শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৩

ইসরাইলের ইনোন পরিকল্পনা ও মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা

 
মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্র্রতিক অস্থিরতা পৃথিবীব্যাপী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন এই অস্থিরতা, এর সাথে কারো পরিকল্পনা সক্রিয় কি না, এ বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ কমই হচ্ছে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ, শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত সৃষ্টি, মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা এবং এর পর নজিরবিহীন গণহত্যাÑ এসব ঘটনার পেছনের রহস্য গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে। প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে এখন যা কিছু ঘটছে তার অনেক কিছুই ঘটানো হচ্ছে একটি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল কাজ শুরু করা হয়। এর পর ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল দু’টি যুদ্ধের পথ ধরে ১৯৭৯ সালে মিসর-ইসরাইল ক্যাম্পডেভিট শান্তিচুক্তি হয়। এর পর নেয়া হয় ১৯৮২ সালে ইনোন পরিকল্পনা আর ইরাক-ইরান দশকব্যাপী যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক অস্থিরতা তৈরি হয় একই ধারাবাহিকতায়। ইনোন পরিকল্পনায় কী রয়েছে? ইনোন পরিকল্পনা (Yinon Plan) হলো আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য ১৯৮২ সালে নেয়া ইসরাইলের কৌশলগত পরিকল্পনা। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ওদেদ ইনোন (Oded Yinon) এই পরিকল্পনা তৈরি করেন। এর পর তেলআবিবের সব সরকার প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এই কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই পরিকল্পনায় বলা হয়, ইসরাইলকে তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে চার পাশের আরব দেশগুলোকে উত্তপ্ত করে ুদ্র ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ভূরাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় ইরাককে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিশ্চিহ্ন করা হয়। এর পর ইনোন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইরাক-ইরান প্রায় দশককাল ধরে যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধের পর সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখল এবং এর পর ইরাকে আমেরিকান আক্রমণে সাদ্দামের পতন হয়। এর পর দেশটিতে সূচনা হয় শিয়াপ্রধান শাসনের। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের পথ ধরে এখন দেশটিতে প্রতিদিন বোমাবাজি ও সহিংসতায় শত শত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এর পাশাপাশি আরব জাগরণকে সমর্থন দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে কয়েকটি দেশে একনায়ক সরকারের পতন ঘটানো হয়। আর এর পথ ধরে সিরিয়ায় রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে এক লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি মিসরে চলছে নানা রক্তক্ষয়ী ঘটনা। এ সব কিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়াচ্ছে ইনোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারীরা। তবে তারা দৃশ্যপটের অন্তরালে থেকেই করছে এ কাজ। ২০০৮ সালে দি আটলান্টিক এবং ২০০৬ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর আর্মড ফোর্সেস জার্নালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি নতুন মানচিত্র ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। এতে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোকে একাধিক ভাগে বিভক্ত দেখানো হয়। মার্কিন সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল র‌্যালফ পিটার্স (Ralph Peters) ২০০৬ সালে ইনোন পরিকল্পনাকে ভিত্তি করে এই মানচিত্র এবং এ সংক্রান্ত একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। ইনোন পরিকল্পনাকে সামনে রেখে করা কর্নেল পিটার্সের মানচিত্রে ইরাকের পাশাপাশি লেবানন, মিসর ও সিরিয়াকেও ভাগ করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া ইরান, তুরস্ক সোমালিয়া ও পাকিস্তানকেও এই বিভক্তি পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুদানকে ইতোমধ্যে যে দুই ভাগ করা হয়েছে সেটি এ পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হয়েছে। এর পর লিবিয়াকে ভাগ করার কাজও এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। মূল পরিকল্পনায় উত্তর আফ্রিকার ভাঙনকাজ মিসর দিয়ে শুরু করার কথা বলা হয়। বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার জন্য মিসরসহ এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোকে বিভক্ত করে দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করার কথা বলা হয় পরিকল্পনায়। বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিত তৈরির জন্য এটি করা হচ্ছে। মূল ভিত্তি দু’টি দু’টি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ইনোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করা হচ্ছে। এই দু’টির একটি হলো ইসরাইলকে টিকে থাকতে হলে দেশটিকে অবশ্যই আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুরো অঞ্চলকে নৃতাত্ত্বিক ও সম্প্রদায়গত পার্থক্যের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। আর এসব দেশের মধ্যে এমনভাবে বিরোধ-সঙ্ঘাত লাগিয়ে রাখতে হবে যাতে একপর্যায়ে এসব দেশের সরকার তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে কার্যত ইসরাইলের আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সেই সাথে তাদের অবস্থা এমন যেন হয় যাতে তারা কোনো সময় ইসরাইলের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে না দাঁড়াতে পারে। ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রথম যখন পত্তন হয় তখন এ ধারণাটি ছিল না। এটি ইনোন পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রহণ করে ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যে এর পরের বিভিন্ন ঘটনা এবং সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি সামনে রাখা হলে এটি স্পষ্ট হবে। বৃহত্তর ইসরাইলের স্বপ্ন ইসরাইলে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকারের লিকুদ পার্টি এবং দেশটির সামরিক ও গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের বড় অংশ বৃহত্তর ইসরাইলের ধারণায় বিশ্বাসী। ইহুদিবাদের প্রতিষ্ঠাতা তিইডর হার্জল মিসর থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত ইসরাইলের সীমানা হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন তার বইয়ে। ইহুদি রাব্বি ফিশকম্যান যে ইসরাইলের কথা তার বইয়ে লিখেছেন তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন সিরিয়া ও লেবাননের একটি অংশকেও। ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতি, ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধ ও সাম্প্রতিক শিয়া-সুন্নি সঙ্ঘাত, ২০১১ সালের লিবীয় যুদ্ধ, সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি, মিসরের শাসন পরিবর্তন, নীল নদের উজানে ইথিওপিয়ায় বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগÑ এসব কিছুতে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষণ দেখা যাবে। বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার এই প্রকল্পে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণকে বিমেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আরবদের বিরোধিতা এবং পশ্চিমের লোক দেখানো আপত্তির মুখে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের কাজ এখন অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে। মিসরে শাসন পরিবর্তনের নেপথ্য শর্ত হিসেবে এ ব্যাপারে উপসাগরীয় দেশগুলোর অনুমোদনের কথা বলা হচ্ছে। এর ফলে এক অর্থহীন শান্তি সংলাপে সম্মত হয়ে ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস ইসরাইলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যত সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। প্রক্সি রাষ্ট্র ও বিভাজনের এজেন্ডা বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় বেশ ক’টি প্রক্সি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও রয়েছে। তবে কোন কোন দেশকে এই প্রক্সি রাষ্ট্র বানানো হবে সেটি উল্লেখ করা হয়নি। কানাডার মন্ট্রিয়ালের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের সমাজতাত্ত্বিক ও গবেষক মেহদি দারবিশ নাজেমোরায়া গ্লোবাল রিসার্র্চে লেখা এক নিবন্ধে এ ব্যাপারে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো তিনি আরব জাগরণের সূচনালগ্নে এর গতিপথ সম্পর্কে সম্ভাব্য যে ধারণার কথা বলেছিলেন তা এখন অনেকাংশে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক অতীতে বিশেষ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এই অঞ্চলের একমাত্র দেশ ইসরাইল আমেরিকার সর্বাত্মক সহায়তায় এর মধ্যেও তার স্থিতি বজায় রাখতে পারছে। অধিকন্তু চার পাশের দেশগুলোর অস্থির অবস্থা দেশটির প্রভাব সম্প্রসারণের কাজকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে। এতে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেমে ইহুদি বসতি বিস্তারের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে পারছে ইসরাইল। এ ক্ষেত্রে দেশটির যা কিছু প্রয়োজন তা তার মিত্ররা সরবে বা নীরবে দিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে আরব উপদ্বীপে তৈরি হয়ে আছে এক বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থা। এখানকার বংশপরম্পরায় শাসিত সব ক’টি আরব দেশের ভঙ্গুর শাসন টিকিয়ে রাখা আমেরিকান, ক্ষেত্র বিশেষে ইসরাইলের সাহায্য ছাড়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইসরাইলের সাথে অপ্রকাশ্য সম্পর্ক তৈরি করেছে অনেক আরব দেশ। এসব দেশের সরকারের সামনে টিকে থাকাটাই এখন মূল এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব আর তীব্র বণ্টন ও চাকরি বৈষম্য থেকে সৃষ্ট তীব্র অসন্তোষকে এখানকার বেশির ভাগ দেশে অনেকটা ছাইচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। এখানকার শাসক পরিবারগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধও মাঝে মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর অভিন্ন ভীতি তাদের আবার একই কাতারে নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে মুরব্বির ভূমিকা পালন করছে সৌদি আরব। বাহরাইন ও ইয়েমেনে শিয়া বিদ্রোহ সৌদি সেনা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দমন করা হয়েছে। এতে দেশ দু’টি এখন আমেরিকা ও সৌদি আরবের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যা তাদের সার্বভৌম অস্তিত্বের জন্য মোটেই সহায়ক হওয়ার কথা নয়। এখানে প্রধানত ইরানের শিয়াভীতিকে জাগিয়ে দিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃরাষ্ট্র ঐক্য ধরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। এর মধ্যেও মাঝে মাঝে বিরোধ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সম্প্রতি সৌদি প্রিন্স খালিদ বিন সুলতানকে ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করার পর তাকে গৃহে অন্তরীণ রাখার আদেশ দিতে হয় বাদশাহ আব্দুল্লাহকে। দেশটিতে যেকোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভকে নির্মম দমনাভিযানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হলেও মাঝে মধ্যেই প্রকাশ্যে বিক্ষোভের ঘটনা দেখা যায়। মুসলিম ব্রাদারহুডের বিপক্ষে মিসরীয় সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন গণহত্যা সমর্থনের ঘটনায় সৌদি আলেমদের সাথেই শুধু রাজপ্রাসাদের বিরোধ দেখা দেয়নি; একই সাথে রাজপরিবারের বিদেশে থাকা অনেক সদস্য এ ব্যাপারে সৌদি রাজ অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। ইনোন পরিকল্পনা ও পিটার্সের মানচিত্রে সৌদি আরবকে তিন ভাগে বিভক্ত দেখানো হয়েছে। মিসর ও সিরিয়ায় সৌদি আরব যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে তাতে এই বিভাজনের ফাটলগুলো ক্রমেই বড় হতে শুরু করেছে। সৌদি রাজতন্ত্র এবং সৌদি আলেম সমাজ দেশটির দুই প্রধান শক্তি। ইসলামি অনুুশাসন, শিক্ষা, বিচার ও সমাজব্যবস্থায় রয়েছে সৌদি আলেমদের প্রভাব। অন্য দিকে সরকার ও প্রশাসন পরিচালনায় রয়েছে সৌদ পরিবারের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। দুই পক্ষ একে অন্যের ব্যাপারে বড়ভাবে হস্তক্ষেপ সাধারণত করে না। এবার মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের পর জেনারেল বেঞ্জামিন আল সিসি আল সৌদের (মিসরে এ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি) সেনা জান্তা যেভাবে অভ্যুত্থানবিরোধী গণ-অবস্থান নিশ্চিহ্ন করার নামে হাজার হাজার মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন এবং শত শত লাশসহ মসজিদ পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়ার মতো অকল্পনীয় ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাতেও সৌদি বাদশাহর প্রকাশ্য সমর্থন কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না আলেমরা। সৌদি আরবের শীর্র্ষস্থানীয় ৫৬ জন আলেম এ ব্যাপারে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে রাজপ্রাসাদের অবস্থানের সাথে ভিন্নমত জানিয়েছেন এবং মিসরীয় সেনাবাহিনীর কাজকে পাপাচার বলে আখ্যা দিয়ে এর প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন। এই ঘটনায় সৌদি আরবে দুই শক্তিমান পক্ষের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে এর ক্ষতি দেশটির শাসকেরা এখন কিছুটা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। রক্তখাদক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা জেনারেল বেঞ্জামিন আল সিসিকে সরিয়ে সেখানে আর কাউকে বসানোর মাধ্যমে মিসরে ব্রাদারহুডের সাথে সমঝোতার একটি প্রস্তাব নিয়ে এখন আলাপ আলোচনা হচ্ছে। মিসরের ঘটনাকে সমর্থন দেয়া এবং এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সৌদি আরবকে বিভক্ত করার ইনোন পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেবে বলে অনেকে মনে করেন। অথচ মিসরের শাসন পরিবর্তনের জন্য দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা অভিন্নভাবে কাজ করেছে। ইনোন পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় পিটার্সের নিবন্ধে সৌদি আরবের মক্কা-মদিনা জেদ্দা সমন্বয়ে পবিত্র ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং একটি অংশকে ইয়েমেনের সাথে দিয়ে দেয়া আর বাকি অংশে সৌদি রাজাদের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি স্থান পায়। ইনোন প্লানের আওতায় পিটার্স যে পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন সে সম্পর্কে সৌদি নীতিনির্ধারকেরা অনবহিত সেটি নয়, তবে সৌদি রাজারা তাদের বাদশাহী শাসনের পথে ব্রাদারহুডের গণতন্ত্রকে বড় হুমকি মনে করে কট্টর এক অবস্থান নিয়েছেন। এতে অর্র্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে ব্রাদারহুড ও সৌদি শাসকদের মধ্যে যে বোঝাপড়ার সম্পর্ক ছিল সেটি অবিশ্বাস ও শত্রুতায় পর্যবসিত হলো অল্প সময়ের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত এতে চাঙ্গা হবে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আরব দেশগুলোতে প্রক্সি সরকার প্রতিষ্ঠা করে রাখার বিষয়টি। আন্তঃসম্প্রদায় সঙ্ঘাত ইনোন পরিকল্পনার আওতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আন্তঃসম্প্রদায় বিরোধ সঙ্ঘাত জিইয়ে রাখা। এর অংশ হিসেবে শিয়া-সুন্নি উত্তেজনা শিখরে নিয়ে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে বিভক্তি ও সঙ্ঘাতময় এক অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। এ সঙ্ঘাতের দুই পক্ষের এক দিকের নেতৃত্বে রয়েছে সৌদি আরব আর অন্য দিকে রয়েছে ইরান। সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর তীব্র আপত্তির মুখে আমেরিকা ইরাকে অভিযান চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনের পতন ঘটায়। সৌদি আরবের আশঙ্কা ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হলে শেষ পর্যন্ত ইরাকের ওপর শিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে এবং ইরানের প্রভাব ইরাক, সিরিয়া হয়ে এক দিকে লেবাননে অন্য দিকে সৌদি আরবের উত্তরাংশের দাহরান এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। সেই উদ্বেগকে মার্কিন অভিযানের সময় আমলে নেয়া হয়নি, বরং মনে করা হয়েছে সৌদি নিরাপত্তা যত বেশি হুমকির মধ্যে থাকবে দাহরান অঞ্চলে আমেরিকান সেনা উপস্থিতির প্রয়োজন দেশটি তত বেশি উপলব্ধি করবে। সাদ্দামের পতনের কয়েক বছরের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ইরাকে ইরানপন্থী এক শিয়া সরকারই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সুন্নি ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর ঠিক এর বিপরীতে আলকায়েদা নামিয়ে পুরো দেশেই সন্ত্রাস বোমাবাজিতে অস্থিরতার স্বর্গরাজ্য বানানো হয়েছে। এমনভাবে ইরাকে দুই পক্ষকে মুখোমুখি করা হয়েছে যেন নিজেদের অস্তিত্ব ও প্রাধান্য রক্ষার জন্য এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নির্মূল করার লড়াইয়ে নেমেছে। এর অনিবার্য পরিণতি হলো পিটার্স ইরাককে সুন্নি ইরাক, শিয়া ইরাক ও কুর্দিস্তান এই তিন ভাগে ভাগ করার যে পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিলেন তার বাস্তবায়ন। সিরিয়ায় আরব জাগরণ শুরু হওয়ার পর থেকে একই খেলা শুরু করা হয়েছে। একবার বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র উপায়-উপকরণ দিয়ে বাশার সরকারকে কোণঠাসা করা হয়েছে। আবার হিজবুল্লাহ ও ইরানের মিলিশিয়ার সমর্থনে যখন বাশার সুসংহত হয়ে উঠেছে তখন রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অজুহাতে পশ্চিমা হামলার আয়োজন চলছে। ঠিক এ সময়ে ইসরাইল বলছে এই হামলার মাধ্যমে শুধু বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করলে হবে না। একই সাথে আলকায়েদাকেও নিশ্চিহ্ন করতে হবে। শেষ পর্যন্ত সিরিয়ার পরিণতিও যে সেই পিটার্সের পরিকল্পিত বিভক্তির দিকে যাচ্ছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। মিসরে আরব জাগরণের সফল নাটকের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষকে জাগিয়ে দেয়া হয়েছে। নানা টানাপড়েন শেষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ড. মুরসি সরকার গঠন করেন। কিন্তু তার সাথে শুরু থেকে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখা হয় সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের। শেষ পর্যন্ত সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও নজিরবিহীন দমন অভিযান শুরু করা হয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর। এতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব কায়রোসহ কয়েকটি শহরে সীমিত হয়ে পড়েছে। আর দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের সৃষ্টি হয়েছে দূরত্ব। এটিকে আরো এগিয়ে নেয়া হলে মিসর কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবে। কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়াসহ আশপাশের অঞ্চলে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকার আর অন্য অঞ্চলে ইসলামিস্টদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হতে পারে। অন্য দিকে সিনাইয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চরমপন্থীদের হামলার অভিযোগ এনে সেটিকে ইসরাইল আবার দখল করে নিতে পারে। ব্রাদারহুডের ব্যাপক লোকক্ষয়ের পরও তাদের প্রতিরোধ সশস্ত্র রূপ না নেয়ায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অবশ্য ব্যাহত হচ্ছে। ইনোন পরিকল্পনা অনুসারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে এক পক্ষকে আরেক পক্ষের সাথে এমনভাবে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তারা আপাতত নিজেদের জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয়েছে মনে হলেও তাতে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা বাস্তবায়নেই অগ্রগতি হচ্ছে। যদিও সচেতনভাবে কোনো পক্ষই হয়তো এ কাজ করছে না। রহস্যময়তা রহস্যময় আলকায়েদা সংগঠনের তৎপরতাকেও বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এমনভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, যার সাথে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরির সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের একটি অংশ মনে করেন, চরম ইসলামিক ভাবধারার কিছু আলেম ও ব্যক্তিত্বের সহায়তায় ওসামা বিন লাদেন এই নেটওয়ার্ক তৈরি করেন, যার সাথে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলেও কেউ কেউ ধারণা করেন। তারা এ ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন, আলকায়েদার মূল বক্তব্য হলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম কায়েম করা যাবে না। সশস্ত্র¿ জিহাদের মাধ্যমে এটি করতে হবে। আলকায়েদার বক্তব্য ও লক্ষ্যবস্তু বিশ্লেষণ করে বিশ্বেষকেরা বলছেন, বিশ্বের মুসলিম স্বার্থের প্রধান শত্রু হিসেবে ইসরাইলকে চিহ্নিত করা হলেও আলকায়েদার লক্ষ্যবস্তু ইসরাইলকে করা হয়েছে এ রকম দৃষ্টান্ত তেমন দেখা যায় না। এর অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু করতে দেখা যায় পশ্চিমা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এতে পশ্চিমের সাথে ইসলামের শত্রুতা ও বৈরিতা তৈরি হচ্ছে, যা ইসরাইলের ইনোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই শেষ পর্যন্ত সহায়ক হচ্ছে। সাম্প্রতিক দৃষ্টান্তে দেখা যায়, সিরিয়ায় এক দিকে আলকায়েদা অন্য দিকে হিজবুল্লাহ ও শিয়া মিলিশিয়ারা মুখোমুখি। সিনাইয়ে আলকায়েদা সংশ্লিষ্ট চরম ধারার সালাফিস্টরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছেÑ এই অজুহাত মুসলিম ব্রাদারহুডকে নির্মূল করার অভিযানে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে সেনা জান্তা। আলকায়েদা সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র গ্রুপ তিউনিসিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের হাতে দুই বিরোধীদলীয় নেতা নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশটির ইসলামিস্ট আন-নাহদার কোয়ালিশন এখন পতনের কাছাকাছি এসে উপনীত হয়েছে। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করে অনেকে বলছেন, আলকায়েদার তৎপরতায় যতটা না ইসলামি এজেন্ডার সংশ্লিষ্টতা দেখা যায় তার চেয়ে বেশি দেখা যায় সৌদি সংশ্লিষ্ট সুন্নি এজেন্ডার বাস্তবায়ন। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া, পাকিস্তান, ইয়েমেন, বাহরাইনÑ সর্বত্র শিয়া-সুন্নি উত্তেজনা এতে বাড়ছে। আর দূর থেকে হিসাব মেলাচ্ছেন বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টারা। mrkmmb@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন