শনিবার, ২৭ জুন, ২০১৫

মোদির ঢাকা সফরের পর নানা ঘটনা

ভারতের আলোচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে অনুষ্ঠিত দুই দেশের মধ্যকার নানা চুক্তি ও সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণা নিয়ে মূল্যায়ন হয়েছে নানাভাবে। মোদির সফরকালে যেসব চুক্তি ও সমঝোতাপত্র সই হয়েছে, তার একটি বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু এসব চুক্তি-সমঝোতায় বিস্তারিতভাবে কী রয়েছে তা প্রকাশ হয়নি। এসবের বাইরে সফরের অঘোষিত কোনো ফল আছে কি না তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য কোনো পক্ষ থেকে নেই। তবে এই ফল নিয়েও জল্পনার কমতি নেই। 
মোদির এই সফরের পর সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল দলবির সিং। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির নতুন সেনা কর্মকর্তাদের পাসিং আউটে বক্তব্য রেখেছেন তিনি। মোদির ঢাকা সফরের পরপর মনিপুরে বিদ্রোহীদের হাতে ২০ জন সেনা সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং এর পর মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঢুকে ভারতের বিশেষ বাহিনীর অপারেশন নিয়েও নানা ধরনের মূল্যায়ন হচ্ছে ভারতের ভেতরে-বাইরে। নরেন্দ্র মোদির প্রতিবেশী কৌশলে নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে কি না তা নিয়েও মূল্যায়ন হচ্ছে ভারত ও এর প্রতিবেশী দেশগুলোতে।

চুক্তি সমঝোতায় একতরফা প্রাপ্তি
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় উভয় দেশ ২২টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও দলিল স্বাক্ষর এবং বিনিময় করেছে। উভয় প্রধানমন্ত্রী ৯টি প্রকল্প উদ্বোধন, ফলক উন্মোচন বা চালু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে কলকাতায় ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সিডিসহ মোট পাঁচটি স্মারক ও উপহার হস্তান্তর করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবিসহ তিনটি ছবি ও মানচিত্র উপহার দিয়েছেন।


নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের দলিল বিনিময় হয়। পাকিস্তান সময়ে নেহরু-ফিরোজ নুন চুক্তির ধারাবাহিকতা অনুসারে ১৯৭৪ সালে এই চুক্তিটি মূলত স্বাক্ষরিত হয় ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। চুক্তিটি তখন বাংলাদেশ সংসদে অনুমোদন করা হলেও ভারতীয় সংসদে সেটি তখন অনুমোদিত হয়নি। ফলে চুক্তিটি কার্যকারিতা পায়নি। ভারতের বিগত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন মনমোহন সিংয়ের সরকারের সময় সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রটোকলগুলো চূড়ান্ত হয়। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন তথা অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিতকরণ, অপদখলীয় জমির মালিকানা নিষ্পত্তি ও ছিটমহল সমস্যার সমাধানের প্রটোকল স্বাক্ষর করা হয়। চুক্তির সেই দলিলগুলো মনমোহন সরকার বিজেপি ও অন্য কয়েকটি বিরোধী দলের বিরোধিতার কারণে পাস করতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সেই বিরোধিতা আর থাকেনি। ফলে বাংলাদেশে আসার আগেই চুক্তিটি সংসদে অনুমোদনের দলিল সাথে নিয়ে এসেছেন তিনি, যেটি সফরকালে দুই নেতার মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিনিময় হয়। এর মাধ্যমে কোনো দেশের এককভাবে লাভবান হওয়ার কিছু সেভাবে নেই। তবে দুই প্রতিবেশী দেশে যে আমীমাংসিত বিষয় ভারতের অনিচ্ছার কারণে অবাস্তবায়িত ছিল, সেটি এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে। মোদির সফরকালে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে তার মধ্যে ভারতের প্রাপ্তিই মূলত একতরফা। 


ট্রানজিট ৬ দশকের আকাক্সক্ষা পূরণ
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে ভারতের মূল অর্জন হলো ট্রানজিট বাস্তবায়ন চুক্তি। সফরকালে ১৯৭২ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি ব্যাপক সংশোধন ও সংযোজনসহ নবায়ন করা হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য ও যান চলাচলের জন্য স্থল, নৌ ও রেল ট্রানজিট দেয়া হয়। সফরের সময় ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে চলাচলের জন্য ঢাকা-শিলং-গৌহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালুর প্রটোকল স্বাক্ষর করা হয়। নৌ-ট্রানজিটের আরেকটি প্রটোকল স্বাক্ষর করা হয়, যার আওতায় বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের জন্য এক দেশের নৌপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য আনা নেয়া করা যাবে। এই প্রটোকল পাঁচ বছরের জন্য স্বাক্ষর হয় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা নবায়ন হতে থাকবে। সফরকালে ভারতের চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য আনা-নেয়া করার ব্যাপারে এক সমঝোতা স্মরক স্বাক্ষর করা হয়। এর আওতায় ভারত বন্দর দু’টি ব্যবহার করে আগরতলা ডাউকি ও সুতারকান্দি রুটে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে। এ জন্য স্থল, রেল ও নৌ সব পথই ব্যবহার করতে পারবে ভারত। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে কলম্বো, সিঙ্গাপুর ও কেলাঙ বন্দর থেকে এক দেশের উপকূল দিয়ে অন্য দেশের কার্গো জাহাজ চলাচলের একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির ফলে উড়িষ্যার বিশাখাপত্তম, অন্ধ্র প্রদেশের প্যারা দ্বীপ ও পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া সমুদ্রবন্দর এবং বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের মধ্যে উপকূল ঘেঁষে ছোট ও মাঝারি জাহাজ চলাচল করবে। মোদির সফরে ডিজিটাল কানেক্টিভিটিরও চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল) এবং ভারত সঞ্চর নিগম লিমিটেডের (বিএসএনএল) মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে আখাউড়ায় ইন্টারনেট সুবিধা দিতে ব্যান্ডউইথ লিজ দেয়া হবে। ট্রানজিট সহায়ক আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ মোদির সফরকে ঘিরে নেয়া হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি কানেক্টিভিটি ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা খাতে শেখ হাসিনার সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান। 


ট্রানজিট বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নবায়নকালে তৃতীয় দেশে ট্রানজিটের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূলত নেপাল ও ভুটানকে টার্গেট করে তৃতীয় দেশে ট্রানজিটের এই অন্তর্ভুক্তি। ফলে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের সাথে বাণিজ্য করতে পারবে বাংলাদেশ। অপর দিকে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারবে। ট্রানজিট-সংক্রান্ত সরকার গঠিত কোর কমিটির আহ্বায়ক ড. মজিবুর রহমানের বক্তব্যটি ট্রানজিটের সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক। তার মতে, ট্রানজিট ব্যবহারের উদ্যোগে বেশি লাভবান হবে ভারতই। তবে বৈশ্বিক বাস্তবতা ও আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য একটা সময় এই ট্রানজিটে যেতেই হতো। এখানে গুরুত্বের দাবি রাখে ট্রানজিটের ব্যবহারের পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে। সে ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া, আস্থা এবং ডাকে সাড়া দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, উইন উইন সিচুয়েশন ছাড়া ট্রানজিট টেকে না। তাই ট্রানজিটের অর্থবহ ব্যবহার এবং এটি দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখতে সব দেশেরই প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক বিধিবিধান পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করা। নবায়নকৃত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় যদি উভয় দেশই এসব শর্ত মেনে চলে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে সব দেশ এর থেকে লাভবান হতে পারে। ট্রানজিট ইস্যুটি বাণিজ্য চুক্তির আদলেই বিবেচিত হবে। এ দুই চুক্তিতে ট্রানজিট ব্যবহারের জন্য মাশুল দেয়ার বিধান রয়েছে। ট্রানজিট ব্যবহারের আগে দেশগুলো আলোচনা করে যৌক্তিক মাশুল নির্ধারণ করতে হবে। 


অভিন্ন যোগাযোগ গ্রাম
ট্রানজিট বাস্তবায়নে অবকাঠামো নির্মাণ সবচেয়ে জরুরি একটি বিষয়। উভয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের (বিবিআইএন) আওতায় বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটি খাতে সহযোগিতার সুযোগ কাজে লাগানোর কথা বলেছেন। বিবিআইএনের আওতায় আঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরির ব্যাপারে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী এই নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ উপ-অঞ্চলটি একটি গ্রামে পরিণত হবে বলে উল্লেখ করেছেন। এর আগে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে দুই দেশের রেল সংযোগ স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতীয় বাংলা সংবাদপত্র ‘এই সময়’-এক প্রতিবেদনে বলেছে, ব্রিটিশ শাসনামলে যেসব রেলপথ দিয়ে তৎকালীন দুই বাংলাকে সংযুক্ত করা হতো, রেলপথের মাধ্যমে তা আবার পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীর বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া ব্রিটিশ রেল রুটের দরজা আবার খুলতে চলেছে। সব ঠিক থাকলে দেশ ভাগের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া মোট আটটি রুট দিয়ে দুই দেশের মধ্যে অচিরেই ট্রেন চলাচল শুরু হবে। আরো একটি নতুন মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন চালু হবে। যাত্রীদের হয়রানি কমাতে মৈত্রী এক্সপ্রেসেই কাস্টম ও ইমিগ্রেশন সার্ভিস চালু হবে। ফলে দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত অনেক সহজ হবে। একই সাথে সহজ হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগও।
মোদির সফরকালে চুক্তি স্বাক্ষরের পর সড়ক ও রেল অবকাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে দ্রুত কাজ করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের মধ্যেই দিল্লি এই কাজের বড় অংশ সম্পন্ন করতে চাইছে। 


সম্পূরক নিরাপত্তা প্রশাসন
মোদির সফরকালে উভয় প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা খাতে অতুলনীয় সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ছাড় না দেয়ার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে তথ্য বিনিময়ের বিষয়েও তারা অঙ্গীকার করেন। নিরাপত্তা সহযোগিতার ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে আগেই একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব কার্যকর থাকার পাশাপাশি এবার স্বাক্ষরিত এক সমঝোতা স্মারকে সামুদ্রিক অঞ্চলের অপরাধ দমনে এক দেশের কোস্টগার্ড আরেক দেশকে সহযোগিতা করার কথা বলা হয়েছে। আরেক সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সামুদ্রিক অর্থনীতি ও মেরিটাইম সহযোগিতা নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ, যৌথ গবেষণা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহায়তার কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি ভারতকে খুলনা ও সিলেটে সহকারী হাইকমিশন খোলার অনুমতি দেয়ায় মোদি বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। এর বিপরীতে গৌহাটিতে বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশন এবং আগরতলায় সহকারী হাইকমিশন খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
নয়াদিল্লি চাইছে ভারতের অভ্যন্তরে সাত রাজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন রয়েছে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে নিরাপত্তা গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে এমন সহযোগিতার সম্পর্ক থাকুক, যাতে কোনো সরকার এই কাঠামো থেকে ভবিষ্যতে বেরিয়ে যেতে না পারে। এবার সমুদ্র সীমানার নিরাপত্তার চুক্তির আওতায় প্রয়োজন বোধ করলে বাংলাদেশের সামুদ্রিক সীমায় ভারতীয় কোস্টগার্ড টহল দিতে পারবে। বাংলাদেশের সীমান্তের অভ্যন্তরে ভারতীয় বাহিনীর অভিযান চালানোর বিষয়ে এর আগে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে।


মোদির ঢাকা সফরের পরপরই ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল দলবীর সিং সুহাগ দুই দিনের সফরে ঢাকা আসেন। সফরকালে জেনারেল দলবীর সিং বাংলাদেশের বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া এবং নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল শাফিউল হক বেলালসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে রাষ্ট্রপতির কুচকাওয়াজও পরিদর্শন করেন তিনি। দলবীর সিং ক্যাডেটদের কৃতিত্বের জন্য তাদের মধ্যে পদক ও পুরস্কার বিতরণ করেন। দলবীর সিং সুহাগের ঢাকা সফরের সময় ভারতের ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকার খবরে বলা হয়, সন্ত্রাসবাদ রুখতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা পেতে ভারতের সশস্ত্রবাহিনী বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ‘সক্ষমতা গড়ে তোলা’র জন্য কাজ করছে। এর আওতায় প্রশিক্ষণ ও যৌথ মহড়া থেকে শুরু করে সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিও সরবরাহ করা হচ্ছে। খবরে বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকেই সরাসরি দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে সংলাপ চলছে। ভবিষ্যতে দুই বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা সম্প্রসারণ করাই এর লক্ষ্য। 


পরিপূরক অর্থনীতি 
ভারতের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতের পরিপূরক করে গড়ে তোলার কথা উচ্চারিত হয়। গত এক দশকে এ ক্ষেত্রে এমন সব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, যাতে এটি বিশেষভাবে কার্যকারিতা লাভ করতে পারে। এর আওতায় বাংলাদেশে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে সংযুক্তিকরণসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে কঠোর শর্তসংবলিত কিছু ঋণসহায়তাও বাংলাদেশকে নিতে হচ্ছে। এবার মোদির সফরকালে ভারত বাংলাদেশকে এর আগে যেসব শর্তে ৮০০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল, সেই একই শর্তে দুই বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা দানের চুক্তি হয়েছে। অনেকটা বাণিজ্যিক হারের সুদসংবলিত এই ঋণের টাকা ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য ব্যবহার করা যাবে। এসব প্রকল্প চূড়ান্তভাবে ভারতের অনুমোদনপ্রাপ্ত হতে হবে।


মোদির সফরকালে উভয় প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য জোরদারে পণ্যের মান বিষয়ে চুক্তি ও সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দেয়ার ওপর জোর দেন। মংলা ও ভেড়ামারায় ভারতের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাকে তারা স্বাগত জানান। দুই দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতাকে ভারত নেপালের মতো দ্বৈত মুদ্রা প্রচলন অথবা উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে অভিন্ন মুদ্রা প্রচলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। ভারতীয় অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশে মৌলিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিকাশের পরিবর্তে এ দেশকে ভারতীয় বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তার বাজার ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রে পরিণত করার ওপর জোর দিতে চান। বিদ্যুৎ ও অন্য কয়েকটি খাতের চুক্তিতে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এই ধারাকে সামনে আরো এগিয়ে নেয়া হবে। 


বিদ্যুৎ খাত : রিলায়েন্স-আদানি গ্রুপের সাথে চুক্তি
মোদির সফরকালে ভারতের রিলায়েন্স ও আদানি গ্রুপের মতো দুই বড় শিল্পপরিবারের সাথে দায়মুক্তি আইনে বিনা টেন্ডারে চার হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর (এমওইউ) হয়েছে। সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ভারতের বৃহৎ এ দু’টি শিল্প গ্রুপ সাড়ে ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। তবে দুই কোম্পানিরই প্রস্তাবিত কেন্দ্রগুলো কিংবা এফএসআরইউ কোথায় হবে এবং বিদ্যুতের দাম কেমন হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ দুটি শিল্প গ্রুপ নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনের সময় বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলো বলে উল্লেখ করা হয়। 


পিডিবির সাথে চুক্তি অনুযায়ী, আদানি পাওয়ার লিমিটেড কয়লাভিত্তিক দু’টি ইউনিটে মোট এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এ জন্য তারা বিনিয়োগ করবে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। অন্য দিকে রিলায়েন্স গ্রুপের রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেড ৭৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছে তিন হাজার মেগাওয়াট। জ্বালানি হিসেবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) তারা আমদানি করবে। এরপর কোম্পানি আমদানিকৃত এলএনজির জন্য ভাসমান মজুদাগার তৈরি করবে এবং সেখান থেকে আবার গ্যাসে রূপান্তর ইউনিট (এফএসআরইউ) স্থাপনের পর গ্যাসভিত্তিক তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে রিলায়েন্স গ্রুপ ব্যয় করবে ৩০০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।


মোদি-হাসিনা দুই প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং সহযোগিতা আরো জোরদারে সম্মত হন। নরেন্দ্র মোদি ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লক্ষ্যের প্রশংসা করে এ লক্ষ্য পূরণে ভারত বৃহৎ অংশীদার হতে পারে বলে জানান। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর প্রবেশাধিকার দিতে শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান। উভয় পক্ষ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের মুজাফফরনগর পর্যন্ত ৭০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণে ঐকমত্যকে স্বাগত জানায়। বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের অগ্রগতিতে উভয় পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেন নরেন্দ্র মোদি।
ভারতের বড় দু’টি শিল্প গ্রুপের বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে দেশের বিদ্যুৎ খাতের ভারতের কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। এ ছাড়া বিনা টেন্ডারে ভারতের সাথে এই চুক্তি করায় এ খাতে বিনিয়োগকারী স্থানীয় উদ্যোক্তারা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন। ভারতের যে দু’টি শিল্প গ্রুপের সাথে আন্তর্জাতিক টেন্ডার ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি করা হয়েছে, তাদের বিদ্যুৎ খাতের অভিজ্ঞতা তুলনামূলক দেশীয় উদ্যোক্তাদের চেয়ে বেশি। একই সাথে তাদের রয়েছে বিশাল পুঁজি। সেই তুলনায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা যেমন কম, তেমনি রয়েছে তুলনামূলক স্বল্প পুঁজি। দেশীয় উদ্যোক্তারা বৃহৎ পরিসরে যতটুকু বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করেছেন এবং করছেন, তা স্থানীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে করা হচ্ছে। ফলে সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের তুলনায় ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে বেশি দেয়া হলে প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় তারা মার খাবেন। এতে দেশের বিদ্যুৎ খাত পুরোপুরি ভারত-নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।


চুক্তি আর আশ্বাস
মোদির এবারের সফরকালে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। অন্য দিকে তিস্তার পানিবণ্টনসহ বাংলাদেশের ইস্যুগুলোতে কেবল পেয়েছে আশ্বাস। শেখ হাসিনা তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি অবিলম্বে স্বাক্ষরের জন্য অনুরোধ জানালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে আলোচনা চলছে। তিস্তার পানি বাংলাদেশ পাবে আর ফেনি নদীর পানি তুলবে ভারত । দ্রুত পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা চলছে। অববাহিকা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনসহ পানিসম্পদ ইস্যু সমাধানে উভয় প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। হিমালয় অঞ্চলের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে না নেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। ভারতে সাংবিধানিক কারণে টিপাইমুখ প্রকল্পের কাজ এখন এগিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি জানান। মোদি আশ্বাস দেন, ভারত এককভাবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে বাংলাদেশে বিরূপ প্রভাব পড়ে। নরেন্দ্র মোদির পুরো সফরকালে বাংলাদেশ পেয়েছে আশ্বাস আর ভারত করে নিয়েছে চুক্তি।


ভারতের নিরাপত্তা কৌশল পরিবর্তন?
ভারতের প্রতিবেশীদের ব্যাপারে নিরাপত্তা কৌশল পাল্টেছে, এমন এক ইস্যু নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী অতি সম্প্রতি মিয়ানমারের ভেতরে ঢুকে যে বিশেষ অপারেশন চালিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু বিদ্রোহীকে মেরে ফেলেছে, আর অন্তত দু’টি শিবির ধ্বংস করেছে বলে সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিশ্লেষণ। ক্ষমতাসীন বিজেপি আর নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একাংশ দাবি করছে, এই বিশেষ অপারেশনের মাধ্যমে একটা কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে সব দেশকে যে, ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইরত সন্ত্রাসীদের রুখতে সীমান্ত পেরোতেও ভারতীয় সেনারা পিছপা হবে না। এই অংশের ইঙ্গিত মূলত পাকিস্তানের দিকেই। বিশ্লেষকদের অন্য অংশের মতে, এর আগেও বিদেশে অপারেশন চালিয়েছে ভারতীয় বাহিনী আর সর্বশেষ এই অপারেশন। কখনোই সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ রোখার জন্য এটা নতুন শক্তিশালী নীতির ফল নয়। 


মিয়ানমারে ভারতের এই অভিযান নিয়ে মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা বেশ বিব্রত। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে যে, সে দেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সেনা অভিযান হয়েছে। এবারের অভিযানে মিয়ানমার সরকার পরোক্ষ সম্মতি দিয়ে থাকলেও সামনে এ ধরনের সম্মতি আর দেবে বলে মনে হয় না। ফলে ভারতের এ নীতি দেশটির প্রতি অনুগত প্রতিবেশী ছাড়া আর কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। এ ঘটনার পর সবচেয়ে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পাকিস্তান। দেশটির সেনাবাহিনী ভারতীয়দের কোনো অ্যাডভেঞ্চারে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছে, পাকিস্তানের মাটিতে এ ধরনের কিছু করার চিন্তা করলেও এর জন্য মারাত্মক মূল্য দিতে হবে। 


ভারতের নিরাপত্তার ব্যাপারে এই কৌশল যে মারাত্মক হতে পারে, এ ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন দেশটির সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণন। তিনি ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় লেখা এক কলামে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম শাহিন এক, দুই ও তিন ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় ভারতের বেশির ভাগ ভূখণ্ডই রয়েছে। সেখানে মিয়ানমারের মতো কিছু করা হলে সেটি মারাত্মক হতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বের আর দু’টি দেশ তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনা করলে ভিন্ন দেশে আঘাত হানার কৌশল অনুসরণ করে। এর একটি হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং আরেকটি ইসরাইল। ভারত সন্ত্রাস বা নিরাপত্তা হুমকি দমনে সে কৌশল নিলে এর সম্ভাব্য পরিণতি ভাবনার মধ্যে রাখা দরকার। ভারত যদি ইসরাইলি কৌশল তার প্রতিবেশীদের ব্যাপারে নিতে চায়, সেটি সবার জন্যই বিপদের কারণ হতে পারে বলে নারায়ণন বিষয়টি গুরুত্বের সাথে প্রধানমন্ত্রী ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ভারতের নেতৃত্ব এ ধরনের কোনো নীতি গ্রহণ করলে তা থেকে পাকিস্তানকে বাদ রাখার কথা ভাবতে পারে। কিন্তু বিপদের ঘনঘটা থাকবে অন্য প্রতিবেশীদের জন্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন