শনিবার, ২৭ জুন, ২০১৫

ঢাকা-দিলি্ল ২২ চুক্তির গোলক-ধাঁধা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ২২ চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে গোলকধাঁধা। সরকার সমর্থকরা বলছেন, এসব চুক্তির বাস্তবায়নে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সূচিত হবে নতুন অধ্যায়। উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগে নবদিগন্তের উন্মোচন হবে, যা বিনিয়োগ-বাণিজ্যের জন্য নজিরবিহীন মাত্রায় সুযোগ সৃষ্টি করবে। 


অন্যদিকে বিরোধীরা বলছেন, ২২ চুক্তিতে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ নেই। বরং এর মধ্য দিয়ে গোটা দেশকে ভারতের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে; চলছে নানা ষড়যন্ত্র। দু'পক্ষের এ ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আর চুক্তি প্রকাশ নিয়ে সরকারের নানা টালবাহানায় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চরম উদ্বিগ্নতা; দেখা দিয়েছে নানামুখী সংশয়। বিশেষ করে দু'পক্ষের কেউই তাদের দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা উপস্থাপন না করায় গোটা বিষয়টি আরো 'জটিল' হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে ২২ চুক্তির আদ্যপান্ত জনসম্মুখে দ্রুত প্রকাশ করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 


তাদের ভাষ্য, এসব চুক্তিতে কী আছে, দেশের মানুষ তা জানার অধিকার রাখে। এমনকি এ ব্যাপারে জনগণের প্রতিক্রিয়াও সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া জরুরি। তা না হলে এ নিয়েও বিভিন্ন মহলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।


সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মোদি তার সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মোট ২২টি চুক্তি স্বাক্ষর করে গেছেন। কিন্তু এই ২২টি চুক্তি কতটুকু দেশের স্বার্থ রক্ষা করে করা হচ্ছে, সে বিষয়ে দেশ ও জনগণ অন্ধকারে। কারণ ক্ষমতাসীন ও সাবেক ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। আর এক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পরোক্ষভাবে হলেও নিজেদের অভিভাবক হিসেবে গণ্য করছে। তাই তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের এ সুযোগ ভারত নিতেই পারে। 
এদিকে কূটনীতিকরা বলছেন, দিলি্ল ও ঢাকার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারকগুলো থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, যেসব চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে আপাতদৃষ্টে সেগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের চেয়ে ভারত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের ভূমি ও সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে ভারত লাভবান হোক, কিন্তু সেই লাভের অংশ যেন বাংলাদেশও পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। 
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সমঝোতা স্মারক ও চুক্তিগুলো খুবই ইতিবাচক। কিন্তু এগুলোর আলোকে পরিকল্পিত বিনিয়োগ করতে হবে, প্রকল্প ঠিক করতে হবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। তার মতে, 'বাংলাদেশের বন্দর, সড়ক, নৌপথ বা অন্য কোনো সুবিধা ব্যবহারের জন্য মাশুলের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য হার রয়েছে। সেই অনুযায়ী মাশুল নিতে পারলে আমরা লাভবান হব।'



কূটনীতিকদের ধারণা, অভ্যন্তরীণ নৌ ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকল (নবায়ন) চুক্তি সই হলেও এর বড় সুবিধা পাবে ভারত। কেননা এখন পর্যন্ত এই ট্রানজিট মূলত ভারতই ব্যবহার করছে। তাই ভারতের দায়িত্ব নৌপরিবহনের উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো। তবে সে আশা কতটা পূরণ হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে। 



এদিকে, সীমান্ত চুক্তির মধ্য দিয়ে সীমান্তের সব সমস্যা সমাধানের আশা নেই বলে মন্তব্য করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সীমান্তে অর্থনৈতিক কর্মকা- নেই বলেই ওই এলাকা অপরাধপ্রবণ। এছাড়া শুধু বাংলাদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে ভারতের সীমান্ত এলাকায় বিপুলসংখ্যক ফেনসিডিলের কারখানা গড়ে ওঠায় চোরাচালান জমে উঠেছে, যা অপরাধ কর্মকা-কে বিস্তৃত করছে। 
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক তৌহিদ হোসেন মনে করেন, সীমান্ত চুক্তি নিয়ে যতটা এবং যা কিছু হচ্ছে, ততটা হওয়ার উপযুক্ত নয়। ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তিতে বাংলাদেশ সই করেছে কিন্তু ভারত করেনি। ৪১ বছর পর এখন করেছে। তাই এখানে বাংলাদেশকে কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়নি। তবে এই চুক্তি একটি ইতিবাচক আবহ তৈরি করেছে বলে মনে করেন তৌহিদ হোসেন।
এদিকে, ভারতের বেসরকারি খাতের দুটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ও আদানি গ্রুপকে বাংলাদেশে বিশেষ আইনের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ দিয়ে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে ভারতেরই স্বার্থসিদ্ধির ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। 
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে প্রভাবশালী গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির মনে করেন, ভারতের প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তি দেয়ার কোনো কারণ নেই। তারা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে এবং তা বিক্রি করবে_ এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। 



তৌহিদ হোসেন প্রশ্ন করেন, কুইক রেন্টালের দায়মুক্তি তাদের বেলায় কেন প্রযোজ্য হবে, তা খোলামেলা বলা উচিত।
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ভারতের ব্যবহারে সমঝোতা স্মারকের মূল সুফল ভারতই পাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে বন্দর ব্যবহারের জন্য মাশুল পাবে বাংলাদেশ।



সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে যদি দেশের শ্রম, পুঁজি ও কাঁচামালের সঙ্গে মূল অর্থনীতির যোগসূত্র স্থাপিত হয়, তাহলে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু এই অঞ্চল যদি কৃত্রিম দ্বীপের মতো থাকে, তা দিয়ে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না।



ভারতের লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশনের কার্যক্রম চালাতে বাংলাদেশের বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার (আইডিআরএ) সম্মতিপত্র হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। 



তাদের ভাষ্য, ভারতের জীবনবীমা কোম্পানির দক্ষতা অনেক বেশি। বাংলাদেশের কোনো জীবনবীমা কোম্পানি সেখানে গিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ পাবে না। অথচ ভারতীয় বীমা কোম্পানিগুলোর এ দেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করে সহজেই দেশি কোম্পানিগুলোয় বড় ধরনের ধস নামানোর সম্ভাবনা রয়েছে।



এদিকে, আখাউড়ায় ইন্টারনেটের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইডথ ইজারার বিষয়ে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি (বিএসএনএল) এবং ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে, তার লাভের পুরোটাই ভারতের ঘরে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কেননা এ সমঝোতার ফলে ভারতের ত্রিপুরাসহ ওই অঞ্চল কম খরচে ইন্টারনেট সুবিধা পাবে। যদিও বাংলাদেশ এর জন্য অর্থ পাবে।



এছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ, চোরাচালান ও জাল মুদ্রার ব্যবসা প্রতিরোধে সমঝোতার সুফল পাবে উভয় পক্ষ। দুই দেশের কোস্টগার্ডের মধ্যে সমঝোতা স্মারক এবং বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে বস্নু ইকোনমি ও সমুদ্রসীমা বিষয়ে সমঝোতার সুবিধা দুই দেশ পাবে।



আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা বলেছেন, চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোয় বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই বেশি লাভবান হবে। কেননা এর মাধ্যমে ভারত কেবল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে দেশটির উত্তরাংশের সাতটি রাজ্যে (ল্যান্ডলক) রেল, পানি, স্থলপথে পণ্য পাঠাতে পারবে না; উপরন্তু সম্ভাব্য স্বল্পসময়ের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যে যেতে পারবে। তাদের মতে, যেহেতু ভারতই সবচেয়ে লাভবান হবে, সেহেতু দেশটির কাছ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার ক্রেডিট সাপ্লায়ারস লোন থেকে ৫০০ মিলিয়ন বা ১ বিলিয়ন ডলার গ্রান্ট দিলে বাংলাদেশের ভালো হতো। কেননা ২ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপির একটি দেশের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার খুব বেশি কিছু নয়।



এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, যেসব চুক্তি এবং সমঝোতা হয়েছে, বিশেষ করে বাণিজ্য চুক্তি ৫ বছর অন্তত অটো নবায়নের বিষয়ে যে ঘোষণা এসেছে, সেখানে বাংলাদেশের দিক থেকে একটি ক্লোজ থাকা উচিত ছিল। তিনি বলেন, ভারতের সরকারপ্রধানের ওই সফরে আঞ্চলিক যোগাযোগসহ উন্নয়নের যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে নেতিবাচক কিছু নেই। তবে এগুলোর বাস্তবায়নের মডালিটিজ নির্ধারণে আমরা কিভাবে আমাদের স্বার্থ সুরক্ষা করতে পারি, তা নিয়ে চলমান আলোচনা আরো জোরদার হওয়া উচিত।



অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে, শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিবেশী কম শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রতি ছোট ভাইসুলভ আচরণ করে। শক্তিশালী রাষ্ট্র সব সময়ই প্রতিবেশীর প্রতি 'বিগ ব্রাদার' বা 'এল্ডার ব্রাদার' হিসেবে আবির্ভূত হয়। যাকে বাংলায় বলে 'দাদাগিরি।' তিনি আরো বলেন, 'এর আগে প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশকে ১০০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওইটা ছিল সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট। যার মানে হচ্ছে, ঋণের অর্থ ভারতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। ঋণের অর্থে যে উন্নয়ন হবে, ওই উন্নয়নের জন্য যে কাঁচামাল লাগবে তার মূল্য ঠিক করে দেবে ভারত, আবার সেই কাঁচামালের মূল অংশ ভারতের কাছ থেকেই কিনতে হবে।' 



ড. আবুল বারকাত বলেন, 'যারা এগুলো নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তারা এই চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক বা প্রটোকলের কতখানি জানেন বা দেখেছেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এর আগে ৮০-এর দশকে ভারতের ঋণের অর্থে বাংলাদেশে কলম উৎপাদিত হলো। পরে দেখা গেল, যে কলম আগে বাজারে এক টাকায় বিক্রি হতো পরে তার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হলো।' 



ভারত সরকার বাংলাদেশকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়ে শর্ত দিয়েছে শতকরা কমপক্ষে ৭৫ ভাগ ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে হবে বাংলাদেশকে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এতে ভারতে ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এতে গতি পাবে ভারত সরকারের মেক ইন ইনডিয়া কর্মসূচি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন