বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিপ্লববার্তা

সজীব ওয়াজেদ জয় বলছেন, ১৯৭১ সালের বিপ্লব সমাপ্ত হয়নি। তাকে সমাপ্ত করতে হবে। আর এটিই হলো বর্তমান সরকারের প্রধান ইতি-কর্তব্য। জয় এখন মার্কিন নাগরিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতাযুদ্ধকে অনেক সময় উল্লেখ করা হয় বিপ্লব হিসেবে। সে অর্থে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে বলা যেতে পারে বিপ্লব। কারণ এর ফলে উদ্ভব ঘটতে পেরেছিল একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে বিপ্লব হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। কিন্তু জয় বলছেন, ১৯৭১-এর বিপ্লব সমাপ্ত হয়নি। তাকে সমাপ্ত করতে হবে। তার এ বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করা যায় নানাভাবে। আসলে ১৯৭১ সালে আমরা কী চেয়েছিলাম। অনেকের মনে এ সম্বন্ধে নেই কোনো সুস্পষ্ট ধারণা। তাই আমরা ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পঠিত মুজিবনগরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া আবশ্যক বোধ করছি :
“যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাঙলা দেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হইয়াছিল এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাঙলা দেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছিলেন; এবং যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেন এবং যেহেতু আহূত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি পালন করিবার পরিবর্তে বাঙলা দেশের গণপ্রতিনিধিদের সহিত পারস্পরিক আলোচনা চলাকালে হঠাৎ ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং যেহেতু উল্লেখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাঙলা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাঙলা দেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছেন এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাইতেছেন এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হইয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছেন; এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাহাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছেন, সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাঙলা দেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্যবোধে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহার দ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।”
ওপরের ঘোষণাপত্রটি পড়লে বোঝা যায়, পাকিস্তানের তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠী যদি ভোটের রায় মেনে নিতেন, তবে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা ঘোষণা করত না। ভাঙত না সাবেক পাকিস্তান। পক্ষান্তরে, এখন অনেক বাম বুদ্ধিজীবী বলছেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু মুজিবনগরের বিখ্যাত ঘোষণাপত্রে কোথাও বলা হয়নি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। আদর্শ হিসেবে বলা হয়নি সমাজতন্ত্রের কথা। আছে কেবল মানব সমতা, মানব মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা। তাই বাম চিন্তকেরা যেমন বলছেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রী বাংলাদেশ গড়ার জন্য, যেটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য বলে মনে করার কোনো ভিত্তি নেই। সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য ১৯৭১-এর বিপ্লব অসমাপ্ত আছে। তার বক্তব্য কতকটা মিলে যাচ্ছে এ দেশের একদল বাম বুদ্ধিজীবীর সাথে; যারা একসময় শেখ মুজিবের করতেন কঠোর সমালোচনা। এমনকি প্রমাণ করতে চাইতেন, শেখ মুজিব চলেছেন সিআইএর নির্দেশে। শেখ মুজিব একজন বিপ্লববাদী ছিলেন না। তার সাথে ছিল না কোনো বামপন্থী চিন্তাধারার যোগাযোগ। আসলে আওয়ামী লীগ ছিল একটি উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল। তার লক্ষ্য ছিল বিপ্লব (Revolution) নয়, বিবর্তনের (Evolution) ধারায় সমাজ-প্রগতি সাধন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার ‘লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার’ মেনে। যাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন, যা হবে প্রজাতন্ত্রী। পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক মতাদর্শন হবে ইসলাম এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সবসময়ই হতে হবে মুসলমান। কারণ তিনি কেবল হবেন না রাষ্ট্রের রক্ষক, একই সাথে তিনি হবেন মানুষের মূল্যবোধেরও সংরক্ষক। যেমনÑ বিলাতের রাজা বা রানী কেবল সে দেশের রাষ্ট্রিক অস্তিত্বের রক্ষক মাত্র নন; বিলাতের অ্যাঙ্গলিকান খ্রিষ্টধর্মের রক্ষকও। অনেক দেশেরই রাষ্ট্রধর্ম আছে। যেমনÑ সুইডেনের রাষ্ট্রধর্ম হলো লুথেরান খ্রিষ্টধর্ম। রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ না হলে গণতান্ত্রিক হয় না অথবা থাকে না মানুষের মুক্ত চিন্তার অধিকার, এ ধারণা সঠিক নয়। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ডের মতো দেশ এখনো ধর্মনিরপেক্ষ নয়। কিন্তু এসব দেশ খুবই উন্নত। আর মানুষ এসব দেশে ভোগ করছে সর্বাধিক ব্যক্তিস্বাধীনতা। তাই বলা চলে না, শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার ১৯৭০ সালের জারি করা ‘লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার’ মেনে নির্বাচনে যোগ দিয়ে কিছু গর্হিত কাজ করেছিল। ধর্ম সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণা যে, তা বর্তমান যুগোপযোগী নয়। কিন্তু ধর্ম এখনো মানুষের মনে সৃষ্টি করতে পারে একটি উৎসর্গের মনোভাব। সেটি না হলে কোনো বড় কাজ করা চলে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির অবস্থা হয়ে উঠেছিল খুবই সঙ্কটাপন্ন। জার্মানির পশ্চিমাংশে বাস করেন প্রধানত ক্যাথলিক খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা। অন্য দিকে পূর্ব জার্মানিতে যারা বাস করে, তারা বেশির ভাগই হলো প্রটেস্ট্যান্ট জার্মান খ্রিষ্টান। পূর্ব জার্মানি চলে যায় সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পশ্চিম জার্মানি যায় না। পশ্চিম জার্মানিতে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানেরা গড়ে খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক দল। তারা আসে রাজনৈতিক ক্ষমতায়। এদের চেষ্টায়ই অল্প দিনের মধ্যে পশ্চিম জার্মানি হয়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই সমৃদ্ধ। আর রাজনৈতিক দিক থেকে গণতন্ত্রী। বর্তমান জার্মানির চ্যান্সেলর হলেন অ্যাঞ্জেলা মারকেল। তিনি হলেন খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দলভুক্ত অর্থাৎ ধর্ম চেতনা এখনো একটা দেশ গড়তে হতে পারে যথেষ্ট সহায়ক। তাকে অবজ্ঞা করার কিছু নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেন তাই করতে চাচ্ছে। করতে চাচ্ছে নিজেদের আধুনিকমনা প্রমাণ করার জন্য। আওয়ামী লীগ বিশ্বের দরবারে প্রমাণ করতে চাচ্ছে, বিএনপি হলো মুসলিম মৌলবাদ প্রভাবিত। তারা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে কেবল একটি মুসলিম মৌলবাদ রাষ্ট্রই নয়, হয়ে উঠবে মুসলিম জঙ্গিবাদী দেশ; যা বিশ্ব শান্তির ক্ষেত্রে সৃষ্টি করবে সমস্যা। কিন্তু এ রকম কথা ভাবার কোনো ধর্মীয় ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। কারণ কুরআন শরিফে বলা হয়েছেÑ ‘হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলিফা করলাম। অতএব, তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের আদেশ করতে থাক। এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করিও না। কেননা কুপ্রবৃত্তির নির্দেশমতো চললে এটি তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে (সূরা-৩৮ : ২৬)। অর্থাৎ কুরআনের শিক্ষা হলো ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র গড়া এবং ব্যক্তি হিসেবে কুপ্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। একে বলা চলে মুসলিম মৌলবাদ। এতে ভীত হওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রচার করা হচ্ছে, ইসলামভীতি। যাকে বলা হচ্ছে জঙ্গি ইসলাম, মিলিট্যান্ট ইসলামি তার উদ্ভব হতে পেরেছে প্রধানত আফগানিস্তানে।
আফগানিস্তানে কমিউনিস্টেরা ক্যুদেতার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। এবং ক্ষমতায় টিকে থাকে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পাঠায় সৈন্য, যাকে আফগানিস্তান থেকে তাড়ানোর জন্য সৃষ্টি হয় জঙ্গি বা ‘মিলিট্যান্ট’ ইসলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে মুসলিম জঙ্গিবাদীদের করেছিল বিশেষ সহায়তা। জঙ্গি ইসলামের উত্থানে মার্কিন সহযোগিতা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগে একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন, আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছিলেন, আফগানিস্তানে আফগান কমিউনিস্টরা যেভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগেরও উচিত হবে সেভাবেই ক্ষমতা দখল করা। বাংলাদেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও ভাবছিল প্রায় একই ধারায়। বাংলাদেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোকে দিয়েছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। আজ আমরা এসব কথা ভুলে যেতেই বসেছি। তাই চাচ্ছি আবার মনে করে দিতে। বাংলাদেশে যদি কমিউনিস্ট কায়দায় একদলের শাসন স্থায়ী করবার প্রচেষ্টা চলে, তবে এখানেও জঙ্গি ইসলামের উদয় অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে জঙ্গি বা মিলিট্যান্ট ইসলামের আবির্ভাব হবে কি হবে না, তা নির্ভর করবে এ দেশে গণতন্ত্র থাকা-না-থাকার ওপর। আর গণতন্ত্র থাকা নির্ভর করবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারার ওপর।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থেকে তিনি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য দাঁড়াতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্ন দেখা দেয়নি; কারণ সেখানে হয়নি ভোটে কারচুপি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টই চাননি একদলের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। যেমন চেয়েছিলেন সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাতামহ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫১ সাল থেকে করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট (অর্থাৎ আট বছরের বেশি) হতে পারবেন না। বাংলাদেশ প্রেসিডেন্টশাসিত গণতন্ত্র নয়। কিন্তু বাংলাদেশ হয়ে উঠতে চাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীশাসিত গণতন্ত্র। এখানে তাই যদি আইন করা হয় যে, দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; তবে সেটি নিশ্চয়ই হতে পারবে একটি উত্তম আইন। যত দূর জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো নির্বাচন কমিশন নেই। তবু সে দেশে হতে পারছে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত প্রেসিডেন্ট হন রিপাবলিকান অথবা ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে। কিন্তু নির্দলীয়ভাবেও যেকোনো ব্যক্তি (জন্মগতভাবে মার্কিন নাগরিক) প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য নির্বাচন প্রার্থী হতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান এখন এমনভাবে বদলানো হয়েছে, নির্দলীয়ভাবে কারো পক্ষে আর দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। এটিকে ধরা যেতে পারে গণতন্ত্রেরই বরখেলাপ হিসেবে। বিলাতে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচিত এমপিদের দেখানো হয় খুবই সম্মান। তাদের মধ্যে থেকেই সাধারণত নির্বাচিত করা হয় স্পিকার বা পার্লামেন্টের সভাপতি। কারণ ধরে নেয়া হয়, যিনি নির্দলীয় এমপি, তিনি কোনো দলের ওপরই পার্লামেন্টের সভাপতি হিসেবে দেখাবেন না পক্ষপাতিত্ব। সব দলের সদস্যকেই পার্লামেন্টে বক্তব্য পেশের দেবেন সমান সুযোগ-সুবিধা।
জয় বলেছেন, দেশে বিপ্লব ঘটাতে হবে। কিন্তু তিনি তার বিপ্লবের ধারণার কোনো পরিলেখ এখনো দিচ্ছেন না আমাদের কাছে। জয়ের বিপ্লবের ধারণা এ দেশের গণতন্ত্রকে করে তুলতে পারে আরো বিপন্ন। ক’দিন আগে দেখা গেল সিলেটে কমিউনিস্টদের মিটিংয়ে ছাত্রলীগের ছেলেদের হামলা করতে। এসব কমিউনিস্ট ঠিক আওয়ামী লীগ বিরোধী নয়। কিন্তু কেন তাদের ওপর এ রকম হামলা করা হলো, তা আমাদের কাছে এখনো স্বচ্ছ নয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে অনেকেই হলেন সাবেক মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট। হতে পারে এদের সাথে বনিবনা হচ্ছে না সেলিম সাহেবদের। অর্থাৎ কেবল বিএনপি নয়, কমিউনিস্টদেরও ভাবা হচ্ছে আওয়ামী লীগের শত্রু। সজীবের বিপ্লববার্তার পরই ঘটতে দেখা গেল এ রকম ঘটনা। সজীবের বিপ্লব হতে গেলে তা-ই ধরে নেয়া যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাবে একদলের ভয়াবহ নিয়ন্ত্রণ। আর থাকবে না গণতন্ত্রের সামান্য পরিচয়। বাংলাদেশের নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ভারত সরকারকে বলতে শোনা গেল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলাদেশ সরকার যথার্থ কাজ করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে ভারত সরকারের সমর্থনকে ধরতে হবে দুরভিসন্ধিমূলক। এ ছাড়া উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭২ সালে ৩ জুলাই বর্তমান পাকিস্তান ও ভারত সরকারের মধ্যে হয়েছিল সিমলা চুক্তি। এর ফলে মুক্তি পেতে পেরেছিল সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী। বিচার করা যায়নি পাকবাহিনীর কোনো যুদ্ধাপরাধীকে। এখানে আরো উল্লেখ করা যায়, সিমলা চুক্তিতে ১৯৭১-এর যুদ্ধকে বলা হয়নি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে সিমলা চুক্তিতে বলা হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। সিমলা আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রতিনিধি দর্শক হিসেবেও উপস্থিত ছিলেন না। অথচ আজ ভারত বলছে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সঠিক কাজ হচ্ছে। এর মূলে আছে বিশেষ দুরভিসন্ধি। জয় কী করবেন আমরা তা জানি না। তবে জয় যে পাবেন তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ভারত সরকারের সমর্থন, সেটি আগেই অনুমান করা চলে। এটি খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমাদের দেশে হতে পারছে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের চিন্তা-চেতনার প্রাদুর্ভাব। আসতে পারছে বিপ্লবের কথা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। চীন নেপথ্যে বান কি মুনকে অনুরোধ করে চিঠি লিখেছিল। বান কি মুন চাচ্ছেন বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ব্যক্ত করেছেন প্রায় একই ধরনের মনোভাব। বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কেবল বাংলাদেশের মানুষের ওপরই নির্ভর করছে, এমনটি আর ভাবা যাচ্ছে না। মার্কিন নাগরিক হিসেবে জয় যা করছেন, তা হতে যাচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পরিপন্থী। যত দূর জানি, কোনো মার্কিন নাগরিক যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখায়, তবে তার মার্কিন নাগরিকত্ব কাটা যেতে পারে। জয়ের মার্কিন নাগরিকত্ব কাটা যাবে কি না, আমরা তা বলতে পারি না।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন