ও পদ্ধতির ধরনের মধ্যে মুশকিল হচ্ছে এটা একান্তই সময়কেন্দ্রিক, সহনশীল দৈশিকতা এখানে অনুপস্থিত : তাঁর পদ্ধতি শুধু অধীনস্থকরণ ও ধারাবাহিকতা নির্ণয় করা জানে, সমন্বয় ও পাশাপাশি বসবাস জানে না। আর এটা তো নিশ্চিত যে, হেগেলের ইতিহাসের শেষ পর্যায় হচ্ছে, একটি সামগ্রিক বিকাশ, যার মধ্যে ইতিহাসের সকল পর্যায়ই অন্তর্গত। কিন্তু এই শেষ পর্যায়ের অস্তিত্বও যেহেতু কালের দ্বারা নির্ণীত, অতএব তা বিশেষের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এই পর্যায়ের মধ্যে অন্যান্য অস্তিত্বকে তাদের স্বাধীন সত্তার মজ্জা শুষে না নিয়ে এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন থেকে নিজেদের যে অর্থ তারা জ্ঞাপন করে, তা ডাকাতি করে শূন্য না করে দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।’

হেগেলের বিরুদ্ধে ফয়েরবাখের এই পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ। সারমর্মে হেগেলের ইতিহাস-ধারণা সম্পর্কে ফয়েরবাখের নিরীক্ষণ অসাধারণ। হেগেলের ইতিহাস-ধারণা সময়কেন্দ্রিক, ওর মধ্যে স্থানিকতার বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য নেই। সেই ইতিহাসে দেশ বা দৈশিকতার কোনো স্থান নেই। দেশ মানে জায়গা বা স্থান। একই জায়গায় বিচিত্র ও বিভিন্ন জিনিস একসঙ্গে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে পাশাপাশি থাকতে পারে। কিন্তু হেগেলের ইতিহাস যেহেতু সময়সর্বস্ব, অন্য দিকে সবকিছুই তিনি তার ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করেন, পর্যায়মূলক সেই অন্তর্ভুক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম বা বিষয়ের পাশাপাশি থাকবার কোনো জায়গা হেগেল রাখেননি। অতএব হেগেলের মধ্যে স্থানিক সহনশীলতা নেই। তিনি স্থানের প্রতি সংবেদনশীল বা সহনশীল নন। 

হেগেল যখন ধর্মের ইতিহাস লেখেন, তখন তিনি ধর্মের ঐতিহাসিক বিবর্তন কিভাবে ঘটেছে, তা হাজির করেন। সেটা দেখাতে গিয়ে তিনি একটি পর্যায়ের ধর্মচিন্তা কী করে তার পরবর্তী পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তার আগের পর্যায়কে নাকচ করছে, তা দেখান। এভাবেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ধর্মকে হেগেল ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। একপর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ের বিবর্তন হিসাবে দেখালেন। তিনি দেখাতে চান মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও ভারতের বিভিন্ন ধর্ম, যেমন- জৈন, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ইত্যাদি খ্রিস্ট ধর্মের তুলনায় চিন্তার ইতিহাসে আগের পর্যায়ের ধর্ম। সেটা দেখাতে গিয়ে, ধর্মগুলোকে খ্রিস্ট ধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করবার দিক থেকেই ব্যাখ্যা করেন। হেগেলীয় ইতিহাসের সিঁড়ির নিচের সিঁড়িতে তাদের স্থান। তাদের হাড়মজ্জা সেই উদ্দেশ্যেই হেগেল বের করে এনে তাকে খ্রিস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য সাজালেন। এর ফলে প্রতিটি ধর্মের যে স্বাধীন ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সত্তা ও তার তাৎপর্য রয়েছে, তা নিরর্থক হয়ে যায়। ফয়েরবাখের বক্তব্য হচ্ছে, যদি হেগেল স্থানিকতার গুরুত্ব দিতেন তাহলে তারা কিভাবে বিশেষ কালে বিশেষ অর্থ নিয়ে বিশেষ স্থানে হাজির রয়েছে তার পূর্ণ মর্ম বোঝা যেত। এখন হেগেলের সর্বগ্রাসী ইতিহাসের মধ্যে তারা খ্রিস্ট ধর্মের ন্যায্যতা প্রতিপাদনের কজে ব্যবহৃত হয়েছে। 

ধর্মের ইতিহাসকে চিন্তার বিবর্তন হিসাবে বোঝার ক্ষেত্রে ফয়েরবাখের আপত্তি নাই। কিন্তু আপত্তি হচ্ছে, বিবর্তন বা বিকাশের উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হতে গিয়ে তাদের নিজের নিজের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলাকে ফয়েরবাখ মেনে নেননি। 

হেগেল দাবি করেন, প্রকৃতি যেভাবে পুরাতনকে নাকচ করে নতুনের আবির্ভাব ঘটায়, তিনি তাঁর ইতিহাসের দর্শনে সেটাই দেখিয়েছেন। হেগেল প্রকৃতির অনুকরণ করছেন। এই অনুকরণে ফয়েরবাখের আপত্তি নাই। হয়তো হেগেল তাই করছেন। কিন্তু ফয়েরবাখের নালিশ হোল, এটা করতে গিয়ে হেগেল সপ্রাণতা বিসর্জন দিচ্ছেন। জীবন তাঁর কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। মেনে নেওয়া যাক, প্রকৃতি মানুষকে জন্তুর ওপর আধিপত্য খাটানোর ক্ষমতা দিয়েছে। মানুষের হাতে জন্তু পোষ মানে। কিন্তু প্রকৃতি শুধু জন্তুকে পোষ মানাবার জন্য মানুষকে হাত দেয়নি; একই সঙ্গে চোখ আর কানও দিয়েছে যাতে জন্তুর মহিমা মানুষ উপলব্ধি করতে পারে। মানুষ যদি জন্তুর এই মহিমার দিক পর্যবেক্ষণ করতে শেখে তাহলে জীবজগতের চেয়ে মানুষ শ্রেষ্ঠ, এই দাবি মানুষ করবে না। কিন্তু হেগেলের ইতিহাসের দর্শন অনুযায়ী বিবর্তন বা ইতিহাসের সিঁড়ির শেষ বা ‘পরম’ প্রান্তে আছে মানুষ। অতএব মানুষের আগের সিঁড়ির সকল প্রাণীর জীবন চরিতার্থ হয়েছে একমাত্র মানুষের মধ্যে। হেগেলের অ্যাবসলিউট বা পরমের ধারণাও এই প্রকার ঐতিহাসিক ধারণা। চিন্তার সর্বোচ্চ বিকাশের পর্যায় হচ্ছে, চিন্তার এই পারমার্থিক পর্যায়। চিন্তার অন্যান্য মুহূর্তকে পরমের বেদিতে বলি দিয়ে হেগেল এই বিভিন্ন চিন্তার নিজস্ব বা স্বাধীন বৈশিষ্ট্যকে উপেক্ষা করেছেন, এমনকি হেয় করেছেন। অন্য সকল ধর্মচিন্তা খ্রিস্ট ধর্মের আবির্ভাবের পরে নিম্ন পর্যায়ে পরিণত হয়েছে, এই দাবি অন্য ধর্মকে হেয় করা অবশ্যই। 

ফয়েরবাখ বলছেন, শিল্পকলার প্রতি মানুষের আকর্ষণ আরেকটি উদাহরণ। আমরা জন্তুকে মাল টানাটানিতে কিম্বা অন্য কোনো পরিশ্রমের কাজে খাটাই। কিন্তু একই সঙ্গে তাদের ছবিও আঁকি; ঘোড়া, খরগোশ, সিংহ, ইত্যাদি। শিল্পের চোখ দিয়ে আমরা যখন জীবজগৎকে দেখি, তখন তার সংবেদনা গরুকে গাড়ি টানবার কাজে ব্যবহার করার চেয়ে আলাদা। ফয়েরবাখ প্রশ্ন তুলেছেন ঈশপের গল্পে প্রাণীগুলো শিশুদের সঙ্গে কথা বলে, তাতেই বোঝা যায় প্রাণীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ধরণ স্রেফ বিবর্তনের ইতিহাসে পর্যবসিত করা যাবে না। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি, কিন্তু নিজেদের পোষা প্রাণীর ওপর আস্থা তো কমে না। 

তাহলে জীবজগৎকে বিবর্তনের সিঁড়ির নিচের সিঁড়িতে রাখবার যে বিবর্তনমূলক, ঐতিহাসিক কিম্বা সময়কেন্দ্রিক চিন্তা, তার বাইরেও প্রকৃতি মানুষকে ভিন্ন সংবেদনা চর্চার ক্ষমতা দিয়েছে। হেগেল ‘পরম’কে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বুদ্ধি বা বিশুদ্ধ চিন্তাশীলতার বাইরে মানুষের অপরাপর সংবেদনাকে যেভাবে উপেক্ষা করেছেন বা এড়িয়ে গিয়েছেন, ফয়েরবাখ তা মানতে রাজি নন। হেগেল প্রকৃতির প্রাকৃতিকতারই অনুকরণ করছেন, হেগেলের এই দাবিও ফয়েরবাখ নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ, তিনি প্রকৃতিকে, অর্থাৎ প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে একপেশেভাবে বুঝেছেন। ‘প্রকৃতি’, ফয়েরবাখ বলছেন, ‘সততই সময়ের রাজতান্ত্রিক প্রবণতার সঙ্গে দৈশিকতার ঔদার্যকে মেশায়।’ 

‘প্রকৃতি সততই সময়ের রাজতান্ত্রিক প্রবণতার সঙ্গে দৈশিকতার ঔদার্যকে মেশায়।’ ফয়েরবাখের এই মন্তব্যটি দারুণ। প্রকৃতির দিকে তাকালে আমরা তো আসলেই দেখি, ফুল পাতাকে নাকচ করছে। অর্থাৎ পাতার যদি কোনো সত্য থাকে তাহলে তার পরমার্থ ফুলে, ফুল ফোটানোর আনন্দে, এটাই হেগেল বলেছেন। ফয়েরবাখ তা অস্বীকার করছেন না। সেটা সময়ের দিক থেকে বিবেচনা। অর্থাৎ সময়মতো ফুলগাছে ফুল না ফুটলে গাছেরই বা সার্থকতা কোথায়? যদি আমরা সময় বা ইতিহাসকেই বিচারের মানদণ্ড ধরি, তাহলে সময়কেন্দ্রিক চিন্তা আমাদের এই সিদ্ধান্তেই নেবে। কিন্তু ফয়েরবাখ বলছেন, সেই বিচার অসম্পূর্ণ। কারণ, আমরা পর্যালোচনার মানদণ্ড থেকে দেশ, জায়গা বা স্থানকে বাদ দিচ্ছি। যেখানে একই সময় কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন বস্তু বা বিষয় বিরাজ করতে পারে। ফুলের উদাহরণই দেয়া যাক। যদি গাছে শুধু ‘ফুল’ থাকত আর পাতা সব পড়ে যেত, সেই ন্যাংটা গাছকে কি আমরা আর গাছ বলতাম? গাছ তো ফুলের পাশাপাশি পাতাকে ধারণ করেই গাছ হয়েছে। কিম্বা ফুল ফোটার পর আর কিছু নাই, মাটিতে পড়ে আছে এক বিশাল ফুল। আমরা গাছ, ফুল, পাতাকে এভাবে দেখি বা উপলব্ধি করি। একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা দখল করে গাছ, ফুল, পাতা, কাণ্ড ইত্যাদি অবশ্যই বিরাজ করতে পারে। দেশ, স্থান বা জায়গার উদারতা বিশাল; সময়ের মতো দেশ বা দৈশিকতার আচরণ রাজতান্ত্রিক বা রাজসিক নয়। তাহলে এটা ঠিক নয় যে, পাতার পরমার্থ কিম্বা গাছের পরমার্থ শুধু ফুল। হেগেলের দার্শনিক চিন্তা ও ইতিহাস সময়-কেন্দ্রিক ধারণার দ্বারা প্রকটভাবে প্রভাবিত বলে ফুলের স্থানে পাতা বা গাছের কথা তিনি আর মনে রাখেন না। হেগেলের চিন্তা প্রকৃতির অনুকরণ করে, অর্থাৎ প্রকৃতি তার একটি রূপ নাকচ করে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়; প্রকৃতির এই দ্বান্দ্বিকতা ফয়েরবাখের মেনে নিতে অসুবিধা নাই। মেনে নিয়েও ফয়েরবাখ স্পষ্টভাবে বলছেন, প্রকৃতির এই দ্বান্দ্বিকতার ধারণা দেশ বা দৈশিকতার কথা বেমালুম ভুলে যায়। এই ভুলে যাওয়া সময়সর্বস্ব ধারণার কুফল। অতএব, তা অসম্পূর্ণ। প্রকৃতি বা ইতিহাস বিচারের ক্ষেত্রে দেশ বা দৈশিকতার গুরুত্বের ওপর জোর দিতে হবে। আমরা শুধু সময়ে বা ইতিহাসে বাস করি না। একই সময়ে নানান বাস্তবতা, নানান জীবন ও নানান ধরণের চিন্তা নিয়েও বাস করি। হেগেলের ‘অ্যাবসলিউট’ বা পরমের ধারণা হেগেলের সময় সংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে যুক্ত। চিন্তাপদার্থই ইতিহাসের কর্তা হয়ে নিজের স্ববিরোধ বা দ্বন্দ্ব নিজে মীমাংসা করতে করতে একদিন পরমের রূপ পরিগ্রহণ করবে, পরম বা অ্যাবসলিউট হয়ে উঠবে; যার আগে বা পরে আর কোনো সত্য থাকবে না। সেটাই হবে জগৎ ও ইতিহাসের পরমার্থ। সময়কেন্দ্রিক ইতিহাস-চিন্তার বিরুদ্ধে ফয়েরবাখের এই পর্যালোচনা তাঁর সময়ে রীতিমতো কামান দাগিয়ে দিয়েছিল। 

এখানে বলে রাখি, হেগেলের ইতিহাস কিম্বা প্রকৃতির বিবর্তনের এই সমালোচনা একই সঙ্গে অ্যাঙ্গেলসের ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ (Dialectics of Nature) সংক্রান্ত চিন্তাপদ্ধতিরও সমালোচনা। ইতোমধ্যে দর্শনে সময়সর্বস্ব চিন্তা ও চিন্তার অভ্যাসের বিস্তর সমালোচনা ও পর্যালোচনা দর্শনে হয়েছে। কিন্তু আমরা ফয়েরবাখের ওপর বিশেষভাবে জোর দিচ্ছি এ কারণে যে, মার্কস ফয়েরবাখের কাছ থেকে চিন্তার যে সূত্রগুলো ধারণ করেছেন এবং যার মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের চিন্তার বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটিয়েছেন, তার ভূমিকা ফয়েরবাখীয় নাস্তিকতার মধ্যে একদমই নয়, বরং ফয়েরবাখ সমাজ (দেশ), ইতিহাস (সময়) ও ইতিহাসের কর্তাশক্তি (পাত্র) নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মার্কসের চিন্তাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিলেন এবং মার্কসের চিন্তার অভিমুখ নির্দিষ্ট করবার ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিলেন, আমরা তা বুঝতে চাই। মার্কস ‘পুঁজি’র ধারণা নির্মাণ ও পুঁজির চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কিভাবে দেশ, কাল ও পাত্র নিয়ে ভেবেছেন এবং তাঁর পর্যালোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন, দর্শনের দিক থেকে তা বোঝা, উপলব্ধি ও পর্যালোচনা আগামি দিনের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ধারণের জন্য জরুরি। 

একই সঙ্গে আমরা দার্শনিক নাস্তিকতার গৌরব ও মহিমার দিকটির সঙ্গে বাংলাদেশে পরিচিত হতে চাই; যাতে নাস্তিকতা, মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার নামে বাংলাদেশে ধর্ম, বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে যে সঙ্ঘবদ্ধ রাজনৈতিক তৎপরতা চলছে, আমরা তা নির্দ্বিধায় মোকাবিলা করতে পারি। 



৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫। ২২ ভাদ্র ১৪২২। আরশিনগর।
www.facebook.com/farhadmazhar2009

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন