সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৫

নফি ও এজবাত ধর্মের পর্যালোচনা ও বাংলাদেশে ইসলাম-৫

[বহুবছর ধরে আমি একটি কথা বারবার বলে আসছি, ধর্মের পর্যালোচনা ছাড়া সক্রিয় চিন্তার স্বভাব এবং গৌরব সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি কিম্বা ধারণা কোনটিই হবে না। কেন বলি, এখানে সে সম্পর্কে দুই-একটি কথা বলব। কিন্তু বিষয়টি এত বড় পরিসরের যে, দুই-এক কিস্তিতে তা পেশ করা কঠিন। তাই বেশ কয়েকটি কিস্তিতে কথাগুলো পেশ করবার চেষ্টা করব। দৈনিক পত্রিকার পাতায় এ ধরনের আলোচনা প্রশস্ত নয়। তবে আমি বাংলাদেশে রাজনীতি সচেতন সেইসব পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে চাইছি যাঁরা মনে করেন ধর্ম- বিশেষত ইসলাম প্রশ্নের মীমাংসার ওপর বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অভিমুখ সঠিকভাবে নির্ণয় করা নির্ভর করে। দৈনিক পত্রিকায় তত্ত্ববাহুল্যের উপদ্রব ঘটিয়ে থাকলে মেহেরবানি করে সদয় পাঠক আমার গোস্তাখি ক্ষমার চোখে দেখবেন- ফম]

আমাদের আলোচনার জন্য লুদভিগ ফয়েরবাখ গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান কারণ, ধর্মের বিষয় আর দর্শনের বিষয় একই, হেগেলের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হেগেলের বিরুদ্ধে ফয়েরবাখের নালিশের জায়গাগুলো আমাদের বোঝা দরকার। হেগেলের এই দাবির ওপর দাঁড়িয়েই আমরা আমাদের আলোচনা শুরু করেছি। এখনও অবধি সেখানে দাঁড়িয়েই আমরা ধর্ম-পর্যালোচনার অর্থ বোঝার চেষ্টা করছি। সেই দিক থেকে ধর্মের বিরুদ্ধে ফয়েরবাখের আপত্তির চরিত্র এবং ‘ফয়েরবাখীয় নাস্তিকতা’র বৈশিষ্ট্য বোঝা আমাদের আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 

বাংলাদেশে ‘মুক্তবুদ্ধি’, ‘মুক্তচিন্তা’ ইত্যাদি নামে নাস্তিকতার যে ধারা আমরা দেখি তার চরিত্র ধর্মবিদ্বেষী, বালখিল্য ও যারপরনাই মূর্খতার ফল। ফলে নাস্তিকতা মানেই ধর্মবিদ্বেষ, ধর্মবিশ্বাসীদের অপমানিত করা, নবী-রাসূলদের নিয়ে কুৎসিতভাবে লেখালেখি করা, শ্রীকৃষ্ণকে লম্পট প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকা, শ্রীমতী রাধার পরকীয়া নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে পড়া, যীশুর জন্ম নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নাস্তিকতা সম্বন্ধে এই ধরনের ধারণাই গড়ে উঠেছে। বলাবাহুল্য এগুলো বিরক্তিকর ও দুঃখজনক। এর রাজনৈতিক ও সামাজিক কুফল আছে। যার লক্ষণ হিংসা, হত্যা ও ক্ষমতাসীনদের অন্ধকার রাজনীতির নোংরা কাদায় খাবি খাওয়ার মধ্যে আমরা দেখছি। 

কিন্তু দর্শনের দিক থেকে এই ধরনের ধারণা বদ্ধমূল হওয়াও বিপজ্জনকও বটে। কারণ নাস্তি বা বিদ্যমান বিষয়কে ‘না’ বলা, বর্তমানকে নির্বিচারে মেনে না নিয়ে আগামীর স্বপ্ন দেখা, এমনকি আল্লাহ, ঈশ্বর, কুরআন, হাদিস বা বেদ-উপনিষদ, বাইবেল, ত্রিপিটক ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তোলা চিন্তার জগতের বাইরের কিছু নয়। যে অনুমান থেকে চিন্তা শুরু করে তার সত্যতার প্রতি নেতিবাচক অবস্থান ছাড়া কোন চিন্তাই শুরু হতে পারে না। নাস্তিকতার মুহূর্ত সজীব ও সক্রিয় চিন্তার আন্তরিক মুহূর্ত, নেতির মধ্য দিয়ে ইতিবাচকতা নির্মাণ। হেগেল চিন্তাকে একটি প্রক্রিয়া আকারে দেখতে গিয়ে দেখিয়েছেন চিন্তা কিভাবে তার নেতিবাচক অবস্থান অতিক্রম করে ইতিবাচক অবস্থায় পৌঁছায়, কিন্তু পৌঁছাবার পর সেই সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া চিন্তা ভুলে যায় না। যে নেতিবাচক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে চিন্তা পরিণত হয়ে উঠেছে, সেই গতিপথ চিন্তা মনে রাখে। নাস্তিকতা যদি চিন্তার স্বভাবে না থাকত, তাহলে জগৎকে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ হিসাবে যেভাবে আমরা দেখতাম বা উপলব্ধি করতাম তার বেশি জগৎ নিয়ে আমরা ভাবতে পারতাম না। বিদ্যমান ও ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ জগতের বাইরেও আরেক সত্য আছে। তাঁকে যে আল্লাহ, ঈশ্বর, গড, প্রভু যে নামই দেই না কেন, তাঁকে প্রত্যক্ষের সত্য অস্বীকার না করে নির্ণয় করা অসম্ভব। কেন এই নাস্তিকতা সজীব ও সক্রিয় চিন্তার জন্য জরুরি সেটা তথাকথিত ‘নাস্তিক’ কিম্বা ‘বিশ্বাসী’ দুইয়ের কেউই আর মনে রাখে না। প্রত্যক্ষবাদী, যারা প্রিতিক্ষের সত্য মানতে রাজি, কিন্তু আল্লাহকে অস্বীকার করে, তারা নাস্তিকতার এক পক্ষে দাঁড়ায়। আর তাদের বিপরীতে দাঁড়ায় সেই সকল বিমূর্ত বিশ্বাসী, যারা আল্লাহ বা পরমের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রত্যক্ষকে অস্বীকার করে। ইসলাম এই দুটো ধারাকেই নাকচ করেছে বহু বহু বছর আগে। আল্লাহ ছাড়া তাঁর সৃষ্টির কোন অর্থ নির্ণয় যেমন অসম্ভব, ঠিক তেমনি সৃষ্টির সত্য অস্বীকার করে স্রষ্টার সত্য উপলব্ধিও অসম্ভব। তাহলে বাংলাদেশের নাস্তিক বা নাস্তিকতার সঙ্গে আমরা যেন দার্শনিক নাস্তিকতা কিম্বা দার্শনিক অর্থে নাস্তিকদের গুলিয়ে না ফেলি। 

নাস্তিকতার নামে ঘোরতর ইসলামবিদ্বেষীদের অন্তঃসারশূন্য চিন্তা, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নামে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে পাশ্চাত্য পরাশক্তির পক্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরির তর্কের সঙ্গে আমরা যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি তার সঙ্গে কোন যোগই নাই। বাংলাদেশে ধর্মবিদ্বেষীদের নাস্তিকতা আসলে রাজনৈতিক ইস্যু। যে কারণে আমরা আগেই বলেছি, রাজনৈতিক দুশমনদের মোকাবিলা রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। সেই রাজনীতির আলোচনা আমরা এখানে করছি না। সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এই লেখাগুলো পাঠের সময় আমাদের তা মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশে ধর্মবিদ্বেষীদের মোকাবিলার বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের সমাজ এড়াতে পারে না। তার রূপ কী দাঁড়াবে তা বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতিই নির্ধারণ করে দেবে। তার পরিণতিও আমরা আগাম বলতে পারব না। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে এই মোকাবিলার কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু দর্শনে মুক্তচিন্তার নামে বালখিল্য তর্কের স্থান নাই। ফয়েরবাখের নাস্তিকতা দর্শনের নাস্তিকতা, তাকে দর্শনের জায়গা থেকে বুঝতে হবে। এর উৎপত্তি পাশ্চাত্য দর্শনে, বিশেষত জর্মন ভাবাদর্শের পরিমণ্ডলে। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের ভেতর থেকে তাকে বোঝাই আমাদের লক্ষ্য। ইসলাম যদি নিজেকে চিন্তার ক্ষেত্রে বিপ্লব হিসাবে গণ্য করে এবং মানবেতিহাসে সেভাবে হাজির হতে চায়, তাহলে দেশকালপাত্র-ভেদে চিন্তার বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে তার দার্শনিক ন্যায্যতা ও অনিবার্যতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সেই দিক থেকে দার্শনিক নাস্তিকতাকে দর্শনের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়েই মোকাবিলার হিম্মত ইসলামকে অর্জন করতে হবে। 

ফয়েরবাখের প্রতি আমাদের আগ্রহ তাঁর দার্শনিক নাস্তিকতার জন্য, যা দিয়ে তিনি জর্মন ভাবাদর্শের রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়েছিলেন এবং কার্ল মার্কসের আবির্ভাব নিশ্চিত করে তুলেছিলেন। দেশকালপাত্র-ভেদে দর্শনের পরিমণ্ডলে নাস্তিকতার বিভিন্ন রূপ ও ধরণ কিম্বা সুনির্দিষ্টভাবে ফয়েরবাখের নাস্তিকতা মোকাবিলা করবার আগে নাস্তিকতা বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামের দার্শনিক অবস্থান কী হতে পারে সে সম্পর্কে খানিক আন্দাজ থাকা জরুরি। অন্তত কিছু আগাম অনুমান জারি না রাখলে পাশ্চাত্য নাস্তিকতার বিচার আমাদের জন্য ফলপ্রসূ হবে না। 

ইসলামপন্থি ও ইসলামবিদ্বেষী উভয়ের মধ্যেই একটি প্রবল বিশ্বাস জারি যে ইসলাম মানেই নাস্তিকবিদ্বেষী বা ঘোরতরভাবে নাস্তিকতাবিরোধী ধর্ম। এই ধারণা ইসলামি চিন্তাচেতনায় এমনকি প্রাজ্ঞ আলেম-ওলামাদের মধ্যেও কেন দানা বেঁধেছে সেটা এক বিস্ময় বটে। এ নিয়ে ভিন্ন গবেষণার দরকার আছে। অথচ নাস্তিকতা একান্তই ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের সমস্যা। মোটেও ইসলামের ঈমান-আকিদা কিম্বা দার্শনিক সমস্যা নয়। ইসলাম ঘোরতরভাবে যার বিরোধী তা হচ্ছে শেরেকি, নাস্তিকতা নয়। অর্থাৎ যিনি নিরন্তর গায়েব এবং দেশকালের অতীত বা দেশকালের বাইরে, তাঁকে বস্তুজ্ঞানে ‘আছে’ কিম্বা ‘নাই’ হিসাবে বিচার করার ঘোর বিরোধী ইসলাম। শুধু তাই নয়, এই এক ও অদ্বৈতকে কোন কিছুর সঙ্গেই তুলনা করা ইসলাম বরদাশত করে না। যে কারণে আল্লাহকে বুদ্ধির বিষয় বা বুদ্ধির নির্ণয়ে পর্যবসিত করাও ইসলাম শেরেকি হিসাবে বিবেচনা করবে। 

আল্লাহ নাই, এটা ইসলামের দিক থেকে মূর্খতা বা বেয়াদবি, কিন্তু বিরাট কোন অপরাধ নয়। কারণ আল্লাহ যে আকাশ, বাতাস, গাছপালা, পাথর, পাহাড় ইত্যাকার কোন বস্তু বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ সত্য হিসাবে ‘নাই’ এটা কোন নতুন কথা না। উপলব্ধির স্তরভেদে মানুষ এই অজ্ঞানতা কাটিয়ে উঠতে পারে, নিজের আত্মবিকাশ নিজেই ঘটাতে পারে। তবে শেরেকি কাটিয়ে উঠতে হলে চিন্তার পদ্ধতির মধ্যে পরিবর্তন আনা জরুরি। ইসলামের দাবি এখানে। নাস্তিকতা তখনই শেরেকি হয়ে ওঠে যখন আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুর তুলনা নিষিদ্ধ করার কথা বললেও অর্থাৎ চিন্তাকে এই স্তরে অধঃপতিত না করার জন্য কঠোরভাবে সাবধান করা সত্ত্বেও আর দশটা বস্তুকে আমরা যেভাবে ‘আছে’ কিম্বা ‘নাই’ বলি, আল্লাহকেও সেই সকল বস্তুর মতোই দেশকালে হাজির একটি সত্তা গণ্য করে ‘আছে’ কিম্বা ‘নাই’য়ের তর্কে জড়িয়ে পড়ি। খেয়াল করতে হবে, নাস্তিক ও আস্তিক উভয়েই এই ভুল করে। অর্থাৎ শেরেকি শুধু নাস্তিকদের সমস্যা নয়, আস্তিকদেরও অজ্ঞানতা। শেরেকি সম্পর্কে ইসলামের এই অবস্থান জানার পরও আল্লাহকে বস্তু হিসাবে গণ্য করার এবং তিনি সামনে না থাকলেও আসমানে কোথাও বস্তুর মতোই আসীন আছেন, এই ধারণা ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যেও প্রবল। চিন্তার এই সাধারণ স্তর অতিক্রম করা আসলে কঠিন। যে কারণে ইসলাম শেরেকির প্রতি যতোটা কঠোর নাস্তিকতার প্রতি ততটা নয়। আল্লাহকে বস্তুজ্ঞান করে বস্তু হিসাবে জগতে আবিষ্কার করতে না পারার মধ্যে অজ্ঞানতা বা জাহেলি আছে, কিন্তু সেটা শেরেকির অপরাধের তুলনায় গৌণ। 

দর্শনের ভাষায় ইসলাম ‘আল্লাহ’ নামচিহ্নে যাঁর দিকে রুকু নির্ণয় করে বা তার চিন্তা, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, সংকল্প, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদিকে ধাবিত করে; তিনি নিরন্তর গায়েব বা অনুপস্থিত। ফলে বস্তুজ্ঞান করে তাঁর সত্তা সম্পর্কে ‘আছে’ বা ‘নাই’ বলা যায় না। এতে আল্লাহকে বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। যারা তা করে, তারা আদতে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়, কারণ শেরেকি ইসলামে ঘোরতরভাবে নিষিদ্ধ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ বস্তু বা চিন্তা, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, সংকল্প, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদির ‘বিষয়’ হিসাবে এই গায়েবকে পর্যবসিত করাও ইসলামের দিক থেকে কুফরি বা অজ্ঞানতা। 

কিন্তু সজীব ও সক্রিয় চিন্তার পদ্ধতি হিসাবে ইসলাম নেতি বা না-বাচক মুহূর্তকে অস্বীকার করে না। এটা আমরা বুঝব কালেমার বিচার করলে। ইসলামের কালেমা শুরু হয় নাস্তির ঘোষণা দিয়ে। অর্থাৎ ‘লা ইলাহা’ বা আল্লাহ নাই, এই ঘোষণার মাধ্যমে। কারণ নাস্তি বা ‘নাফি’ ছাড়া ‘এজবাত’ হয় না, অর্থাৎ এরপর ইল্লাল্লাহ বলবার শর্ত তৈরি হয় না। যেসব বস্তু বা বিষয় এ যাবৎকাল ‘আছে’ বলে জানি বা জেনে এসেছি, এরা যে কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর সমতুল্য নয়, সেই নেতিবাচক ঘোষণার মধ্য দিয়েই ইসলামের ঈমান নিজের রুকু নির্ধারণ বা নির্ণয় করে। এ কারণে প্রথাগত অর্থে আমরা ধর্মে বিশ্বাস বলতে যা বুঝি, ইসলামে ঈমান ধারণাটিকে সেভাবে অনুবাদ করা যায় না। দর্শনের দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ ‘আছে’ গণ্য করে ইসলাম আরম্ভ করে না, কোন কিছুই তাঁর সমতুল্য বা তাঁর সঙ্গে তুলনীয় নয়, সেই নিখিল নাস্তির ঘোষণা দিয়ে শুরু করে। এতকাল মানুষের ইতিহাস ‘আল্লাহ’ নামচিহ্নের অধীনে সে সকল সত্তা বা বিষয়কে ভেবেছে, এই নিখিল নাস্তি তা অস্বীকার শুরু করে। ‘আল্লাহ নাই, কিন্তু আছে’ এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসলাম যে আল্লাহর এজবাত করে, তাঁকে বর্তমান করে তোলার চিন্তা ও রাজনীতি হাজির করে মানুষের চিন্তা তা পুরোপুরি বুঝেছে বা আত্মস্থ করেছে কি না একালের দর্শনের দিক থেকে তা গভীর ও গুরুতর প্রশ্ন। পাশ্চাত্যে ধর্ম ও চিন্তার ইতিহাসের আরম্ভ আস্তিকতায়, কিন্তু পরিণতি নাস্তি বা নাস্তিকতায়। ইসলামের শুরু নাস্তিকতায়, ‘আছে’ বা ‘আছি’ বলে আমরা যেভাবে জীবন ও জগৎকে বুঝি, তাকে প্রশ্ন বা অস্বীকার করে তার আরম্ভ, অথচ ইসলাম যা কায়েম করতে চায় তা হচ্ছে তৌহিদ বা সেই সর্বব্যাপী বর্তমানতা, যিনি নিরন্তর গায়েব হয়েও সর্বত্র ও সর্বকালে হাজির : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। অতএব নাস্তিকতার ঘোষণা ইসলামের জন্য জরুরি। কিন্তু বোঝার দিকটা অন্যত্র। যে ঘোষণার শুরু নাস্তিকতায়, তার অভিমুখ বা রুকু আল্লাহর প্রতি, অর্থাৎ আস্তিকতায়। পাশ্চাত্যের শুরু তার বিপরীতে। তার শুরু আস্তিকতায়, কিন্তু তার পরিসমাপ্তি ঘটছে নাস্তিকতায়। পাশ্চাত্য ‘আছে’ বা ‘আছি’ কথাটির অর্থ বোঝার জন্য দর্শনে এখন পেরেশান হয়ে যাচ্ছে। কালেমার সংক্ষিপ্ত ভাবটুকু বুঝতে পারলে সজীব ও সক্রিয় চিন্তার অভিমুখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগামী দিনে ইসলামের নির্ধারক ভূমিকা সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ আমরা করতে পারব। যে কারণে ইসলামকে নাস্তিকতা সম্পর্কে লেকচার দিয়ে কোন লাভ নাই। 

আল্লাহ দেশকালের অধীন কোন ধারণা নয়, ফলে বস্তুর মতো তিনি অস্তিত্বমান নন। তিনি সর্বদাই গায়েব অথচ তিনি ‘নাই’ হয়েও- নিরন্তর মানুষের কাছে গায়েব থেকেও- আছেন। এটা কী করে সম্ভব? সম্ভব এ কারণে যে, বস্তুর ‘আছে’ গুণ যে কারণে দেশকালের অধীন বস্তুর গুণ হিসাবে আমরা ব্যবহার করি, তেমনি ‘নাই’ কথাটাও দেশকালাধীন বস্তুর অনুপস্থিতি ব্যক্ত করবার জন্যই আমরা বলি। তাই তিনি গায়েব বললে আমরা তাঁকে বস্তুজ্ঞান করে ‘নাই’ বলে ভাবতে শুরু করি। অর্থাৎ গায়েব থেকেও কিভাবে বিরাজ করেন, কিভাবে বর্তমান থাকেন; সেটা সহজে বুঝতে পারি না। তাঁর বিরাজমানতা বা বর্তমানতা তৌহিদের ধারণার সঙ্গে যুক্ত। এতোটুকু আমরা বুঝতে পারছি যে আল্লাহকে বস্তু গণ্য করবার ভুল করি বলেই তাঁর সম্পর্কে ‘আছে’ বা ‘নাই’য়ের তর্ক আমরা তুলি। ইসলামে আস্তিকতা/নাস্তিকতার তর্ক এত সরল নয়। এই জাহেলি বা অজ্ঞতা নিয়ে ইসলামের আল্লাহকে বোঝা অসম্ভবই বটে। এই অজ্ঞতা সম্পর্কেই ফকির লালন শাহের বিখ্যাত একটি পদ রয়েছে। তিনি বলছেন : 
‘নফি এজবাত যে জানে না
মিছেরে তার পড়াশোনা
লালন কয় ভেদ উপাসনা
না জেনে চটকে মারে।’ 
যারা প্রথমে ‘লা ইলাহা’ এবং পরে ‘ইল্লাল্লাহ’ বলবার ভেদ বোঝে না কিম্বা এই পার্থক্য নিরূপণের মর্ম বোঝে না, তারা ধর্মের নামে চটকদারি করে বেড়ায়। আছে ও নাইয়ের ভেদবিচার ছাড়া আল্লাহকে বোঝা অসম্ভব। যারা এই ভেদবিচার করতে অক্ষম, তারা আল্লাহর কিতাব পড়ে কী করবে? তারা তো কুরআনুল কারিম পড়ে কিছুই বুঝবে না। ধর্মের পর্যালোচনা আমাদের চিন্তার নতুন দিগন্ত রেখা উন্মোচনে সহায়ক হবে আশা করা যায়। 

ফয়েরবাখের নাস্তিকতা নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে নফি ও এজবাত সম্পর্কে এই ভূমিকাটুকু জরুরি ছিল। এরপর আমরা বিচার করব ফয়েরবাখের পর পাশ্চাত্যে নাস্তিকতা কিম্বা আস্তিকতার প্রতি দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গির কোন গুণগত পরিবর্তন ঘটল কি না। দর্শন যদি ধর্মের বিষয় নিয়েই কারবার করে, তাহলে এটা অনুমান করা যায় যে, হেগেলের দিক থেকে ধর্ম-পর্যালোচনার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ধর্মের বিষয়কে দর্শনে আত্মস্থ ও মোকাবিলা করা। ফয়েরবাখের প্রধান নালিশ এখানেই যে, হেগেল ধর্মকে চিন্তার গৌরবটুকু দিতে গিয়ে দর্শনকে ধর্মে পরিণত করে ফেলেছেন। পাশ্চাত্যের এই তর্ক বিবেচনার মধ্যে আনা আমাদের জন্য জরুরি। প্রথমত, ধর্মের বিষয় আর দর্শনের বিষয় একই, হেগেলের এই দাবির প্রতি আমাদের সায় আছে। কিন্তু হেগেল কথাটি যেভাবে বলেছেন, সেটা যেমন আমাদের বুঝতে হবে, তেমনি তার পর্যালোচনাও আমরা করব। নইলে ইসলাম প্রসঙ্গে আমাদের পর্যালোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে। হেগেলকে ফয়েরবাখ যেভাবে সমালোচনা করেছেন, তার ফলে ইসলামের দার্শনিক পাঠ আমাদের নতুন কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে কি না, সেই দিকটাও আমরা আরো সতর্কভাবে বিবেচনা করব। এর মধ্য দিয়ে চিন্তার বৈশ্বিক দিগন্তের বাইরে নয়, কিম্বা প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্য চিন্তার অনড় বাইনারি বা নিত্য বিরোধ অনুমান করে নয়, বরং মানুষের স্বভাব হিসাবে যে চিন্তার শক্তি আমাদের সবার মধ্যে বিরাজ করে, চিন্তার সেই দিগন্তের অভ্যন্তর থেকেই ইসলাম নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনার অভিমুখ নির্দেশ করা আমাদের জন্য সহজ হবে। আগামী বিশ্ব ইতিহাস নির্মাণে ইসলামের আদৌ যদি কোন হিম্মত থেকে থাকে তাহলে বিশ্বব্যাপী চিন্তার বিদ্যমান অবস্থা, তার সংকট ও স্ববিরোধিতা অতিক্রম করে যাবার সম্ভাবনা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আমরা তা আগাম আন্দাজ করতে পারব। 
২৩ অগাস্ট ২০১৫। ৮ ভাদ্র ১৪২২। শ্যামলী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন