বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

চিকিৎসাব্যবস্থায় চলছে নৈরাজ্য


প্রতিদিনের কাগজের পাতা উল্টালেই চোখে পড়বে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার চরম দুর্ভোগের নানা দৃশ্য, যা একটি স্বাধীন দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর। নাগরিকদের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের একটি হলো চিকিৎসা লাভের অধিকারÑ এখানে চলছে চরম দুর্নীতি ও অনিয়ম। মূলত চিকিৎসা হচ্ছে এখন বড় বাণিজ্য। বিত্তবানদের খাতায় নাম ওঠানোর এ যেন এক লাভজনক ব্যবসায়। সরকারি হাসপাতালে বড় ডাক্তারদের সাথে দেখা করতে চাইলে ডাক্তারের সহকারীর উত্তর হলোÑ স্যার চেম্বারে নেই। কোথায় আছে জিজ্ঞেস করলে জবাবÑ ভিজিটিং অথবা রেস্টে বা মিটিংয়ে আছেন। এ ধরনের বক্তব্য বড় ডাক্তারদের ক্ষেত্রে প্রায় সব রোগীই শুনে থাকেন। আসল কথা হলো, বড় ডাক্তার দেখাতে হলে তার ব্যক্তিগত চেম্বারে যেতে হবেÑ এ জন্য একটি ভিজিটিং কার্ড রোগীর হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। 
হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো সাধারণ রোগীর জন্য তাই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেম্বারে গেলে আরেক বিপদÑ ডাক্তারের ফি নি¤েœ ৫০০, ওপরে এক হাজার ২০০ টাকা। সিরিয়াল পেতে সময় লাগবে অন্তত এক সপ্তাহ। আমার জানা মতে, একজন কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসরকে দেখাতে প্রায় দুই মাস ওয়েটিংলিস্টে থাকতে হয়। নির্ধারিত সময়ে দেখাতে গেলেও বসে থাকতে হয় প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা। কারণ হলোÑ রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে বড় ডাক্তারেরা ব্যক্তিগত ব্যবসায় বা রাজনীতিসংক্রান্ত টেলিফোনে আলাপ অথবা ল্যাপটপে কোনো থিসিস, নিবন্ধ বা গ্রন্থÑ এ ধরনের কাজে ব্যস্ত থাকেন। আমার মতো অনেকেই এর ভুক্তভোগী। ডাক্তারেরাও রাজনীতিতে জড়িত। তাদের বহু টাকা-পয়সা, পদ-পদবি দরকার। সরকারি হাসপাতালেই এর প্রভাব বেশি। হাসপাতালেও রোগীর দুর্ভোগের শেষ নেই। বর্তমানে বড় ডাক্তারের কাছে গেলে ২০ হাজার টাকার একটি স্লিøপ ধরিয়ে দেবেন, পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীরের সব অঙ্গের টেস্ট করাতে হবে। কোথায় করাতে হবে তা-ও প্রায় নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামের পাশে টিকচিহ্ন মেরে দেন। আবার কিছু ডাক্তার বলে দেন, যখন আবার আসবেন প্রতিবারই ওইসব টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আসা দরকার। প্রেসক্রিপশনে ওইসব কোম্পানির ওষুধ লেখা হয়, যাদের সাথে রয়েছে একটি বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা ভিড় করেন বড় বড় ডাক্তারের চেম্বারে। তাদের কারণে ডাক্তার দেখাতে বিলম্ব সহ্য করতে হয় অসহায় দুস্থ রোগীদের। ডাক্তার দেখাতে সময় নষ্ট হওয়ার কারণে তাদের অসুস্থতা আরো বেড়ে যায়। অতীতে দেখেছি, চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ওষুধও ফ্রি দেয়া হতো, সেই ব্যবস্থা এখন নেই বললেই চলে। আগেও এই সেক্টরে ভোগান্তি ছিল; কিন্তু সেটি এখন বড় আকারে রূপ নিয়েছে বাণিজ্যিক কারণে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোভনীয় বিলবোর্ড শোভা পাচ্ছে। সেবার চেয়ে সাধারণ রোগীর পকেট কাটার দিকে নজর বেশি। এই অশুভ কাজটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নাকের ডগার ওপর দিয়েই ঘটছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে প্রতিটি পরিবারের মাসিক বাজেটে ন্যূনতম পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা ধার্য করে রাখতে হয়। উন্নত বিশ্বে হাসপাতালে অন্তত প্রবীণদের চিকিৎসাসেবা ফ্রি। 
আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে লিখলে একটি বড় ধরনের গ্রন্থে রূপ নেবে। সবচেয়ে হতবাক হওয়ার বিষয় হলোÑ সম্প্রতি আমার এক আত্মীয়ের এমআরআই (oncology) টেস্টে খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। ঢাকার একটি বিখ্যাত বেসরকারি হাসপাতালে করা হয়েছিল। ৮ জুলাই Mount Elizabeth Novena Hospital রোগীকে দেখানোর জন্য রোগীর সাথে সিঙ্গাপুর যাই। ঢাকার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট এবং ঢাকার উল্লিখিত হাসপাতালের এমআরআইয়ের রিপোর্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই টেস্টটি মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের ঢাকার প্রতিনিধির নির্দেশে করা হয়েছিল। সিঙ্গাপুরে খরচ অনেক বেশি হবে বিধায় তার পরামর্শে ইউনাইটেড হাসপাতালে টেস্টটি করে ফেলি। যা হোক, সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের Dr. Charles Bih-Shion- (Senior Consultant, General Surgeon) রিপোর্টটি দেখে বললেনÑ এটি অস্বচ্ছ এবং যথার্থ নিয়মে হয়নি, তাই বোঝা যাচ্ছে না। এ রকম অনেক উদাহরণ আছেÑ এমনকি ঢাকার বড় বড় হাসপাতালের রিপোর্টেও রোগের ডায়াগনোসিস ভুল প্রমাণিত হয়েছে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, বোম্বে, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি, মাদ্রাজে অবস্থিত বড় বড় হাসপাতালে যাওয়ার পর। অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায়ও রোগ নির্ণয় সম্পর্কে ঢাকার রিপোর্টকে ভুল বলে অভিহিত করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই অভিযোগ রোগীর মুখ থেকে শুনতে হয়েছে। মানুষ বাড়িঘর-জমি বিক্রি করে হলেও কঠিন ব্যাধি যথার্থ নির্ণয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য হয়েছে এ কারণে। বাংলাদেশের মন্ত্রী-মিনিস্টারর সাধারণ রোগ নিয়েও চেকআপের জন্য যান দিল্লি, বোম্বে, ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুর। তাদেরও বাংলাদেশে রোগ নির্ণয়ে চেকআপে শতভাগ বিশ্বাস নেই। অতীতেও ছিল না, বর্তমানেও নেই। ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা। বিত্তশালীরা বলতে গেলে ঢাকায় চিকিৎসা করান না। ঢাকার চিকিৎসার প্রতি তাদের আস্থা উঠে গেছে। ভেজাল খাদ্যের কারণে বাংলাদেশে এখন ক্যান্সার, বিশেষ করে কোন ক্যান্সার ও ব্লাড ক্যান্সার বাড়ছে। সম্প্রতি পত্রিকায় উঠেছেÑ বাংলাদেশে প্রতিদিনই ক্যান্সারের রোগীর হার বাড়ছে। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ ক্যান্সারের জীবাণু বহন করছে খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে। অভিজ্ঞ ডাক্তার না থাকায় এর যথার্থ ডায়াগনোসিস ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হচ্ছে না। ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন নির্ধারিত মানে (Criteria) বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশ্বের সাথে চ্যালেঞ্জ দিতে পারে বিশেষ করে রোগ নির্ণয়ে ও নিরাময়ে, এমন হাসপাতাল বাংলাদেশে নেই বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময়ে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল, বর্তমানে এটির নাম বিশ্বের সেরা কয়েক শ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের তালিকায় নেই। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার যে অবনতি, তা ভাবলে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। স্রষ্টার সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের দুরবস্থা যদি এতটাই নি¤œমানের হয়, তাহলে আর একটা দেশের থাকল কী। একটি জাতির শিক্ষা ও স্বাস্থ্য যদি এতই দুর্বল মানের হয়, সে জাতি কিভাবে উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হবে? এটিই আজ জাতির ভাবনার বিষয়। শুনতে পাই সরকারি দল গণমাধ্যমে এত বেশি ডিজিটাল শব্দটি উচ্চারণ করছে; কিন্তু বাস্তবে এর নমুনা দেখা যায় না। কেউ কেউ বলছে ডিজিটাল নয়, আমরা সেই ব্রিটিশ আমলের ম্যানুয়েল যুগে প্রবেশ করেছি। এর প্রমাণও দিয়ে দেন এভাবেÑ রাস্তায় জ্যামে যখন গাড়ি আটকে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তখন বিরক্ত হয়ে অনেক যাত্রী গাড়ি থেকে নেমে আদিম স্টাইলে পদব্রজে বাড়ির পথে গমন করেন। এরই নাম দিয়েছেন তারা ম্যানুয়েল। আজকের বিশ্ব যোগাযোগ খাত কোথায় পৌঁছে গেছে, আর আমরা দুর্ঘটনায় প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ নিহত হচ্ছি। এর নাম কী করে ডিজিটাল হয়Ñ আমাদের বুঝে আসে না।
অনেকে বলবেন, বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ, রোগী তো বাড়বেই। ভারত ও চীনের জনসংখ্যা মিলে ২৫০ কোটির ওপরে। কিন্তু দেশ দু’টিতে চিকিৎসা মুনাফালোভী বাণিজ্যে রূপ নেয়নি। ব্যাঙের ছাতার মতো মানহীন হাসপাতাল চীন ও ভারতে গড়ে ওঠেনি, যা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। হাসপাতাল গড়ে ওঠা তো খুবই প্রয়োজনÑ যদি সেটা সেবার নামে গড়ে ওঠে; কিন্তু আমরা শুধু দেখছি অর্থের অপচয় আর ভোগান্তি। প্রতিনিয়ত বড় বড় ‘অভিজাত’ হাসপাতাল থেকেও যদি লাশ হয়ে ফিরতে হয় সুচিকিৎসার অভাবে, তাহলে মানুষ আর কোথায় ভরসা পাবে? হয়তো কেউ কেউ বলবেন, তকদিরের লিখন বা ‘আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছেন’Ñ কারো কিছু করার নেই। এই যুক্তি দিয়ে সান্ত্বনা খোঁজা অনেকটা সত্যকে আড়াল করার মতো। পিনাক-৬ পদ্মায় লঞ্চডুবিতে যারা মারা গেছেনÑ এরাও কি সান্ত্বনা খুঁজবেন একইভাবে? নির্মম পরিহাসই বটে। যে লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৭৫ এবং তার কার্যক্ষমতাও ফুরিয়ে গেছে; সেই লঞ্চটি কিভাবে কার নির্দেশে, কাদের লোভে ৩০০ জন যাত্রী নিয়ে অশান্ত পদ্মার বুক দিয়ে যাত্রা শুরু করে। সব দোষ নিয়তির ওপর চাপিয়ে দিয়ে দোষী ব্যক্তিদের খালাস দেয়া হলে অপরাধী হিসেবে শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে একজন খুনি হিসেবে। বিষয়টি এখনই উপলব্ধি করতে হবে সব মানুষকে। 
বাংলাদেশে ওষুধ কোম্পানি রয়েছে প্রায় ৫০০। এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয় তারই ভিত্তিতে এ সংখ্যা উল্লেখ করা হলো। কয়েক বছর আগে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ওষুধ কোম্পানি নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছিল। এতে উল্লেখ করা হয়েছিলÑ বাংলাদেশে অর্ধেকের বেশি ওষুধ কোম্পানিতে Quaility Control Department নেই, গামছায় ওষুধ ফিল্টার করা হয়Ñ পুরান ঢাকায় এ ধরনের অবিশ্বাস্য দৃশ্য প্রতিবেদক দেখেছেন। ওষুধের পাইকারি বাজার মিটফোর্ড ও ইংলিশ রোডে দেশীয় কোম্পানির নকল ওষুধে ভরে গেছে। এটাকে বলে জিঞ্জিরা মেইড। কিছু দিন আগেও র‌্যাব ও পুলিশের অনুসন্ধানে বহু নকল ওষুধের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো পাইকারি দরে অন্যান্য ওষুধের সাথে বিক্রি হচ্ছে। অবৈধ বিদেশী ওষুধে বিশেষত ভারতের ওষুধে বাজার ছেয়ে গেছে। 
পত্রিকায় লিড নিউজ : কিছু দিন আগে শিশুমৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত প্যারাসিটামল ওষুধ। অ্যান্টিবায়োটিকেও সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে। নেশাজাতীয় ওষুধ অর্থাৎ মাদক বিক্রি হচ্ছে দেদারÑ পত্রিকায় এ ধরনের খবর প্রতিদিনই বের হচ্ছে। ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি তাহলে করছেটা কীÑ প্রশ্ন এসে যায়। লাইফ সেভিং ড্রাগস যদি নকল হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ হয়, প্রস্তুতপ্রণালী যদি স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানসম্মত না হয়, গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) মেনে চলা না হয়, তাহলে জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে। মানুষের বেঁচে থাকার অরগানগুলো বিশেষ করে পাকস্থলী, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্কের নার্ভÑ এগুলো যেকোনো একটি বিকল হয়ে গেলেই তাকে প্রাণ হারাতে হবে। অথবা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বহু দিন অতিবাহিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পেশাজীবী, ডাক্তার, ওষুধ প্রশাসন, ওষুধ কোম্পানি, ওষুধ ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ সবাই কম-বেশি দায়ী। দেশের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাত ভয়ঙ্কর ঝুঁকির মধ্যে আছে খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে। সরকারের এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে নজর দেয়া প্রয়োজন। 
লেখক : হারুন-আর-রশিদ , গ্রন্থাকার, গবেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন