মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০১৪

তাহের বলেছিলেন, উচিত ছিল বঙ্গবন্ধুর লাশ বঙ্গোপসাগরে ফেলা

সন্ধ্যায় খোন্দকার মোশ্‌তাক আহ্‌মাদ বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহের উপস্থিত ছিলেন। দু’দিন পর ১৭ই আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী পরিস্থিতি প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের প্রকাশিতব্য গ্রন্থে এসব কথা বলা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায়- ‘৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো’ শিরোনামে বইটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের ছিলেন জাসদের সামরিক সংগঠন বিপ্লবী গণবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার। তিনি সম্ভবত জানতেন না, ১৫ই আগস্ট তারিখটিই অভ্যুত্থানের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে। তবে এ রকম একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে তা তার অজানা থাকার কথা নয়। কোটি টাকার প্রশ্ন ছিল, কবে কখন? শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতের জন্য তাহেরের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। শেখ মুজিবের প্রতি তার ক্ষোভ ছিল অপরিসীম। তাহের মনে করতেন, মুজিব সরকার সেনাবাহিনীর উন্নয়নে চরম অবহেলা দেখিয়েছে এবং রক্ষীবাহিনীর মতো একটা কুখ্যাত আধাসামরিক বাহিনী তৈরি করেছে। তিনি সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় ভারতের সঙ্গে করা গোপন চুক্তির ব্যাপারেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বাহাত্তর সালের নভেম্বরেই এসব ঘটেছিল এবং এ কারণেই লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন এবং তিনি যার যার রাজনৈতিক লাইন বেছে নিয়েছিলেন। অবশ্য তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করতেন। ছিয়াত্তরে তাহের ও অন্যদের বিচারের সময় তাহের এসব কথা উল্লেখ করেন। শেখ মুজিব সম্পর্কে তাহেরের মূল্যায়ন ছিল এ রকম: শেখ মুজিব জনগণের নেতা ছিলেন। অস্বীকার করার অর্থ হবে সত্যকে অস্বীকার করা। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার জনগণের ওপরই বর্তায়। জনগণের জন্য সঠিক পথ হবে জেগে ওঠা এবং প্রতারণার দায়ে মুজিবকে উৎখাত করা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জনগণ মুজিবকে নেতা বানিয়েছে তারাই একদিন স্বৈরাচারী মুজিবকে ধ্বংস করবে। জনগণ কাউকে ষড়যন্ত্র করার অধিকার দেয়নি।

১৫ই আগস্ট সকালে মুহসীন হলের ছাত্র নূর মোহাম্মদ ঢাকা নগর গণবাহিনীর উপপ্রধান আবুল হাসিব খানের কাছে ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের একটি চিরকুট নিয়ে আসেন। চিরকুটে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের অফিসে ঢাকা নগর গণবাহিনীর জরুরি সভা হবে বলে উল্লেখ ছিল। সভা শুরু হলে আনোয়ার হোসেন উপস্থিত সবাইকে বলেন, ‘ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ‘... এর মেজর হয়েছ। এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল’ প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না। জানো কাল ইউনিভার্সিটিতে কারা বোমা ফাটিয়েছিল? দে আর মাই বয়েজ।’ লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের মেজর রশিদের অনুরোধে সকাল নয়টায় ঢাকা বেতার কেন্দ্রে যান। সেখানে তিনি খোন্দকার মোশ্‌তাক আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মেজর ডালিম ও মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে দেখতে পান। তার পরামর্শে ডালিমরা সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে আসেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে বিবৃতি দেয়ার জন্য। তিনি খোন্দকার মোশ্‌তাককে পাঁচটি প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবগুলো ছিল: ১. অবিলম্বে সংবিধান বাতিল করতে হবে; ২. সারা দেশে সামরিক আইন জারি এবং এর প্রয়োগ করতে হবে; ৩. দল-মত-নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিতে হবে; ৪. বাকশালকে বাদ দিয়ে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে; ৫. অবিলম্বে একটি গণপরিষদ তথা পার্লামেন্টের জন্য সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সামরিক শাসন জারির দাবি ছিল তাহেরের একান্ত নিজস্ব।


তাহের প্রস্তাব দিলেন জিয়াকে সামনে রেখে অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে

৬ই নভেম্বর সন্ধ্যায় জাসদের পার্টি ফোরামের ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক বসে ঢাকায়। সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলছিল। কর্নেল তাহের সভায় উপস্থিত হন। তিনি সবাইকে জানান, জিয়াউর রহমান টেলিফোনে তাকে বাঁচানোর অনুরোধ করেছেন। কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনীর একজন তরুণ কর্মকর্তা আসেন অসামরিক পোশাকে। তিনি তাহেরকে ফিসফিস করে কিছু বলেন এবং তাঁর হাতে দু’টো চিরকুট দেন। ওই ব্যক্তি চলে যাওয়ার পর তাহের একটি চিরকুট পড়ে শোনান। সেটি জিয়ার হাতের লেখা। আই অ্যাম ইনটার্নড। আই কান্ট টেক দ্য লিড। মাই ম্যান আর দেয়ার। ইফ ইউ টেক দ্য লিড, মাই মেন উইল জয়েন ইউ। তাহের প্রস্তাব দিলেন জিয়াকে সামনে রেখে অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে। আখলাকুর রহমান বেঁকে বসলেন। স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বললেন, ‘ইতা কিতা কন? তাইনরে আমরা চিনি না।’ সবার মুখে প্রশ্ন, জিয়াকে কি বিশ্বাস করা যায়? তাহের বললেন, আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস করেন, তাহলে জিয়াকেও বিশ্বাস করতে পারেন। হি উইল বি আন্ডার মাই ফিট।
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের প্রকাশিতব্য গ্রন্থে এ সব কথা বলা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায়- ‘৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো’ শিরোনামে বইটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে,  পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে ফারুক-রশীদের একটা ছোট গ্রুপ জড়িত ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ইচ্ছা ও চেষ্টা ছিল অনেকদিন ধরেই। গুটিকয়েক সেনা কর্মকর্তা বাদে অধিকাংশের মনেই সরকার উৎখাতের প্রবল ইচ্ছা ছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থান সেনা কর্মকর্তাদের বেশির ভাগেরই সমর্থন পায়। কিন্তু মাত্র কয়েকজন জুনিয়র অফিসার বঙ্গভবনে বসে ছড়ি ঘোরাবে এটা অন্যদের পছন্দ হয়নি। তারা চেয়েছিলেন সত্যিকার অর্থেই একটি সেনাশাসন। খোন্দকার মোশ্‌তাকের নেতৃত্বে অন্য ধরনের আওয়ামী শাসনে তাঁদের ঘোরতর আপত্তি ছিল। সুতরাং সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অন্যরা সংগঠিত হতে থাকেন। এতে মূল ভূমিকা নিয়েছিলেন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল। তিনি নতুন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখেই কাজটি করতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী: অক্টোবর নাগাদ চিফ অব স্টাফ জিয়া অভ্যুত্থানকারী সেনা অফিসারদের বিশৃঙ্খল কার্যকলাপের গুরুতর অনুযোগ করলেন আমার কাছে। আমি তাকে বললাম, ‘স্যার আপনি চিফ, আপনি অর্ডার করলে আমি জোর করে এদের চেইন অব কমান্ডে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারি’। কিন্তু জিয়া ছিলেন দোটানায়। তখন তিনি এক পা এগোন তো দুই পা পিছিয়ে যান। মনে হলো চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস সঞ্চার করে উঠতে পারছেন না জিয়া। যা করার নিজেদেরই করতে হবে। 
পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির নেতারা সামরিক গোয়েন্দা তথ্য পেতেন তাঁদের দলের সদস্য এবং ডিজিএফআই’র কর্মকর্তা মেজর জিয়াউদ্দিনের মাধ্যমে। তাঁরা জানতে পারলেন নতুন করে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হচ্ছে। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর সর্বহারা পার্টি অনেক অগোছালো হয়ে পড়েছিল, উপদলীয় কোন্দলে অনেকটা জড়িয়ে পড়েছিল। তাঁদের অন্যতম প্রধান নেতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জিয়াউদ্দিন কোন রকম সামরিক অভ্যুত্থানের পক্ষে ছিলেন না। দলের বক্তব্য ছিল- অভ্যুত্থান হলে একই শ্রেণীর দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা চালাচালি হবে। আমাদের তাতে কি লাভ আর জনগণেরই বা কি লাভ। সেনাবাহিনীর ইকবাল কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সাহায্য চাইলেন। ২৮শে অক্টোবর অভ্যুত্থানের কথা ছিল। পরে তারিখ বদলানো হয়। মেজর ইকবাল কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করে বললেন, আমাদের সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ থাকবেন।  জিয়াউদ্দিন বললেন, এটা ভেস্তে যাবে। সবাই এটাকে প্রো-ইন্ডিয়ান ক্যু হিসেবে দেখবে, তোমরা মারা পড়বে। ইকবাল বললেন, আপনি হাফিজকে বোঝান। মেজর হাফিজউদ্দিন আহমদ তখন ঢাকার ব্রিগেড মেজর। এটা ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ। জিয়াউদ্দিন হাফিজকে চিঠি দিলেন, ডোন্ট গো ফর ক্যু। কোন একটি সূত্র থেকে মেজর ডালিম অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার কথা শুনেছিলেন। তিনি ইকবালকে বললেন, দোস্ত তোমরা নাকি আমাদের বিরুদ্ধে কি সব করতাছ? ইকবাল ভাবনায় পড়ে গেলেন- মেজর ডালিম জানলো কিভাবে?
২রা নভেম্বর ঢাকায় সামরিক অভ্যুত্থান হলো। সশস্ত্র বাহিনীতে ‘চেইন অব কমান্ড’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের শক্তি ও সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে। আগের দিন রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ও কর্নেল শাফায়াত সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অফিসে বসে পরিকল্পনা করেন ২রা নভেম্বর দিবাগত রাত দুইটায় বঙ্গভবনে মোতায়েন ৪৬ ব্রিগেডের দু’টি কোম্পানি সেনানিবাসে ফিরে আসবে। সেটাই হবে অভ্যুত্থানের সূচনার ইঙ্গিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরু হলো কাজ। স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের মাধ্যমে বিমান বাহিনীর সহায়তা নিশ্চিত করা হয়। তাঁরা ৩রা নভেম্বর ভোরে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার উড়িয়েছিলেন। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তার বাসভবনে অন্তরীণ করা হয়।
১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িতরা বঙ্গভবনেই থাকতেন। তাঁরা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন। জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় আপসরফা হয়। রশীদ, ফারুক, ডালিমসহ ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের ১৫ জনের কুশীলবকে বিমানে ব্যাংককে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। ৪ঠা নভেম্বর ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে একটা শোক মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবের বাসভবনে যায়। মিছিলে খালেদ মোশাররফের ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ এবং তাঁর মা অংশ নিয়েছিলেন। শহরে রটে যায়, ‘আওয়ামী বাকশালীদের’ পক্ষে অভ্যুত্থান হয়েছে। ৪ তারিখে জানা যায়, আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছে। খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে দেন-দরবার করতে থাকেন তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য। ৪ঠা নভেম্বর খোন্দকার মোশ্‌তাক তাকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। ৫ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করলে তিনি রাজি হন। ৬ই নভেম্বর বিচারপতি সায়েম খোন্দকার মোশ্‌তাকের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং অভ্যুত্থানকারীদের পরামর্শ অনুযায়ী জাতীয় সংসদ বাতিল ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যে রটে যায়, ভারতের মদতে খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের প্রতি অনুগত সৈনিকরা বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে ঢাকার দিকে রওনা হন। মোশ্‌তাক এবং ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের সমর্থক গোষ্ঠীও সক্রিয় হয়। এ সময় কর্নেল তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে সৈনিকদের বিদ্রোহ করার আহ্বান জানান। জাসদ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে সেনানিবাসগুলোতে প্রচারপত্র বিলি করা হয় এবং ‘ভারতের দালাল ও বিশ্বাসঘাতক চক্রকে’ উৎখাত করার আহ্বান জানানো হয়।
খালেদ মোশাররফ যখন সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য বঙ্গভবনে দেন-দরবার করছিলেন তাহের তখন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন। জাসদের পার্টি ফোরাম এ সময় একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটি ছিল ৯ই নভেম্বর থেকে লাগাতার হরতাল দেয়া এবং ঢাকায় ব্যাপক শ্রমিক-জনতার সমাবেশ আয়োজন করে একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটানো। তবে ৬ই নভেম্বর জাসদের পার্টি ফোরামের ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে তাহের আরও বলেন, তিনি ইতিমধ্যে সৈনিক সংস্থার লোকদের অভ্যুত্থান ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাহেরকে অনুরোধ করা হলো এ নির্দেশ প্রত্যাহার করার জন্য। কারণ অন্যদের তেমন কোন প্রস্তুতি নেই। তাহের জানালেন, এটা ওয়ানওয়ে কমিউনিকেশন। আমার লোকেরা যোগাযোগ না করলে আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবো না। তিনি দ্বিতীয় চিরকুটটা বের করলেন। বললেন, এটা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার গোয়েন্দা শাখা থেকে পাঠানো হয়েছে এবং এটা খুবই জরুরি বার্তা: ‘খালেদ মোশাররফ মেন আর মুভিং ফাস্ট। দ্য আয়রন ইজ টু হট। ইট ইজ টাইম টু হিট।’ (খালেদ মোশাররফের লোকেরা খুবই তৎপর। লোহা অত্যন্ত গরম। এটাই আঘাত করার উপযুক্ত সময়।) আখলাকুর রহমান তারপরও আপত্তি করছিলেন। তাহের বলশেভিক বিপ্লবের প্রসঙ্গ টেনে লেনিনীয় ভঙ্গিতে বললেন, টু নাইট অর নেভার (আজ রাতে নইলে কখনওই নয়)। তিনি হাসানুল হক ইনুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
কথা ছিল রাত একটায় সুবেদার মাহবুব ফাঁকা গুলি ছুড়ে সঙ্কেত দেবেন। তখন সৈনিকেরা অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্রশস্ত্র নেবে এবং বিপ্লব শুরু করে দেবে। উত্তেজনার বশে সময় ঠিক রাখা যায়নি। এক ঘণ্টা আগেই গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। একদল সৈন্য জিয়ার বাসায় গিয়ে জানান, তিনি মুক্ত, বিপ্লব হয়ে গেছে। জিয়া বেরিয়ে এলে মেজর মহিউদ্দিন তাকে ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিয়ে আসেন। তাহেরের লোকেরা ঢাকা বেতারের নিয়ন্ত্রণ নেন। ভোরে তাহের ও ইনু সেনানিবাসে গিয়ে জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। জিয়া জানতে চান, সিরাজুল আলম খান কোথায়? জিয়া জাসদের মূল নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। সিরাজুল আলম খান কোথায় তা কেউ জানেন না। তাঁর এই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে ধারণা করা হয়, তাহেরের এই উদ্যোগ সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং তিনি এর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাননি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন