এক
দৈনিক যুগান্তরে ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন ল্য’ (২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩,
দেখুন chintaa.com) প্রকাশের পর সাড়া পেয়েছি বিস্তর। এতে অবাক হয়েছি,
কিছুটা। সমাজ যেভাবে বিভক্ত তাতে যে কথা বলতে চেয়েছি তা পাঠকদের কাছে
পৌঁছানো কঠিন ভেবেছিলাম। কিন্তু মনে হয় তারা বুঝেছেন।
শাপলা/শাহবাগ বিভাজনের রাজনৈতিক মুহূর্ত বাংলাদেশে ঘটে যাবার ফলে আমাদের
প্রথাগত চিন্তার ছক খানিক নড়বড়ে হয়েছে। অনেকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি
হয়েছে, অনেকের সঙ্গে বাধ্য হয়েই দূরত্ব তৈরি করতে হয়েছে। ফেসবুক নামক
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে সঙ্গ বজায় রাখার চেষ্টা করি, দেখলাম অনেকে
ইলেকট্রনিক রিশতা ত্যাগ করে চলে গিয়েছেন। এতে আমি নির্বান্ধব হইনি। কারণ
সমাজে সচেতন ও সজ্ঞান মানুষের অভাব নাই। তাদের কাছে পৌঁছানোই রাজনৈতিক দিক
থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
চিন্তার শক্তি অনেকের থাকে না। অনেকের থাকলেও নানা কারণে খুইয়ে ফেলে। আর
অন্ধ ভাবে যখন কেউ কোন একটা পরে নির্বিচার পপাতী হয়ে দাঁড়ায় তখন তাদের
মস্তিষ্কের পাথর ভাঙা রীতিমতো অসম্ভব কাজ হয়ে ওঠে। প্রথাগত চিন্তার ছক
নিয়ে যারা বড় হয় তারা তাদের ছকের বাইরে ভাবতে পারে না। সেটা বাঙালি
জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী, ইসলামপন্থী, কিম্বা বামপন্থী যা-ই
হোকÑ প্রত্যেকেরই নিজ নিজ নকশাকাটা ঘর রয়েছে। ছকের বাইরে যাওয়া
প্রত্যেকের জন্যই কঠিন। এই মুশকিল সব সমাজেই থাকে। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়।
এতে নিরাশ হওয়ার কিছু নাই।
বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে ভাবা, চিন্তা
করা ও পর্যালোচনা খুবই দরকার, এ কথাই আমি বারবারই বলে আসছি। শাপলা বনাম
শাহবাগের বিভাজন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে
সমাজকে সাদা-কালো বিভাজনে ভাগ করে রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ধারণ করা যাবে না।
অর্থাৎ শাহবাগের পে দাঁড়িয়ে শাপলার বিরোধিতা, কিম্বা শাপলার পে দাঁড়িয়ে
শাহবাগ বিরোধিতা দিয়ে রাজনীতির যে সরল সমীকরণ আমরা দেখছি, তা আমাদের আরো
গহ্বরে ঠেলে দিতে পারে। আমাদের ইতিহাস ও সমাজের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব এই
বিভাজনে রূপ নিয়েছে কেন সেটা আমাদের ঐতিহাসিক ভাবেই বুঝতে হবে। সমাজকে
সামগ্রিকভাবে তার বিভাজনসহ বোঝাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। সে জন্যই
আত্মপরিচয়ের রাজনীতিÑ সেটা ‘বাঙালি’ হোক, কিম্বা হোক ‘মুসলমান’ তাকে
ঐতিহাসিক ভাবে পর্যালোচনার আমি পপাতী। এগুলো কোন স্থির, প্রাকৃতিক বা
চিরায়ত সংজ্ঞা নয়। গত লেখায় সেই দিক নিয়েই কিছু আলোচনা করেছি।
এই বিভাজন জনগণের বিভক্তিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিভক্তির
মীমাংসা এক পরে পরাজয় আর অপর পরে বিজয় নয়। এখনকার কাজ রাষ্ট্রকে
সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। তাহলে রাজনৈতিক বিভাজন
হতে হবে অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী শ্রেণী ও শক্তির বিরুদ্ধে সমাজের নিপীড়িত
শ্রেণী ও শক্তিগুলোর গণতান্ত্রিক মৈত্রী ও ঐক্য। সেই ঐক্য যেন ভাষা ও
সংস্কৃতির দোহাই, কিম্বা ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ ভাঙতে না পারে সেই দিকে
নজর আকর্ষণের আমি চেষ্টা করি। বলা বাহুল্য, এই ঐক্য গড়ে তোলার মতাদর্শিক
লড়াই চালিয়ে যাওয়াই এখনকার গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ। গণতান্ত্রিক
বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম এবং ওর মধ্যে প্রত্যেক নাগরিকের
চিন্তার চর্চাসহ নাগরিক ও মানবিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানই বর্তমান
দ্বন্দ্ব মীমাংসার প্রাথমিক পদপে বলে আমি মনে করি। প্রাথমিক এ কারণে যে
গণতন্ত্রের যে ইউরোপীয় ধারণা ও চরিত্র তার পর্যালোচনার দরকার আছে।
গণতন্ত্রের ধারণার মধ্যে সমষ্টির বিপরীতে ব্যক্তির অধিকারের আধিক্য সমষ্টির
স্বার্থ ুণœ করবার বিপদ নিহিত রয়েছে। তা ছাড়া এ কালে নাগরিক ও মানবিক
অধিকারের মধ্যে প্রাণ, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাণের শর্ত রা
গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। রাষ্ট্রকে এই অধিকার ুণœ করবার মতা দেয়া যায় না।
তার মানে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ইউরোপ থেকে ধার করা কিছু হবে না, তার একটা
বাংলাদেশী ছাপ থাকবে। অবশ্যই।
দুই
‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন ল্য’ লেখাটির সূত্র ধরে আমার এক বন্ধু আমাকে
লিখেছেন, গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাময়িক বন্ধ রেখে এখন কি রামপাল সামলানো
যায়? কারণ এতে ব্যাপক প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট হবে। আর সাথে গার্মেন্টে মজুরি।
আমার তৎণাৎ উত্তর ছিল, সাময়িক বন্ধ রাখার প্রস্তাবটা বিপ্লব স্থগিত রাখা
কিম্বা বিপ্লব ঠেকাবার প্রস্তাব বলে মনে হতে পারে। আমি অবশ্য ঠেকানো বা
স্থগিত রাখা দূরের কথা, দুটোই বরং সমানতালে চালাতে চাই। ঠেকানো যাদের
রাজনীতি তারা বিপ্লব স্থগিত রাখতে পারেন। কী আর করা!
তার কথার পেছনে একটা শ্লেষ থাকতে পারে, কিন্তু যে প্রশ্ন তিনি তুলেছেন তাকে
উপো করার জো নাই। সেটা হচ্ছে অর্থনীতিবাদী বা পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গে
রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের পার্থক্য। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আদায় ও
রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধের সংগ্রাম এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। এই
ধরনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করবার সুযোগ তৈরি
হয়। এই দিকগুলো নিয়ে লেখালিখির প্রয়োজনীয়তা তিনি বোধ করেছেন। তার
আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে যে তাগিদ অনুভব করেছি আজকের লেখা তারই ফল বলা যায়।
শুরুতে আমি আরো যেসব কথা তৎণাৎ বলেছি সেটা কমবেশি হুবহু তুলে ধরব। এরপর
দুই-একটি বিষয় ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করব।
পেটিবুর্জোয়া বা সাধারণ ভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন পরিবেশ ও প্রকৃতির কথা
বলে তখন সে নদী, জমি, পাহাড়, সুন্দরবন, বাঘ, ভাল্লুক, পাখি ইত্যাদি নিয়ে
খুব কাতর হয়ে যায়। ব্যাপারগুলো খুবই রোমান্টিক ও রাবীন্দ্রিক ব্যাপার
ধারণ করে। তারা ‘প্রাণবৈচিত্র্য’ বলে না, বলে ‘জীববৈচিত্র্য’Ñ অথচ
প্রাণবৈচিত্র্য মানে শুধু জীবজন্তুর বৈচিত্র্য নাÑ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর,
সংস্কৃতি, জীবনব্যবস্থা, খাদ্যব্যবস্থা, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের দৈনন্দিনের
সম্পর্ক ইত্যাদি। খেয়াল করা দরকার এই শ্রেণির কাছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র
স্থাপনবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে গিয়েছে বাঘ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
গরান বনের (mangrove Forest) প্রাণবৈচিত্র্য রা খুবই জটিল ব্যাপার। দুই-এক
প্রজাতির পশু বা পাখি রা করা না। ধরিত্রী সম্মেলনে (Earth Summit ১৯৯২)
বায়োডাইর্ভাসিটি সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড লোকাল
কমিউনিটির কথাও বারবার জোর দিয়ে বলতে হয়েছে। মানুষের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে
‘জীববৈচিত্র্য’ পাতি বুর্জোয়া ও করপোরেট ধারণা। ‘জীববৈচিত্র্য’ আর
‘প্রাণবৈচিত্র্য’ একটি ইংরাজি শব্দ অনুবাদের সমস্যা নয়Ñ পরিবেশ আন্দোলনের
রাজনৈতিক মর্ম বুঝবার অভাব। যে কারণে বাঘ রার আন্দোলন যত গুরুত্বপূর্ণ মনে
হয়, সেই তুলনায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি কৃষকের বীজ রার আন্দোলনকে অত
গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। বীজ ও খাদ্যব্যবস্থা চোখের সামনে দুই-এক দশকের
মধ্যেই বহুজাতিক বীজ কোম্পানির অধীনে চলে যাওয়ার পরেও তার হুঁশ নাই।
রাজনীতিতে চিন্তার এই অভাব বা খামতিগুলো বোঝার দরকার আছে।
তবু রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আমি নিঃশর্ত সমর্থন
করি, কারণ এটা খালি বাঘ বাঁচাবার সংগ্রাম না, এটা দিল্লি-ঢাকা অশুভ আঞ্চলিক
আগ্রাসী আঁতাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। শেখ হাসিনা যখন ২০১০ সালের জানুয়ারি
মাসে ভারতে গিয়েছিলেন তখন ভারতের সঙ্গে যে যৌথ ঘোষণায় স্বার করেছেন,
রামপাল প্রকল্প তারই অন্তর্গত। এটা নিছকই উন্নয়ন প্রকল্প নয়, ভারতীয়
আগ্রাসনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ। যারা এই আন্দোলন করছেন তাদের মধ্যে
অনেকে আছেন, যারা মতাসীন সরকারের নীতির সমর্থক কিম্বা তারা মতাসীনদের
রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে নয়। তাই না? ফলে তাদের পপাতদুষ্ট অস্বচ্ছ রাজনৈতিক
অবস্থান এই আন্দোলনের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মর্ম বিকাশের েেত্র বড় একটা
প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে। দিল্লির প্রশ্নে তাদের কণ্ঠ নিচু খাদে নেমে গিয়ে
প্রায় নিঃশব্দ হয়ে যায়। আর প্রায় সবাই মতাসীন সরকারের বিরোধী যে
রাজনীতি তারও বিরোধী। এটাই বাস্তবতা। ঠিক কি না? রাজনীতির কথা বললে শ্রেণির
প্রশ্ন ছাড়াও এসব বিবেচনাও মাথায় রাখতে হয়। জাতীয় সম্পদ রার েেত্র এত
বছর ধরে গড়ে তোলা আন্দোলনের পেছনে এ কারণেই পুরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা
যায়নি। কারণ শেষতক পেটি বুর্জোয়া একে একটি বিশেষ ধারার রাজনীতি বহন করবার
কাজেই খাটাচ্ছেÑ গণমানুষের সামষ্টিক স্বার্থ গৌণ হয়ে রয়েছে।
মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন আমি অবশ্যই সমর্থন করি। একইভাবে নিঃশর্তে। কিন্তু
যেহেতু আমি অর্থনীতিবাদী না, রাজনৈতিক ভাবে ভাবতে চাই, তাই মজুরি বৃদ্ধির
অর্থনৈতিক দাবির পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠন করবার অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক
প্রশ্নটাকেই আমি প্রধান গণ্য করি। শ্রমিক তার শ্রমশক্তি বেচাবিক্রির জন্য
বাজারব্যবস্থায় দর কষাকষি করবেÑ এই ন্যূনতম বুর্জোয়া অধিকার আদায়ের কথা
না বলে, শ্রমিক আন্দোলনকে অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার মধ্যে সংকীর্ণ রাখা মূলত
গণতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান। আমি তা নাকচ করি।
বন্ধুর সঙ্গে এইভাবেই তাৎণিক কথাগুলো শেষ হয়েছে। সেই সূত্র ধরে অনেক বিষয়
নিয়ে আলোচনার থাকলেও দুই-একটি বিষয় নিয়ে আপাতত কথা বলতে চাই। এখন তাহলে
সেই কথাগুলোই পেশ করার চেষ্টা করি।
প্রথমে বলে রাখি, যেকোন আন্দোলনেরই শ্রেণিচরিত্র থাকে, এতে ন্যায্য আন্দোলন
অন্যায্য হয়ে যায় না। একে গণমানুষের সংগ্রামে রূপান্তরিত করবার দরকারেই
এর পর্যালোচনার দরকার। তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রা জাতীয়
কমিটির আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশের আন্দোলন, যারা নিজেদের প্রগতিশীল
ও ধর্মনিরপে মনে করেন। মোটা দাগে তারা আওয়ামী-সিপিবি ধারার রাজনৈতিক
চিন্তা-চেতনার অধীন। এই আন্দোলনের ওপর এই ধারার বিভিন্ন দলের দলীয়
নিয়ন্ত্রণও রয়েছে। এরা আওয়ামী-বাম ধারার মধ্যেই আন্দোলনকে বেঁধে রাখতে
চায়। দল-মত নির্বিশেষে জাতীয় স্বার্থ রার প্রশ্নে জনগণকে একত্র করার
চেয়ে জাতীয় েেত্র তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা এই আন্দোলনের কৃতিত্ব দিয়ে
তারা পূরণ করতে চায়। এখানেই এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা।
এই আন্দোলনে সক্রিয় দলও রয়েছে যারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের
রাজনৈতিক চিন্তা ধারণ করে। নেতৃস্থানীয় অনেকে আছেন যাদের ধর্মের প্রতি
বিদ্বেষ অজানা নয়। তেল গ্যাস বন্দর রার সংগঠকেরা নিজেদের জাতীয় কমিটি
বললেও তাদের জাতীয় চরিত্র নাই। অথচ তারা যে ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করছেন সেই
আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও শক্তির সমর্থন আছে। বৃহত্তর জাতীয়
স্বার্থের দিক থেকে তাকালে থাকাই উচিত। কিন্তু এই আন্দোলনকে সংকীর্ণ দলীয়
বা গোষ্ঠিস্বার্থে ব্যবহার করবার চেষ্টার কারণে আন্দোলন জাতীয় রূপ
পরিগ্রহণ করতে পারছে না। এই ধরনের আন্দোলন তরুণদের আকৃষ্ট করে এবং আন্দোলনে
অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা তাদের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের সুযোগ পায়।
কিন্তু দলীয় সংকীর্ণতা এবং আওয়ামী-সিপিবি ধারার সীমার মধ্যে খাবি খেয়ে
তা নষ্টও হয়ে যায়।
অস্বীকার করার উপায় নাই যে বাংলাদেশে জ্বালানিসম্পদ বাংলাদেশের
নিয়ন্ত্রণে থাকুক এবং তার সুবিধা বাংলাদেশ ভোগ করুক এই ধরনের জাতীয় চেতনা
জ্বালানিসম্পদ রার আন্দোলন সমর্থন করবার পেছনে কাজ করে। মধ্যবিত্ত তরুণেরা
মনে করে, এর মধ্য দিয়ে তারা জাতীয় স্বার্থ রা করছে। যে ইস্যু নিয়ে তারা
আন্দোলন করছেন তা ‘জাতীয়’। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে বাংলাদেশের মতো দেশে
যেখানে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয়নি,
সেখানে জাতীয় স্বার্থ রার স্বপ্ন দেখা আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র।
পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত এই ধরনের দুর্বল, অগণতান্ত্রিক ও
গণবিরোধী রাষ্ট্রে পুঁজির বিচলন ও বিনিয়োগের ওপর নৈতিক, সামাজিক ও
রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েমের কোন ব্যবস্থা নাই। বিদ্যমান গণবিরোধী রাষ্ট্র
ও রাষ্ট্রমতার বিরুদ্ধের কোন কথা না তুলে বিদ্যমান ব্যবস্থার অধীনে জাতীয়
স্বার্থ রার আন্দোলনের অর্থ হচ্ছে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া। যে কারণে
সবার আগে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের কর্তব্যের
কথা আমি বারবার বলি। ঘোড়ার ডিম কল্পনা করা যায়, কিন্তু সেটা যে বাস্তব
নয়, সেই হুঁশ আমাদের আসুক, সে প্রত্যশা করি। কেতাবি কথা বলে রাজনৈতিক
চেতনার বিকাশ ঘটানো যায় না। আন্দোলনের কোন বিকল্প নাই। যে কারণে
জ্বালানিসম্পদ রার আন্দোলনকে রাজনৈতিক ভাবে অস্বচ্ছ গণ্য করলেও তাকে
নিঃশর্ত সমর্থন দিতে আমি কুণ্ঠা বোধ করি না। কারণ সহজ বা শর্টকাট কোন পথ
নাই। এভাবেই আমরা সচেতন হয়ে উঠব।
এই দিক থেকে জাতীয় স্বার্থ কথাটাও অস্বচ্ছ ও বিভ্রান্তিমূলক। বিদ্যমান
রাষ্ট্রের অধীনে বাংলাদেশের জ্বালানিসম্পদের সুবিধা ধনী ও উচ্চবিত্ত
শ্রেণিই ভোগ করবে। বহুজাতিক কোম্পানির লুণ্ঠন বন্ধ হলেও বহাল আর্থ-সামাজিক ও
রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার সুবিধা গরিব মজলুম মেহনতি মানুষ পাবে না, সেটা
নিশ্চিত। অর্থাৎ তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রা জাতীয় কমিটির
আন্দোলন ধনী আর উচ্চবিত্তের স্বার্থ রার আন্দোলনই করছে।
আমি তাতে দোষ দেখি না। কারণ বাংলাদেশের জ্বালানিসম্পদ কার জন্য রা করছি
আন্দোলনের শক্তির দিক সেই প্রশ্নে নিহিত নয়। বরং মতাসীন রাষ্ট্র ও
রাষ্ট্রশক্তির বাইরে জনগণের মতা নির্মাণের দিকÑ অর্থাৎ আন্দোলনের
সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণশক্তি গঠনের যে সীমিত চেষ্টা এই আন্দোলনে ল করা যায়
তার গুরুত্ব অনেক। আন্দোলনের এই রাজনৈতিক মর্মই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে
গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে আওয়ামী-সিপিবি ধারার রাজনীতির বিরোধী হলেও আমাদের
উচিত এই আন্দোলনকে সমর্থন করা। আওয়ামী-সিপিবি মার্কা যে রাজনৈতিক ধারা এই
আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করছে, আন্দোলনের
কর্মীদের উচিত সেই শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসা এবং জনগণকে আরো বিপুল ভাবে
সম্পৃক্ত করবার পদপে গ্রহণ করা। যে কারণে বিএনপি ও তাদের সমর্থক রাজনৈতিক
ধারাকে এই আন্দোলনের বাইরে রাখা হয়েছে, ঠিক একই কারণে আওয়ামী-সিপিবি
ধারাকে আন্দোলনের স্বার্থে বাইরে রাখা দরকার। মূল ইস্যু হচ্ছে বিদ্যমান
গণবিরোধী মতার বিপরীতে জনগণের পাল্টা মতা তৈরি।
ন্যায্য আন্দোলনকেও সফল করতে হলে তার পেছনে জনগণের বিভিন্ন অংশের অংশগ্রহণ
নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বলয়
অতিক্রম করে যেতে সম হলে আন্দোলনের মধ্য থেকে নতুন গণতান্ত্রিক শক্তির
উত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়। নইলে মধ্যবিত্তের গণ্ডির মধ্যেই সেটা খাবি
খেতে থাকে। চেষ্টা করতে হবে যেন সাধারণ মানুষ আন্দোলনে আগ্রহী হয় ও
অংশগ্রহণ করতে পারে। কিভাবে তা করা যায় তার সূত্রগুলো অন্বেষণ করবার জন্য
ন্যায্য দাবি ও আন্দোলনেরও আত্মপর্যালোচনা জরুরি।
তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রা জাতীয় কমিটি সুন্দরবন রাসহ জাতীয়
কমিটির সাত দফা দাবিতে ঢাকা থেকে সুন্দরবন অভিমুখে লংমার্চ কেন তা
ব্যাখ্যা করে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, রামপাল
কয়লাভিত্তিক প্রকল্প সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে এবং এই প্রকল্প ‘জাতীয়
স্বার্থবিরোধী’। যদিও গত কয়েক যুগের উন্নয়ন নীতিÑ বিশেষত চিংড়ি রফতানির
কারণে সুন্দরবন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর বর্ধিত অংশ চকোরিয়ার অনেক আগেই
বিলীন হয়েছে। এখন বাঘ রার জন্য আন্তর্জাতিক তোড়জোড় প্রবল।
তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রা জাতীয় কমিটি এই প্রকল্প অবিলম্বে
বাতিল করবার দাবি করছে। কিন্তু বর্তমান উন্নয়ননীতি না বদলালে এই ধরনের
প্রকল্প না থাকলেও সুন্দরবন ধ্বংস হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান কী
করে করা যায় তার প্রস্তাবও জাতীয় কমিটি করেছে। পুস্তিকার মূল স্লোগান
হচ্ছেÑ ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, সুন্দরবনের কোন বিকল্প নাই’।
জাতীয় কমিটি যে যুক্তি দিয়েছে তার বিপরীতে সরকারপও তাদের যুক্তি দিচ্ছে।
সরকারপরে যুক্তির কোন বৈজ্ঞানিক দিশা বা ভিত্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অনেক
সীমাবদ্ধতা থাকলেও জাতীয় কমিটি যে তথ্য ও বিশ্লেষণ হাজির করেছে তার সঙ্গে
আমি একমত। বাংলাদেশের জনগণের জ্বালানি চাহিদা মেটাবার দিক থেকে বিদ্যুৎ
উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার কথাও তোলেন অনেকে। জাতীয় কমিটি সেই বিবেচনায়
বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের বিকল্প প্রস্তাবও দিয়েছেন।
রামপাল প্রকল্পবিরোধী আন্দোলনের নতুন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই প্রথম জাতীয়
কমিটি তাদের আন্দোলনকে পরিবেশ রার আন্দোলন বলছেন। এত দিন তারা জীবাশ্ম
জ্বালানি রার আন্দোলন করছিলেন। সেই দিক থেকে তারা শিল্পসভ্যতার পরে
আন্দোলনই করছিলেন। পরিবেশ আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মর্ম
জীবাশ্মভিত্তিক সংস্কৃতি, সভ্যতা ও জীবনযাপনের বিরোধিতা করা। জাতীয় কমিটির
দলিলে তার কোন বিরোধিতা দেখলাম না। তারা শিল্পসভ্যতার আদর্শকে প্রশ্ন করেন
নি, বিদ্যুৎ তারাও চাইছেন। ফারাক হচ্ছে প্রকল্পটি সুন্দরবনে নয়, অন্যত্র
করলেও করা যেতে পারে।
তবু বাঘ আর সুন্দরবন রার রোমান্টিক আকুতির মধ্য দিয়ে আন্দোলন এগিয়ে যাক।
আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পরিবেশ আন্দোলনের তাৎপর্য ও রাজনীতি স্পষ্ট হবে। এই
আশা করি। এটাও আশা করি যিনি বা যারা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রশ্ন ও
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের রাজনীতি আপাতত স্থগিত রেখে বাঘ আর সুন্দরবন
রার কথা বলছেন তাদের কাছে আমার অবস্থান পরিচ্ছন্ন করতে পেরেছি।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩। ১৩ আশ্বিন ১৪২০।
farhadmazhar@hotmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন